Wednesday, 13 March 2024

আচার্য ভারতীতীর্থ বা আনন্দভারতীতীর্থ—

 



শঙ্করানন্দ প্রমুখ আচার্যের মেধাশক্তিতে খৃষ্টীয় ১৩শ শতকে মধ্বাচার্যের আক্রমণের বিরুদ্ধে অদ্বৈতবাদের বিজয়-শঙ্খ বেজে উঠলেও তখনও প্রতিপক্ষগণের আক্রমণ এবং প্রতিরোধ-চেষ্টা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসছিল। খৃষ্টীয় ত্রয়োদশ শতকের শেষভাগে রামানুজ সম্প্রদায়ের প্রবীণ আচার্য বেঙ্কটনাথ বা বেদান্ত-মহাদেশিকাচার্যের অভ্যুদয়ে বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ প্রবল আকার ধারণ করে। তাছাড়া মধ্বাচার্যের শিষ্য অক্ষোভ্য মুনি দ্বৈতবেদান্ত নব্যন্যায়ে অসামান্য পাণ্ডিত্য লাভ করেন। ঠিক সেই সময় ভারতী তীর্থ, বিদ্যারণ্য মুনীশ্বর প্রভৃতি অদ্বৈতাচার্যগণ আবির্ভূত হয়ে সেই প্রতিপক্ষ আক্রমণ বেগ প্রতিহত করে অদ্বৈত-শশীকে প্রতিবাদী রাহু-গ্রাস হতে মুক্ত করেন।

ভারতীতীর্থ বিদ্যারণ্য মুনির গুরু ছিলেন, একথা বিদ্যারণ্যমুনি স্বরচিত 'জৈমিনীয়ন্যায়মালাবিস্তর' নামক গ্রন্থে স্বীকার করেছেন। ভারতীতীর্থের গুরুর নাম ছিল বিদ্যাতীর্থ। গুরু পরম্পরায় বিদ্যাতীর্থের পর ভারতীতীর্থ শৃঙ্গেরী মঠের মঠাধীশ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। শৃঙ্গেরী মঠের ১৩৪৬ খৃষ্টাব্দের এক শিলালিপি হতে জানা যায় যে, বিজয়নগর রাজ্যের রাজা প্রথম হরিহর এবং তাঁর ভাতৃগণ কম্পন, প্রথম বুক্ক, মারপ মুদ্দপ ভারতীতীর্থকে ভূমিদান (প্রায় নয়টি গ্রাম দান) করেছিলেন। এটা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ভারতীতীর্থ খৃষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং শৃঙ্গেরী মঠের গুরুপীঠে শঙ্করাচার্য পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। শৃঙ্গেরী মঠের গুরুপরম্পরা হতে অবগত হওয়া যায়, ভারতীকৃষ্ণতীর্থের উক্ত মঠের গুরুপীঠে অবস্থিতিকাল ১৩২৮ খৃষ্টাব্দ হতে ১৩৮০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত। সম্ভবত ইনিই ভারতী তীর্থ আনন্দভারতীতীর্থ এই উভয় নামেই পরিচিত হন।

তিনি একশিলানগরের (বর্তমান ওয়ারঙ্গল, অন্ধ্রপ্রদেশ) বাসিন্দা ছিলেন। আচার্যের সময়কাল ছিল ভারতের ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সময়। আচার্যের শিষ্য বিদ্যারণ্যের নির্দেশনায় তখন বিজয়নগরের মহান হিন্দু সাম্রাজ্য ১৩৩৬ খৃষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আচার্য জানতেন যে হিন্দু শাসকদের দ্বারা ক্ষমতা বজায় থাকলেই ভারতের পবিত্র ধর্ম রক্ষা করা যেতে পারে। জনসাধারণের মনে আধ্যাত্মিক জাগরণ, শৃঙ্গেরি মঠের প্রভাব বৃদ্ধি ভক্তগণের মঙ্গলার্থে তিনি তখন মঠ মন্দির সংস্কারের দায়িত্ব নেন। বিজয়নগর রাজ্য প্রতিষ্ঠার সময় বিদ্যাশঙ্কর মন্দিরও নির্মিত হয়েছিল। তিনি আদি শঙ্করাচার্যের সময়কাল থেকে স্থাপিত চন্দনকাষ্ঠের মূর্তির জায়গায় ভগবতী শারদাদেবীর একটি স্বর্ণমূর্তি প্রতিস্থাপন করেছিলেন। তখন মঠ থেকে বেদাদি শাস্ত্রে পারদর্শী পণ্ডিতদের উপাধি উপহার দিয়ে ভূষিত সম্মাণিত করা হত। বিদ্যাশঙ্কর মন্দিরের অনুষ্ঠানের দিন, আচার্য ভারতীতীর্থ দানে প্রাপ্ত ভূমিকে বিভক্ত করে ১২০ জন বিদ্বান ব্রাহ্মণকে উপহার দিয়েছিলেন যারা মঠের সন্নিকটেই বসতি স্থাপন করেছিলেন। এটিই ছিল বর্তমান শৃঙ্গেরী শহরের সূচনা যা একটি আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল।

ভারতীতীর্থ 'বৈয়াসিক-ন্যায়মালা' নামে বেদান্তদর্শনের অধিকরণমালা রচনা করে প্রগাঢ় পাণ্ডিত্যের পরিচয় প্রদান করেছেন। 'বৈয়াসিকন্যায়মালা', 'পঞ্চদশী' কিয়দংশ "দৃগ্দৃশ্যবিবেক" ভারতীতীর্থ বিরচিত বলে সুপ্রসিদ্ধ। 'বৈয়াসিকন্যায়মালা' ভগবান্ শঙ্করাচার্য বিরচিত শারীরকভাষ্যের তাৎপর্য গ্রহণের পক্ষে সবিশেষ উপযোগী। এতে ব্রহ্মসূত্রের প্রত্যেক অধিকরণের পূর্বপক্ষ সিদ্ধান্ত শ্লোকাকারে নিবদ্ধ হয়েছে এবং সমগ্র গ্রন্থের তাৎপর্য চারটিমাত্র শ্লোকে সংগৃহীত হয়েছে। এটারই অনুকরণে বিদ্যারণ্যমুনি 'জৈমিনীয়ন্যায়মালাবিস্তর' রচনা করেন। সুপ্রসিদ্ধ বেদান্তপ্রকরণগ্রন্থ 'পঞ্চদশী' কোন অংশ কার বিরচিত তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। নিশ্চলদাশ বৃত্তিপ্রভাকর গ্রন্থে লিখেছেন, শেষের পাঁচ অধ্যায় ভারতীতীর্থ বিরচিত এবং পূর্ব দশ অধ্যায় বিদ্যারণ্য বিরচিত। অপ্পয় দীক্ষিত 'সিদ্ধান্তলেশসংগ্রহ' গ্রন্থে 'পঞ্চদশী' নবম অধ্যায় ধ্যানদীপ প্রকরণকে ভারতীতীর্থ বিরচিত বলে নির্দেশ করেছেন। 'দৃগ্দৃশ্যবিবেক' ভারতী তীর্থের রচিত কিনা এটা নিয়েও মতভেদ রয়েছে। টীকাকার ব্রহ্মানন্দ ভারতী তদীয় গুরু শৃঙ্গেরি পীঠাধীশ ভারতীতীর্থকেই 'দৃগ্দৃশ্যবিবেক' গ্রন্থের রচয়িতা বলে স্পষ্টতঃ নির্দেশ করেছেন। কিন্তু টীকাকার আনন্দগিরি আবার এই প্রকরণগ্রন্থকে ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য বিরচিত বলে গ্রহণ করেছেন।

"অজ্ঞানাং জাহ্নবী তীর্থং বিদ্যাতীর্থং বিবেকিনাম্।

সর্বেষাং সুখদং তীর্থং ভারতীতীর্থমাশ্রয়ে।।"

"(যিনি) অজ্ঞদের নিকট গঙ্গারূপী তীর্থ, বিবেকবানগণের নিকট সকল বিদ্যারূপী তীর্থ, (এবং) সকলের জন্যই সুখ প্রদানকারী তীর্থস্বরূপ,(সেই) ভারতীতীর্থ স্বামীকে নমষ্কার করি।"..........

তথ্যসূত্রঃ-

.  উদ্বোধন প্রকাশিত 'দৃগ্দৃশ্যবিবেক', গ্রন্থকার পরিচিতি।

. বেদান্তদর্শনঅদ্বৈতবাদ, প্রথম খণ্ড, আশুতোষ শাস্ত্রী কাব্য-ব্যাকরণ-সাংখ্য-বেদান্ততীর্থ বিদ্যাবাচস্পতি।

. https://sringeri.net/jagadgurus/the-early-acharyas

শ্রীশুভ চৌধুরী

মার্চ ১১, ২০২৪ খৃষ্টাব্দ।

No comments:

আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...