এক
নিত্যচৈতন্যই অনাদি-অজ্ঞানবশতঃ জীব-চৈতন্য, ঈশ্বর-চৈতন্য, কূটস্থ-চৈতন্য ও ব্রহ্ম-চৈতন্য—এই চতুর্বিধ রূপে
প্রকাশিত হয়। সংক্ষেপ-শারীরক-রচয়িতা সর্বজ্ঞাত্ম মুনি প্রভৃতি আচার্যগণ
জীব, ঈশ্বর ও ব্রহ্মচৈতন্য, এই
তিন প্রকার চৈতন্যের পরিচয় প্রদান করেছেন। কিন্তু আচার্য বিদ্যারণ্য মুনি কূটস্থ সাক্ষি-চৈতন্যকে যোগ করে চার
প্রকার চৈতন্যের স্বরূপ বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি 'পঞ্চদশী'র চিত্রদীপে কূটস্থ
চৈতন্যের একটি সংজ্ঞা দিয়েছেন—
অধিষ্ঠানতয়া
দেহদ্বয়াবচ্ছিন্নচেতনঃ।
কূটবন্নির্বিকারেণ
স্থিতঃ কূটস্থ-উচ্যতে ॥
-(পঞ্চদশী-৬/২২)
—স্থূল ও
সূক্ষ্ম দেহের আধারভূত এবং সেই দেহদ্বয়
দ্বারা অবচ্ছিন্ন আত্মা কূট অর্থাৎ কামারের
'নাঈ' বা 'নেহাই' এর
মতো নিশ্চল ও নির্বিকার থাকেন।
তাই তাঁকে কূটস্থ বলা হয়।
সুতরাং
স্থূল ও সূক্ষ্ম শরীরদ্বয়ের
অধিষ্ঠান এবং উক্ত শরীরদ্বয়-পরিচ্ছিন্ন চৈতন্যই কূটস্থ চৈতন্য বা সাক্ষি-চৈতন্য
বলে অদ্বৈতবেদান্তে পরিচিত। সর্ববিধ বিকার প্রবাহের মধ্যে পড়েও চৈতন্য স্বতঃ 'কূটের' ন্যায় নির্বিকারে অবস্থান করে বলে, ঐ
চৈতন্যকে কূটস্থ আখ্যা দেয়া হয়।
তাছাড়া
এই কূটস্থ চৈতন্যের স্বরূপ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ভগবান্
শঙ্করাচার্য শ্রীগীতাভাষ্যে (১২/৩) বলেছেন—
যা বাইরে থেকে দেখতে গুণসম্পন্ন কিন্তু ভিতরে দোষ-পরিপূর্ণ এমন বস্তুকে 'কূট' বলে। সংসারে 'কূট' শব্দ এই অর্থেই প্রযুক্ত; যথা— 'কূটরূপ' (ছদ্মবেশ) 'কূটসাক্ষ্য' (মিথ্যা সাক্ষী) প্রভৃতি পদ প্রসিদ্ধ। সেইরূপ অবিদ্যাদি অনেক সংসার-বীজরূপ অন্তর্দোষযুক্ত এবং যা 'মায়া', 'অব্যাকৃত' ইত্যাদি শব্দবাচ্য এবং শ্রুতিতে—'মায়াং তু প্রকৃতিং বিদ্যান্মায়িনং তু মহেশ্বরম্'- (শ্বেতাশ্বতর উপনিষৎ-৪/১০) অর্থাৎ 'প্রকৃতিকে মায়া বলে জানবে এবং মায়ীকে মহেশ্বর বলে জানবে'; এবং শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায়— 'মম মায়া দুরত্যয়া'- (গীতা ৭৷১৪) অর্থাৎ 'আমার দুরত্যয়া মায়া' প্রভৃতি বাক্যে যা প্রসিদ্ধ, তাই কূট। সেই কূটে যিনি স্থিত তিনি কূটস্থ। অর্থাৎ সেই কূটশব্দবাচ্য মায়ার অধ্যক্ষ অর্থাৎ পতি বলে তাঁকে কূটস্থ বলা হয়। অথবা কূট শব্দের অর্থ রাশি (গিরিশৃঙ্গ) বা স্তূপের মত অচল অবিকৃতভাবে স্থিত তাই কূটস্থ; যেহেতু কূটস্থ অতএব অচল যেহেতু অচল সেহেতু ধ্রুব অর্থাৎ নিত্য— এরূপ অর্থ।
স্বয়ং
ভগবান শ্রীগীতার পুরুষোত্তমযোগে কূটস্থকে অক্ষর পুরুষ বলে অভিহিত করেছেন।
যথা—
দ্বাবিমৌ
পুরুষৌ লোকে ক্ষরশ্চাক্ষর এব
চ৷
ক্ষরঃ
সর্বাণি ভূতানি কূটস্থোক্ষর উচ্যতে৷৷
উত্তমঃ পুরুষস্ত্বন্যঃ পরমাত্মেত্যুদাহৃতঃ৷
-(শ্রী গীতা-১৫/১৬,১৭)
অর্থাৎ
'ক্ষর ও অক্ষর দুই
পুরুষ ইহলোকে প্রসিদ্ধ আছে । তন্মধ্যে
সর্বভূত ক্ষর পুরুষ এবং
কূটস্থ অক্ষর পুরুষ বলিয়া কথিত হন। এই
উভয় পুরুষ হইতে অত্যন্ত বিলক্ষণ
উত্তম পুরুষ হচ্ছেন পরমাত্মা।
এই
শ্লোকের ভাষ্যে আচার্য শঙ্কর বলেছেন—"অক্ষর পুরুষ হল ভগবানের মায়া
শক্তি অর্থাৎ পরাপ্রকৃতি উপহিত চৈতন্য। অনেক মায়া বৈচিত্র্যের
সহিত তাদাত্ম্য সম্বন্ধে স্থিত চৈতন্যই কূটস্থ। অনন্ত সংসার-বীজত্ব আছে বলে প্রকৃতিকে
অক্ষর বলা হয় অর্থাৎ
যার ক্ষয় নেই।"......
তথ্যসূত্রঃ-
১.
ভগবান শঙ্করাচার্যের ভগবদ্গীতা ভাষ্য।
২.
আচার্য বিদ্যারণ্য মুনীশ্বরের পঞ্চদশী।
শ্রীশুভ
চৌধুরী
আগস্ট ২১, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ।
No comments:
Post a Comment