Sunday, 7 May 2023

পঞ্চকোশবিবেক—

 


বেদান্তে কোশ অর্থে আবরণ বা আধারকে বুঝায়। তরবারির কোশ অর্থাৎ খাপের মধ্যে যেমন তরবারিটি থাকে, সেরকম অন্নময় প্রভৃতি পাঁচটি কোশের অন্তরালে নিত্যশুদ্ধ আত্মা বিরাজমান থাকে। জল হতে উৎপন্ন শেওলা প্রভৃতির দ্বারা আবৃত হয়ে পুষ্করিণীস্থিত জল যেমন দৃষ্টিগোচর হয় না, সেই প্রকারে আত্মার অবিদ্যাশক্তি হতে উৎপন্ন অন্নময়াদি পঞ্চকোশের দ্বারা আবৃত হয়ে আত্মা প্রকাশ পায় না। যখন বিবেক-বিচারের দ্বারা পাঁচটি কোশের কোনটিই আত্মা নয়, এই প্রকার দৃঢ় নিশ্চয় জন্মে, তখন শুদ্ধ, সদানন্দময়, প্রত্যেকের অন্তরে সাক্ষিরূপে স্থিত, শ্রেষ্ঠ, প্রকাশস্বভাব আত্মা স্বতঃই প্রকাশ পান। তৈত্তিরীয় উপনিষদের দ্বিতীয় বল্লীতে পঞ্চকোশের বর্ণনা স্পষ্টরূপে দ্রষ্টব্য। "গুহাহিত"-(তৈত্তিরীয় উপনিষৎ -.) অর্থাৎ গুহায় অবস্থিত বলে যে ব্রহ্ম বর্ণিত হয়েছে, 'গুহা' শব্দবাচ্য অন্নময়াদি পঞ্চকোশের বিচার দ্বারা সেই ব্রহ্মকে জানতে পারা যায়।

অন্নময় কোশঃ-

"অন্নাৎপুরুষঃ"-(তৈত্তিরীয় উপনিষৎ-.) অর্থাৎ রেতোরূপে পরিণত অন্ন হতে শিরঃ হস্তাদি আকৃতিবিশিষ্ট দেহ উৎপন্ন হল। সেই প্রসিদ্ধ দেহ অন্নরসময়অন্নরসের বিকার। মাতাপিতার ভুক্ত অন্নাদির পরিণাম হতে উৎপন্ন এই দেহ অন্নময় কোশ বলে অভিহিত হয়। এটা অন্নের দ্বারা জীবিত থাকে, অন্ন না পেলে মরে যায়।

ত্বক-চর্ম-মাংস-রক্ত-অস্থি-বিষ্ঠার সমষ্টি এই অন্নময় কোশ কখনও নিত্যশুদ্ধ আত্মা হতে পারে না। দেহ আত্মা নয় কেন?

 এই দেহ জন্মের আগে বা মৃত্যুর পরেও বর্তমান থাকে না। এটা জন্ম-মৃত্যুর মধ্যকালে অল্প সময়ের জন্য আবির্ভূত হয় এবং অল্পকালের জন্যই রমণীয়ভাবে প্রকাশ পায়। এটা যতদিন বর্তমান থাকে ততদিন একরূপও থাকে না (অঙ্গপ্রত্যঙ্গাদির হ্রাস-বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন পরিণতিলাভ করে); এটা ঘটাদির মতো দৃশ্য পদার্থ (ঘট যেমন মৃত্তিকার পরিণামমাত্র এবং ক্ষণস্থায়ী, দেহও তেমন ভূতসমূহের পরিণাম) এবং জড় (চৈতন্যরহিত) এই প্রকারের দেহ কিভাবে দেহ মনের সকলপরিণামের জ্ঞাতা স্বীয় আত্মা হতে পারে? (অর্থাৎ জড়দেহ কখনই চৈতন্যস্বরূপ আত্মা নয়; আত্মা দেহ হইতে সর্বতোভাবে ভিন্ন) দেহ আত্মা নয় কেন? উৎপন্ন হয়, বিনাশ পায়, অল্পসময়মাত্র বর্তমান থাকে, বিভিন্ন পরিণামপ্রাপ্ত হয়, বিকারগ্রস্ত হয়, দৃষ্ট হয় এবং জড়স্বভাব বলে দেহ আত্মা হতে পারে না।

প্রাণময় কোশঃ-

পঞ্চকর্মেন্দ্রিয়ের সহিত সংযুক্ত হয়ে প্রাণই প্রাণময় কোশরূপে পরিণত হয়। এই প্রাণময় কোশের দ্বারা ব্যাপ্ত হয়ে জড় অন্নময়কোশ চেতনের ন্যায় সকল কর্মে প্রবৃত্ত হয়। শ্রুতি বলছেন"তস্মাদ্বা এতস্মাদন্নরসময়াৎ। অন্যোহন্তর আত্মা প্রাণময়ঃ। তেনৈষ পূর্ণঃ।"-(তৈত্তিরীয় উপনিষৎ-.) অর্থাৎ এই অন্নরসময় দেহপিণ্ড হতে পৃথক অথচ তারই অভ্যন্তরে প্রাণের পরিণামভূত এবং আত্মারূপে কল্পিত প্রাণময় কোশ আছে। সেই প্রাণময় কোশের দ্বারা অন্নময় কোশ পরিপূর্ণ।

প্রাণময় কোশ অপঞ্চীকৃত বায়ুর বিকার বলে আত্মা নয়। যেহেতু এটা বায়ুর ন্যায় ভিতরে বাইরে যাতায়াত করে, কোন কালে কিছুমাত্র ভাল-মন্দ বুঝতে পারে না, 'কে আপন কে বা পর' নির্ণয় করতে পারে না এবং যেহেতু এটা পরাধীন (অর্থাৎ মনের অধীন), সেহেতু এটা আত্মা হতে পারে না।

মনোময় কোশঃ-

পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয় এবং মন একত্র মনোময়-কোশ বলে অভিহিত হয়। 'আমি' 'আমার' ইত্যাদি প্রকারের নানাবিধ বস্তুকল্পনার কারণ এবং নামরূপ-ক্রিয়াদি বিবিধ ভেদের সহিত বর্তমান এবং বলবান্ এই মনোময় কোশ তৎপুর্ববর্তী প্রাণময়-কোশকে ব্যাপিয়া প্রকাশ পায়।

দেহের চেষ্টাসমূহ প্রাণের অধীন বলে দেহ অপেক্ষা প্রাণ বলবান্। আবার প্রাণের ক্রিয়াসমূহ মনের সংকল্পের উপর নির্ভর করে বলে মনোময় কোশ বলিষ্ঠ। বিষয়ে শ্রুতি প্রমাণ"তস্মাদ্ বা এতস্মাৎ প্রাণময়াৎ অন্যোহন্তরঃ আত্মা মনোময়ঃ। তেনৈষ পূর্ণঃ।'-(তৈত্তিরীয় উপনিষৎ -.) অর্থাৎ উক্ত প্রাণময় হতে ব্যতিরিক্ত অথচ তদভ্যন্তরে মনোময় কোশ আছে। সেই মনোময়ের দ্বারা প্রাণময় পূর্ণ।

মনোময় কোশ যেহেতু উৎপত্তি বিনাশশীল, পরিণামী, দুঃখময় এবং জ্ঞানের বিষয়, সেহেতু এটা কিছুতেই পরমাত্মা হতে পারে না। দ্রষ্টা কখনোই দৃশ্য বস্তুরূপে কারও জ্ঞানের বিষয় হন না। 'অন্নমশিতং ত্রেধা বিধীয়তে; তস্য যঃ স্থবিষ্ঠো ধাতুস্তৎ পুরীষং ভবতি, যো মধ্যমস্তন্মাংসং, যোহণিষ্ঠস্তন্মনঃ'-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-..)—ভুক্ত অন্ন ত্রিবিধ আকারে পরিণত হয়। ওটার স্থূলতম অংশ মলে, মধ্যমাংশ মাংসে এবং সূক্ষ্মতম অংশ মনে পরিণত হয়। 'অস্য পুরুষস্য প্রয়তো বাঙ্মনসি সম্পদ্যতে মনঃ প্রাণে প্রাণস্তেজসি তেজঃ পরস্যাং দেবতায়াম্।'--(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-..) অর্থাৎ এই পুরুষ যখন মুমূর্ষু হয় তখন তার বাক্ মনে, মন প্রাণে, প্রাণ তেজে এবং তেজ পরম দেবতায় উপসংহৃত হয়। এই দুই শ্রুতিবাক্য দ্বারা মনোময় কোশ যে উৎপত্তি বিনাশশীল তা বলা হল।

বিজ্ঞানময় কোশঃ-

বুদ্ধি যখন পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়ের সহিত যুক্ত, অহংকারাদি বৃত্তির এবং 'আমি কর্তা' এই অনুভবের সহিত বর্তমান থাকে, তখন তা বিজ্ঞানময়-কোশ নামে অভিহিত হয়। এই বিজ্ঞানময়-কোশই জীবের সংসার-বন্ধনের কারণ। প্রসিদ্ধ মনোময় হতে ভিন্ন তদভ্যন্তরস্থ হচ্ছে বিজ্ঞানময় শরীর। সেই বিজ্ঞানময়ের দ্বারা এই মনোময় পরিপূর্ণ। "তস্মাদ্ বা এতস্মাৎ প্রাণময়াৎ অন্যোহন্তরঃ আত্মা বিজ্ঞানময়ঃ। তেনৈষ পূর্ণঃ।'-(তৈত্তিরীয় উপনিষৎ -.)

চিৎ-শক্তির প্রতিবিম্বের সহিত বর্তমান, প্রকৃতির বিকার, জ্ঞান ক্রিয়াশক্তিসম্পন্ন বিজ্ঞানময় কোশ স্বভাবতঃ জড় হলেও চৈতন্য-প্রতিবিম্বিত হওয়ার জন্য সর্বদা সম্পূর্ণরূপে দেহ ইন্দ্রিয়সমূহ 'আমি' এরূপ জ্ঞান করে থাকে। অহংবোধের আশ্রয়, উৎপত্তিরহিত, বিজ্ঞানময়-কোশরূপ এই জীব লৌকিক বৈদিক সকল কর্মের অনুষ্ঠান করে থাকে। সে বিষয়ে শ্রুতিই প্রমাণ। 'বিজ্ঞানং যজ্ঞং তনুতে কর্মাণি তনুতেহপি চ।'-(তৈত্তিরীয় উপনিষৎ -.) বিজ্ঞানই (নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধি) যজ্ঞ বিস্তৃত করে এবং কর্মসমূহের অনুষ্ঠাতা। বিজ্ঞানময়-কোশরূপী এই জীব নানা যোনিতে জন্মগ্রহণ করে কখনও ঊর্ধ্বগতি কখনও অধোগতি প্রাপ্ত হয়। জাগ্রতস্বপ্নাদি অবস্থার অনুভব এবং সুখ-দুঃখাদিরও অনুভব এই বিজ্ঞানময় জীবেরই হয়ে থাকে। শুদ্ধ আত্মা নির্বিকার। তার জন্মমরণ, সুখদুঃখ-ভোগ বা জাগ্রৎ-স্বপ্নাদি অবস্থার অনুভবএসব কিছুই হয় না। সুতরাং বিজ্ঞানময়-কোশ চিদাত্মা হতে পারে না। এই বিজ্ঞানময়-কোশ বিকারশীল। ইহা জড়, দেশকালের দ্বারা সীমাবদ্ধ, দৃশ্যবস্তু এবং ব্যাভিচারী।

আনন্দময় কোশঃ-

বাঞ্ছিত বস্তুর লাভে প্রকাশপ্রাপ্ত, প্রিয়-মোদ-প্রমোদরূপে পরিণত, স্থিরীভূত এবং অন্তর্মুখ-তমোবৃত্তি আনন্দস্বরূপ আত্মার দ্বারা প্রতিবিম্বিত হয়ে আনন্দময়-কোশরূপে পরিণত হয়। সৌভাগ্যশালী ব্যক্তিগণের পুণ্যকর্মের অনুভবের সময় এই আনন্দময় কোশ স্বতঃ প্রকাশ পায়। দেহধারী জীবমাত্র বিনা চেষ্টায় এই আনন্দময়-কোশে সুখানুভব করে। 

'প্রিয়াদিগুণকঃ'-(তৈত্তিরীয় উপনিষৎ-.) প্রিয়, মোদ প্রমোদআনন্দসম্ভোগের এই ত্রিবিধ প্রকার আনন্দময়-কোশের গুণ।

তমোগুণরূপ উপাধিযুক্ত বলে, প্রকৃতির পরিণাম বলে, পূর্বকৃত পূর্ণ্যকর্মসমূহের ফলে উৎপন্ন বলে এবং অন্নময়াদি বিকারসমূহের মধ্যে বর্তমান বলে এই আনন্দময় কোশও পরমাত্মা হতে পারে না। যুক্তির দ্বারা এবং শ্রুতিপ্রমাণের সহায়ে অন্নময়াদি পঞ্চকোশ আত্মা নয়, এটা প্রমাণিত হলে মিথ্যা বলে প্রমাণিত এই কোশসমূহ যাঁর আশ্রয়ে প্রকাশিত হয়, সেই স্বয়ংপ্রকাশ চৈতন্যস্বরূপ আত্মা অবশিষ্ট থাকেন। 'পঞ্চকোশ পরিত্যাগে সাক্ষিবোধ-অবশেষতঃ স্বস্বরূপং এব' অর্থাৎ পঞ্চকোশের পরিত্যাগ করলে যে সাক্ষিরূপ বোধ অবশিষ্ট থাকে, তাই স্বস্বরূপ।.........

তথ্যসূত্র-

. ভগবান্ শঙ্করাচার্যের 'বিবেকচূড়ামণি'

. আচার্য বিদ্যারণ্য স্বামীর 'পঞ্চদশী'

. তৈত্তিরীয় উপনিষৎ।

 

শ্রীশুভ চৌধুরী

ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ।

No comments:

জ্ঞানবিজ্ঞানযোগ-

  শ্রীভগবানুবাচ ময্যাসক্তমনাঃ পার্থ যোগং যুঞ্জন্মদাশ্রয়ঃ৷ অসংশয়ং সমগ্রং মাং যথা জ্ঞাস্যসি তচ্ছৃণু ৷৷ ১   ‘শাঙ্করভাষ্য’   অনুস...