পঞ্চপাদিকা বিবরণে আচার্য প্রকাশাত্মযতি বলছেন— মায়া ও অবিদ্যা ভিন্ন তত্ত্ব নয়। মায়া অবিদ্যারই নামান্তর। ভাষ্যকার ভগবান্ শঙ্করাচার্য ব্রহ্মসূত্র ১.৪.১ ভাষ্যে মায়া শক্তিকে "অবিদ্যাত্মিকা" বলে মায়া ও অবিদ্যার অভেদই উপপাদন করেছেন। মায়া ও অবিদ্যা বস্তুতঃ এক হলেও ব্যবহারে দেখা যায় যে, ব্রহ্মের তিরস্করণী (আবরণশক্তি প্রধানা) মায়াকে অবিদ্যা, আর বিশ্ব-জননী (বিক্ষেপশক্তিপ্রধানা) মায়াকে মায়া বলা হয়ে থাকে। অব্যক্ত নামক পরমেশ্বরের শক্তিই অনাদি অবিদ্যা। ভগবান্ শঙ্করাচার্য বিবেকচূড়ামণি গ্রন্থে বলেছেন—"অব্যক্তনাম্নী পরমেশশক্তিরনাদ্যবিদ্যা ত্রিগুণাত্মিকা পরা" অর্থাৎ "অব্যক্ত নামক পরমেশ্বরের শক্তিই অনাদি অবিদ্যা। ইহা সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ এই ত্রিগুণাত্মিকা এবং পরা অর্থাৎ কারণরূপা।" সদানন্দযোগীন্দ্র সরস্বতী বেদান্তসারে এই বিষয়ে শ্রুতি প্রমাণ দিচ্ছেন—"দেবাত্মশক্তিং স্বগুণৈঃ নিগূঢ়াম্"-(শ্বেতাশ্বতর উপনিষৎ-১/৩)
অবিদ্যার
লক্ষণ কি? এই প্রশ্নের উত্তরে চিৎসুখাচার্য বলেন—
'অনাদি
ভাবরূপং যদবিজ্ঞানেন বিলীয়তে।
তদজ্ঞানমিতি প্রজ্ঞা লক্ষণং সংপ্রচক্ষতে।।' -(চিৎসুখী,
১ম পরিচ্ছেদ)
"যা
অনাদি, ভাবস্বরূপ এবং তত্ত্বজ্ঞানের উদয়ে বিলয় প্রাপ্ত হয়, অজ্ঞানের তাই লক্ষণ বলে
পণ্ডিতগণ ব্যাখ্যা করে থাকেন।"
আচার্য
মধুসূদন সরস্বতী তাঁর অদ্বৈতসিদ্ধিতে অবিদ্যার লক্ষণ নিরূপণ করতে গিয়ে, উল্লেখিত চিৎসুখের
লক্ষণের প্রতিধ্বনি করে বলেন—"অনাদিভাবত্বে সতি জ্ঞাননিবর্ত্যাসেতি"-(অদ্বৈতসিদ্ধি,
অজ্ঞানলক্ষণ নিরুক্তি) অর্থাৎ "যা অনাদি ভাবরূপ এবং জ্ঞানবিনাশ্য তাকেই অবিদ্যা
বলে জানবে।"
সুরেশ্বরাচার্য
নৈষ্কর্ম্যসিদ্ধিতে বলেছেন—"ঐকত্ম্যাপ্রতিপত্তির্যা স্বাত্মানুভবসংশ্রয়া। সাহবিদ্যা
সংসৃতের্বীজং তন্নাশো মুক্তিরাত্মনঃ" অর্থাৎ স্বাত্মানুভবসংশ্রয়া সংসারবীজরূপ
যে একাত্মতার অপ্রতিপত্তি (অজ্ঞান) তাই অবিদ্যা। তার নাশই আত্মার মুক্তি।
অবিদ্যা
ভ্রান্তিস্বরূপা। সপ্তশতী চণ্ডীর দেব্যাদূতসংবাদ নামক পঞ্চম অধ্যায়ে বর্ণিত আছে—
"যা দেবী সর্বভূতেষু ভ্রান্তিরূপেণ সংস্থিতা।" অর্থাৎ 'যে দেবী সর্বপ্রাণীতে
ভ্রান্তিরূপে অর্থাৎ যাহা যাহা নয়, তাহাকে তাহা মনে করারূপ মিথ্যাজ্ঞানরূপে অবস্থিতা।'
বিদ্যা বা জ্ঞানের দ্বারা এই অবিদ্যার নিবৃত্তি হয়। আচার্য বিদ্যারণ্য স্বামী 'পঞ্চদশী'র
চিত্রদীপে তাই বলেছেন—"সংসারঃ পরমার্থোহয়ং সংলগ্নঃ স্বাত্মবস্তুনি। ইতি ভ্রান্তিরবিদ্যা
স্যাদ্বিদ্যয়ৈষা নিবর্ততে", অর্থাৎ "এই সংসার পরমার্থতঃ আত্মায় যুক্ত,
এরূপ যে ভ্রান্তি, তাই অবিদ্যা। বিদ্যা বা জ্ঞানের দ্বারা এই অবিদ্যার নিবৃত্তি হয়।"
ভগবান্
ভাষ্যকার শঙ্করাচার্য ব্রহ্মসূত্রের অধ্যাসভাষ্যে একই সুরে বলেছেন—"অধ্যাসং পণ্ডিতাঃ
অবিদ্যা ইতি মন্যন্তে" অর্থাৎ এই অধ্যাসকে (—ভ্রমকে) পণ্ডিতগণ মূলাবিদ্যার কার্য
হওয়ায় অবিদ্যা বলে মনে করেন।" এই মূলাবিদ্যা কি? 'পঞ্চদশী'র চিত্রদীপে আচার্য
বিদ্যারণ্য তা স্পষ্ট করেছেন—"অয়ং জীবো ন কূটস্থং বিবিনক্তি কদাচন। অনাদিরবিবেকোহয়ং
মূলাবিদ্যেতি গম্যতাম্", অর্থাৎ "এই জীব কখনই কূটস্থকে বিবেকদ্বারা আপনা
হতে পৃথক করে বুঝতে পারে না। এই যে অনাদি অবিবেক, ইহাকে মূল-অবিদ্যা বলে বুঝতে হবে।"
অদ্বৈতবেদান্তে
অবিদ্যাকে 'অনির্বাচ্য' বলেও ব্যাখ্যা করা হয়েছে। অনির্বাচ্য অবিদ্যার রহস্য এই যে,
অবিদ্যা সৎও নয়, অসৎও নয়, সদসৎও নয়; ভাবও
নয়, অভাবও নয়, ভাবাভাবও নয়, এরূপেই আচার্য মধুসূদন সরস্বতী তাঁর অদ্বৈতসিদ্ধিতে
অনির্বাচ্য অবিদ্যার লক্ষণ নিরূপণ করার চেষ্টা করেছেন। যথা—"অবিদ্যা ভাবাভাববিলক্ষণং
যৎকিঞ্চিদ্বস্তু সত্ত্বরহিতত্বে সতি সদসত্ত্বরহিতত্বম"- (অদ্বৈতসিদ্ধি, অনির্বাচ্যত্বলক্ষণোপপত্তিঃ).....
No comments:
Post a Comment