মায়ার আবরণ ও বিক্ষেপ নামক দুই প্রকার শক্তি আছে। 'জীবেশাবাভাসেন করোতি মায়া চাবিদ্যা চ স্বয়মেব ভবতি'-(নৃসিংহ উত্তর তাপনীয় উপনিষৎ ৯/৫) —মায়া চিদাভাসের সাহায্যে জীব ও ঈশ্বর উভয়ই সৃজন করে থাকেন এবং নিজেই (ঈশ্বরে) মায়া এবং (জীবে) অবিদ্যারূপ ধারণ করেন। এরূপ বেদান্তবাক্যসমূহে মায়ার আবরণ ও বিক্ষেপ নামক দুই শক্তি থাকা প্রসিদ্ধ আছে।
বিক্ষেপশক্তি—
'বিক্ষেপ' শব্দে
'বিবিধ করা' বোঝায়, অর্থাৎ
বিবিধরূপে প্রকাশ করা বা বিবিধরূপ
হওয়া। সেই বিক্ষেপরূপ যে
শক্তি তাই বিক্ষেপশক্তি। 'বিক্ষেপশক্তির্লিঙ্গাদিব্রহ্মাণ্ডান্তং
জগৎ সৃজেৎ'-(বাক্যসুধা) অর্থাৎ বিক্ষেপশক্তি লিঙ্গশরীর হতে আরম্ভ করে
ব্রহ্মাণ্ড পর্যন্ত সমগ্র জগৎ সৃজন করেন।
অধ্যাত্ম চিন্মাত্রকে (জীবশরীরত্রয়াবিভক্ত চৈতন্যকে) বিশ্ব, তৈজস, প্রাজ্ঞ প্রভৃতি ভেদে এবং অধিদৈবত
চিন্মাত্রকে (ঈশ্বরশরীরত্রয়াভিব্যক্ত চৈতন্যকে) বিরাট, হিরণ্যগর্ভ, অন্তর্যামী প্রভৃতি ভেদে বিক্ষিপ্ত করে
বলে তার নাম বিক্ষেপশক্তি।
চিন্মাত্র এই শক্তি দ্বারা
বিক্ষিপ্ত হন অর্থাৎ গিরি,
নদী, সমুদ্র প্রভৃতি অনেক নামরূপাকারে আপনিই
আপনাকে বিক্ষেপ করেন বা নামরূপাদির
আকারে পরিণত বা বিবর্তিত হন।
যেমন রজ্জুর অজ্ঞান রজ্জুকে আবৃত করে রজ্জুতে
নিজশক্তির দ্বারা সর্প প্রভৃতি কল্পনা
করে, সেরূপ আত্মাশ্রিত অজ্ঞান আত্মাকে আবৃত করে আত্মাতে
নিজশক্তি বলে আকাশাদি জগৎ
সৃষ্টি করে। সৃষ্টি করার
এই সামর্থ্যকে বিক্ষেপশক্তি বলে।
সচ্চিদানন্দ ব্রহ্মে যে বিক্ষেপাত্মিকা মায়া রয়েছে, সেই ব্রহ্মেই সেই মায়ার যে সমস্ত নাম রূপাকারে বিবর্তন তাকেই সৃষ্টি বলে। তা অনেকটা সমুদ্রে ফেনাদি বিস্তারের ন্যায়। সমুদ্রের উপর ফেন, তরঙ্গ, বুদ্বুদ প্রভৃতি আকারে যে বিবর্তন তাকে যেমন সৃষ্টি বলে, এস্থলেও সেইরূপ। যেহেতু সৃষ্টি মায়াময়, সেহেতু (প্রতীত সর্পের) অধিষ্ঠানরূপে রজ্জু সর্পাকারে বিবর্তিত হলে, রজ্জুকে যেমন সর্পের কারণ বলা হয়, সেরূপ ব্রহ্মও রজ্জুর ন্যায় কূটস্থ (নির্বিকার) থেকে, মায়াকে সত্তা ও প্রকাশ দিয়ে, মায়ার অনুগমনমাত্র করে বলে ব্রহ্মকে কারণ বলা হয়ে থাকে। পারমার্থিকভাবে ব্রহ্মকে কারণ বলা হয় না।
আবরণশক্তি-
আত্মা
যে সংসারী হয় অর্থাৎ স্বীয়
ব্রহ্মস্বরূপতা বুঝতে পারে না, মায়ার
আবরণশক্তিই তার কারণ। এই
যে বুঝতে
না দেওয়ার শক্তি, একেই অজ্ঞানের আবরণ
শক্তি বলে। বাক্যসুধাতে বর্ণিত
আছে—
"অন্তর্দৃগ্দৃশ্যয়োর্ভেদং
বহিশ্চ ব্রহ্মসর্গয়োঃ। আবৃণোত্যপরা শক্তিঃ সা সংসারস্য কারণম্।"
যে
শক্তি স্থূলশরীরের অভ্যন্তরে দ্রষ্টা আত্মা হতে দৃশ্যের ভেদকে
আবরণ করে রাখে, আর
শরীরের বাইরে ব্রহ্ম ও সৃষ্টির ভেদ
আচ্ছাদন করে রাখে, সেই
শক্তিই জন্ম-মৃত্যু-অনুভবরূপ
সংসারের কারণ।
'দৃক্' বা
সাক্ষী, যা 'আমি' এরূপ
প্রত্যয়ের আলম্বন, কেবলমাত্র দ্রষ্টৃস্বরূপ, তা স্থূল, সূক্ষ্ম
ও কারণ শরীরের সহিত
তাদাত্ম্যবশে ভোক্তৃরূপ প্রাপ্ত হয়, কারণ শ্রুতি
বলছেন—'অহমান্নাদোঽহমন্নাদঃ'-(তৈত্তিরীয় উপনিষৎ-৩/১০/৬)
আমি ভোক্তৃরূপ হচ্ছি; কিন্তু পারমার্থিকভাবে ভোক্তৃরূপ নয়। 'দৃশ্য'—'তুমি' বা 'এই' এরূপ
প্রত্যয়ের আলম্বনস্বরূপ, অহঙ্কার হতে আরম্ভ করে
দেহ পর্যন্ত, তা অবিদ্যার কার্য
বলে জড়স্বরূপ। এই উভয়ের মধ্যে
যে ভেদ বা পরস্পর
বৈলক্ষণ্য, বা পৃথগ্ভাব তাকে
দৃগ্দৃশ্যের ভেদ বলছেন। এই
আবরণশক্তি সেই ভেদকে আবৃত
করে।
আবার
সত্য-জ্ঞান-অনন্ত-আনন্দ-একরসরূপাত্মক ব্রহ্ম ও সৃষ্ট প্রপঞ্চ—
তদুভয়ের পরস্পর ভিন্নস্বভাবতাকে আবৃত করে রাখে
বলে এই শক্তিকে আবরণশক্তি
বলা হয়। আবরণশক্তি হলো
যেমন একখণ্ড ছোট মেঘ, দ্রষ্টাপুরুষের
নয়নপথ আচ্ছাদিত করে অনেক যোজন
আয়তন বিশিষ্ট সূর্যমণ্ডল যেন আচ্ছন্ন হয়ে
গেছে বলে বোধ হয়,
সেরূপ অজ্ঞান পরিচ্ছিন্ন হলেও দ্রষ্টা পুরুষের
বুদ্ধিকে আচ্ছাদন করায় অসীম অসংসারী আত্মা
যেন আচ্ছাদিত হয়েছে, এরূপ বোধ করার
সামর্থকে আবরণশক্তি বলে। যেমন নিজ
অজ্ঞানের দ্বারা আবৃত রজ্জুতে সর্পভাবনার
সম্ভাবনা থাকে, সেরূপে অজ্ঞানের এই আবরণশক্তির দ্বারা
আবৃত আত্মায় কর্তৃত্ব ভোক্তৃত্ব সুখিত্ব দুঃখিত্ব প্রভৃতি সংসার সম্ভাবনাও থাকে। এই হলো আবরণশক্তির
কাজ।....
তথ্যসূত্রঃ-
১.
ভগবান্ শঙ্করাচার্য (মতান্তরে ভারতী তীর্থ) বিরচিত "দৃগ্দৃশ্যবিবেক", আনন্দগিরি ও ব্রহ্মানন্দ ভারতীকৃত
টীকা সমেত।
২. সদানন্দ যোগীন্দ্র বিরচিত বেদান্ত-সারঃ।
শ্রীশুভ
চৌধুরী
মার্চ
১৮, ২০২৪ খৃষ্টাব্দ।
No comments:
Post a Comment