প্রথমেই বলে রাখি আমি আজকের আলোচ্য বিষয় অদ্বৈতবেদান্তের প্রতিবিম্বেশ্বরবাদ অবলম্বনে আলোচনা করব। 'পঞ্চদশী'র চিত্রদীপ প্রকরণে আচার্য বিদ্যারণ্য স্বামী এর একটি সুস্পষ্ট ধারণা দিচ্ছেন—
"চিত্রাঙ্কনযোগ্য
বস্ত্রখণ্ডের যেমন চারটি অবস্থা দেখা যায় সেইরূপ পরমাত্মার চারটি অবস্থা বুঝতে হবে।
যেমন চিত্রাঙ্কনযোগ্য বস্ত্রখণ্ডের ধৌত, মণ্ডলিপ্ত, রেখাঙ্কিত এবং বর্ণরঞ্জিত— এই চারটি
অবস্থা দেখা যায় সেইরূপ পরমাত্মা শুদ্ধচৈতন্য, ঈশ্বর, হিরণ্যগর্ভ এবং বিরাট এই চার
অবস্থাবিশিষ্ট বলে বলা হয়ে থাকে। এই চার অবস্থার মধ্যে বস্ত্রের যে স্বাভাবিক শুভ্র
অবস্থা তাকে ধৌত অবস্থা বলে। অন্নমণ্ড লেপন করলে ঘট্টিত অবস্থা হয়। কালিদ্বারা চিত্রের
রেখাঙ্কন করলে লাঞ্ছিত অবস্থা এবং রংদ্বারা সেই চিত্র পূরণ করলে রঞ্জিত অবস্থা হয়।
পরমাত্মা স্বরূপতঃ 'চিৎ' শব্দ দ্বারা উল্লিখিত হন। মায়া উপাধিযুক্ত হলে তাকে অন্তর্যামী
বা 'ঈশ্বর' বলে। সমষ্টি- সূক্ষ্মশরীরের সহিত যোগ বা সম্বন্ধবশতঃ তিনি সূত্রাত্মা বা
হিরণ্যগর্ভ এবং স্থূলদৃষ্টিদ্বারা বিরাট্ —এইসব নামেই অভিহিত হন।"-(পঞ্চদশী, ষষ্ঠ
অধ্যায়, ১-৪)
প্রথমতঃ
বিবরণকারের মতে ঈশ্বর বিম্ব ও জীব প্রতিবিম্ব। বিদ্যারণ্য স্বামী মুখ্যতঃ প্রতিবিম্ববাদ
অনুসরণ করলেও তিনি ইহা কিঞ্চিত পরিবর্তিত রূপে গ্রহণ করেছেন। তাঁর মতে ঈশ্বর ও জীব
উভয়ই প্রতিবিম্ব। মায়া প্রতিবিম্ব ঈশ্বর ও অবিদ্যা প্রতিবিম্ব জীব। দ্বিতীয়তঃ পঞ্চদশীকারের মতে চিদাভাস (চিচ্ছায়া) প্রতিবিম্বের
ন্যায় সত্য নহে, পরন্ত কেবল বিম্বের আভাস, সুতরাং মিথ্যা। ফলে আভাসবাদে স্বরূপের অনুভব
চিদাভাসের মিথ্যাত্বনিশ্চয়ের দ্বারাই লভ্য, বিম্ব-প্রতিবিম্বের অভেদ জ্ঞানের দ্বারা
নয়।
অনুভূতিস্বরূপাচার্য
'প্রকটার্থবিবরণে' বলছেন—মায়া অনাদি, অনির্বচনীয়া, সর্বভূতের প্রকৃতি এবং চৈতন্যমাত্রে
আশ্রিতা। উক্ত মায়াতে চৈতন্যের যে প্রতিবিম্ব, উহাই ঈশ্বর। উক্ত মায়ারই আবরণ ও বিক্ষেপশক্তিযুক্ত
এবং অবিদ্যা নামে অভিহিত যে পরিচ্ছিন্ন ও অনন্ত প্রদেশ আছে, তাতে চৈতন্যের যে প্রতিবিম্ব,
উহাই জীব।
'পঞ্চদশী'র
তত্ত্ববিবেকে (১৬-১৭) কিন্তু বলা হয়েছে—"আভাসের দ্বারা জীব ও ঈশ্বর সৃজন করে
এবং স্বয়ং মায়া ও অবিদ্যা হয়ে থাকে"-(নৃসিংহ উত্তর তাপনীয় উপনিষৎ-৯) এই শ্রুতি
হতে সিদ্ধ হয় যে, ত্রিগুণাত্মিকা প্রকৃতির দুইটি রূপভেদ আছে—মায়া ও অবিদ্যা। প্রকাশাত্মক
সত্ত্বগুণের বিশুদ্ধতা (অন্য দুইগুণ দ্বারা মলিন না হওয়া) ও অবিশুদ্ধতা (অন্য দুই
গুণের দ্বারা মলিন হওয়া) হতেই সেই দুটিকে মায়া ও অবিদ্যা বলা হয়েছে। অর্থাৎ বিশুদ্ধসত্ত্বপ্রধানা
প্রকৃতির নাম মায়া এবং মলিনসত্ত্বপ্রধানা প্রকৃতির নাম অবিদ্যা। মায়াতে প্রতিবিম্বিত
চিদাত্মা, সেই মায়াকে নিজ বশে রেখে সর্বজ্ঞ ঈশ্বররূপে আখ্যাত হন। আর অবিদ্যায় প্রতিবিম্বিত
ও তার বশবর্তী যে চৈতন্য, তিনি জীব। অবিদ্যার অবিশুদ্ধির তারতম্যবশতঃ জীব দেবতা, তির্য্যগাদি
ভেদে অনেক প্রকারের হয়। .....
No comments:
Post a Comment