Friday, 26 August 2022

ব্রহ্ম জগতের বিবর্ত্তোপাদানঃ-

 


ব্রহ্ম অবিকারী এবং কূটস্থ। ব্রহ্মের কোনপ্রকার বিকার বা পরিণাম নেই। অদ্বৈতবেদান্তে ব্রহ্ম অপরিণামী উপাদান বা বিবর্ত্ত উপাদান, এই দৃশ্যমান বিশ্বপ্রপঞ্চ মায়ার পরিণাম এবং ব্রহ্মের বিবর্ত্ত। অজ্ঞানবশতঃ রজ্জুতে যেমন মিথ্যা সর্পের সৃষ্টি হয়, শুক্তিতে যেমন মিথ্যা রজতের ভাতি হয়, সেরূপই অবিদ্যাবশে পরব্রহ্মে মিথ্যা জগতের ভাতি হয়ে থাকে। ব্রহ্মপরিণামবাদীর মতানুসারে ব্রহ্মের বাস্তব পরিণাম স্বীকার করতে গেলেই শ্রুতি প্রতিপাদিত পরব্রহ্মের নির্বিকারত্ব ব্যাহত হয়।বেদান্তমীমাংসা শাস্ত্রের কৃৎস্নপ্রসক্ত্যধিকরণের প্রতিপাদ্য বিষয় হল নিরবয়ব ব্রহ্মের জগদ্রূপে মায়িক পরিণাম অর্থাৎ বিবর্ত্ত। এই বিষয়ে সর্বাগ্রে শ্রীভারতী তীর্থের বৈয়াসিক ন্যায়মালার অনুসরণে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করব। "ইন্দ্রঃ মায়াভিঃ পুরুরূপঃ ঈয়তে"-(ঋগ্বেদ সংহিতা-৬/৪৭/১৮) অর্থাৎ "ইন্দ্র মায়াসকলের দ্বারা বহুপ্রকার রূপ ধারণ করেন" ইত্যাদি শ্রুতিতে মায়া সকলের দ্বারা ব্রহ্মের বহুরূপতা অবগত হওয়া যাচ্ছে। কিন্তু সমগ্রভাবে পরিণামবশতঃ অথবা অংশতঃ পরিণামবশতঃ তাঁর বহুরূপতা হয় না। আচ্ছা, অবয়ববিহীন ব্রহ্মের দুগ্ধ ও দধি প্রভৃতির ন্যায় পরিণাম কিপ্রকারে হবে? তা বলা হচ্ছে— উক্ত পরিণাম কিন্তু বাস্তব নয়। যেহেতু এই ব্রহ্মকারণবাদে নিরবয়ব হলেও ব্রহ্মের মায়িক পরিণাম অর্থাৎ বিবর্ত্ত যুক্তিসঙ্গত। সেইহেতু সমগ্রভাবে পরিণাম এবং একাংশে পরিণাম, এই কল্পনাদ্বয়ের এখানে অবকাশ নেই। আর "সাবয়ব বস্তুই উপাদান", এই যুক্তিও মায়িক পরিণামে অর্থাৎ বিবর্ত্তে সঙ্গত নয়। এই বিষয়ে ভামতীকার বাচস্পতি মিশ্র বলেন— "জীবাশ্রিত মায়ার দ্বারা বিষয়ীকৃত হয়ে ব্রহ্ম স্বতঃই জড়তার আশ্রয়ীভূত জগৎপ্রপঞ্চরূপে বিবর্তিত হন।"

এখন ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্যের ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্যানুসারে বিস্তৃত আলোচনা করব।

"শ্রুতেস্তু শব্দমূলত্বাৎ"৷৷-(ব্রহ্মসূত্র-২/১/২৭)

'তু' শব্দটির দ্বারা ভগবান সূত্রকার আক্ষেপকে পরিহার করছেন। কৃৎস্নপ্রসক্তি অর্থাৎ ব্রহ্মের সমগ্রভাবে জগদাকারে পরিণামপ্রাপ্তি হয় না। তাতে হেতু কি? "শ্রুতে"— অর্থাৎ যেহেতু "যতো বা ইমানি ভূতানি জায়ন্তে"-(তৈত্তিরীয় উপনিষৎ-৩/১) "যাঁ হতে এই ভূতসকল উৎপন্ন হয়", ইত্যাদি শ্রুতিতে যেমন ব্রহ্মের জগদুপাদনতা শ্রত হচ্ছে, এইরূপে "তাবানস্য মহিমা ততো জ্যায়াংশচ পূরুষঃ। পাদোহস্য সর্বা ভূতানি ত্ৰিপাদস্যামৃতং দিবীতি"-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ- ৩/১২/৬) অর্থাৎ "ব্রহ্মের চতুষ্পদ ও ষড়বিধ বিকারাত্মক যে পরিমাণ একপাদ গায়ত্রী বলে বর্ণিত হল, সেই পরিমাণই অৰ্থাৎ তৎসমস্তই উক্ত গায়ত্রী সংজ্ঞক সমস্ত ব্ৰহ্মের মহিমা, অর্থাৎ বিভূতির বিস্তার ; অতএব, তদাপেক্ষা অর্থাৎ গায়ত্রী-সংজ্ঞক বাচারম্ভণমাত্ররূপী অসত্য বিকারাত্মক ব্ৰহ্ম অপেক্ষাও পরমার্থ সত্য, বিকারহীন পুরুষ (পরব্রহ্ম) অতিশয় মহৎ ; কারণ, তিনিই সর্ব জগৎকে পরিপূরণ করেন, অথবা হৃদয়রূপ পুরে অবস্থান করেন, এইজন্য পুরুষ-পদবাচ্য হন। সমস্ত ভূত অর্থাৎ তেজ, জল ও পৃথিবী প্রভৃতি স্থাবর-জঙ্গম-সমূহ সেই এই পুরুষেরই একপাদ (একাংশমাত্র); এই গায়ত্র্যাত্মক সমস্ত ব্ৰহ্মের ত্রিপাদযুক্ত অমৃতস্বরূপ পুরুষ প্রকাশময় নিজ আত্মস্বরূপে অবস্থিত আছেন", ইত্যাদি শ্রুতিতে কার্য-ব্যতিরেকে তাঁর অস্তিত্বও শ্রুত হচ্ছে। এপ্রকারে শ্রুতিকর্তৃকই বিবর্ত্তবাদ স্পষ্টীকৃত হয়েছে, যেহেতু পরিণামবাদে কার্যব্যতিরেকে নিরবয়ব কারণের অস্তিত্ব সম্ভব হয় না। অতএব কার্যব্যতিরেকে ব্রহ্মের অস্তিত্ব শ্রুতিতে পঠিত হচ্ছে বলে ব্রহ্মের সমগ্রভাবে জগদাকারে পরিণামপ্রাপ্তিরূপ দোষের অবকাশ নেই। কিন্তু যুক্তির দ্বারা বাধিত হওয়ায় শ্রুতিই বা কি প্রকারে কার্যব্যতিরেকে ব্রহ্মের অস্তিত্ব বোধ করাবেন? তদুত্তরে ভগবান সূত্রকার বলছেন"শব্দমূলত্বাৎ"—যেহেতু ব্রহ্ম একমাত্র বেদরূপ প্রমাণগম্য। অতীন্দ্রিয় ব্রহ্মবস্তুর স্বরূপ শ্রুতিমাত্রগম্য। 'অচিন্ত্যাঃ খলু যে ভাবা ন তাংস্তর্কেণ যোজযেত্৷ প্রকৃতিভ্যঃ পরং যচ্চ তদচিন্ত্যস্য লক্ষণম্'-(মহাভারত, ভীষ্মপর্ব-৫/১২) অর্থাৎ "যে সকল পদার্থ চিন্তার অতীত, তাদেরকে তর্কের সহিত যোজনা করা অর্থাৎ যুক্তির দ্বারা বাধিত করা উচিত নয়। যা প্রকৃতি হতে বিলক্ষণ কেবলমাত্র শাস্ত্র ও আচার্যের উপদেশগম্য, তাই অচিন্ত্যের লক্ষণ (—স্বরূপ)।" অতএব তর্কের অগম্য হওয়ায় অতীন্দ্রিয় বস্তুর যথার্থস্বরূপবিষয়কজ্ঞান নিশ্চয়ই শব্দমূল (—বেদরূপ প্রমাণগম্য)। অতএব নিরবয়ব ব্রহ্ম জগদ্রূপে পরিণত হলেও তদতিরিক্ত অবিকৃত নিরবয়বস্বরূপেও অবস্থান করেন, আগমপ্রমাণবলে ইহা সিদ্ধ হয়। সুতরাং এতে সিদ্ধান্তীপক্ষে নিরবয়বত্বশব্দকোপরূপ দোষ হয় না অর্থাৎ ব্রহ্মের নিরবয়বতা প্রতিপাদক শ্রুতিবাক্যের বাধিত হওয়া নিরাকৃত হল।

ব্রহ্ম নিরবয়ব হলে জগতের পরিণামী উপাদান হতে পারবেন না; সাবয়ব হলে বিনাশী হয়ে পড়বেন ও নিরবয়বত্ব প্রতিপাদিকা শ্রুতিসকল বাধিত হয়ে পড়বে; বস্তুর স্বরূপে বিকল্প সম্ভব নয় এবং অন্যপ্রকার উপপত্তিও প্রাপ্ত হওয়া যাচ্ছে না; এ সকল হেতুবশতঃ ব্রহ্মের জগৎকারণতাপ্রতিপাদিকা শ্রুতির প্রামাণ্য দুর্ঘট, ইত্যাদি। তদুত্তরে বলব এটা দোষ নয়, যেহেতু অবিদ্যার দ্বারা কল্পিত রূপের বিভিন্নতা অঙ্গীকার করা হয়। ব্রহ্ম স্বরূপতঃ নিরবয়ব ও অবিকারি, মায়াবশতঃ তাঁর নানা মিথ্যা পরিণাম অঙ্গীকৃত হয়, সুতরাং দুর্ঘটত্বদোষ হয় না। কিন্তু এপ্রকারে রূপভেদ অঙ্গীকার করলে ব্রহ্মের সাবয়বতা দুর্বার হয়ে পড়বে। তদুত্তরে বলবঅবিদ্যাকল্পিত রূপভেদের দ্বারা বস্তু কদাপি সাবয়ব হয়ে পড়ে না। যার চক্ষু তিমির-রোগগ্রস্ত, তৎকর্তৃক যেন অনেকরূপে পরিদৃশ্যমান চন্দ্রমা নিশ্চয়ই অনেক হয়ে পড়ে না। কিন্তু নামরূপের বিভিন্নতা অবিদ্যাকল্পিত হলে অবিদ্যাই হবে জগৎ-কারণ, ব্রহ্ম নন। তদুত্তরে বলব অবিদ্যার দ্বারা কল্পিত নাম ও রূপাত্মক যে রূপভেদ, যা ব্যক্ত ও অব্যক্তস্বরূপ এবং যা সৎ নয় ও অসৎ নয় বলে তত্ত্ব এবং অন্যত্বের দ্বারা 'এটা এপ্রকার অথবা এপ্রকার নয়'— এরূপে নির্বাচনীয় নয়, তা দ্বারা তদধিষ্ঠানভূত ব্রহ্ম পরিণাম প্রভৃতি সকলপ্রকার ব্যবহারের আশ্রয় হয়ে থাকেন সুতরাং ব্রহ্মই কারণ, পারমার্থিক সত্তাহীন অবিদ্যা নয়। কিন্তু অবিদ্যার আশ্রয়ভূত ব্রহ্মের অপরিণামিতা কি প্রকারে সিদ্ধ হবে? তদুত্তরে বলব পারমার্থিকরূপে স্বীয় যথার্থস্বরূপে, তিনি সকল প্রকার ব্যবহারের অতীত অপরিণামিরূপে অবস্থান করেন। আর অবিদ্যার দ্বারা কল্পিত নাম ও রূপের বিভিন্নতা বাঙ্মাত্রকে অবলম্বনকরতঃ (ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৬/১/৪) বর্তমান থাকে বলে (—পরমার্থতঃ থাকে না বলে) ব্রহ্মের নিরবয়বতা বাধিত হয় না। কিন্তু "সচ্চ ত্যচ্চ অভবৎ....যদিদং কিঞ্চ" (তৈত্তিরীয় উপনিষৎ-২/৬) ইত্যাদি শ্রুতিপ্রতিপাদ্য ব্রহ্মের পরিণাম বাঙ্মাত্রকে অবলম্বনকারী মিথ্যা কি প্রকারে হবে? তদুত্তরে বলব এই পরিণামবিষয়িণী শ্রুতি অর্থাৎ সৃষ্টিপ্রতিপাদক শ্রুতিবাক্যসকল, ব্রহ্মের পরিণাম প্রতিপাদনের জন্য নয়, যেহেতু তদ্বিষয়ক জ্ঞান হলে কোনরূপ ফল অবগত হওয়া যায় না। আচ্ছা, উক্ত শ্রুতিবাক্যসকল তা হলে কি প্রতিপাদন করে? উত্তরে বলব এই পরিণামবিষয়িণী শ্রুতি সকলপ্রকার ব্যবহারের অতীত ব্রহ্মাত্মভাব প্রতিপাদনের জন্য, যেহেতু তদ্বিষয়ক জ্ঞান হলে মোক্ষরূপ ফল অবগত হওয়া যায়। ব্রহ্মাত্মজ্ঞান হলে মোক্ষরূপ ফল হয়, এই বিষয়ে প্রমাণ প্রদর্শন করব "সঃ এষঃ নেতি নেতি আত্মা", "সেই এই আত্মা ইহা নয়, ইহা নয়", এইপ্রকারে আরম্ভ করে শ্রুতি বলছেন "অভয়ং বৈজনক প্রাপ্তঃ অসি" (বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪/২/৪) "হে জনক, তুমি ভয়শূন্যকে অর্থাৎ জন্মমরণাদিভয়রহিত ব্রহ্মকে প্রাপ্ত হয়েছ", ইত্যাদি। সেহেতু এইপ্রকারে নিরবয়ব ও অবিকারি ব্রহ্মের মিথ্যা পরিণাম অঙ্গীকৃত হওয়ায়, বিবর্ত্তবাদী আমাদের পক্ষে কৃৎস্নপ্রসক্তি ও নিরবয়বত্ব-শব্দকোপ প্রভৃতি কোনপ্রকার দোষের সম্ভাবনা নেই।

তাছাড়া ভগবান্ সূত্রকার বাদরায়ণ স্বপ্নের প্রকাশক সাক্ষিচৈতন্যকে দৃষ্টান্তরূপে গ্রহণের দ্বারা ব্রহ্মের বিবর্ত্তোপাদানতাই প্রতিপাদন করেছেন, যথা

আত্মনিচৈবং বিচিত্রাশ্চ হি৷৷-(ব্রহ্মসূত্র-//২৮)

এই সূত্রের ভাষ্যে ভগবান্ ভাষ্যকার শঙ্কর স্পষ্ট করছেনআর দেখ এই বিষয়ে বিবাদ করা উচিত নয় যে, কিপ্রকারে স্বরূপের নাশ ব্যাতিরেকেই একব্রহ্মে অনেকপ্রকার আকারবিশিষ্ট সৃষ্টি হবে? যেহেতু '' তত্র রথা রথযোগা পন্থানো ভবন্ত্যথ রথান্রথযোগান্পথঃ সৃজতে'-বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-//১০, অর্থাৎ 'সেখানে (স্বপ্নে) রথসকল থাকে না, অশ্বসকল থাকে না এবং পথসকল থাকে না অথচ তিনি রথসকল অশ্বসকল পথসকলকে সৃষ্টি করেন।' ইত্যাদি শ্রুতিবাক্যের দ্বারা স্বপ্নদর্শী এক আত্মাতেও স্বরূপের নাশ ব্যাতিরেকেই অনেকপ্রকার আকারবিশিষ্ট সৃষ্টি পঠিত হচ্ছে। আর লোকমধ্যেও দেবতা প্রভৃতিতে এবং মায়াবী প্রভৃতিতে স্বরূপের নাশ ব্যতিরেকেই হস্তী অশ্ব প্রভৃতি বিচিত্র সৃষ্টিসকল পরিদৃষ্ট হচ্ছে। এই প্রকার এক ব্রহ্মেও স্বরূপের নাশ ব্যতিরেকেই অনেকপ্রকার আকার বিশিষ্ট সৃষ্টি হবে। ..........

শ্রীশুভ চৌধুরী

আগস্ট ২৬, ২০২১ খ্রিষ্টাব্দ।

Tuesday, 23 August 2022

কূটস্থ চৈতন্য

                                      

এক নিত্যচৈতন্যই অনাদি-অজ্ঞানবশতঃ জীব-চৈতন্য, ঈশ্বর-চৈতন্য, কূটস্থ-চৈতন্য ব্রহ্ম-চৈতন্যএই চতুর্বিধ রূপে প্রকাশিত হয়। সংক্ষেপ-শারীরক-রচয়িতা সর্বজ্ঞাত্ম মুনি প্রভৃতি আচার্যগণ জীব, ঈশ্বর ব্রহ্মচৈতন্য, এই তিন প্রকার চৈতন্যের পরিচয় প্রদান করেছেন। কিন্তু আচার্য বিদ্যারণ্য মুনি কূটস্থ সাক্ষি-চৈতন্যকে যোগ করে চার প্রকার চৈতন্যের স্বরূপ বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি 'পঞ্চদশী' চিত্রদীপে কূটস্থ চৈতন্যের একটি সংজ্ঞা দিয়েছেন

অধিষ্ঠানতয়া দেহদ্বয়াবচ্ছিন্নচেতনঃ।

কূটবন্নির্বিকারেণ স্থিতঃ কূটস্থ-উচ্যতে

-(পঞ্চদশী-/২২)

স্থূল সূক্ষ্ম দেহের আধারভূত এবং সেই দেহদ্বয় দ্বারা অবচ্ছিন্ন আত্মা কূট অর্থাৎ কামারের 'নাঈ' বা 'নেহাই' এর মতো নিশ্চল নির্বিকার থাকেন। তাই তাঁকে কূটস্থ বলা হয়।

সুতরাং স্থূল সূক্ষ্ম শরীরদ্বয়ের অধিষ্ঠান এবং উক্ত শরীরদ্বয়-পরিচ্ছিন্ন চৈতন্যই কূটস্থ চৈতন্য বা সাক্ষি-চৈতন্য বলে অদ্বৈতবেদান্তে পরিচিত। সর্ববিধ বিকার প্রবাহের মধ্যে পড়েও চৈতন্য স্বতঃ 'কূটের' ন্যায় নির্বিকারে অবস্থান করে বলে, চৈতন্যকে কূটস্থ আখ্যা দেয়া হয়।

তাছাড়া এই কূটস্থ চৈতন্যের স্বরূপ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ভগবান্ শঙ্করাচার্য শ্রীগীতাভাষ্যে (১২/) বলেছেন

যা বাইরে থেকে দেখতে গুণসম্পন্ন কিন্তু ভিতরে দোষ-পরিপূর্ণ এমন বস্তুকে 'কূট' বলে। সংসারে 'কূট' শব্দ এই অর্থেই প্রযুক্ত; যথা— 'কূটরূপ' (ছদ্মবেশ) 'কূটসাক্ষ্য' (মিথ্যা সাক্ষী) প্রভৃতি পদ প্রসিদ্ধ। সেইরূপ অবিদ্যাদি অনেক সংসার-বীজরূপ অন্তর্দোষযুক্ত এবং যা 'মায়া', 'অব্যাকৃত' ইত্যাদি শব্দবাচ্য এবং শ্রুতিতে'মায়াং তু প্রকৃতিং বিদ্যান্মায়িনং তু মহেশ্বরম্'- (শ্বেতাশ্বতর উপনিষৎ-/১০অর্থাৎ 'প্রকৃতিকে মায়া বলে জানবে এবং মায়ীকে মহেশ্বর বলে জানবে'; এবং শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় 'মম মায়া দুরত্যয়া'- (গীতা ৭৷১৪) অর্থাৎ 'আমার দুরত্যয়া মায়া' প্রভৃতি বাক্যে যা প্রসিদ্ধ, তাই কূট। সেই কূটে যিনি স্থিত তিনি কূটস্থ। অর্থাৎ সেই কূটশব্দবাচ্য মায়ার অধ্যক্ষ অর্থাৎ পতি বলে তাঁকে কূটস্থ বলা হয়। অথবা কূট শব্দের অর্থ রাশি (গিরিশৃঙ্গ) বা স্তূপের মত অচল অবিকৃতভাবে স্থিত তাই কূটস্থ; যেহেতু কূটস্থ অতএব অচল যেহেতু অচল সেহেতু ধ্রুব অর্থাৎ নিত্যএরূপ অর্থ।

স্বয়ং ভগবান শ্রীগীতার পুরুষোত্তমযোগে কূটস্থকে অক্ষর পুরুষ বলে অভিহিত করেছেন। যথা

দ্বাবিমৌ পুরুষৌ লোকে ক্ষরশ্চাক্ষর এব চ৷

ক্ষরঃ সর্বাণি ভূতানি কূটস্থোক্ষর উচ্যতে৷৷

উত্তমঃ পুরুষস্ত্বন্যঃ পরমাত্মেত্যুদাহৃতঃ৷

-(শ্রী গীতা-১৫/১৬,১৭)

অর্থাৎ 'ক্ষর অক্ষর দুই পুরুষ ইহলোকে প্রসিদ্ধ আছে তন্মধ্যে সর্বভূত ক্ষর পুরুষ এবং কূটস্থ অক্ষর পুরুষ বলিয়া কথিত হন। এই উভয় পুরুষ হইতে অত্যন্ত বিলক্ষণ উত্তম পুরুষ হচ্ছেন পরমাত্মা।

এই শ্লোকের ভাষ্যে আচার্য শঙ্কর বলেছেন—"অক্ষর পুরুষ হল ভগবানের মায়া শক্তি অর্থাৎ পরাপ্রকৃতি উপহিত চৈতন্য। অনেক মায়া বৈচিত্র্যের সহিত তাদাত্ম্য সম্বন্ধে স্থিত চৈতন্যই কূটস্থ। অনন্ত সংসার-বীজত্ব আছে বলে প্রকৃতিকে অক্ষর বলা হয় অর্থাৎ যার ক্ষয় নেই।"......

তথ্যসূত্রঃ-

. ভগবান শঙ্করাচার্যের ভগবদ্গীতা ভাষ্য।

. আচার্য বিদ্যারণ্য মুনীশ্বরের পঞ্চদশী।

শ্রীশুভ চৌধুরী

আগস্ট ২১, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ।

Saturday, 13 August 2022

বেদান্তে 'অধ্যারোপ' ও 'অপবাদ' কি?


ব্রহ্ম বাক্য ও মনের অগোচর হওয়ায় তদ্বিষয়ে 'ইনি এই প্রকার', এইরূপে বিধিমুখে উপদেশ করা সম্ভব নয়। সেইহেতু 'অধ্যারোপ' ও 'অপবাদ' অবলম্বনে শ্রুতি সর্বপ্রপঞ্চাতীত ব্রহ্মবিষয়ে উপদেশ প্রদান করেন। রজ্জুতে সর্পের আরোপের ন্যায় ব্রহ্মবস্তুতে যে জগতের আরোপ (—অধ্যাস), তাকে বলে অধ্যারোপ। আর রজ্জুতে আরোপিত সর্প যেমন বস্তুতঃ রজ্জুমাত্র, তদ্রূপ ব্রহ্মে আরোপিত জগৎপ্রপঞ্চও বস্তুতঃ ব্রহ্মমাত্র, এইপ্রকার বাধনিশ্চয়কে বলে অপবাদ

শ্রুতি "নেতি নেতি"-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪/২/৪), "ইদং সর্বং যদয়মাত্মা"-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-২/৪/৬) ইত্যাদি বাক্যসকলের দ্বারা ব্রহ্মে এই জগৎপ্রপঞ্চের অপবাদ করেন। তাতে রজ্জুতে আরোপিত সর্প যেমন মিথ্যা, তদ্রূপ ব্রহ্মে অধ্যস্ত এই জগৎপ্রপঞ্চও মিথ্যা, এইপ্রকারে জগতের মিথ্যাত্বের বোধ হয়। তার ফলে দ্বৈতবিভ্রম বিনষ্ট হয়ে ব্রহ্ম স্বগত সজাতীয় ও বিজাতীয় ভেদবিহীন একরস ও অদ্বিতীয়, এইপ্রকার বোধ উৎপন্ন হয়।

চিৎ (শুদ্ধ চৈতন্য) কে? ঈশ্বর কে? আর জীবই বা কে?

 


প্রথমেই বলে রাখি আমি আজকের আলোচ্য বিষয় অদ্বৈতবেদান্তের প্রতিবিম্বেশ্বরবাদ অবলম্বনে আলোচনা করব। 'পঞ্চদশী'র চিত্রদীপ প্রকরণে আচার্য বিদ্যারণ্য স্বামী এর একটি সুস্পষ্ট ধারণা দিচ্ছেন—

"চিত্রাঙ্কনযোগ্য বস্ত্রখণ্ডের যেমন চারটি অবস্থা দেখা যায় সেইরূপ পরমাত্মার চারটি অবস্থা বুঝতে হবে। যেমন চিত্রাঙ্কনযোগ্য বস্ত্রখণ্ডের ধৌত, মণ্ডলিপ্ত, রেখাঙ্কিত এবং বর্ণরঞ্জিত— এই চারটি অবস্থা দেখা যায় সেইরূপ পরমাত্মা শুদ্ধচৈতন্য, ঈশ্বর, হিরণ্যগর্ভ এবং বিরাট এই চার অবস্থাবিশিষ্ট বলে বলা হয়ে থাকে। এই চার অবস্থার মধ্যে বস্ত্রের যে স্বাভাবিক শুভ্র অবস্থা তাকে ধৌত অবস্থা বলে। অন্নমণ্ড লেপন করলে ঘট্টিত অবস্থা হয়। কালিদ্বারা চিত্রের রেখাঙ্কন করলে লাঞ্ছিত অবস্থা এবং রংদ্বারা সেই চিত্র পূরণ করলে রঞ্জিত অবস্থা হয়। পরমাত্মা স্বরূপতঃ 'চিৎ' শব্দ দ্বারা উল্লিখিত হন। মায়া উপাধিযুক্ত হলে তাকে অন্তর্যামী বা 'ঈশ্বর' বলে। সমষ্টি- সূক্ষ্মশরীরের সহিত যোগ বা সম্বন্ধবশতঃ তিনি সূত্রাত্মা বা হিরণ্যগর্ভ এবং স্থূলদৃষ্টিদ্বারা বিরাট্ —এইসব নামেই অভিহিত হন।"-(পঞ্চদশী, ষষ্ঠ অধ্যায়, ১-৪)

প্রথমতঃ বিবরণকারের মতে ঈশ্বর বিম্ব ও জীব প্রতিবিম্ব। বিদ্যারণ্য স্বামী মুখ্যতঃ প্রতিবিম্ববাদ অনুসরণ করলেও তিনি ইহা কিঞ্চিত পরিবর্তিত রূপে গ্রহণ করেছেন। তাঁর মতে ঈশ্বর ও জীব উভয়ই প্রতিবিম্ব। মায়া প্রতিবিম্ব ঈশ্বর ও অবিদ্যা প্রতিবিম্ব জীব। দ্বিতীয়তঃ পঞ্চদশীকারের মতে চিদাভাস (চিচ্ছায়া) প্রতিবিম্বের ন্যায় সত্য নহে, পরন্ত কেবল বিম্বের আভাস, সুতরাং মিথ্যা। ফলে আভাসবাদে স্বরূপের অনুভব চিদাভাসের মিথ্যাত্বনিশ্চয়ের দ্বারাই লভ্য, বিম্ব-প্রতিবিম্বের অভেদ জ্ঞানের দ্বারা নয়।

অনুভূতিস্বরূপাচার্য 'প্রকটার্থবিবরণে' বলছেন—মায়া অনাদি, অনির্বচনীয়া, সর্বভূতের প্রকৃতি এবং চৈতন্যমাত্রে আশ্রিতা। উক্ত মায়াতে চৈতন্যের যে প্রতিবিম্ব, উহাই ঈশ্বর। উক্ত মায়ারই আবরণ ও বিক্ষেপশক্তিযুক্ত এবং অবিদ্যা নামে অভিহিত যে পরিচ্ছিন্ন ও অনন্ত প্রদেশ আছে, তাতে চৈতন্যের যে প্রতিবিম্ব, উহাই জীব।

'পঞ্চদশী'র তত্ত্ববিবেকে (১৬-১৭) কিন্তু বলা হয়েছে—"আভাসের দ্বারা জীব ও ঈশ্বর সৃজন করে এবং স্বয়ং মায়া ও অবিদ্যা হয়ে থাকে"-(নৃসিংহ উত্তর তাপনীয় উপনিষৎ-৯) এই শ্রুতি হতে সিদ্ধ হয় যে, ত্রিগুণাত্মিকা প্রকৃতির দুইটি রূপভেদ আছে—মায়া ও অবিদ্যা। প্রকাশাত্মক সত্ত্বগুণের বিশুদ্ধতা (অন্য দুইগুণ দ্বারা মলিন না হওয়া) ও অবিশুদ্ধতা (অন্য দুই গুণের দ্বারা মলিন হওয়া) হতেই সেই দুটিকে মায়া ও অবিদ্যা বলা হয়েছে। অর্থাৎ বিশুদ্ধসত্ত্বপ্রধানা প্রকৃতির নাম মায়া এবং মলিনসত্ত্বপ্রধানা প্রকৃতির নাম অবিদ্যা। মায়াতে প্রতিবিম্বিত চিদাত্মা, সেই মায়াকে নিজ বশে রেখে সর্বজ্ঞ ঈশ্বররূপে আখ্যাত হন। আর অবিদ্যায় প্রতিবিম্বিত ও তার বশবর্তী যে চৈতন্য, তিনি জীব। অবিদ্যার অবিশুদ্ধির তারতম্যবশতঃ জীব দেবতা, তির্য্যগাদি ভেদে অনেক প্রকারের হয়। .....

Tuesday, 9 August 2022

ব্রহ্মকে জেনে ব্রহ্মবিৎ ব্রহ্মই হয়ে যানঃ—

 


(সংশয়) আচ্ছা ইহা তো প্রসিদ্ধ যে শ্রেয়ঃপথে অনেক প্রকার অন্তরায় থাকে। অতএব ক্লেশসকলের কোনও একটির দ্বারা অথবা দেবতাদের দ্বারা বিঘ্নিত হয়ে ব্রহ্মবিৎ হয়েও ব্রহ্ম ভিন্ন অন্য গতিপ্রাপ্তি অর্থাৎ মৃত্যু হলে তিনি একমাত্র ব্রহ্মকেই তো প্রাপ্ত হন না।

(উত্তর) না, জ্ঞানের দ্বারাই তাঁর সর্বপ্রকার বাধা নষ্ট হয়ে যায় বলে তা হতে পারে না। আর অবিদ্যার দ্বারা বাধিত না হওয়াই হল মোক্ষ, তদ্ভিন্ন আর কোনভাবে বাধিত হওয়া নয়। কেননা যেহেতু মোক্ষ নিত্যপ্রাপ্ত এবং আত্মস্বরূপভূত। একারণে অথর্ববেদীয় মুণ্ডক শ্রুতি বলছেন—

স যো হ বৈ তৎ পরমং ব্রহ্ম বেদ

ব্রহ্মৈব ভবতি নাস্যাব্রহ্মবিৎকুলে ভবতি ।

তরতি শোকং তরতি পাপ্মানং গুহাগ্রন্থিভ্যো

বিমুক্তোঽমৃতো ভবতি ॥- (মুণ্ডক উপনিষৎ-৩/২/৯)

আচার্য শঙ্কর ভাষ্যে বলছেন— অতএব ঐরূপ যে এই জগতে সেই পরম্ ব্রহ্মকে (প্রত্যক্ চৈতন্যকে) জানেন অর্থাৎ আমি সাক্ষাৎ ব্রহ্মস্বরূপ হই— এইরূপ উপলব্ধি করেন তিনি অন্যপ্রকার গতিপ্রাপ্ত হন না। দেবগণও তাঁর ব্রহ্মপ্রাপ্তিতে কোন বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারেন না, কেননা তিনি তাঁদেরও আত্মা হয়ে যান। সুতরাং ব্রহ্মকে জেনে তিনি ব্রহ্মই হয়ে যান।

অধিকন্তু এই ব্রহ্মজ্ঞের বিদ্যাবংশে আর কেউ অব্রহ্মবিৎ হয় না। আর তিনি শোককে অতিক্রম করেন অর্থাৎ জীবৎকালেই বিবিধ ইষ্টবস্তুর বিয়োগজনিত মানসিক সন্তাপকে অতিক্রম করে ফেলেন এবং ধর্মাধর্মসংজ্ঞক প্রতিবন্ধক অর্থাৎ ভাল-মন্দ সবকিছুকে অতিক্রম করেন। আর গুহাগ্রন্থি হতে অর্থাৎ হৃদয়গুহাস্থ অবিদ্যাগ্রন্থি হতে মুক্ত হয়ে অমৃত (#জীবন্মুক্ত) হয়ে যান।....

আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...