Wednesday, 14 September 2022

বেদান্তে অবিদ্যা কি?

 


বেদান্তে অবিদ্যা কি?

অঘটন-ঘটন-পটীয়সী অবিদ্যাই ভ্রান্তি জননী, জীব জগৎপ্রসবিনী। অদ্বৈতবেদান্তোক্ত এই অনির্বচনীয় অবিদ্যার লক্ষণ বা পরিচয় কি? এই প্রশ্নের উত্তরে চিৎসুখাচার্য বলেন

'অনাদি ভাবরূপং যদবিজ্ঞানেন বিলীয়তে।

 তদজ্ঞানমিতি প্রজ্ঞা লক্ষণং সংপ্রচক্ষতে।।' -(চিৎসুখী, ১ম পরিচ্ছেদ)

"যা অনাদি, ভাবস্বরূপ এবং তত্ত্বজ্ঞানের উদয়ে বিলয় প্রাপ্ত হয়, অজ্ঞানের তাই লক্ষণ বলে পণ্ডিতগণ ব্যাখ্যা করে থাকেন।"

শ্রীমৎ মধুসূদন সরস্বতী তাঁর অদ্বৈতসিদ্ধিতে অবিদ্যার লক্ষণ নিরূপণ করতে গিয়ে, উল্লেখিত চিৎসুখের লক্ষণের প্রতিধ্বনি করে বলেন"অনাদিভাবত্বে সতি জ্ঞাননিবর্ত্যাসেতি"-(অদ্বৈতসিদ্ধি, অজ্ঞানলক্ষণ নিরুক্তি) অর্থাৎ "যা অনাদি ভাবরূপ এবং জ্ঞানবিনাশ্য তাকেই অবিদ্যা বলে জানবে।"

ব্রহ্মসূত্রের দেবতাধিকরণের ৩০শ সূত্রে বেদান্তকল্পতরু টীকায় অমলানন্দ স্বামী"ভাবরূপা মতাঽবিদ্যা স্ফুটং বাচস্পতেরিহ।" এইরূপে অবিদ্যার ব্যাখ্যা করে ভাবরূপ অবিদ্যাই যে ভামতীকার বাচস্পতি মিশ্রের অনুমোদিত তা নিঃসংশয়ে প্রতিপাদন করেছেন।

সুতরাং অবিদ্যার লক্ষণে অবিদ্যার পরিচায়ক তিনটি বিশেষণ পদের প্রয়োগ দেখতে পাওয়া যায়—() অনাদি, () ভাবরূপ, () জ্ঞাননাশ্য। তবে অদ্বৈতবেদান্তে অবিদ্যাকে 'অনির্বাচ্য' বলেও ব্যাখ্যা করা হয়েছে। অবিদ্যা লক্ষণের ব্যাখ্যায় আচার্য মধুসূদন সরস্বতী বলেনঅবিদ্যার লক্ষণে অবিদ্যাকে ভাবরূপা বলা হলেও অবিদ্যা প্রকৃতপক্ষে ভাবরূপা নয়, এটা 'ভাবাভাববিলক্ষণা', অনির্বাচ্যা। অদ্বৈতবাদী অবিদ্যালক্ষণোক্ত ভাব শব্দের স্বাভাবিক ভাবরূপতা অর্থ পরিত্যাগ করে ভাব শব্দের 'অভাববিলক্ষণ' রূপ গৌণ অর্থ গ্রহণ করেছেন। অবিদ্যা কেবল অভাবেরই উপাদান নয়, অবিদ্যা ভাব বস্তুরও উপাদান। এই অবস্থায় অবিদ্যাকে শুধু অভাববিলক্ষণ বললে চলবে না; এটাকে ভাববিলক্ষণও বলতে হবে। ফলে ভাব শব্দের 'ভাবাভাববিলক্ষণা' বা অনির্বাচ্যই হবে প্রকৃত অর্থ।

অনির্বাচ্য অবিদ্যাররহস্য এই যে, অবিদ্যা সৎও নয়,  অসৎও নয়, সদসৎও নয়; ভাবও নয়, অভাবও নয়, ভাবাভাবও নয়, এরূপেই মধুসূদন সরস্বতী তাঁর অদ্বৈতসিদ্ধিতে অনির্বাচ্য অবিদ্যার লক্ষণ নিরূপণ করার চেষ্টা করেছেন। যথা"অবিদ্যা ভাবাভাববিলক্ষণং যৎকিঞ্চিদ্বস্তু সত্ত্বরহিতত্বে সতি সদসত্ত্বরহিতত্বম"- (অদ্বৈতসিদ্ধি, অনির্বাচ্যত্বলক্ষণোপপত্তিঃ)

পঞ্চপাদিকা বিবরণে আচার্য প্রকাশাত্মযতি বলছেনমায়া অবিদ্যা ভিন্ন তত্ত্ব নয়। মায়া অবিদ্যারই নামান্তর। ভাষ্যকার ভগবান্ শঙ্করাচার্য ব্রহ্মসূত্র .. ভাষ্যে মায়া শক্তিকে "অবিদ্যাত্মিকা" বলে মায়া অবিদ্যার অভেদই উপপাদন করেছেন। মায়া অবিদ্যা বস্তুতঃ এক হলেও ব্যবহারে দেখা যায় যে, ব্রহ্মের তিরস্করণী (আবরণশক্তি প্রধানা) মায়াকে অবিদ্যা, আর বিশ্ব-জননী (বিক্ষেপশক্তিপ্রধানা) মায়াকে মায়া বলা হয়ে থাকে।

অব্যক্ত নামক পরমেশ্বরের শক্তিই অনাদি অবিদ্যা। ভগবান্ শঙ্করাচার্য বিবেকচূড়ামণি গ্রন্থে বলেছেন"অব্যক্তনাম্নী পরমেশশক্তিরনাদ্যবিদ্যা ত্রিগুণাত্মিকা পরা" অর্থাৎ "অব্যক্ত নামক পরমেশ্বরের শক্তিই অনাদি অবিদ্যা। ইহা সত্ত্ব, রজঃ তমঃ এই ত্রিগুণাত্মিকা এবং পরা অর্থাৎ কারণরূপা।" সদানন্দযোগীন্দ্র সরস্বতী বেদান্তসারে এই বিষয়ে শ্রুতি প্রমাণ দিচ্ছেন"দেবাত্মশক্তিং স্বগুণৈঃ নিগূঢ়াম্"-( শ্বেতাশ্বতর উপনিষৎ-/)

তবে শঙ্করশিষ্য সুরেশ্বরাচার্য নৈষ্কর্ম্যসিদ্ধিতে অবিদ্যা বিষয়ে বলেছেন—"ঐকত্ম্যাপ্রতিপত্তির্যা স্বাত্মানুভবসংশ্রয়া। সাহবিদ্যা সংসৃতের্বীজং তন্নাশো মুক্তিরাত্মনঃ" অর্থাৎ স্বাত্মানুভবসংশ্রয়া সংসারবীজরূপ যে একাত্মতার অপ্রতিপত্তি (অজ্ঞান) তাই অবিদ্যা। তার নাশই আত্মার মুক্তি। অবিদ্যাবশতঃই দেহকে 'আমি' বলে বোধ হয়। এই দেহবন্ধন অবিদ্যাকল্পিত। মনের অতিরিক্ত অবিদ্যা নেই; মনই সংসার বন্ধনের হেতু অবিদ্যা। মনের নাশ হলে সকল সংসার বন্ধন নষ্ট হয়ে যায়।

অবিদ্যা ভ্রান্তিস্বরূপা। সপ্তশতী চণ্ডীর দেব্যাদূতসংবাদ নামক পঞ্চম অধ্যায়ে বর্ণিত আছে "যা দেবী সর্বভূতেষু ভ্রান্তিরূপেণ সংস্থিতা।" অর্থাৎ 'যে দেবী সর্বপ্রাণীতে ভ্রান্তিরূপে অর্থাৎ যা যা নয়, তাকে তা মনে করারূপ মিথ্যাজ্ঞানরূপে অবস্থিতা।' বিদ্যা বা জ্ঞানের দ্বারা এই অবিদ্যার নিবৃত্তি হয়। আচার্য বিদ্যারণ্য স্বামী 'পঞ্চদশী' চিত্রদীপে তাই বলেছেন"সংসারঃ পরমার্থোহয়ং সংলগ্নঃ স্বাত্মবস্তুনি। ইতি ভ্রান্তিরবিদ্যা স্যাদ্বিদ্যয়ৈষা নিবর্ততে", অর্থাৎ "এই সংসার পরমার্থতঃ আত্মায় যুক্ত, এরূপ যে ভ্রান্তি, তাই অবিদ্যা। বিদ্যা বা জ্ঞানের দ্বারা এই অবিদ্যার নিবৃত্তি হয়।"

ভগবান্ ভাষ্যকার শঙ্করাচার্য ব্রহ্মসূত্রের অধ্যাসভাষ্যে একই সুরে বলেছেন"অধ্যাসং পণ্ডিতাঃ অবিদ্যা ইতি মন্যন্তে" অর্থাৎ এই অধ্যাসকে (—ভ্রমকে) পণ্ডিতগণ মূলাবিদ্যার কার্য হওয়ায় অবিদ্যা বলে মনে করেন।" এই মূলাবিদ্যা কি? 'পঞ্চদশী' চিত্রদীপে আচার্য বিদ্যারণ্য স্বামী তা স্পষ্ট করেছেন—"অয়ং জীবো কূটস্থং বিবিনক্তি কদাচন। অনাদিরবিবেকোহয়ং মূলাবিদ্যেতি গম্যতাম্", অর্থাৎ "এই জীব কখনই কূটস্থকে বিবেকদ্বারা আপনা হতে পৃথক করে বুঝতে পারে না। এই যে অনাদি অবিবেক, ইহাকে মূল-অবিদ্যা বলে বুঝতে হবে।"

সুতরাং অবিদ্যা হতে উৎপন্ন এই জগৎ অনাদি হলেও প্রাগভাবের ন্যায় নাশশীল, নিত্য নয়; এটা স্পষ্ট উপলব্ধ হয়। প্রাগভাব (প্রাক্+অভাব) অর্থাৎ কোন বস্তু কোন সময়ে উৎপন্ন হয়েছে বললে এটাও বোঝায় যে সেই বস্তু সেই সময়ের প্রাক্ (পূর্বে) বর্তমান ছিল না; তখন তার 'অভাব' ছিল। এই অভাব অনাদি। কিন্তু সেই বস্তুর উৎপত্তির সঙ্গে ওটার সেই 'প্রাগভাব'টি নষ্ট হয়ে যায়। এই প্রকার অবিদ্যা অনাদি হলেও জ্ঞান উৎপত্তির সঙ্গে সঙ্গে এর বিনাশ হয়। তাই অবিদ্যা প্রাগভাবের ন্যায় অনিত্য।....

তথ্যসূত্রঃ-

. ভগবান্ শঙ্করাচার্যের শারীরক-মীমাংসা ভাষ্য "বিবেকচূড়ামণি"

. আচার্য বিদ্যারণ্য স্বামীর "পঞ্চদশী"

. "বেদান্তদর্শন-অদ্বৈতবাদ", কাব্য-ব্যাকরণ-সাংখ্য-বেদান্ততীর্থ আশুতোষ শাস্ত্রী বিদ্যাবাচস্পতি।

শ্রীশুভ চৌধুরী

সেপ্টেম্বর , ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ।


No comments:

তুরীয় ব্রহ্মের স্বরূপঃ-

  মাণ্ডুক্য উপনিষদে তুরীয় ব্রহ্মতত্ত্বের উপদেশ রয়েছে। ঐ দুর্জ্ঞেয় তুরীয় তত্ত্ব বুঝানোর জন্য ওঁকার বা প্রণবকে ব্রহ্মের প্...