Wednesday, 17 May 2023

অবস্থাত্রয় বিবেকঃ

 


অবস্থাত্রয় ' জাগ্রত, স্বপ্ন সুষুপ্তি। আত্মা এই অবস্থাত্রয়ের সাক্ষী। জীব এই তিন অবস্থায় বিচরণ করে। এই তিন অবস্থায় জ্ঞাতা, দ্রষ্টা আত্মা। যখন স্থূল ইন্দ্রিয়সহায়ে বিষয় উপলব্ধি হয় সেই অবস্থাকে জাগ্রত অবস্থা বলা হয়। যখন আমরা নিদ্রা যাই, তখন সেখানে বাহ্য ইন্দ্রিয়সমূহ অকেজো হয়ে থাকে। তারা তখন নিশ্চেষ্ট অবস্থায় অবস্থান করে। তথাপি সময়ে আমরা স্বপ্নে বহুবিধ দৃশ্য দেখি, বহু বিষয়ের সমাগমে ব্যবহারও করি। রাজা হই, ফকির হই তত্তৎ ব্যবহারাদিও করি। গুলির সৃজন বস্তুতঃপক্ষে জাগরণকালীন দৃষ্ট, অনুভূত বিষয়সমূহের সংস্কার থেকে হয়ে থাকে। সুতরাং জাগ্রত অবস্থার সংস্কারজনিত সমানবিষয়ক প্রত্যয় অর্থাৎ জ্ঞানই স্বপ্নাবস্থা। কিন্তু যখন আমরা গভীর নিদ্রাভিভূত থাকি তখন কোন বিষয় থাকে না, কোন দৃশ্য থাকে না। যেখানে সকল বিষয়ের অভাব সেই অবস্থাটি সুষুপ্তি অবস্থা।

মাণ্ডুক্য উপনিষদে বর্ণিত এই জাগ্রতকালীন স্থূলশরীরাভিমানী চৈতন্য ' বিশ্ব। স্বপ্নকালীন সূক্ষ্মশরীরাভিমানী চৈতন্যকে তৈজস বলে। সুষুপ্তিকালীন কারণ শরীরাভিমানী চৈতন্য ' প্রাজ্ঞ। এইরূপে একই স্বপ্রকাশ চৈতন্যস্বরূপ আত্মা উপাধির ভেদ বশতঃ বিশ্ব, তৈজস প্রাজ্ঞ এই তিন রূপে অবস্থিত আছেন।

আত্মা অবস্থাত্রয়ের সাক্ষী কি প্রকারে? জাগ্রদাদি অবস্থাত্রয় অতীতে ছিল, বর্তমানে রয়েছে ভবিষ্যতে থাকবে। এইরূপ এই বিকারি অবস্থাত্রয়ের থেকে ভিন্ন অবিকারী সত্ত্বারূপে আত্মাকে জানা যায়। ভগবান্ শঙ্করাচার্য মাণ্ডুক্যকারিকার ভাষ্যে স্পষ্ট বলছেনচৈতন্য যেরূপ আত্মার স্বভাব সিদ্ধ, জাগ্রদাদি অবস্থাত্রয় সেরূপ আত্মার স্বভাব নয়; কারণ, স্বভাবের কখনও ব্যভিচার হয় না; কিন্তু পূর্বোক্ত অবস্থাত্রয়ের ব্যভিচার দৃষ্ট হয়; সেহেতু স্বপ্রকাশ চৈতন্যস্বরূপ আত্মা পূর্বোক্ত অবস্থাত্রয় হতে বিলক্ষণ। পর্যায়ক্রমে জাগ্রৎ স্বপ্ন সুষুপ্তির সহিত আত্মার সম্বন্ধ হওয়ায় এবং "যে আমি এখন জেগে আছি, সে আমিই স্বপ্নে দেখেছি এবং সে আমিই সুপ্ত ছিলাম"—এরূপ আত্মানুসন্ধান হেতু এবং ধর্মাধর্ম, রাগদ্বেষাদি অবস্থাত্রয়ের ধর্ম বলে এবং শ্রুতিতে উদাহৃত তিমি প্রভৃতি মহামৎস্য জলাশয়ের উভয় কূলে পর্যায়ক্রমে বিচরণ করলেও, উভয় কূল হতে স্বতন্ত্র এবং উভয় কূলের দোষগুণে লিপ্ত হয় না, এই দৃষ্টান্ত অনুসারে আত্মা জাগ্রৎ স্বপ্ন সুষুপ্তি এই অবস্থাত্রয়ে অবস্থান করলেও, অবস্থাত্রয় হতে স্বতন্ত্র, এক, শুদ্ধ অসঙ্গ। সুতরাং অবস্থাত্রয় হতে আত্মার স্বতন্ত্রতা, একত্ব, শুদ্ধত্ব অসঙ্গত্ব সিদ্ধ হল।.....

তথ্যসূত্রঃ-

. ভগবান্ শঙ্করাচার্যের মাণ্ডুক্যকারিকা ভাষ্য।

. ভগবান শঙ্করাচার্যের আত্মানাত্মবিবেকঃ।

শ্রীশুভ চৌধুরী

মে ১২, ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ।

মনোনিগ্রহের উপায়ঃ-

 


মনই সংসারের মূল। ভগবান্ বশিষ্ঠদেব বলেছেন—"সর্ব উপদ্রবদায়ী এই সংসারবৃক্ষের নিগ্রহের একটিই উপায় আছে, তা হলো নিজের মনের নিগ্রহ।" মনোনাশেই দুঃখনিবৃত্তি অক্ষয়শান্তি। মনোনিগ্রহ বা চিত্তজয়ের চারটি উপায় লঘুযোগবাশিষ্ঠের উপশম প্রকরণে বর্ণিত হয়েছে

"অধ্যাত্মবিদ্যাধিগমঃ সাধুসংগম্ এব চ।।

বাসনাসম্পরিত্যাগঃ প্রাণস্পন্দনিরোধনম্।

এতাস্তু যুক্তয়ঃ পুষ্টাঃ সন্তি চিত্তজয়ে কিল।।

-(লঘুযোগবাশিষ্ঠ, উপশমপ্রকরণ,২৮/১২৮,১২৯)

অধ্যাত্মবিদ্যার অর্জন, সাধুসঙ্গ, বাসনার সম্যগ্রূপে ত্যাগ প্রাণসংযমএই চারটি যুক্তি চিত্তজয়ে নিশ্চিত পুষ্ট হয়, অর্থাৎ সফল হয়।

আচার্য বিদ্যারণ্য স্বামী জীবন্মুক্তিবিবেকে এই উপায়গুলোর সাবলীল ব্যাখ্যা করেছেন। অধ্যাত্মবিদ্যা ' দৃগ্-দৃশ্য-বিবেক। সেই অধ্যাত্মবিদ্যাও দৃশ্যের মিথ্যাত্ব দ্রষ্টার স্বয়ং প্রকাশস্বরূপতা জানায়। এরূপ হলে এই মন নিজ গোচরীভূত দৃশ্যসমূহে প্রয়োজনের অভাব এবং প্রয়োজনের বস্তু দ্রষ্টাকে মনের অগোচর জেনে ইন্ধনবিহীন অগ্নির মতো নিজেই শান্ত হয়ে যায়। সেরূপ শ্রুতিতেও বলা হয়েছে—"যেরূপ ইন্ধনবিহীন অগ্নি নিজকারণে উপশান্ত হয়, সেরূপ বৃত্তি ক্ষয় হওয়ায় চিত্তও নিজকারণে উপশান্ত হয়।"-(মৈত্রায়ণি উপনিষৎ-/)

কিন্তু যে বুঝিয়ে দিলেও আত্মতত্ত্বকে যথাযথ বোঝে না এবং যে ভুলে যায়, তাদের উভয়ের সাধুসঙ্গই উপায়। যেহেতু সাধুরা বারংবার জানিয়ে দেন এবং স্মরণ করিয়ে দেন। কিন্তু যে বিদ্যার অহঙ্কার প্রভৃতি দুর্বাসনা দ্বারা পীড়িত হয়ে সাধুদের অনুসরণ করতে উৎসাহী হয় না, তার পূর্বোক্ত বিবেক অভ্যাস দ্বারা বাসনাত্যাগই উপায়। বাসনাসমূহের প্রাবল্যবশত ত্যাগ করতে অসমর্থ হলে, প্রাণস্পন্দনের নিরোধই উপায়। প্রাণস্পন্দন বাসনা চিত্তের প্রেরক হওয়ায় তাদের নিরোধ করলে চিত্তের শান্তি উপপন্ন হয়।......

শ্রীশুভ চৌধুরী

মে ১৬, ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ।

Sunday, 7 May 2023

পঞ্চকোশবিবেক—

 


বেদান্তে কোশ অর্থে আবরণ বা আধারকে বুঝায়। তরবারির কোশ অর্থাৎ খাপের মধ্যে যেমন তরবারিটি থাকে, সেরকম অন্নময় প্রভৃতি পাঁচটি কোশের অন্তরালে নিত্যশুদ্ধ আত্মা বিরাজমান থাকে। জল হতে উৎপন্ন শেওলা প্রভৃতির দ্বারা আবৃত হয়ে পুষ্করিণীস্থিত জল যেমন দৃষ্টিগোচর হয় না, সেই প্রকারে আত্মার অবিদ্যাশক্তি হতে উৎপন্ন অন্নময়াদি পঞ্চকোশের দ্বারা আবৃত হয়ে আত্মা প্রকাশ পায় না। যখন বিবেক-বিচারের দ্বারা পাঁচটি কোশের কোনটিই আত্মা নয়, এই প্রকার দৃঢ় নিশ্চয় জন্মে, তখন শুদ্ধ, সদানন্দময়, প্রত্যেকের অন্তরে সাক্ষিরূপে স্থিত, শ্রেষ্ঠ, প্রকাশস্বভাব আত্মা স্বতঃই প্রকাশ পান। তৈত্তিরীয় উপনিষদের দ্বিতীয় বল্লীতে পঞ্চকোশের বর্ণনা স্পষ্টরূপে দ্রষ্টব্য। "গুহাহিত"-(তৈত্তিরীয় উপনিষৎ -.) অর্থাৎ গুহায় অবস্থিত বলে যে ব্রহ্ম বর্ণিত হয়েছে, 'গুহা' শব্দবাচ্য অন্নময়াদি পঞ্চকোশের বিচার দ্বারা সেই ব্রহ্মকে জানতে পারা যায়।

অন্নময় কোশঃ-

"অন্নাৎপুরুষঃ"-(তৈত্তিরীয় উপনিষৎ-.) অর্থাৎ রেতোরূপে পরিণত অন্ন হতে শিরঃ হস্তাদি আকৃতিবিশিষ্ট দেহ উৎপন্ন হল। সেই প্রসিদ্ধ দেহ অন্নরসময়অন্নরসের বিকার। মাতাপিতার ভুক্ত অন্নাদির পরিণাম হতে উৎপন্ন এই দেহ অন্নময় কোশ বলে অভিহিত হয়। এটা অন্নের দ্বারা জীবিত থাকে, অন্ন না পেলে মরে যায়।

ত্বক-চর্ম-মাংস-রক্ত-অস্থি-বিষ্ঠার সমষ্টি এই অন্নময় কোশ কখনও নিত্যশুদ্ধ আত্মা হতে পারে না। দেহ আত্মা নয় কেন?

 এই দেহ জন্মের আগে বা মৃত্যুর পরেও বর্তমান থাকে না। এটা জন্ম-মৃত্যুর মধ্যকালে অল্প সময়ের জন্য আবির্ভূত হয় এবং অল্পকালের জন্যই রমণীয়ভাবে প্রকাশ পায়। এটা যতদিন বর্তমান থাকে ততদিন একরূপও থাকে না (অঙ্গপ্রত্যঙ্গাদির হ্রাস-বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন পরিণতিলাভ করে); এটা ঘটাদির মতো দৃশ্য পদার্থ (ঘট যেমন মৃত্তিকার পরিণামমাত্র এবং ক্ষণস্থায়ী, দেহও তেমন ভূতসমূহের পরিণাম) এবং জড় (চৈতন্যরহিত) এই প্রকারের দেহ কিভাবে দেহ মনের সকলপরিণামের জ্ঞাতা স্বীয় আত্মা হতে পারে? (অর্থাৎ জড়দেহ কখনই চৈতন্যস্বরূপ আত্মা নয়; আত্মা দেহ হইতে সর্বতোভাবে ভিন্ন) দেহ আত্মা নয় কেন? উৎপন্ন হয়, বিনাশ পায়, অল্পসময়মাত্র বর্তমান থাকে, বিভিন্ন পরিণামপ্রাপ্ত হয়, বিকারগ্রস্ত হয়, দৃষ্ট হয় এবং জড়স্বভাব বলে দেহ আত্মা হতে পারে না।

প্রাণময় কোশঃ-

পঞ্চকর্মেন্দ্রিয়ের সহিত সংযুক্ত হয়ে প্রাণই প্রাণময় কোশরূপে পরিণত হয়। এই প্রাণময় কোশের দ্বারা ব্যাপ্ত হয়ে জড় অন্নময়কোশ চেতনের ন্যায় সকল কর্মে প্রবৃত্ত হয়। শ্রুতি বলছেন"তস্মাদ্বা এতস্মাদন্নরসময়াৎ। অন্যোহন্তর আত্মা প্রাণময়ঃ। তেনৈষ পূর্ণঃ।"-(তৈত্তিরীয় উপনিষৎ-.) অর্থাৎ এই অন্নরসময় দেহপিণ্ড হতে পৃথক অথচ তারই অভ্যন্তরে প্রাণের পরিণামভূত এবং আত্মারূপে কল্পিত প্রাণময় কোশ আছে। সেই প্রাণময় কোশের দ্বারা অন্নময় কোশ পরিপূর্ণ।

প্রাণময় কোশ অপঞ্চীকৃত বায়ুর বিকার বলে আত্মা নয়। যেহেতু এটা বায়ুর ন্যায় ভিতরে বাইরে যাতায়াত করে, কোন কালে কিছুমাত্র ভাল-মন্দ বুঝতে পারে না, 'কে আপন কে বা পর' নির্ণয় করতে পারে না এবং যেহেতু এটা পরাধীন (অর্থাৎ মনের অধীন), সেহেতু এটা আত্মা হতে পারে না।

মনোময় কোশঃ-

পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয় এবং মন একত্র মনোময়-কোশ বলে অভিহিত হয়। 'আমি' 'আমার' ইত্যাদি প্রকারের নানাবিধ বস্তুকল্পনার কারণ এবং নামরূপ-ক্রিয়াদি বিবিধ ভেদের সহিত বর্তমান এবং বলবান্ এই মনোময় কোশ তৎপুর্ববর্তী প্রাণময়-কোশকে ব্যাপিয়া প্রকাশ পায়।

দেহের চেষ্টাসমূহ প্রাণের অধীন বলে দেহ অপেক্ষা প্রাণ বলবান্। আবার প্রাণের ক্রিয়াসমূহ মনের সংকল্পের উপর নির্ভর করে বলে মনোময় কোশ বলিষ্ঠ। বিষয়ে শ্রুতি প্রমাণ"তস্মাদ্ বা এতস্মাৎ প্রাণময়াৎ অন্যোহন্তরঃ আত্মা মনোময়ঃ। তেনৈষ পূর্ণঃ।'-(তৈত্তিরীয় উপনিষৎ -.) অর্থাৎ উক্ত প্রাণময় হতে ব্যতিরিক্ত অথচ তদভ্যন্তরে মনোময় কোশ আছে। সেই মনোময়ের দ্বারা প্রাণময় পূর্ণ।

মনোময় কোশ যেহেতু উৎপত্তি বিনাশশীল, পরিণামী, দুঃখময় এবং জ্ঞানের বিষয়, সেহেতু এটা কিছুতেই পরমাত্মা হতে পারে না। দ্রষ্টা কখনোই দৃশ্য বস্তুরূপে কারও জ্ঞানের বিষয় হন না। 'অন্নমশিতং ত্রেধা বিধীয়তে; তস্য যঃ স্থবিষ্ঠো ধাতুস্তৎ পুরীষং ভবতি, যো মধ্যমস্তন্মাংসং, যোহণিষ্ঠস্তন্মনঃ'-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-..)—ভুক্ত অন্ন ত্রিবিধ আকারে পরিণত হয়। ওটার স্থূলতম অংশ মলে, মধ্যমাংশ মাংসে এবং সূক্ষ্মতম অংশ মনে পরিণত হয়। 'অস্য পুরুষস্য প্রয়তো বাঙ্মনসি সম্পদ্যতে মনঃ প্রাণে প্রাণস্তেজসি তেজঃ পরস্যাং দেবতায়াম্।'--(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-..) অর্থাৎ এই পুরুষ যখন মুমূর্ষু হয় তখন তার বাক্ মনে, মন প্রাণে, প্রাণ তেজে এবং তেজ পরম দেবতায় উপসংহৃত হয়। এই দুই শ্রুতিবাক্য দ্বারা মনোময় কোশ যে উৎপত্তি বিনাশশীল তা বলা হল।

বিজ্ঞানময় কোশঃ-

বুদ্ধি যখন পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়ের সহিত যুক্ত, অহংকারাদি বৃত্তির এবং 'আমি কর্তা' এই অনুভবের সহিত বর্তমান থাকে, তখন তা বিজ্ঞানময়-কোশ নামে অভিহিত হয়। এই বিজ্ঞানময়-কোশই জীবের সংসার-বন্ধনের কারণ। প্রসিদ্ধ মনোময় হতে ভিন্ন তদভ্যন্তরস্থ হচ্ছে বিজ্ঞানময় শরীর। সেই বিজ্ঞানময়ের দ্বারা এই মনোময় পরিপূর্ণ। "তস্মাদ্ বা এতস্মাৎ প্রাণময়াৎ অন্যোহন্তরঃ আত্মা বিজ্ঞানময়ঃ। তেনৈষ পূর্ণঃ।'-(তৈত্তিরীয় উপনিষৎ -.)

চিৎ-শক্তির প্রতিবিম্বের সহিত বর্তমান, প্রকৃতির বিকার, জ্ঞান ক্রিয়াশক্তিসম্পন্ন বিজ্ঞানময় কোশ স্বভাবতঃ জড় হলেও চৈতন্য-প্রতিবিম্বিত হওয়ার জন্য সর্বদা সম্পূর্ণরূপে দেহ ইন্দ্রিয়সমূহ 'আমি' এরূপ জ্ঞান করে থাকে। অহংবোধের আশ্রয়, উৎপত্তিরহিত, বিজ্ঞানময়-কোশরূপ এই জীব লৌকিক বৈদিক সকল কর্মের অনুষ্ঠান করে থাকে। সে বিষয়ে শ্রুতিই প্রমাণ। 'বিজ্ঞানং যজ্ঞং তনুতে কর্মাণি তনুতেহপি চ।'-(তৈত্তিরীয় উপনিষৎ -.) বিজ্ঞানই (নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধি) যজ্ঞ বিস্তৃত করে এবং কর্মসমূহের অনুষ্ঠাতা। বিজ্ঞানময়-কোশরূপী এই জীব নানা যোনিতে জন্মগ্রহণ করে কখনও ঊর্ধ্বগতি কখনও অধোগতি প্রাপ্ত হয়। জাগ্রতস্বপ্নাদি অবস্থার অনুভব এবং সুখ-দুঃখাদিরও অনুভব এই বিজ্ঞানময় জীবেরই হয়ে থাকে। শুদ্ধ আত্মা নির্বিকার। তার জন্মমরণ, সুখদুঃখ-ভোগ বা জাগ্রৎ-স্বপ্নাদি অবস্থার অনুভবএসব কিছুই হয় না। সুতরাং বিজ্ঞানময়-কোশ চিদাত্মা হতে পারে না। এই বিজ্ঞানময়-কোশ বিকারশীল। ইহা জড়, দেশকালের দ্বারা সীমাবদ্ধ, দৃশ্যবস্তু এবং ব্যাভিচারী।

আনন্দময় কোশঃ-

বাঞ্ছিত বস্তুর লাভে প্রকাশপ্রাপ্ত, প্রিয়-মোদ-প্রমোদরূপে পরিণত, স্থিরীভূত এবং অন্তর্মুখ-তমোবৃত্তি আনন্দস্বরূপ আত্মার দ্বারা প্রতিবিম্বিত হয়ে আনন্দময়-কোশরূপে পরিণত হয়। সৌভাগ্যশালী ব্যক্তিগণের পুণ্যকর্মের অনুভবের সময় এই আনন্দময় কোশ স্বতঃ প্রকাশ পায়। দেহধারী জীবমাত্র বিনা চেষ্টায় এই আনন্দময়-কোশে সুখানুভব করে। 

'প্রিয়াদিগুণকঃ'-(তৈত্তিরীয় উপনিষৎ-.) প্রিয়, মোদ প্রমোদআনন্দসম্ভোগের এই ত্রিবিধ প্রকার আনন্দময়-কোশের গুণ।

তমোগুণরূপ উপাধিযুক্ত বলে, প্রকৃতির পরিণাম বলে, পূর্বকৃত পূর্ণ্যকর্মসমূহের ফলে উৎপন্ন বলে এবং অন্নময়াদি বিকারসমূহের মধ্যে বর্তমান বলে এই আনন্দময় কোশও পরমাত্মা হতে পারে না। যুক্তির দ্বারা এবং শ্রুতিপ্রমাণের সহায়ে অন্নময়াদি পঞ্চকোশ আত্মা নয়, এটা প্রমাণিত হলে মিথ্যা বলে প্রমাণিত এই কোশসমূহ যাঁর আশ্রয়ে প্রকাশিত হয়, সেই স্বয়ংপ্রকাশ চৈতন্যস্বরূপ আত্মা অবশিষ্ট থাকেন। 'পঞ্চকোশ পরিত্যাগে সাক্ষিবোধ-অবশেষতঃ স্বস্বরূপং এব' অর্থাৎ পঞ্চকোশের পরিত্যাগ করলে যে সাক্ষিরূপ বোধ অবশিষ্ট থাকে, তাই স্বস্বরূপ।.........

তথ্যসূত্র-

. ভগবান্ শঙ্করাচার্যের 'বিবেকচূড়ামণি'

. আচার্য বিদ্যারণ্য স্বামীর 'পঞ্চদশী'

. তৈত্তিরীয় উপনিষৎ।

 

শ্রীশুভ চৌধুরী

ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ।

আত্মানাত্মবিবেকঃ-

  আত্মা ও অনাত্মা অর্থাৎ আত্মা ভিন্ন দেহের পৃথকত্বের বিবেকবোধই আত্মানাত্মবিবেক। দেহকেই আমরা ' আমি ' ভাবিয়া থাকি। ...