এই বিষয়ে আজকে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার গুণত্রয়বিভাগযোগের শঙ্করাচার্যের ভাষ্যানুসারে বিস্তৃত আলোচনা করব। ত্রিগুণ কি? "সত্ত্বং রজঃ তমঃ ইতি এবংনামানঃ", অর্থাৎ সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ— এই নামের তিনটি গুণ। এখানে 'গুণ' শব্দটি পারিভাষিক; এটা নৈয়ায়িকদের রূপরসাদির ন্যায় দ্রব্যাশ্রিত কিন্তু দ্রব্য হতে ভিন্ন কোন পদার্থ নয়। অথবা এখানে ভেদাভেদবাদি-বেদান্তসম্মত গুণগুণী পদার্থদ্বয়ের প্রথমটিও বিবক্ষিত নয়। এটা হলো অনির্বাচ্য ভগবান্মায়া সম্ভবারূপ পদার্থ।
এখন
প্রশ্ন ত্রিগুণ কি হতে জাত?
শ্রীভগবান্
বলছেন—"প্রকৃতিসংভবাঃ" এই শ্লোকের ভাষ্যে ভাষ্যকার
শঙ্করাচার্য বলেন—"ভগবন্মায়াসংভবাঃ", প্রকৃতি-সম্ভব অর্থাৎ
ভগবান্মায়া হতে জাত। প্রকৃতিজাত সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ - অনাদিত্ব ও নির্গুণত্বহেতু অব্যয়
আত্মাকে এই গুণত্রয় দেহাভিমান দ্বারা শরীরে আবদ্ধ করে। এরা অবিদ্যাত্মক বলে ক্ষেত্রজ্ঞকে
যেন বন্ধনও করে। পরমার্থতঃ দেহী লিপ্ত হন না, 'যেন' শব্দের অধ্যাহার কোরে সেই 'যেন'
শব্দের দ্বারা 'দেহী যেন নিবদ্ধ হন', এইরূপ অর্থ।
এই গুণত্রয়ের মধ্যে সত্ত্বগুণ স্ফটিকমণির ন্যায় নির্মল,
স্বচ্ছ চৈতন্যপ্রতিবিম্বগ্রহণে সমর্থ বলে নিরুপদ্রব ও প্রকাশক। এই সত্ত্বগুণ 'আমি সুখি'
এইরূপ সুখাসক্তি এবং 'আমি জ্ঞানী' এইরূপ জ্ঞানাসক্তি দ্বারা আত্মাকে যেন আবদ্ধ করে।
রজোগুণ রাগাত্মক। ইহা অপ্রাপ্তের অভিলাষ ও প্রাপ্তবিষয়ে মনের প্রীতির উৎপাদক বলে জানবে।
দৃষ্ট ও অদৃষ্ট ফলের নিমিত্ত কর্মে আসক্তি দ্বারা ইহা আত্মাকে যেন আবদ্ধ করে, অর্থাৎ
যেন 'আমি করি' - এই অভিমান দ্বারা কর্মে প্রবর্তিত করে। তমোগুণ আবরণশক্তিপ্রধান প্রকৃতির
অংশ হতে উৎপন্ন এবং দেহধারিগণের মোহজনক (হিতাহিত-বিবেকের প্রতিবন্ধক) জানবে। উহা প্রমাদ,
আলস্য ও নিদ্রা দ্বারা আত্মাকে দেহে যেন বদ্ধ করে।
পুনরায়
গুণসকলের ব্যাপার সংক্ষেপে আলোচনা করব। সত্ত্বগুণ সাধ্য বিষয়ে ও রজোগুণ সাধ্য কর্মে
জীবকে আবদ্ধ করে এবং তমোগুণ সত্ত্বকৃত বিবেককে আবৃত করে জীবকে প্রমাদ ও আলস্য প্রভৃতিতে
নিমজ্জিত করে।
গুণসকল
পূর্বোক্ত কার্যসকল কখন করে থাকে?
তদুত্তরে ভগবান বলছেন—"সত্ত্বগুণ
রজঃ ও তমোগুণকে অভিভূত করে প্রবল হয়। রজোগুণ সত্ত্ব ও তমোগুণকে অভিভূত করে প্রবল হয়।
আর তমোগুণ সত্ত্ব ও রজোগুণকে অভিভূত করে প্রবল হয়।"
যখন
যে গুণ উদ্ভূত হয়, তখন তার কি চিহ্ন হয় তাই বলা হচ্ছে—
"যখন
এই ভোগায়তন দেহের সমস্ত ইন্দ্রিয়দ্বার বুদ্ধিবৃত্তির প্রকাশ দ্বারা উদ্ভাসিত হয়, তখন
জানবে যে সত্ত্বগুণ বর্ধিত হচ্ছে। লোভ, কর্মে প্রবৃত্তি ও প্রচেষ্টা, হর্ষ ও অনুরাগাদির
অনিবৃত্তি এবং বিষয়ভোগের স্পৃহা - এই সকল রজোগুণের বৃদ্ধিকালে উৎপন্ন হয়। কর্তব্যাকর্তব্য
বিবেকের অভাব, অনুদ্যম, কর্তব্যে অবহেলা ও মূঢ়তা প্রভৃতি লক্ষণ তমোগুণ বৃদ্ধি পেলে
জন্মে।"
মরণকালের
সত্ত্বাদি অবস্থার দ্বারা যে ফল জীব প্রাপ্ত হয়, সে সবের হেতু আসক্তি ও বিষয়রাগ,
সেজন্য তা ত্রিগুণের প্রভাবজন্যই— এটি দেখানোর জন্য ভগবান বলছেন—
"সত্ত্বগুণের
বৃদ্ধিকালে মানুষ দেহত্যাগ করলে হিরণ্যগর্ভাদি উপাসকদিগের সুখময় ব্রহ্মলোকাদিতে গমন
করে। রজোগুণের বৃদ্ধিকালে মৃত্যু হলে কর্মভূমি মনুষ্যলোকে জন্ম হয় এবং তমোগুণের বৃদ্ধিকালে
মৃত্যু হলে পশ্বাদি মূঢ়জন্ম প্রাপ্ত হয়। শিষ্টগণ বলেন - সাত্ত্বিক কর্মের ফল নির্মল
সুখ, রাজসিক কর্মের ফল দুঃখ ও তামসিক কর্মের ফল মূঢ়তা (পশু প্রভৃতি জন্মে দৃশ্যমান
অজ্ঞান)। রজঃ ও তমোগুণকে অভিভূত করবার পর সত্ত্বগুণ হতে সকল ইন্দ্রিয়ের জ্ঞান জন্মে।
সত্ত্ব ও তমোগুণকে অভিভবের পর রজোগুণ হতে লোভপ্রবৃত্তি জাত হয়। আর তমোগুণ সত্ত্ব ও
রজোগুণকে অভিভূত করলে তা হতে অবিবেক, অনবধানতা ও মূঢ়তা উৎপন্ন হয়। সত্ত্বগুণে অবস্থিত
(শাস্ত্রীয় উপাসনা ও কর্মে নিরত) ব্যক্তিগণ দেবলোকাদিতে গমন করেন, রজোগুণী (লোভাদিবশতঃ
কাম্য-নিষিদ্ধাদি কর্মে নিযুক্ত) ব্যক্তিগণ দুঃখবহুল মনুষ্যলোকে জন্মগ্রহণ করেন এবং
জঘন্যগুণবৃত্তিতে (নিদ্রা-আলস্যাদিতে) স্থিত তামসিক ব্যক্তিগণ পশ্বাদি হীন জন্মলাভ
করে।"
আর
গুণাতীত অবস্থায় জীবের অমৃতত্ব প্রাপ্তি হয়, এই বিষয়ে শ্রীভগবান্ বলছেন—
"যখন
জীব কার্য-কারণ-বিষয়াকারে পরিণত ত্রিগুণ ব্যতীত অন্য কাউকেও কর্তা বলে দেখেন না এবং
ত্রিগুণের অতীত ও তাদের কার্যসমূহের সাক্ষী আত্মাকে জ্ঞাত হন, তখন তিনি ব্রহ্মস্বরূপ
অধিগত হন। দেহোৎপত্তির কারণ এই অবিদ্যাময় গুণত্রয় অতিক্রম করলে জীব জন্ম, মৃত্যু ও
জরা-রূপ দুঃখ হতে জীবনকালেই বিমুক্ত হন এবং ব্রহ্মানন্দরূপ অমৃতত্ত্ব লাভ করেন।"
No comments:
Post a Comment