Tuesday, 6 June 2023

পরব্রহ্মই জগদধিষ্ঠানঃ-

 


মুণ্ডকে শ্রুত হচ্ছে"যস্মিন্ দৌঃ পৃথিবী চান্তরিক্ষম্"-(মুণ্ডক উপনিষৎ-..) অর্থাৎ যাঁতে দ্যুলোক, পৃথিবী অন্তরিক্ষ সমর্পিত আছে", এই স্থলে দ্যুলোক ভূর্লোক প্রভৃতি কোন কিছুতে সমর্পিত আছে এই প্রকার শ্রুত হচ্ছে বলে কোন অধিষ্ঠানের প্রতীতি হচ্ছে। সেই অধিষ্ঠান বা আশ্রয় কি?

তদুত্তরে ভগবান্ সূত্রকার বাদরায়ণ সিদ্ধান্ত করছেন

দ্যুভ্বাদ্যায়তনং স্বশব্দাৎ৷৷ (ব্রহ্মসূত্র-..)

ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য এই সূত্রের ভাষ্যে বলেছেন

দৌঃ এবং ভূ (—দ্যুলোক এবং ভূর্লোক) এই প্রকারে 'দ্যুভূবৌ' এই পদ নিষ্পন্ন হয়, সেই দ্যু এবং ভূঃ হয় আদি যার, তা এই দ্যুভ্বাদি। এই বাক্যে এই যা দ্যুলোক পৃথিবী  অন্তরিক্ষ মন এবং প্রাণসকল (—ইন্দ্রিয়সকল) ইত্যাদি এইপ্রকার স্বরূপবিশিষ্ট জগৎ সূত্রাশ্রিত বস্ত্রের ন্যায় পরব্রহ্মে আশ্রিতরূপে নির্দিষ্ট হয়েছে, তার 'আয়তন' (—আশ্রয়, অধিষ্ঠান) হন পরব্রহ্ম, এটাই সঙ্গত। কোন হেতু বলে? 'স্বশব্দাৎ' অর্থাৎ যেহেতু 'আত্ম' শব্দের প্রয়োগ আছে, এটাই ভাব। 'তমেবৈকং জানথ আত্মানম্'-(মুণ্ডক উপনিষৎ-..) "সেই অদ্বিতীয় আত্মাকে অবগত হও" ইত্যাদি এই স্থলে আত্মশব্দের প্রয়োগ আছে। আর পরমাত্মা পরিগৃহীত হলে আত্মশব্দ সম্যগ্ভাবে সঙ্গত হয়, কিন্তু অন্য পদার্থ গৃহীত হলে তা হয় না। আবার কোন কোন স্থলে স্বশব্দের (—ব্রহ্মবোধক শব্দের) দ্বারাই ব্রহ্মের আয়তনতা (—জগদাধারতা) শ্রুতিতে বর্ণিত হচ্ছে, যথা

'সন্মূলাঃ সোম্যেমাঃ সর্বাঃ প্রজাঃ সদায়তনাঃ সৎপ্রতিষ্ঠাঃ'-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-..)

"হে সোম্য, এইসকল প্রজা (—স্থাবরজঙ্গমাত্মক এই জগৎ) সৎস্বরূপ ব্রহ্ম হতে উৎপন্ন হয়, স্থিতিকালে সৎস্বরূপ ব্রহ্মে আশ্রিত থাকে এবং প্রলয়কালে সৎস্বরূপ ব্রহ্মে বিলীন হয়", ইত্যাদি।

আবার স্বশব্দের দ্বারাই মুণ্ডকের শ্লোকের পূর্বে এবং পরে ব্রহ্ম বর্ণিত হচ্ছে, যথা'পুরুষঃ এবেদং বিশ্বং কর্ম তপঃ ব্রহ্ম পরামৃতম্'-(মুণ্ডক উপনিষৎ-..১০) অর্থাৎ "পুরুষই এই অগ্নিহোত্রাদি কর্ম জ্ঞানাত্মক বিশ্ব, পরম অমৃতস্বরূপ ব্রহ্ম", ইত্যাদি এবং 'ব্রহ্মৈবেদমমৃতং পুরস্তাদ্ব্রহ্ম পশ্চাদ্ব্রহ্ম দক্ষিণতশ্চোত্তরেণ'-(মুণ্ডক উপনিষৎ-..১১) "এই অমৃতস্বরূপ ব্রহ্মই পুরোভাগে, ব্রহ্মই পশ্চাদ্ভাগে, ব্রহ্মই দক্ষিণভাগে, ব্রহ্মই উত্তরভাগে প্রকাশিত হচ্ছেন", ইত্যাদি। সুতরাং প্রকরণবলে ব্রহ্মই যে জগদাধার, এটা নির্ণীত হয়েছে।

"সকল পদার্থ ব্রহ্মস্বরূপ" এই প্রকার সামাণাধিকরণ্য প্রতীত হচ্ছে বলে, যেমন শাখা স্কন্ধ এবং মূল ইত্যাদি ভেদে বৃক্ষ হয় অনেকাত্মক, এইরূপে আত্মাও নানারস বিচিত্র হবেন, এই প্রকার আশঙ্কা হওয়া সম্ভব; তাকে নিরাকরণ করবার জন্য শ্রুতি নিশ্চয়পূর্বক বলছেন'তমেবৈকং জানথ আত্মানম্'-(মুণ্ডক উপনিষৎ-..) "সেই অদ্বিতীয় আত্মাকে অবগত হবে।"

কিন্তু ব্রহ্ম জগতের আশ্রয় হলে একরস কি প্রকারে হবেন? এখানে এটাই বলা হচ্ছেকার্যপ্রপঞ্চবিশিষ্ট বিচিত্র আত্মা (—সবিশেষ ব্রহ্ম) বিজ্ঞেয় নন। তবে কীদৃশ ব্রহ্ম বিজ্ঞেয়? অবিদ্যাকৃত কার্যপ্রপঞ্চকে বিদ্যার দ্বারা বিলোপকরতঃ সেই অধিষ্ঠানভূত অদ্বিতীয় একরস আত্মাকে অবগত হবে যেমন 'দেবদত্ত যাতে উপবিষ্ট আছে, তা আনয়ন কর', এরূপ বললে লোকে আসনই আনয়ন করে, দেবদত্তকে নয়; তদ্রূপ অধিষ্ঠানভূত যে একরস আত্মা, তাঁরই বিজ্ঞেয়তা উপদিষ্ট হচ্ছে, কিন্তু দ্যুলোকাদিবিশিষ্ট সবিশেষ আত্মার নয়। আর কার্যভূত মিথ্যাবস্তুতে যাঁর অভিসন্ধি থাকে, শ্রুতিতে তাঁর অপবাদ বর্ণিত হচ্ছে, যথা

'মৃত্যোঃ মৃত্যুমাপ্নোতি ইহ নানেব পশ্যতি'-(কঠ উপনিষৎ-..১১) অর্থাৎ "যিনি একরস ব্রহ্মে নানার ন্যায় দর্শন করেন অর্থাৎ স্বল্পমাত্রও ভেদ দর্শন করেন, তিনি মৃত্যু হতে মৃত্যুকে প্রাপ্ত হন।"

আর 'সকল পদার্থই ব্রহ্মস্বরূপ', এইপ্রকার যে সামানাধিকরণ্য, তা প্রপঞ্চকে বিলোপ করবার জন্য, কিন্তু ব্রহ্মের অনেক রসতা প্রতিপাদন করবার জন্য নয়; যেহেতু ' যথা সৈন্ধবঘনোনন্তরোবাহ্যঃ কৃত্স্নো রসঘন এবৈবং বা অরেযমাত্মানন্তরোবাহ্যঃ কৃত্স্নঃ প্রজ্ঞানঘন এব'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ -..১৩)

"সেই লবণপিণ্ড যেমন অন্তরে বাইরে একইপ্রকার রসযুক্ত এবং সমগ্রভাবে রসঘনই, হে মৈত্রেয়ি! এই প্রকারে এই আত্মা অন্তররহিত বাহ্যরহিত এবং সমগ্রভাবে প্রজ্ঞানঘনই অর্থাৎ সর্বাত্মকভাবে চৈতন্যৈকরসস্বরূপ।" এই প্রকারে শ্রুতিতে ব্রহ্মের একরসতা বর্ণিত হয়েছে। সেহেতু পরব্রহ্মই দ্যুলোক ভূর্লোকাদির অধিষ্ঠান।....

শ্রীশুভ চৌধুরী

মে ২৬, ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ।

No comments:

আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...