ব্রহ্ম
অবিকারী এবং কূটস্থ। ব্রহ্মের কোনপ্রকার বিকার বা পরিণাম নেই।
অদ্বৈতবেদান্তে ব্রহ্ম অপরিণামী উপাদান বা বিবর্ত্ত উপাদান,
এই দৃশ্যমান বিশ্বপ্রপঞ্চ মায়ার পরিণাম এবং ব্রহ্মের বিবর্ত্ত। অজ্ঞানবশতঃ রজ্জুতে যেমন মিথ্যা সর্পের সৃষ্টি হয়, শুক্তিতে যেমন মিথ্যা রজতের ভাতি হয়, সেরূপই অবিদ্যাবশে পরব্রহ্মে মিথ্যা জগতের ভাতি হয়ে থাকে। ব্রহ্মপরিণামবাদীর মতানুসারে ব্রহ্মের বাস্তব পরিণাম স্বীকার করতে গেলেই শ্রুতি প্রতিপাদিত পরব্রহ্মের নির্বিকারত্ব ব্যাহত হয়।বেদান্তমীমাংসা
শাস্ত্রের কৃৎস্নপ্রসক্ত্যধিকরণের প্রতিপাদ্য বিষয় হল নিরবয়ব ব্রহ্মের জগদ্রূপে মায়িক
পরিণাম অর্থাৎ বিবর্ত্ত। এই বিষয়ে সর্বাগ্রে শ্রীভারতী তীর্থের বৈয়াসিক ন্যায়মালার
অনুসরণে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করব। "ইন্দ্রঃ মায়াভিঃ পুরুরূপঃ ঈয়তে"-(ঋগ্বেদ
সংহিতা-৬/৪৭/১৮) অর্থাৎ "ইন্দ্র মায়াসকলের দ্বারা বহুপ্রকার রূপ ধারণ করেন"
ইত্যাদি শ্রুতিতে মায়া সকলের দ্বারা ব্রহ্মের বহুরূপতা অবগত হওয়া যাচ্ছে। কিন্তু
সমগ্রভাবে পরিণামবশতঃ অথবা অংশতঃ পরিণামবশতঃ তাঁর বহুরূপতা হয় না। আচ্ছা, অবয়ববিহীন
ব্রহ্মের দুগ্ধ ও দধি প্রভৃতির ন্যায় পরিণাম কিপ্রকারে হবে? তা বলা হচ্ছে— উক্ত পরিণাম
কিন্তু বাস্তব নয়। যেহেতু এই ব্রহ্মকারণবাদে নিরবয়ব হলেও ব্রহ্মের মায়িক পরিণাম
অর্থাৎ বিবর্ত্ত যুক্তিসঙ্গত। সেইহেতু সমগ্রভাবে পরিণাম এবং একাংশে পরিণাম, এই কল্পনাদ্বয়ের
এখানে অবকাশ নেই। আর "সাবয়ব বস্তুই উপাদান", এই যুক্তিও মায়িক পরিণামে
অর্থাৎ বিবর্ত্তে সঙ্গত নয়। এই বিষয়ে ভামতীকার বাচস্পতি মিশ্র বলেন— "জীবাশ্রিত মায়ার
দ্বারা বিষয়ীকৃত হয়ে ব্রহ্ম স্বতঃই জড়তার আশ্রয়ীভূত জগৎপ্রপঞ্চরূপে বিবর্তিত হন।"
"শ্রুতেস্তু শব্দমূলত্বাৎ"৷৷-(ব্রহ্মসূত্র-২/১/২৭)
'তু' শব্দটির দ্বারা ভগবান সূত্রকার আক্ষেপকে পরিহার করছেন। কৃৎস্নপ্রসক্তি অর্থাৎ ব্রহ্মের সমগ্রভাবে জগদাকারে পরিণামপ্রাপ্তি হয় না। তাতে হেতু কি? "শ্রুতে"— অর্থাৎ যেহেতু "যতো বা ইমানি ভূতানি জায়ন্তে"-(তৈত্তিরীয় উপনিষৎ-৩/১) "যাঁ হতে এই ভূতসকল উৎপন্ন হয়", ইত্যাদি শ্রুতিতে যেমন ব্রহ্মের জগদুপাদনতা শ্রত হচ্ছে, এইরূপে "তাবানস্য মহিমা ততো জ্যায়াংশচ পূরুষঃ। পাদোহস্য সর্বা ভূতানি ত্ৰিপাদস্যামৃতং দিবীতি"-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ- ৩/১২/৬) অর্থাৎ "ব্রহ্মের চতুষ্পদ ও ষড়বিধ বিকারাত্মক যে পরিমাণ একপাদ গায়ত্রী বলে বর্ণিত হল, সেই পরিমাণই অৰ্থাৎ তৎসমস্তই উক্ত গায়ত্রী সংজ্ঞক সমস্ত ব্ৰহ্মের মহিমা, অর্থাৎ বিভূতির বিস্তার ; অতএব, তদাপেক্ষা অর্থাৎ গায়ত্রী-সংজ্ঞক বাচারম্ভণমাত্ররূপী অসত্য বিকারাত্মক ব্ৰহ্ম অপেক্ষাও পরমার্থ সত্য, বিকারহীন পুরুষ (পরব্রহ্ম) অতিশয় মহৎ ; কারণ, তিনিই সর্ব জগৎকে পরিপূরণ করেন, অথবা হৃদয়রূপ পুরে অবস্থান করেন, এইজন্য পুরুষ-পদবাচ্য হন। সমস্ত ভূত অর্থাৎ তেজ, জল ও পৃথিবী প্রভৃতি স্থাবর-জঙ্গম-সমূহ সেই এই পুরুষেরই একপাদ (একাংশমাত্র); এই গায়ত্র্যাত্মক সমস্ত ব্ৰহ্মের ত্রিপাদযুক্ত অমৃতস্বরূপ পুরুষ প্রকাশময় নিজ আত্মস্বরূপে অবস্থিত আছেন", ইত্যাদি শ্রুতিতে কার্য-ব্যতিরেকে তাঁর অস্তিত্বও শ্রুত হচ্ছে। এপ্রকারে শ্রুতিকর্তৃকই বিবর্ত্তবাদ স্পষ্টীকৃত হয়েছে, যেহেতু পরিণামবাদে কার্যব্যতিরেকে নিরবয়ব কারণের অস্তিত্ব সম্ভব হয় না। অতএব কার্যব্যতিরেকে ব্রহ্মের অস্তিত্ব শ্রুতিতে পঠিত হচ্ছে বলে ব্রহ্মের সমগ্রভাবে জগদাকারে পরিণামপ্রাপ্তিরূপ দোষের অবকাশ নেই। কিন্তু যুক্তির দ্বারা বাধিত হওয়ায় শ্রুতিই বা কি প্রকারে কার্যব্যতিরেকে ব্রহ্মের অস্তিত্ব বোধ করাবেন? তদুত্তরে ভগবান সূত্রকার বলছেন—"শব্দমূলত্বাৎ"—যেহেতু ব্রহ্ম একমাত্র বেদরূপ প্রমাণগম্য। অতীন্দ্রিয় ব্রহ্মবস্তুর স্বরূপ শ্রুতিমাত্রগম্য। 'অচিন্ত্যাঃ খলু যে ভাবা ন তাংস্তর্কেণ যোজযেত্৷ প্রকৃতিভ্যঃ পরং যচ্চ তদচিন্ত্যস্য লক্ষণম্'-(মহাভারত, ভীষ্মপর্ব-৫/১২) অর্থাৎ "যে সকল পদার্থ চিন্তার অতীত, তাদেরকে তর্কের সহিত যোজনা করা অর্থাৎ যুক্তির দ্বারা বাধিত করা উচিত নয়। যা প্রকৃতি হতে বিলক্ষণ কেবলমাত্র শাস্ত্র ও আচার্যের উপদেশগম্য, তাই অচিন্ত্যের লক্ষণ (—স্বরূপ)।" অতএব তর্কের অগম্য হওয়ায় অতীন্দ্রিয় বস্তুর যথার্থস্বরূপবিষয়কজ্ঞান নিশ্চয়ই শব্দমূল (—বেদরূপ প্রমাণগম্য)। অতএব নিরবয়ব ব্রহ্ম জগদ্রূপে পরিণত হলেও তদতিরিক্ত অবিকৃত নিরবয়বস্বরূপেও অবস্থান করেন, আগমপ্রমাণবলে ইহা সিদ্ধ হয়। সুতরাং এতে সিদ্ধান্তীপক্ষে নিরবয়বত্বশব্দকোপরূপ দোষ হয় না অর্থাৎ ব্রহ্মের নিরবয়বতা প্রতিপাদক শ্রুতিবাক্যের বাধিত হওয়া নিরাকৃত হল।
ব্রহ্ম নিরবয়ব হলে জগতের পরিণামী উপাদান হতে পারবেন না; সাবয়ব হলে বিনাশী হয়ে পড়বেন ও নিরবয়বত্ব প্রতিপাদিকা শ্রুতিসকল বাধিত হয়ে পড়বে; বস্তুর স্বরূপে বিকল্প সম্ভব নয় এবং অন্যপ্রকার উপপত্তিও প্রাপ্ত হওয়া যাচ্ছে না; এ সকল হেতুবশতঃ ব্রহ্মের জগৎকারণতাপ্রতিপাদিকা শ্রুতির প্রামাণ্য দুর্ঘট, ইত্যাদি। তদুত্তরে বলব— এটা দোষ নয়, যেহেতু অবিদ্যার দ্বারা কল্পিত রূপের বিভিন্নতা অঙ্গীকার করা হয়। ব্রহ্ম স্বরূপতঃ নিরবয়ব ও অবিকারি, মায়াবশতঃ তাঁর নানা মিথ্যা পরিণাম অঙ্গীকৃত হয়, সুতরাং দুর্ঘটত্বদোষ হয় না। কিন্তু এপ্রকারে রূপভেদ অঙ্গীকার করলে ব্রহ্মের সাবয়বতা দুর্বার হয়ে পড়বে। তদুত্তরে বলব—অবিদ্যাকল্পিত রূপভেদের দ্বারা বস্তু কদাপি সাবয়ব হয়ে পড়ে না। যার চক্ষু তিমির-রোগগ্রস্ত, তৎকর্তৃক যেন অনেকরূপে পরিদৃশ্যমান চন্দ্রমা নিশ্চয়ই অনেক হয়ে পড়ে না। কিন্তু নামরূপের বিভিন্নতা অবিদ্যাকল্পিত হলে অবিদ্যাই হবে জগৎ-কারণ, ব্রহ্ম নন। তদুত্তরে বলব— অবিদ্যার দ্বারা কল্পিত নাম ও রূপাত্মক যে রূপভেদ, যা ব্যক্ত ও অব্যক্তস্বরূপ এবং যা সৎ নয় ও অসৎ নয় বলে তত্ত্ব এবং অন্যত্বের দ্বারা 'এটা এপ্রকার অথবা এপ্রকার নয়'— এরূপে নির্বাচনীয় নয়, তা দ্বারা তদধিষ্ঠানভূত ব্রহ্ম পরিণাম প্রভৃতি সকলপ্রকার ব্যবহারের আশ্রয় হয়ে থাকেন সুতরাং ব্রহ্মই কারণ, পারমার্থিক সত্তাহীন অবিদ্যা নয়। কিন্তু অবিদ্যার আশ্রয়ভূত ব্রহ্মের অপরিণামিতা কি প্রকারে সিদ্ধ হবে? তদুত্তরে বলব— পারমার্থিকরূপে স্বীয় যথার্থস্বরূপে, তিনি সকল প্রকার ব্যবহারের অতীত অপরিণামিরূপে অবস্থান করেন। আর অবিদ্যার দ্বারা কল্পিত নাম ও রূপের বিভিন্নতা বাঙ্মাত্রকে অবলম্বনকরতঃ (ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৬/১/৪) বর্তমান থাকে বলে (—পরমার্থতঃ থাকে না বলে) ব্রহ্মের নিরবয়বতা বাধিত হয় না। কিন্তু "সচ্চ ত্যচ্চ অভবৎ....যদিদং কিঞ্চ" (তৈত্তিরীয় উপনিষৎ-২/৬) ইত্যাদি শ্রুতিপ্রতিপাদ্য ব্রহ্মের পরিণাম বাঙ্মাত্রকে অবলম্বনকারী মিথ্যা কি প্রকারে হবে? তদুত্তরে বলব এই পরিণামবিষয়িণী শ্রুতি অর্থাৎ সৃষ্টিপ্রতিপাদক শ্রুতিবাক্যসকল, ব্রহ্মের পরিণাম প্রতিপাদনের জন্য নয়, যেহেতু তদ্বিষয়ক জ্ঞান হলে কোনরূপ ফল অবগত হওয়া যায় না। আচ্ছা, উক্ত শ্রুতিবাক্যসকল তা হলে কি প্রতিপাদন করে? উত্তরে বলব— এই পরিণামবিষয়িণী শ্রুতি সকলপ্রকার ব্যবহারের অতীত ব্রহ্মাত্মভাব প্রতিপাদনের জন্য, যেহেতু তদ্বিষয়ক জ্ঞান হলে মোক্ষরূপ ফল অবগত হওয়া যায়। ব্রহ্মাত্মজ্ঞান হলে মোক্ষরূপ ফল হয়, এই বিষয়ে প্রমাণ প্রদর্শন করব— "সঃ এষঃ নেতি নেতি আত্মা", "সেই এই আত্মা ইহা নয়, ইহা নয়", এইপ্রকারে আরম্ভ করে শ্রুতি বলছেন— "অভয়ং বৈজনক প্রাপ্তঃ অসি" (বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪/২/৪) "হে জনক, তুমি ভয়শূন্যকে অর্থাৎ জন্মমরণাদিভয়রহিত ব্রহ্মকে প্রাপ্ত হয়েছ", ইত্যাদি। সেহেতু এইপ্রকারে নিরবয়ব ও অবিকারি ব্রহ্মের মিথ্যা পরিণাম অঙ্গীকৃত হওয়ায়, বিবর্ত্তবাদী আমাদের পক্ষে কৃৎস্নপ্রসক্তি ও নিরবয়বত্ব-শব্দকোপ প্রভৃতি কোনপ্রকার দোষের সম্ভাবনা নেই।
তাছাড়া
ভগবান্ সূত্রকার বাদরায়ণ স্বপ্নের প্রকাশক সাক্ষিচৈতন্যকে দৃষ্টান্তরূপে গ্রহণের দ্বারা ব্রহ্মের বিবর্ত্তোপাদানতাই প্রতিপাদন করেছেন, যথা—
আত্মনিচৈবং
বিচিত্রাশ্চ হি৷৷-(ব্রহ্মসূত্র-২/১/২৮)
এই সূত্রের ভাষ্যে ভগবান্ ভাষ্যকার শঙ্কর স্পষ্ট করছেন— আর দেখ এই বিষয়ে বিবাদ করা উচিত নয় যে, কিপ্রকারে স্বরূপের নাশ ব্যাতিরেকেই একব্রহ্মে অনেকপ্রকার আকারবিশিষ্ট সৃষ্টি হবে? যেহেতু ''ন তত্র রথা ন রথযোগা ন পন্থানো ভবন্ত্যথ রথান্রথযোগান্পথঃ সৃজতে'-বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪/৩/১০, অর্থাৎ 'সেখানে (স্বপ্নে) রথসকল থাকে না, অশ্বসকল থাকে না এবং পথসকল থাকে না অথচ তিনি রথসকল অশ্বসকল ও পথসকলকে সৃষ্টি করেন।' ইত্যাদি শ্রুতিবাক্যের দ্বারা স্বপ্নদর্শী এক আত্মাতেও স্বরূপের নাশ ব্যাতিরেকেই অনেকপ্রকার আকারবিশিষ্ট সৃষ্টি পঠিত হচ্ছে। আর লোকমধ্যেও দেবতা প্রভৃতিতে এবং মায়াবী প্রভৃতিতে স্বরূপের নাশ ব্যতিরেকেই হস্তী ও অশ্ব প্রভৃতি বিচিত্র সৃষ্টিসকল পরিদৃষ্ট হচ্ছে। এই প্রকার এক ব্রহ্মেও স্বরূপের নাশ ব্যতিরেকেই অনেকপ্রকার আকার বিশিষ্ট সৃষ্টি হবে। ..........
শ্রীশুভ
চৌধুরী
আগস্ট
২৬, ২০২১ খ্রিষ্টাব্দ।