সর্বদুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি ও পরমানন্দাত্মক ব্রহ্মস্বরূপতা প্রাপ্তিরই নাম মুক্তি। এই প্রাপ্তি শব্দের অর্থ— 'অপ্রাপ্তের প্রাপ্তি নয়', কিন্তু স্বকণ্ঠগত, অথচ বিস্মৃত মণিমালার প্রাপ্তির ন্যায় 'প্রাপ্তের প্রাপ্তিকে' বুঝতে হবে; কারণ স্বকণ্ঠস্থিত মণিমালার ন্যায় ব্রহ্মস্বরূপতা জীবের নিত্য প্রাপ্ত। কিন্তু অনাদি অবিদ্যাবশতঃ সেই ব্রহ্মস্বরূপতা, স্বকণ্ঠস্থিত হলেও বিস্মৃত মণিমালার ন্যায় যেন অপ্রাপ্তই হয়ে পড়েছে। ব্রহ্মাত্মবিজ্ঞানের ফলে অবিদ্যার নাশ হলে সেই নিত্যপ্রাপ্ত ব্রহ্মস্বরূপতারই অভিব্যক্তিরূপ প্রাপ্তি হয়ে থাকে এবং অবিদ্যোত্থ সর্বদুঃখের আত্যন্তিক উপরম হয়ে যায়। একেই মুক্তি বলে। ব্রহ্মস্বরূপভূতা এই মুক্তি একই প্রকার হলেও তৎপ্রাপ্তির উপায়ভূতা বিদ্যার বিভিন্নতা এবং সাধকের প্রাপ্তব্য অবস্থার বিভিন্নতাবশতঃ প্রধানত দুই প্রকারে অভিহিত হয়ে থাকে, যথা— সদ্যোমুক্তি ও ক্রমমুক্তি।
নির্গুণব্রহ্মবিদ্যা অনুশীলনকারীর "অহং ব্রহ্মাস্মি", এপ্রকার জ্ঞানোদয়ের ফলে মূল-অবিদ্যা বিনষ্ট হলে স্বকণ্ঠগত বিস্মৃত মণিমালার প্রাপ্তির ন্যায়, ব্রহ্মরূপ স্বীয় পূর্বসিদ্ধ স্বরূপে যে অবস্থিতি, তাই সদ্যোমুক্তি। কারণ মোক্ষ জীবের স্বরূপ, তা নিত্য; উপাসনারূপ ধর্মের ফল নয়। এই বিষয়ে ব্রহ্মসূত্রের (১/১/৪) ভাষ্যে ভগবান শঙ্করাচার্য বলেছেন—
আত্মার
অশরীরত্ব স্বাভাবিক। কি প্রকারে তা জানলে? উত্তর—অশরীর্রীরেষু অনবস্থেষ্ববস্থিতম্৷
মহান্তং বিভুমাত্মানং মত্বা ধীরো ন শোচতি'-(কঠ উপনিষৎ-১/২/২২)
"অনিত্য
শরীরসকলে অবস্থিত শরীররহিত মহান্ এবং বিভু আত্মাকে অবগত হয়ে ধীমান ব্যক্তি শোক করেন
না",
'অপ্রাণো
হ্যমনাঃ শুভ্রঃ'-(মুণ্ডক উপনিষৎ-২/১/২)
"সেই
পুরুষ অপ্রাণ (—ক্রিয়াশক্তিমান মুখ্যপ্রাণ তার নাই), অমন (—জ্ঞানশক্তিমান সংকল্পবিকল্পাত্মক
মন তাঁর নাই) সেহেতু তিনি শুভ্র (—শুদ্ধ"),
'অসঙ্গো হ্যযং পুরুষঃ'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪/৩/১৫)
"যেহেতু
সে পুরুষ অসঙ্গ স্থূলসূক্ষ্মাদি দেহের সহিত সম্বন্ধশূন্য", ইত্যাদি শ্রুতিসমূহ হতে আত্মার স্বাভাবিক অশরীরতা
অবগত হওয়া যায়। অতএব অনুষ্ঠেয় কর্ম্মের ফল হতে ভিন্ন মোক্ষ নামক অশরীরত্ব নিত্য,
এটি সিদ্ধ হল।
সদ্যোমুক্তি শব্দের অর্থ 'জ্ঞানোদয়সমকালে মুক্তি' , তখনই মুক্তি, এখন অবিদ্যাধ্বংসী নিশ্চল অপরোক্ষ ব্রহ্মাত্মবিজ্ঞানের উদয় হল, আর মুক্তি কর্মফলের ন্যায় কালান্তরে হবে, এইরূপ নয়। সদ্যোমুক্ত পুরুষ ব্রহ্মাত্মজ্ঞানোৎপত্তির সমকালেই 'ইহার পূর্বেও আমি কর্তা বা ভোক্তা ছিলাম না, বর্তমানকালেও তা নয় এবং ভবিষ্যৎকালেও তা হব না', 'আমি এক অদ্বয় ব্রহ্মস্বরূপ' ইত্যাদি এই প্রকার অনুভব করতে থাকেন। তখন তাঁর আর দেহাত্মবিষয়ক জ্ঞান থাকে না। তখন তাকে জীবন্মুক্ত বলা হয়। এই বিষয়ে বরাহ শ্রুতিতে একটি সুন্দর সংজ্ঞা দেয়া আছে—
"যস্য
নাহংকৃতো ভাবো বুদ্ধির্যস্য ন লিপ্যতে। কুর্বতোহকুর্বতো বাপি স জীবন্মুক্ত উচ্যতে।"-(বরাহ
উপনিষৎ-৪/২৫)
অর্থাৎ
"যাঁর 'আমি কর্তা' এইরূপ ভাব নেই, যাঁর বুদ্ধি লিপ্ত হয় না, তিনি কিছু করুন বা
না করুন তিনি— জীবন্মুক্ত বলে কথিত হন।"
তাঁর
স্বদৃষ্টিতে তখন স্বীয় শরীর ও জগদাদি সমস্ত পদার্থই বাধিত হয়ে পড়ে। ভেদক উপাধি বিনষ্ট
হওয়ায় তিনি তখন শুদ্ধ জলে মিলিত শুদ্ধ জলের ন্যায় নিত্যশুদ্ধবুদ্ধ পরমানন্দস্বরূপ
ব্রহ্মই হয়ে পড়েন। এই বিষয়ে ভগবান্ ভাষ্যকার শঙ্করাচার্য ব্রহ্মসূত্রের (৪/১/১৩)
বলিতেছেন—"পূর্বসিদ্ধ কর্তৃত্ব ও ভোক্তৃত্বের বিপরীত যে কালত্রয়েই অকর্তৃ ও অভোক্তৃস্বরূপ
ব্রহ্ম, তিনিই আমি; ইহার পূর্বেও আমি কর্তা বা ভোক্তা ছিলাম না, বর্তমানকালেও তা নয়,
ভবিষ্যৎকালেও তা হব না; নির্গুণব্রহ্মবিদ্ এপ্রকার অনুভব করে থাকেন।" তাঁর স্বশরীরও
"বল্মীকে পরিত্যক্ত সর্পত্বকের ন্যায়" প্রতিভাত হয়। জীবন্মুক্ত অপরোক্ষ
ব্রহ্মাত্মজ্ঞানীর জীবদ্দশাতে অনুভূত যে অশরীরতা তা কেবল যে যুক্তিসিদ্ধ তা নয়, বরংচ
শ্রুতিসিদ্ধ। ব্রহ্মবিদ্গণের বিষয়ে এইরূপ শ্রুতিতেও আছে, যথা—
'যথা পর্বে প্রমুচ্যন্তে কামা যেহস্য হৃদি শ্রিতাঃ। অথ মর্ত্যোহমৃতো ভবত্যত্র ব্রহ্মসমশ্নুতে।। ইতি। তদ্যথাহিনির্ল্বযনী বল্মীকে মৃতা প্রত্যস্তা শযীতৈবমেবেদ্রীরং শেতে অথাযমশরীরোমৃতঃ প্রাণো ব্রহ্মৈব তেজ এব'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪/৪/৭)
অর্থাৎ
"মনুষ্যের হৃদয়ে (বুদ্ধিতে) যে সকল কামাশ্রিত তৃষ্ণা আছে, তারা সকলে যখন সমূলে
বিনষ্ট হয়, তখন মরমানুষ অমর হয় এবং এই দেহেই ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত হয়। ব্রহ্মজ্ঞের
দেহান্তরের অপ্রাপ্তি বিষয়ে দৃষ্টান্ত এই— সাপের খোলস যেমন বল্মীকে (উইটিবি) নিক্ষিপ্ত
হয়ে পড়ে থাকে, ব্রহ্মজ্ঞের এই শরীর ঠিক তেমনি পড়ে থাকে। অতঃপর জীবন্মুক্ত পুরুষ
শরীরে বর্তমান থাকলেও শরীরাভিমান না থাকায় অমৃত, প্রাণস্বরূপ (প্রাণের প্রাণ, পরমাত্মা),
ব্রহ্মস্বরূপ, তেজস্বরূপই হয়ে পড়েন।"
আর
'স্থিতপ্রজ্ঞস্য কা ভাষা'-(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা-২/৫৪) "স্থিতপ্রজ্ঞের লক্ষণ কি"?
ইত্যাদি স্মৃতিও স্থিতপ্রজ্ঞের লক্ষণসকলের বর্ণনা করতে প্রবৃত্ত হয়ে সকলপ্রকার প্রবৃত্তির
সহিত বিদ্বান পুরুষের সম্বন্ধশূন্যতাই প্রদর্শন করছেন। সুতরাং সদ্যোমুক্ত পুরুষের স্বদৃষ্টিতে
তাঁর শরীরপাত হয়ে গেছে। তখন "জীবন্মুক্তি ইত্যাদি তাঁর দৃষ্টিতে কল্পিত বস্তু
মাত্র এবং তৎপ্রতিপাদক শাস্ত্র তাঁর দৃষ্টিতে অর্থবাদ" (সংক্ষেপ শারীরক-৪/৩৯)।
জগৎ তাঁর কাছে দগ্ধ বস্ত্রের ন্যায়, স্বাপ্নপদার্থের স্মৃতির ন্যায়, অথবা মায়ামরীচিকার
ন্যায় প্রতিভাত হতে থাকে। স্বদৃষ্টিতে তাঁর প্রারব্ধ ইত্যাদি কিছুই থাকেনা। তাঁর প্রাণও
(—লিঙ্গশরীরও) উৎক্রমণ করে না, তিনি সচ্চিদানন্দস্বরূপ ব্রহ্মেই বিলীন হয়ে যান। পরদৃষ্টিতে
কিন্তু তাঁর প্রারব্ধকর্মবলে যতদিন শরীর থাকে, ততদিন তিনি জগৎকে স্বপ্নবৎ, বা মায়ামরীচিকাবৎ
দর্শন করেন। এটিই সিদ্ধান্ত সম্মত সদ্যোমুক্তাবস্থা।
কিন্তু
'অজ্ঞানিজনবোধার্থং প্রারব্ধং বক্তি বৈ শ্রুতিঃ"-(অপরোক্ষানুভূতি-৯৭) —' অজ্ঞানী
ব্যক্তির দৃষ্টিকে অপেক্ষা করে শ্রুতি তাদৃশ নির্গুণব্রহ্মাত্মবিদের প্রারব্ধকর্মের
কথা বলেন'। সুতরাং তাদৃশ সদ্যোমুক্ত পুরুষের প্রারব্ধকর্মবশে যতকাল শরীর থাকে, ততকাল
তাঁকে বলা হয়—'জীবন্মুক্ত'। সেহেতু তৎকালে তাঁর মুক্তির আখ্যা হয়—'জীবন্মুক্তি'।
আবার প্রারব্ধকর্মক্ষয়ে সেই জীবন্মুক্ত পুরুষের শরীর বিনষ্ট হলে, তাঁকে বলা হয়—'বিদেহমুক্ত', 'নির্বাণমুক্ত', ইত্যাদি। সেহেতু তখন তাঁর মুক্তির
আখ্যা হয় বিদেহমুক্তি, নির্বাণমুক্তি, ইত্যাদি। এরূপে এটিই সিদ্ধ হয় যে— জীবন্মুক্তি,
বিদেহমুক্তি এবং নির্ব্বাণমুক্তি প্রভৃতি উক্ত সদ্যোমুক্তিরই দৃষ্টিভেদে নামান্তর মাত্র।.......