Saturday, 30 March 2024

ত্রিবিধ জীব (অবচ্ছিন্ন, চিদাভাস ও স্বপ্নকল্পিত)—

 


শ্রুতিতে সত্যাদি লক্ষণ দ্বারা যে ব্রহ্ম বর্ণিত হয়েছে, তাতে আবরণ বিক্ষেপ নামক শক্তিদ্বয়স্বরূপ অনির্বচনীয় মায়া অবস্থিত থেকে স্বীয় আশ্রয়স্বরূপ ব্রহ্মের অখণ্ডতাকে আচ্ছাদন করে অবচ্ছেদ্য সাক্ষিরূপব্রহ্মে জগৎ জীব কল্পনা করে থাকে। অনাদি অবিদ্যা প্রভাবে সচ্চিদানন্দ পরব্রহ্মই দেহ, মনঃ, ইন্দ্রিয় প্রভৃতির আবেষ্টনীর মধ্যে পড়ে স্বভাবতঃ অসীম অনন্ত হলেও সসীমের ন্যায়, পরমাত্মা হতে অভিন্ন হলেও ভিন্নের ন্যায়, অকর্তা হলেও কর্তার ন্যায়, অভোক্তা, অজ্ঞাতা হলেও ভোক্তা জ্ঞাতার ন্যায়, অবাঙ্মনসগোচর হলেও অহংপ্রত্যয়-গোচর হয়ে 'জীব' আখ্যা লাভ করে। অখণ্ড আকাশ যেমন ঘটাদি অবচ্ছেদ বা আবেষ্টনীর মধ্যে পড়ে ঘটাকাশ বলে অভিহিত হয় এবং মহাকাশ হতে ভিন্ন বলে প্রতীয়মান হয়, সেরূপ অন্তঃকরণের আবেষ্টনীর মধ্যে পড়ে অখণ্ড ব্রহ্ম জীবসংজ্ঞা লাভ করে। দৃগ্দৃশ্যবিবেক অনুসারে এই জীব তিন প্রকার, যথাঅবচ্ছিন্ন , চিদাভাস স্বপ্নকল্পিত। "অবচ্ছিন্নশ্চিদাভাসস্তৃতীয়ঃ স্বপ্নকল্পিতঃ।"

. 'অবচ্ছিন্নঃ'—ঘটাকাশাদির ন্যায় প্রাণাদিসঙ্ঘাত দ্বারা অবচ্ছিন্ন চিদাত্মা অর্থাৎ প্রত্যগাত্মা, জীবের প্রথম প্রকার। পরিচ্ছিন্ন অর্থাৎ পরিপূর্ণ পরব্রহ্মে অবিদ্যা অহঙ্কার দ্বারা অবচ্ছেদ্য যে সাক্ষিচৈতন্য তাই 'অবচ্ছিন্ন' নামক জীব।

. 'চিদাভাসঃ'—জলে সূর্যাদির প্রতিবিম্বের ন্যায় উপাধিতে চৈতন্যের প্রতিবিম্ব, যা জলের কম্পনাদির ন্যায় উপাধিধর্মের দ্বারা আক্রান্ত হয়, তাই দ্বিতীয় প্রকার জীব। যাতে চৈতন্যের স্বপ্রকাশাদি লক্ষণ খাটে না, কিন্তু যা চৈতন্যের ন্যায় প্রকাশমান, তাই চিদাভাস।

. 'স্বপ্নকল্পিতঃ'—'আমি দেব', 'আমি মনুষ্য' এরূপে স্থূল সংঘাতের সহিত অভিন্ন বলে কল্পিত। যেমন স্বপ্নে কেউ কোন কল্পিত দেহের সহিত অভিন্নভাব প্রাপ্ত হয়, সেরূপ। এটা জীবের তৃতীয় প্রকার।

এই তিন প্রকার জীবের মধ্যে প্রথমোল্লিখিত 'অবচ্ছিন্ন' নামক জীবকেই পারমার্থিক জীব বলা হয়। অবচ্ছেদক প্রাণাদি উপাধি অবাস্তব বলে তৎকৃত অবচ্ছেদও অবাস্তব বটে, কিন্তু অবচ্ছেদ্য বস্তু চিদাত্মতত্ত্ব অবাস্তব নয়। নূপুরাদি চরণালংকারে যে সর্প ভ্রান্তি হয়, সেই সর্প দ্বারা চরণবেষ্টন অবাস্তব হলেও, তদ্দারা বেষ্টিত চরণ কখনো অবাস্তব হয় না। তাই অবচ্ছেদ্য বস্তুটি কল্পিত নয়, তা পারমার্থিক সত্য। জীবত্বরূপ অবচ্ছেদ কল্পিত, অবচ্ছেদ্য শুদ্ধচৈতন্যই বাস্তব। সেই বাস্তবস্বরূপ শুদ্ধচৈতন্যে জীবত্ব আরোপিত হয়ে থাকে; কিন্তু তাতে ব্রহ্মত্ব স্বভাবতই আছে। 'তত্ত্বমসি' প্রভৃতি মহাবাক্য 'অবচ্ছিন্ন' নামক জীবের সহিত পূর্ণব্রহ্মের একতা বর্ণনা করছে, অপর দুই প্রকার জীব অর্থাৎ চিদাভাস এবং স্বপ্নকল্পিত জীবের সহিত ব্রহ্মের একতা বর্ণনা করছে না। যেহেতু উভয়ই স্বরূপতই কল্পিত এবং সেই হেতু মিথ্যা।.......…

তথ্যসূত্রঃ-

. বাচস্পতি মিশ্রের "ভামতী"

. ভগবান্ শঙ্করাচার্য (মতান্তরে ভারতী তীর্থ) বিরচিত "দৃগ্দৃশ্যবিবেক", আনন্দগিরি ব্রহ্মানন্দ ভারতীকৃত টীকা সমেত।

শ্রীশুভ চৌধুরী

মার্চ ২৯, ২০২৪ খৃষ্টাব্দ।

মায়ার আবরণ ও বিক্ষেপ শক্তি

 


মায়ার আবরণ বিক্ষেপ নামক দুই প্রকার শক্তি আছে। 'জীবেশাবাভাসেন করোতি মায়া চাবিদ্যা স্বয়মেব ভবতি'-(নৃসিংহ উত্তর তাপনীয় উপনিষৎ /)মায়া চিদাভাসের সাহায্যে জীব ঈশ্বর উভয়ই সৃজন করে থাকেন এবং নিজেই (ঈশ্বরে) মায়া এবং (জীবে) অবিদ্যারূপ ধারণ করেন। এরূপ বেদান্তবাক্যসমূহে মায়ার আবরণ বিক্ষেপ নামক দুই শক্তি থাকা প্রসিদ্ধ আছে।

বিক্ষেপশক্তি

'বিক্ষেপ' শব্দে 'বিবিধ করা' বোঝায়, অর্থাৎ বিবিধরূপে প্রকাশ করা বা বিবিধরূপ হওয়া। সেই বিক্ষেপরূপ যে শক্তি তাই বিক্ষেপশক্তি। 'বিক্ষেপশক্তির্লিঙ্গাদিব্রহ্মাণ্ডান্তং জগৎ সৃজেৎ'-(বাক্যসুধা) অর্থাৎ বিক্ষেপশক্তি লিঙ্গশরীর হতে আরম্ভ করে ব্রহ্মাণ্ড পর্যন্ত সমগ্র জগৎ সৃজন করেন। অধ্যাত্ম চিন্মাত্রকে (জীবশরীরত্রয়াবিভক্ত চৈতন্যকে) বিশ্ব, তৈজস, প্রাজ্ঞ প্রভৃতি ভেদে এবং অধিদৈবত চিন্মাত্রকে (ঈশ্বরশরীরত্রয়াভিব্যক্ত চৈতন্যকে) বিরাট, হিরণ্যগর্ভ, অন্তর্যামী প্রভৃতি ভেদে বিক্ষিপ্ত করে বলে তার নাম বিক্ষেপশক্তি। চিন্মাত্র এই শক্তি দ্বারা বিক্ষিপ্ত হন অর্থাৎ গিরি, নদী, সমুদ্র প্রভৃতি অনেক নামরূপাকারে আপনিই আপনাকে বিক্ষেপ করেন বা নামরূপাদির আকারে পরিণত বা বিবর্তিত হন। যেমন রজ্জুর অজ্ঞান রজ্জুকে আবৃত করে রজ্জুতে নিজশক্তির দ্বারা সর্প প্রভৃতি কল্পনা করে, সেরূপ আত্মাশ্রিত অজ্ঞান আত্মাকে আবৃত করে আত্মাতে নিজশক্তি বলে আকাশাদি জগৎ সৃষ্টি করে। সৃষ্টি করার এই সামর্থ্যকে বিক্ষেপশক্তি বলে।

সচ্চিদানন্দ ব্রহ্মে যে বিক্ষেপাত্মিকা মায়া রয়েছে, সেই ব্রহ্মেই সেই মায়ার যে সমস্ত নাম রূপাকারে বিবর্তন তাকেই সৃষ্টি বলে। তা অনেকটা সমুদ্রে ফেনাদি বিস্তারের ন্যায়। সমুদ্রের উপর ফেন, তরঙ্গ, বুদ্বুদ প্রভৃতি আকারে যে বিবর্তন তাকে যেমন সৃষ্টি বলে, এস্থলেও সেইরূপ। যেহেতু সৃষ্টি মায়াময়, সেহেতু (প্রতীত সর্পের) অধিষ্ঠানরূপে রজ্জু সর্পাকারে বিবর্তিত হলে, রজ্জুকে যেমন সর্পের কারণ বলা হয়, সেরূপ ব্রহ্মও রজ্জুর ন্যায় কূটস্থ (নির্বিকার) থেকে, মায়াকে সত্তা প্রকাশ দিয়ে, মায়ার অনুগমনমাত্র করে বলে ব্রহ্মকে কারণ বলা হয়ে থাকে। পারমার্থিকভাবে ব্রহ্মকে কারণ বলা হয় না।

আবরণশক্তি-

আত্মা যে সংসারী হয় অর্থাৎ স্বীয় ব্রহ্মস্বরূপতা বুঝতে পারে না, মায়ার আবরণশক্তিই তার কারণ। এই যে  বুঝতে না দেওয়ার শক্তি, একেই অজ্ঞানের আবরণ শক্তি বলে। বাক্যসুধাতে বর্ণিত আছে

 "অন্তর্দৃগ্দৃশ্যয়োর্ভেদং বহিশ্চ ব্রহ্মসর্গয়োঃ। আবৃণোত্যপরা শক্তিঃ সা সংসারস্য কারণম্।"

যে শক্তি স্থূলশরীরের অভ্যন্তরে দ্রষ্টা আত্মা হতে দৃশ্যের ভেদকে আবরণ করে রাখে, আর শরীরের বাইরে ব্রহ্ম সৃষ্টির ভেদ আচ্ছাদন করে রাখে, সেই শক্তিই জন্ম-মৃত্যু-অনুভবরূপ সংসারের কারণ।

'দৃক্' বা সাক্ষী, যা 'আমি' এরূপ প্রত্যয়ের আলম্বন, কেবলমাত্র দ্রষ্টৃস্বরূপ, তা স্থূল, সূক্ষ্ম কারণ শরীরের সহিত তাদাত্ম্যবশে ভোক্তৃরূপ প্রাপ্ত হয়, কারণ শ্রুতি বলছেন'অহমান্নাদোঽহমন্নাদঃ'-(তৈত্তিরীয় উপনিষৎ-/১০/) আমি ভোক্তৃরূপ হচ্ছি; কিন্তু পারমার্থিকভাবে ভোক্তৃরূপ নয়। 'দৃশ্য'—'তুমি' বা 'এই' এরূপ প্রত্যয়ের আলম্বনস্বরূপ, অহঙ্কার হতে আরম্ভ করে দেহ পর্যন্ত, তা অবিদ্যার কার্য বলে জড়স্বরূপ। এই উভয়ের মধ্যে যে ভেদ বা পরস্পর বৈলক্ষণ্য, বা পৃথগ্ভাব তাকে দৃগ্দৃশ্যের ভেদ বলছেন। এই আবরণশক্তি সেই ভেদকে আবৃত করে।

আবার সত্য-জ্ঞান-অনন্ত-আনন্দ-একরসরূপাত্মক ব্রহ্ম সৃষ্ট প্রপঞ্চতদুভয়ের পরস্পর ভিন্নস্বভাবতাকে আবৃত করে রাখে বলে এই শক্তিকে আবরণশক্তি বলা হয়। আবরণশক্তি হলো যেমন একখণ্ড ছোট মেঘ, দ্রষ্টাপুরুষের নয়নপথ আচ্ছাদিত করে অনেক যোজন আয়তন বিশিষ্ট সূর্যমণ্ডল যেন আচ্ছন্ন হয়ে গেছে বলে বোধ হয়, সেরূপ অজ্ঞান পরিচ্ছিন্ন হলেও দ্রষ্টা পুরুষের বুদ্ধিকে আচ্ছাদন করায় অসীম অসংসারী আত্মা যেন আচ্ছাদিত হয়েছে, এরূপ বোধ করার সামর্থকে আবরণশক্তি বলে। যেমন নিজ অজ্ঞানের দ্বারা আবৃত রজ্জুতে সর্পভাবনার সম্ভাবনা থাকে, সেরূপে অজ্ঞানের এই আবরণশক্তির দ্বারা আবৃত আত্মায় কর্তৃত্ব ভোক্তৃত্ব সুখিত্ব দুঃখিত্ব প্রভৃতি সংসার সম্ভাবনাও থাকে। এই হলো আবরণশক্তির কাজ।....

তথ্যসূত্রঃ-

. ভগবান্ শঙ্করাচার্য (মতান্তরে ভারতী তীর্থ) বিরচিত "দৃগ্দৃশ্যবিবেক", আনন্দগিরি ব্রহ্মানন্দ ভারতীকৃত টীকা সমেত।

. সদানন্দ যোগীন্দ্র বিরচিত বেদান্ত-সারঃ।

শ্রীশুভ চৌধুরী

মার্চ ১৮, ২০২৪ খৃষ্টাব্দ।

Wednesday, 13 March 2024

আচার্য ভারতীতীর্থ বা আনন্দভারতীতীর্থ—

 



শঙ্করানন্দ প্রমুখ আচার্যের মেধাশক্তিতে খৃষ্টীয় ১৩শ শতকে মধ্বাচার্যের আক্রমণের বিরুদ্ধে অদ্বৈতবাদের বিজয়-শঙ্খ বেজে উঠলেও তখনও প্রতিপক্ষগণের আক্রমণ এবং প্রতিরোধ-চেষ্টা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসছিল। খৃষ্টীয় ত্রয়োদশ শতকের শেষভাগে রামানুজ সম্প্রদায়ের প্রবীণ আচার্য বেঙ্কটনাথ বা বেদান্ত-মহাদেশিকাচার্যের অভ্যুদয়ে বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ প্রবল আকার ধারণ করে। তাছাড়া মধ্বাচার্যের শিষ্য অক্ষোভ্য মুনি দ্বৈতবেদান্ত নব্যন্যায়ে অসামান্য পাণ্ডিত্য লাভ করেন। ঠিক সেই সময় ভারতী তীর্থ, বিদ্যারণ্য মুনীশ্বর প্রভৃতি অদ্বৈতাচার্যগণ আবির্ভূত হয়ে সেই প্রতিপক্ষ আক্রমণ বেগ প্রতিহত করে অদ্বৈত-শশীকে প্রতিবাদী রাহু-গ্রাস হতে মুক্ত করেন।

ভারতীতীর্থ বিদ্যারণ্য মুনির গুরু ছিলেন, একথা বিদ্যারণ্যমুনি স্বরচিত 'জৈমিনীয়ন্যায়মালাবিস্তর' নামক গ্রন্থে স্বীকার করেছেন। ভারতীতীর্থের গুরুর নাম ছিল বিদ্যাতীর্থ। গুরু পরম্পরায় বিদ্যাতীর্থের পর ভারতীতীর্থ শৃঙ্গেরী মঠের মঠাধীশ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। শৃঙ্গেরী মঠের ১৩৪৬ খৃষ্টাব্দের এক শিলালিপি হতে জানা যায় যে, বিজয়নগর রাজ্যের রাজা প্রথম হরিহর এবং তাঁর ভাতৃগণ কম্পন, প্রথম বুক্ক, মারপ মুদ্দপ ভারতীতীর্থকে ভূমিদান (প্রায় নয়টি গ্রাম দান) করেছিলেন। এটা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ভারতীতীর্থ খৃষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং শৃঙ্গেরী মঠের গুরুপীঠে শঙ্করাচার্য পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। শৃঙ্গেরী মঠের গুরুপরম্পরা হতে অবগত হওয়া যায়, ভারতীকৃষ্ণতীর্থের উক্ত মঠের গুরুপীঠে অবস্থিতিকাল ১৩২৮ খৃষ্টাব্দ হতে ১৩৮০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত। সম্ভবত ইনিই ভারতী তীর্থ আনন্দভারতীতীর্থ এই উভয় নামেই পরিচিত হন।

তিনি একশিলানগরের (বর্তমান ওয়ারঙ্গল, অন্ধ্রপ্রদেশ) বাসিন্দা ছিলেন। আচার্যের সময়কাল ছিল ভারতের ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সময়। আচার্যের শিষ্য বিদ্যারণ্যের নির্দেশনায় তখন বিজয়নগরের মহান হিন্দু সাম্রাজ্য ১৩৩৬ খৃষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আচার্য জানতেন যে হিন্দু শাসকদের দ্বারা ক্ষমতা বজায় থাকলেই ভারতের পবিত্র ধর্ম রক্ষা করা যেতে পারে। জনসাধারণের মনে আধ্যাত্মিক জাগরণ, শৃঙ্গেরি মঠের প্রভাব বৃদ্ধি ভক্তগণের মঙ্গলার্থে তিনি তখন মঠ মন্দির সংস্কারের দায়িত্ব নেন। বিজয়নগর রাজ্য প্রতিষ্ঠার সময় বিদ্যাশঙ্কর মন্দিরও নির্মিত হয়েছিল। তিনি আদি শঙ্করাচার্যের সময়কাল থেকে স্থাপিত চন্দনকাষ্ঠের মূর্তির জায়গায় ভগবতী শারদাদেবীর একটি স্বর্ণমূর্তি প্রতিস্থাপন করেছিলেন। তখন মঠ থেকে বেদাদি শাস্ত্রে পারদর্শী পণ্ডিতদের উপাধি উপহার দিয়ে ভূষিত সম্মাণিত করা হত। বিদ্যাশঙ্কর মন্দিরের অনুষ্ঠানের দিন, আচার্য ভারতীতীর্থ দানে প্রাপ্ত ভূমিকে বিভক্ত করে ১২০ জন বিদ্বান ব্রাহ্মণকে উপহার দিয়েছিলেন যারা মঠের সন্নিকটেই বসতি স্থাপন করেছিলেন। এটিই ছিল বর্তমান শৃঙ্গেরী শহরের সূচনা যা একটি আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল।

ভারতীতীর্থ 'বৈয়াসিক-ন্যায়মালা' নামে বেদান্তদর্শনের অধিকরণমালা রচনা করে প্রগাঢ় পাণ্ডিত্যের পরিচয় প্রদান করেছেন। 'বৈয়াসিকন্যায়মালা', 'পঞ্চদশী' কিয়দংশ "দৃগ্দৃশ্যবিবেক" ভারতীতীর্থ বিরচিত বলে সুপ্রসিদ্ধ। 'বৈয়াসিকন্যায়মালা' ভগবান্ শঙ্করাচার্য বিরচিত শারীরকভাষ্যের তাৎপর্য গ্রহণের পক্ষে সবিশেষ উপযোগী। এতে ব্রহ্মসূত্রের প্রত্যেক অধিকরণের পূর্বপক্ষ সিদ্ধান্ত শ্লোকাকারে নিবদ্ধ হয়েছে এবং সমগ্র গ্রন্থের তাৎপর্য চারটিমাত্র শ্লোকে সংগৃহীত হয়েছে। এটারই অনুকরণে বিদ্যারণ্যমুনি 'জৈমিনীয়ন্যায়মালাবিস্তর' রচনা করেন। সুপ্রসিদ্ধ বেদান্তপ্রকরণগ্রন্থ 'পঞ্চদশী' কোন অংশ কার বিরচিত তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। নিশ্চলদাশ বৃত্তিপ্রভাকর গ্রন্থে লিখেছেন, শেষের পাঁচ অধ্যায় ভারতীতীর্থ বিরচিত এবং পূর্ব দশ অধ্যায় বিদ্যারণ্য বিরচিত। অপ্পয় দীক্ষিত 'সিদ্ধান্তলেশসংগ্রহ' গ্রন্থে 'পঞ্চদশী' নবম অধ্যায় ধ্যানদীপ প্রকরণকে ভারতীতীর্থ বিরচিত বলে নির্দেশ করেছেন। 'দৃগ্দৃশ্যবিবেক' ভারতী তীর্থের রচিত কিনা এটা নিয়েও মতভেদ রয়েছে। টীকাকার ব্রহ্মানন্দ ভারতী তদীয় গুরু শৃঙ্গেরি পীঠাধীশ ভারতীতীর্থকেই 'দৃগ্দৃশ্যবিবেক' গ্রন্থের রচয়িতা বলে স্পষ্টতঃ নির্দেশ করেছেন। কিন্তু টীকাকার আনন্দগিরি আবার এই প্রকরণগ্রন্থকে ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য বিরচিত বলে গ্রহণ করেছেন।

"অজ্ঞানাং জাহ্নবী তীর্থং বিদ্যাতীর্থং বিবেকিনাম্।

সর্বেষাং সুখদং তীর্থং ভারতীতীর্থমাশ্রয়ে।।"

"(যিনি) অজ্ঞদের নিকট গঙ্গারূপী তীর্থ, বিবেকবানগণের নিকট সকল বিদ্যারূপী তীর্থ, (এবং) সকলের জন্যই সুখ প্রদানকারী তীর্থস্বরূপ,(সেই) ভারতীতীর্থ স্বামীকে নমষ্কার করি।"..........

তথ্যসূত্রঃ-

.  উদ্বোধন প্রকাশিত 'দৃগ্দৃশ্যবিবেক', গ্রন্থকার পরিচিতি।

. বেদান্তদর্শনঅদ্বৈতবাদ, প্রথম খণ্ড, আশুতোষ শাস্ত্রী কাব্য-ব্যাকরণ-সাংখ্য-বেদান্ততীর্থ বিদ্যাবাচস্পতি।

. https://sringeri.net/jagadgurus/the-early-acharyas

শ্রীশুভ চৌধুরী

মার্চ ১১, ২০২৪ খৃষ্টাব্দ।

আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...