Saturday, 17 September 2022

সদ্যোমুক্তি (জীবন্মুক্তি)-

 


সর্বদুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি ও পরমানন্দাত্মক ব্রহ্মস্বরূপতা প্রাপ্তিরই নাম মুক্তি। এই প্রাপ্তি শব্দের অর্থ— 'অপ্রাপ্তের প্রাপ্তি নয়', কিন্তু স্বকণ্ঠগত, অথচ বিস্মৃত মণিমালার প্রাপ্তির ন্যায় 'প্রাপ্তের প্রাপ্তিকে' বুঝতে হবে; কারণ স্বকণ্ঠস্থিত মণিমালার ন্যায় ব্রহ্মস্বরূপতা জীবের নিত্য প্রাপ্ত। কিন্তু অনাদি অবিদ্যাবশতঃ সেই ব্রহ্মস্বরূপতা, স্বকণ্ঠস্থিত হলেও বিস্মৃত মণিমালার ন্যায় যেন অপ্রাপ্তই হয়ে পড়েছে। ব্রহ্মাত্মবিজ্ঞানের ফলে অবিদ্যার নাশ হলে সেই নিত্যপ্রাপ্ত ব্রহ্মস্বরূপতারই অভিব্যক্তিরূপ প্রাপ্তি হয়ে থাকে এবং অবিদ্যোত্থ সর্বদুঃখের আত্যন্তিক উপরম হয়ে যায়। একেই মুক্তি বলে। ব্রহ্মস্বরূপভূতা এই মুক্তি একই প্রকার হলেও তৎপ্রাপ্তির উপায়ভূতা বিদ্যার বিভিন্নতা এবং সাধকের প্রাপ্তব্য অবস্থার বিভিন্নতাবশতঃ প্রধানত দুই প্রকারে অভিহিত হয়ে থাকে, যথা— সদ্যোমুক্তি ক্রমমুক্তি

নির্গুণব্রহ্মবিদ্যা অনুশীলনকারীর "অহং ব্রহ্মাস্মি", এপ্রকার জ্ঞানোদয়ের ফলে মূল-অবিদ্যা বিনষ্ট হলে স্বকণ্ঠগত বিস্মৃত মণিমালার প্রাপ্তির ন্যায়, ব্রহ্মরূপ স্বীয় পূর্বসিদ্ধ স্বরূপে যে অবস্থিতি, তাই সদ্যোমুক্তি। কারণ মোক্ষ জীবের স্বরূপ, তা নিত্য; উপাসনারূপ ধর্মের ফল নয়। এই বিষয়ে ব্রহ্মসূত্রের (১/১/৪) ভাষ্যে ভগবান শঙ্করাচার্য বলেছেন—

আত্মার অশরীরত্ব স্বাভাবিক। কি প্রকারে তা জানলে? উত্তর—অশরীর্রীরেষু অনবস্থেষ্ববস্থিতম্৷ মহান্তং বিভুমাত্মানং মত্বা ধীরো ন শোচতি'-(কঠ উপনিষৎ-১/২/২২)

"অনিত্য শরীরসকলে অবস্থিত শরীররহিত মহান্ এবং বিভু আত্মাকে অবগত হয়ে ধীমান ব্যক্তি শোক করেন না",

'অপ্রাণো হ্যমনাঃ শুভ্রঃ'-(মুণ্ডক উপনিষৎ-২/১/২)

"সেই পুরুষ অপ্রাণ (—ক্রিয়াশক্তিমান মুখ্যপ্রাণ তার নাই), অমন (—জ্ঞানশক্তিমান সংকল্পবিকল্পাত্মক মন তাঁর নাই) সেহেতু তিনি শুভ্র (—শুদ্ধ"),

 'অসঙ্গো হ্যযং পুরুষঃ'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪/৩/১৫)

"যেহেতু সে পুরুষ অসঙ্গ স্থূলসূক্ষ্মাদি দেহের সহিত সম্বন্ধশূন্য",  ইত্যাদি শ্রুতিসমূহ হতে আত্মার স্বাভাবিক অশরীরতা অবগত হওয়া যায়। অতএব অনুষ্ঠেয় কর্ম্মের ফল হতে ভিন্ন মোক্ষ নামক অশরীরত্ব নিত্য, এটি সিদ্ধ হল।

সদ্যোমুক্তি শব্দের অর্থ 'জ্ঞানোদয়সমকালে মুক্তি' , তখনই মুক্তি, এখন অবিদ্যাধ্বংসী নিশ্চল অপরোক্ষ ব্রহ্মাত্মবিজ্ঞানের উদয় হল, আর মুক্তি কর্মফলের ন্যায় কালান্তরে হবে, এইরূপ নয়। সদ্যোমুক্ত পুরুষ ব্রহ্মাত্মজ্ঞানোৎপত্তির সমকালেই 'ইহার পূর্বেও আমি কর্তা বা ভোক্তা ছিলাম না, বর্তমানকালেও তা নয় এবং ভবিষ্যৎকালেও তা হব না', 'আমি এক অদ্বয় ব্রহ্মস্বরূপ' ইত্যাদি এই প্রকার অনুভব করতে থাকেন। তখন তাঁর আর দেহাত্মবিষয়ক জ্ঞান থাকে না। তখন তাকে জীবন্মুক্ত বলা হয়। এই বিষয়ে বরাহ শ্রুতিতে একটি সুন্দর সংজ্ঞা দেয়া আছে—

"যস্য নাহংকৃতো ভাবো বুদ্ধির্যস্য ন লিপ্যতে। কুর্বতোহকুর্বতো বাপি স জীবন্মুক্ত উচ্যতে।"-(বরাহ উপনিষৎ-৪/২৫)

অর্থাৎ "যাঁর 'আমি কর্তা' এইরূপ ভাব নেই, যাঁর বুদ্ধি লিপ্ত হয় না, তিনি কিছু করুন বা না করুন তিনি— জীবন্মুক্ত বলে কথিত হন।"

তাঁর স্বদৃষ্টিতে তখন স্বীয় শরীর ও জগদাদি সমস্ত পদার্থই বাধিত হয়ে পড়ে। ভেদক উপাধি বিনষ্ট হওয়ায় তিনি তখন শুদ্ধ জলে মিলিত শুদ্ধ জলের ন্যায় নিত্যশুদ্ধবুদ্ধ পরমানন্দস্বরূপ ব্রহ্মই হয়ে পড়েন। এই বিষয়ে ভগবান্ ভাষ্যকার শঙ্করাচার্য ব্রহ্মসূত্রের (৪/১/১৩) বলিতেছেন—"পূর্বসিদ্ধ কর্তৃত্ব ও ভোক্তৃত্বের বিপরীত যে কালত্রয়েই অকর্তৃ ও অভোক্তৃস্বরূপ ব্রহ্ম, তিনিই আমি; ইহার পূর্বেও আমি কর্তা বা ভোক্তা ছিলাম না, বর্তমানকালেও তা নয়, ভবিষ্যৎকালেও তা হব না; নির্গুণব্রহ্মবিদ্ এপ্রকার অনুভব করে থাকেন।" তাঁর স্বশরীরও "বল্মীকে পরিত্যক্ত সর্পত্বকের ন্যায়" প্রতিভাত হয়। জীবন্মুক্ত অপরোক্ষ ব্রহ্মাত্মজ্ঞানীর জীবদ্দশাতে অনুভূত যে অশরীরতা তা কেবল যে যুক্তিসিদ্ধ তা নয়, বরংচ শ্রুতিসিদ্ধ। ব্রহ্মবিদ্গণের বিষয়ে এইরূপ শ্রুতিতেও আছে, যথা—

'যথা পর্বে প্রমুচ্যন্তে কামা যেহস্য হৃদি শ্রিতাঃ। অথ মর্ত্যোহমৃতো ভবত্যত্র ব্রহ্মসমশ্নুতে।। ইতি।  তদ্যথাহিনির্ল্বযনী বল্মীকে মৃতা প্রত্যস্তা শযীতৈবমেবেদ্রীরং শেতে অথাযমশরীরোমৃতঃ প্রাণো ব্রহ্মৈব তেজ এব'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪/৪/৭)

অর্থাৎ "মনুষ্যের হৃদয়ে (বুদ্ধিতে) যে সকল কামাশ্রিত তৃষ্ণা আছে, তারা সকলে যখন সমূলে বিনষ্ট হয়, তখন মরমানুষ অমর হয় এবং এই দেহেই ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত হয়। ব্রহ্মজ্ঞের দেহান্তরের অপ্রাপ্তি বিষয়ে দৃষ্টান্ত এই— সাপের খোলস যেমন বল্মীকে (উইটিবি) নিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে থাকে, ব্রহ্মজ্ঞের এই শরীর ঠিক তেমনি পড়ে থাকে। অতঃপর জীবন্মুক্ত পুরুষ শরীরে বর্তমান থাকলেও শরীরাভিমান না থাকায় অমৃত, প্রাণস্বরূপ (প্রাণের প্রাণ, পরমাত্মা), ব্রহ্মস্বরূপ, তেজস্বরূপই হয়ে পড়েন।"

আর 'স্থিতপ্রজ্ঞস্য কা ভাষা'-(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা-২/৫৪) "স্থিতপ্রজ্ঞের লক্ষণ কি"? ইত্যাদি স্মৃতিও স্থিতপ্রজ্ঞের লক্ষণসকলের বর্ণনা করতে প্রবৃত্ত হয়ে সকলপ্রকার প্রবৃত্তির সহিত বিদ্বান পুরুষের সম্বন্ধশূন্যতাই প্রদর্শন করছেন। সুতরাং সদ্যোমুক্ত পুরুষের স্বদৃষ্টিতে তাঁর শরীরপাত হয়ে গেছে। তখন "জীবন্মুক্তি ইত্যাদি তাঁর দৃষ্টিতে কল্পিত বস্তু মাত্র এবং তৎপ্রতিপাদক শাস্ত্র তাঁর দৃষ্টিতে অর্থবাদ" (সংক্ষেপ শারীরক-৪/৩৯)। জগৎ তাঁর কাছে দগ্ধ বস্ত্রের ন্যায়, স্বাপ্নপদার্থের স্মৃতির ন্যায়, অথবা মায়ামরীচিকার ন্যায় প্রতিভাত হতে থাকে। স্বদৃষ্টিতে তাঁর প্রারব্ধ ইত্যাদি কিছুই থাকেনা। তাঁর প্রাণও (—লিঙ্গশরীরও) উৎক্রমণ করে না, তিনি সচ্চিদানন্দস্বরূপ ব্রহ্মেই বিলীন হয়ে যান। পরদৃষ্টিতে কিন্তু তাঁর প্রারব্ধকর্মবলে যতদিন শরীর থাকে, ততদিন তিনি জগৎকে স্বপ্নবৎ, বা মায়ামরীচিকাবৎ দর্শন করেন। এটিই সিদ্ধান্ত সম্মত সদ্যোমুক্তাবস্থা।

কিন্তু 'অজ্ঞানিজনবোধার্থং প্রারব্ধং বক্তি বৈ শ্রুতিঃ"-(অপরোক্ষানুভূতি-৯৭) —' অজ্ঞানী ব্যক্তির দৃষ্টিকে অপেক্ষা করে শ্রুতি তাদৃশ নির্গুণব্রহ্মাত্মবিদের প্রারব্ধকর্মের কথা বলেন‌'। সুতরাং তাদৃশ সদ্যোমুক্ত পুরুষের প্রারব্ধকর্মবশে যতকাল শরীর থাকে, ততকাল তাঁকে বলা হয়—'জীবন্মুক্ত'। সেহেতু তৎকালে তাঁর মুক্তির আখ্যা হয়—'জীবন্মুক্তি'। আবার প্রারব্ধকর্মক্ষয়ে সেই জীবন্মুক্ত পুরুষের শরীর বিনষ্ট হলে, তাঁকে বলা হয়—'বিদেহমুক্ত',  'নির্বাণমুক্ত', ইত্যাদি। সেহেতু তখন তাঁর মুক্তির আখ্যা হয় বিদেহমুক্তি, নির্বাণমুক্তি, ইত্যাদি। এরূপে এটিই সিদ্ধ হয় যে— জীবন্মুক্তি, বিদেহমুক্তি এবং নির্ব্বাণমুক্তি প্রভৃতি উক্ত সদ্যোমুক্তিরই দৃষ্টিভেদে নামান্তর মাত্র।.......

Wednesday, 14 September 2022

ত্রিগুণ:-

 


এই বিষয়ে আজকে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার গুণত্রয়বিভাগযোগের শঙ্করাচার্যের ভাষ্যানুসারে বিস্তৃত আলোচনা করব। ত্রিগুণ কি? "সত্ত্বং রজঃ তমঃ ইতি এবংনামানঃ", অর্থাৎ সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ এই নামের তিনটি গুণ। এখানে 'গুণ' শব্দটি পারিভাষিক; এটা নৈয়ায়িকদের রূপরসাদির ন্যায় দ্রব্যাশ্রিত কিন্তু দ্রব্য হতে ভিন্ন কোন পদার্থ নয়। অথবা এখানে ভেদাভেদবাদি-বেদান্তসম্মত গুণগুণী পদার্থদ্বয়ের প্রথমটিও বিবক্ষিত নয়। এটা হলো অনির্বাচ্য ভগবান্মায়া সম্ভবারূপ পদার্থ।

এখন প্রশ্ন ত্রিগুণ কি হতে জাত?

শ্রীভগবান্ বলছেন"প্রকৃতিসংভবাঃ" এই শ্লোকের ভাষ্যে ভাষ্যকার শঙ্করাচার্য বলেন"ভগবন্মায়াসংভবাঃ", প্রকৃতি-সম্ভব অর্থাৎ ভগবান্মায়া হতে জাত। প্রকৃতিজাত সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ - অনাদিত্ব ও নির্গুণত্বহেতু অব্যয় আত্মাকে এই গুণত্রয় দেহাভিমান দ্বারা শরীরে আবদ্ধ করে। এরা অবিদ্যাত্মক বলে ক্ষেত্রজ্ঞকে যেন বন্ধনও করে। পরমার্থতঃ দেহী লিপ্ত হন না, 'যেন' শব্দের অধ্যাহার কোরে সেই 'যেন' শব্দের দ্বারা 'দেহী যেন নিবদ্ধ হন', এইরূপ অর্থ।

 এই গুণত্রয়ের মধ্যে সত্ত্বগুণ স্ফটিকমণির ন্যায় নির্মল, স্বচ্ছ চৈতন্যপ্রতিবিম্বগ্রহণে সমর্থ বলে নিরুপদ্রব ও প্রকাশক। এই সত্ত্বগুণ 'আমি সুখি' এইরূপ সুখাসক্তি এবং 'আমি জ্ঞানী' এইরূপ জ্ঞানাসক্তি দ্বারা আত্মাকে যেন আবদ্ধ করে। রজোগুণ রাগাত্মক। ইহা অপ্রাপ্তের অভিলাষ ও প্রাপ্তবিষয়ে মনের প্রীতির উৎপাদক বলে জানবে। দৃষ্ট ও অদৃষ্ট ফলের নিমিত্ত কর্মে আসক্তি দ্বারা ইহা আত্মাকে যেন আবদ্ধ করে, অর্থাৎ যেন 'আমি করি' - এই অভিমান দ্বারা কর্মে প্রবর্তিত করে। তমোগুণ আবরণশক্তিপ্রধান প্রকৃতির অংশ হতে উৎপন্ন এবং দেহধারিগণের মোহজনক (হিতাহিত-বিবেকের প্রতিবন্ধক) জানবে। উহা প্রমাদ, আলস্য ও নিদ্রা দ্বারা আত্মাকে দেহে যেন বদ্ধ করে।

পুনরায় গুণসকলের ব্যাপার সংক্ষেপে আলোচনা করব। সত্ত্বগুণ সাধ্য বিষয়ে ও রজোগুণ সাধ্য কর্মে জীবকে আবদ্ধ করে এবং তমোগুণ সত্ত্বকৃত বিবেককে আবৃত করে জীবকে প্রমাদ ও আলস্য প্রভৃতিতে নিমজ্জিত করে।

গুণসকল পূর্বোক্ত কার্যসকল কখন করে থাকে?

 তদুত্তরে ভগবান বলছেন"সত্ত্বগুণ রজঃ ও তমোগুণকে অভিভূত করে প্রবল হয়। রজোগুণ সত্ত্ব ও তমোগুণকে অভিভূত করে প্রবল হয়। আর তমোগুণ সত্ত্ব ও রজোগুণকে অভিভূত করে প্রবল হয়।"

যখন যে গুণ উদ্ভূত হয়, তখন তার কি চিহ্ন হয় তাই বলা হচ্ছে

"যখন এই ভোগায়তন দেহের সমস্ত ইন্দ্রিয়দ্বার বুদ্ধিবৃত্তির প্রকাশ দ্বারা উদ্ভাসিত হয়, তখন জানবে যে সত্ত্বগুণ বর্ধিত হচ্ছে। লোভ, কর্মে প্রবৃত্তি ও প্রচেষ্টা, হর্ষ ও অনুরাগাদির অনিবৃত্তি এবং বিষয়ভোগের স্পৃহা - এই সকল রজোগুণের বৃদ্ধিকালে উৎপন্ন হয়। কর্তব্যাকর্তব্য বিবেকের অভাব, অনুদ্যম, কর্তব্যে অবহেলা ও মূঢ়তা প্রভৃতি লক্ষণ তমোগুণ বৃদ্ধি পেলে জন্মে।"

মরণকালের সত্ত্বাদি অবস্থার দ্বারা যে ফল জীব প্রাপ্ত হয়, সে সবের হেতু আসক্তি ও বিষয়রাগ, সেজন্য তা ত্রিগুণের প্রভাবজন্যই এটি দেখানোর জন্য ভগবান বলছেন

"সত্ত্বগুণের বৃদ্ধিকালে মানুষ দেহত্যাগ করলে হিরণ্যগর্ভাদি উপাসকদিগের সুখময় ব্রহ্মলোকাদিতে গমন করে। রজোগুণের বৃদ্ধিকালে মৃত্যু হলে কর্মভূমি মনুষ্যলোকে জন্ম হয় এবং তমোগুণের বৃদ্ধিকালে মৃত্যু হলে পশ্বাদি মূঢ়জন্ম প্রাপ্ত হয়। শিষ্টগণ বলেন - সাত্ত্বিক কর্মের ফল নির্মল সুখ, রাজসিক কর্মের ফল দুঃখ ও তামসিক কর্মের ফল মূঢ়তা (পশু প্রভৃতি জন্মে দৃশ্যমান অজ্ঞান)। রজঃ ও তমোগুণকে অভিভূত করবার পর সত্ত্বগুণ হতে সকল ইন্দ্রিয়ের জ্ঞান জন্মে। সত্ত্ব ও তমোগুণকে অভিভবের পর রজোগুণ হতে লোভপ্রবৃত্তি জাত হয়। আর তমোগুণ সত্ত্ব ও রজোগুণকে অভিভূত করলে তা হতে অবিবেক, অনবধানতা ও মূঢ়তা উৎপন্ন হয়। সত্ত্বগুণে অবস্থিত (শাস্ত্রীয় উপাসনা ও কর্মে নিরত) ব্যক্তিগণ দেবলোকাদিতে গমন করেন, রজোগুণী (লোভাদিবশতঃ কাম্য-নিষিদ্ধাদি কর্মে নিযুক্ত) ব্যক্তিগণ দুঃখবহুল মনুষ্যলোকে জন্মগ্রহণ করেন এবং জঘন্যগুণবৃত্তিতে (নিদ্রা-আলস্যাদিতে) স্থিত তামসিক ব্যক্তিগণ পশ্বাদি হীন জন্মলাভ করে।"

আর গুণাতীত অবস্থায় জীবের অমৃতত্ব প্রাপ্তি হয়, এই বিষয়ে শ্রীভগবান্ বলছেন

"যখন জীব কার্য-কারণ-বিষয়াকারে পরিণত ত্রিগুণ ব্যতীত অন্য কাউকেও কর্তা বলে দেখেন না এবং ত্রিগুণের অতীত ও তাদের কার্যসমূহের সাক্ষী আত্মাকে জ্ঞাত হন, তখন তিনি ব্রহ্মস্বরূপ অধিগত হন। দেহোৎপত্তির কারণ এই অবিদ্যাময় গুণত্রয় অতিক্রম করলে জীব জন্ম, মৃত্যু ও জরা-রূপ দুঃখ হতে জীবনকালেই বিমুক্ত হন এবং ব্রহ্মানন্দরূপ অমৃতত্ত্ব লাভ করেন।"

ব্রহ্মবিদ্ গুরুর কর্তব্য কি?


 

এই বিষয়ে শ্রুতি কি বলছে দেখে নেয়া যাক

তস্মৈ স বিদ্বানুপসন্নায় সম্যক্

প্রশান্তচিত্তায় শমান্বিতায় ।

যেনাক্ষরং পুরুষং বেদ সত্যং প্রোবাচ

তাং তত্ত্বতো ব্রহ্মবিদ্যাম্ ॥ -(মুণ্ডক উপনিষৎ-১/২/১৩)

অর্থাৎ সেই বিদ্বান্ অর্থাৎ ব্রহ্মবিদ্ গুরু যথাবিধি সমীপাগত প্রশান্তচিত্ত (দর্পাদিদোষরহিত), শমান্বিত (সংযতেন্দ্রিয় অর্থাৎ সর্ববিষয়ে বৈরাগ্যযুক্ত) সেই শিষ্যকে সেই ব্রহ্মবিদ্যা যথাযথরূপে বলবেন যে বিদ্যার নিমিত্ত সেই অক্ষরসংজ্ঞক পরমার্থস্বভাববিশিষ্ট সত্য পুরুষকে জানা যায়।

দীন শরণাগত শিষ্যদর্শনে জ্ঞানীগণ করুণাপরবশ হয়ে অবশ্যই উপদেশ প্রদান করে থাকেন। বসন্তের ন্যায় লোকহিত আচরণ করাই বিদ্বানগণের স্বভাব। যোগবাশিষ্ঠসারের বৈরাগ্য প্রকরণে বর্ণিত আছে"জ্ঞানিনামপি চিত্তং চেৎ কেবলাত্মসুখোদিতম্। সত্ত্বাঃ সংসারদুঃখার্ত্তা কং যান্তি শরণং তদা।" অর্থাৎ জ্ঞানীগণের চিত্ত যদি কেবল আত্মানন্দ লাভেই সমুৎসুক থাকে, তবে সংসারদুঃখসন্তপ্ত জীবগণ একটু শান্তি প্রাপ্তির আশায় কার শরণাপন্ন হবে? অতএব জ্ঞানীগণ সদা পরোপকারপরায়ণ হয়ে থাকেন।

বিদ্বানগণ স্বয়ং এই সংসারপ্রহেলিকার পারে উত্তীর্ণ হয়ে তাঁরা অপরকেও সেই মোক্ষমার্গে আরূঢ় করিয়ে থাকেন। এটা তাঁদের কর্তব্য। আচার্য শ্রীশঙ্কর উপরোক্ত মুণ্ডক শ্রুতির ভাষ্যে বলেছেন"বিধিপূর্বক সমীপাগত, যোগ্য, সৎ শিষ্যকে সংসাররূপ অবিদ্যা-সাগর হতে উদ্ধার করা আচার্যের অবশ্য কর্তব্য।"

শ্রীমদ্ভাগবত্ পুরাণের (১/৩/৫) শ্লোকের বিকৃত তাৎপর্য ও ভগবান শিবকে নিয়ে নির্লজ্জ অপপ্রচারের খণ্ডনঃ-

 


প্রথমত বলে রাখি শুধুমাত্র সত্য প্রকাশের নিমিত্ত ও বিবিধ অপপ্রচারের বিরুদ্ধে জবাব দেবার জন্যই আমি এই খণ্ডনকর্মে প্রবৃত্ত হচ্ছি। নিজেদের বৈষ্ণব দাবি করা একটি নির্দিষ্ট সংগঠনের অনুসারীরা শ্রীমদ্ভাগবত্ পুরাণের প্রথম স্কন্ধের তৃতীয় অধ্যায়ের ৫ম শ্লোকের তাৎপর্যে বলেন

পূর্বপক্ষশিব কোন সাধারণ জীব নন, তিনি ভগবানের অংশ। কিন্তু যেহেতু শিব সরাসরিভাবে জড়া প্রকৃতির সঙ্গে যুক্ত, তাই তিনি ঠিক বিষ্ণুর মতো পূর্ণরূপে গুণাতীত নন। তাঁদের পার্থক্য অনেকটা দুধ এবং দইয়ের মধ্যে পার্থক্যের মতো। দই দুধ ছাড়া আর কিছুই নয়, তবুও তা দুধ নয়।

সিদ্ধান্ত এইধরণের কোন তাৎপর্যই আলোচ্য শ্লোকের মূল বা শ্রীধর টীকাতে নেই। প্রথমে মূলে কি বলা আছে অনুবাদসমেত দেখে নেয়া যাক

এতন্নানাবতারাণাং নিধানং বীজমব্যয়ম্ ।

যস্যাংশাংশেন সৃজ্যন্তে দেবতির্যঙ্নরাদয়ঃ ॥ ৫॥

অনুবাদঃ- উল্লিখিত কারণোদকশায়ী রূপই লীলাবসানে নানা অবতারের প্রবেশস্থলী অক্ষয় এবং উদ্গমস্থান যাঁর অংশ ব্রহ্মা ও ব্রহ্মাংশ মরীচাদি ঋষিগণ, (তিনিই) দেব-নর-তীর্যক-সর্বপ্রকার প্রাণী সৃষ্টি করেন।

এবার শ্রীচৈতন্যদেবাদি মান্য শ্রীমদ্ভাগবতের  সর্বপ্রাচীনতম ও পণ্ডিতগণ স্বীকৃত প্রখ্যাত টীকাকার পূজ্যপাদ্ আচার্য শ্রীধর স্বামী ভাবার্থদীপিকায় কি বলছেন দেখে নেয়া যাক।

শ্রীধরটীকাঃ- এতত্তু কূটস্থং ন ত্বন্যাবতারবদাবির্ভাব-তিরোভাববদিত্যাহএতদিতি। এতত্তু আদিনারায়ণরূপম। নিধীয়তেহস্মিন্নিতি নিধানং, কার্যাবসানে প্রবেশস্থানমিত্যর্থঃ। বীজমন্ত্র উদ্গমস্থানং বীজত্বেহপি নান্যবীজতুল্যং কিন্ত্বব্যয়ম। ন কেবলমবতারাণামেব বীজং, কিন্তু সর্বপ্রাণিনামিত্যাহ, যস্যাংশো ব্রহ্মা তস্যাংশো মরীচ্যাদিস্তেন।

টীকানুবাদঃ- এটি কূটস্থ অর্থাৎ অন্য অবতারের মতো এখানে আবির্ভাব-তিরোভাব নেইএই কথা বলার জন্য 'এতৎ' ইত্যাদি শ্লোক। 'এতৎ' শব্দের অর্থ আদিনারায়ণরূপ। নিধানমএখানে রক্ষিত হয়। অর্থাৎ লীলাবসানে যেটি প্রবেশস্থল। 'বীজম'—উদ্গমস্থান, এখানে শব্দটি বীজ হলেও অন্য বীজের মত নয়। কারণ এই বীজ অক্ষয়অব্যয়। আবার কেবল অবতারদেরই বীজ নয়, অন্য সর্বপ্রকার প্রাণীদেরও বীজস্বরূপ, এই কথা বোঝানোর জন্য বলা হলো, 'যস্যাংশো ব্রহ্মা তস্যাংশো মরীচ্যাদিস্তেন'—যাঁর অংশ ব্রহ্মা, আবার সেই ব্রহ্মার অংশ মরীচাদি ঋষিগণ, তাঁর দ্বারাই (সৃষ্ট হয়)।......

বেদান্তে অবিদ্যা কি?

 


পঞ্চপাদিকা বিবরণে আচার্য প্রকাশাত্মযতি বলছেন— মায়া ও অবিদ্যা ভিন্ন তত্ত্ব নয়। মায়া অবিদ্যারই নামান্তর। ভাষ্যকার ভগবান্ শঙ্করাচার্য ব্রহ্মসূত্র ১.৪.১ ভাষ্যে মায়া শক্তিকে "অবিদ্যাত্মিকা" বলে মায়া ও অবিদ্যার অভেদই উপপাদন করেছেন। মায়া ও অবিদ্যা বস্তুতঃ এক হলেও ব্যবহারে দেখা যায় যে, ব্রহ্মের তিরস্করণী (আবরণশক্তি প্রধানা) মায়াকে অবিদ্যা, আর বিশ্ব-জননী (বিক্ষেপশক্তিপ্রধানা) মায়াকে মায়া বলা হয়ে থাকে। অব্যক্ত নামক পরমেশ্বরের শক্তিই অনাদি অবিদ্যা। ভগবান্ শঙ্করাচার্য বিবেকচূড়ামণি গ্রন্থে বলেছেন—"অব্যক্তনাম্নী পরমেশশক্তিরনাদ্যবিদ্যা ত্রিগুণাত্মিকা পরা" অর্থাৎ "অব্যক্ত নামক পরমেশ্বরের শক্তিই অনাদি অবিদ্যা। ইহা সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ এই ত্রিগুণাত্মিকা এবং পরা অর্থাৎ কারণরূপা।" সদানন্দযোগীন্দ্র সরস্বতী বেদান্তসারে এই বিষয়ে শ্রুতি প্রমাণ দিচ্ছেন—"দেবাত্মশক্তিং স্বগুণৈঃ নিগূঢ়াম্"-(শ্বেতাশ্বতর উপনিষৎ-১/৩)

অবিদ্যার লক্ষণ কি? এই প্রশ্নের উত্তরে চিৎসুখাচার্য বলেন—

'অনাদি ভাবরূপং যদবিজ্ঞানেন বিলীয়তে।

 তদজ্ঞানমিতি প্রজ্ঞা লক্ষণং সংপ্রচক্ষতে।।' -(চিৎসুখী, ১ম পরিচ্ছেদ)

"যা অনাদি, ভাবস্বরূপ এবং তত্ত্বজ্ঞানের উদয়ে বিলয় প্রাপ্ত হয়, অজ্ঞানের তাই লক্ষণ বলে পণ্ডিতগণ ব্যাখ্যা করে থাকেন।"

আচার্য মধুসূদন সরস্বতী তাঁর অদ্বৈতসিদ্ধিতে অবিদ্যার লক্ষণ নিরূপণ করতে গিয়ে, উল্লেখিত চিৎসুখের লক্ষণের প্রতিধ্বনি করে বলেন—"অনাদিভাবত্বে সতি জ্ঞাননিবর্ত্যাসেতি"-(অদ্বৈতসিদ্ধি, অজ্ঞানলক্ষণ নিরুক্তি) অর্থাৎ "যা অনাদি ভাবরূপ এবং জ্ঞানবিনাশ্য তাকেই অবিদ্যা বলে জানবে।"

সুরেশ্বরাচার্য নৈষ্কর্ম্যসিদ্ধিতে বলেছেন—"ঐকত্ম্যাপ্রতিপত্তির্যা স্বাত্মানুভবসংশ্রয়া। সাহবিদ্যা সংসৃতের্বীজং তন্নাশো মুক্তিরাত্মনঃ" অর্থাৎ স্বাত্মানুভবসংশ্রয়া সংসারবীজরূপ যে একাত্মতার অপ্রতিপত্তি (অজ্ঞান) তাই অবিদ্যা। তার নাশই আত্মার মুক্তি।

অবিদ্যা ভ্রান্তিস্বরূপা। সপ্তশতী চণ্ডীর দেব্যাদূতসংবাদ নামক পঞ্চম অধ্যায়ে বর্ণিত আছে— "যা দেবী সর্বভূতেষু ভ্রান্তিরূপেণ সংস্থিতা।" অর্থাৎ 'যে দেবী সর্বপ্রাণীতে ভ্রান্তিরূপে অর্থাৎ যাহা যাহা নয়, তাহাকে তাহা মনে করারূপ মিথ্যাজ্ঞানরূপে অবস্থিতা।' বিদ্যা বা জ্ঞানের দ্বারা এই অবিদ্যার নিবৃত্তি হয়। আচার্য বিদ্যারণ্য স্বামী 'পঞ্চদশী'র চিত্রদীপে তাই বলেছেন—"সংসারঃ পরমার্থোহয়ং সংলগ্নঃ স্বাত্মবস্তুনি। ইতি ভ্রান্তিরবিদ্যা স্যাদ্বিদ্যয়ৈষা নিবর্ততে", অর্থাৎ "এই সংসার পরমার্থতঃ আত্মায় যুক্ত, এরূপ যে ভ্রান্তি, তাই অবিদ্যা। বিদ্যা বা জ্ঞানের দ্বারা এই অবিদ্যার নিবৃত্তি হয়।"

ভগবান্ ভাষ্যকার শঙ্করাচার্য ব্রহ্মসূত্রের অধ্যাসভাষ্যে একই সুরে বলেছেন—"অধ্যাসং পণ্ডিতাঃ অবিদ্যা ইতি মন্যন্তে" অর্থাৎ এই অধ্যাসকে (—ভ্রমকে) পণ্ডিতগণ মূলাবিদ্যার কার্য হওয়ায় অবিদ্যা বলে মনে করেন।" এই মূলাবিদ্যা কি? 'পঞ্চদশী'র চিত্রদীপে আচার্য বিদ্যারণ্য তা স্পষ্ট করেছেন—"অয়ং জীবো ন কূটস্থং বিবিনক্তি কদাচন। অনাদিরবিবেকোহয়ং মূলাবিদ্যেতি গম্যতাম্", অর্থাৎ "এই জীব কখনই কূটস্থকে বিবেকদ্বারা আপনা হতে পৃথক করে বুঝতে পারে না। এই যে অনাদি অবিবেক, ইহাকে মূল-অবিদ্যা বলে বুঝতে হবে।"

অদ্বৈতবেদান্তে অবিদ্যাকে 'অনির্বাচ্য' বলেও ব্যাখ্যা করা হয়েছে। অনির্বাচ্য অবিদ্যার‌ রহস্য এই যে, অবিদ্যা সৎও নয়,  অসৎও নয়, সদসৎও নয়; ভাবও নয়, অভাবও নয়, ভাবাভাবও নয়, এরূপেই আচার্য মধুসূদন সরস্বতী তাঁর অদ্বৈতসিদ্ধিতে অনির্বাচ্য অবিদ্যার লক্ষণ নিরূপণ করার চেষ্টা করেছেন। যথা—"অবিদ্যা ভাবাভাববিলক্ষণং যৎকিঞ্চিদ্বস্তু সত্ত্বরহিতত্বে সতি সদসত্ত্বরহিতত্বম"- (অদ্বৈতসিদ্ধি, অনির্বাচ্যত্বলক্ষণোপপত্তিঃ).....

আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...