শুরুতেই
বলে রাখি, রামানুজাচার্য, মধ্বাচার্য প্রভৃতি প্রতিবাদী দার্শনিকগণ বৌদ্ধদর্শন ও অদ্বৈতদর্শনের কেবলমাত্র
একটি দিক্ দেখেই এইরূপ
একটি অনভিপ্রেত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। সেই দিক্টি হল
'নেতিবাচক' দিক্। মাধ্যমিক, যোগাচার ও অদ্বৈতবেদান্তে পরিদৃশ্যমান
বিশ্বের বাস্তব সত্যতা স্বীকৃত হয় নি, এটা
সত্য বটে। কিন্তু এই
নিষেধাত্মক দিক্টিতে মহাযান বৌদ্ধমত ও অদ্বৈতবেদান্ত মতের
অংশতঃ মিল দেখেই, বিভিন্ন
খাতে প্রবাহিত দুইটি দার্শনিক চিন্তাধারাকে এক ও অভিন্ন
বলে সিদ্ধান্ত করা বিভ্রান্তির পরিচায়ক
সন্দেহ নেই। নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ
থেকে তত্ত্ব বিচার করতে গেলে, দুইটি
বিশিষ্ট দার্শনিক মত কোন তত্ত্ব
অস্বীকার করল, শুধু তা
দেখলেই চলবে না; কোন
তত্ত্ব স্বীকার করল তাও আলোচনা
করতে হবে।
অস্বীকারের
ক্ষেত্রে মিল থাকলেও, স্বীকারের
ক্ষেত্রে যদি গুরুতর পার্থক্য
দেখা দেয়, তবে দুইটি ভিন্ন
পথগামী দর্শনকে মূলতঃ এক বলে অভিযোগ
উত্থাপন করা নিতান্তই অসমীচীন।
'নেতিবাচক'ও 'ইতিবাচক' দুইটি
দিক্ সমানভাবে বিচার করেই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে
হবে। অদ্বৈতবেদান্ত সিদ্ধান্তে বিজ্ঞানাতিরিক্ত বিজ্ঞেয় জগতের কোনরূপ বাস্তব সত্তা নেই; কিন্তু এই
বিজ্ঞান এক অদ্বিতীয় শাশ্বত
ও ধ্রুব। এই বিজ্ঞান বিশেষ্য-বিশেষণ, জ্ঞান-জ্ঞাতা-জ্ঞেয় প্রভৃতি সর্বপ্রকার সম্বন্ধের অতীত, কূটস্থ ব্রহ্মস্বরূপ। বিজ্ঞানবাদী বৌদ্ধমতে বিজ্ঞানই একমাত্র সৎ হলেও, এই
বিজ্ঞান ক্ষণিক। 'উৎপদ্য বিনশ্যতি', এটাই বৌদ্ধক্ত বিজ্ঞানের
স্বভাব। বৌদ্ধ সিদ্ধান্তে সৎ বা সত্তামাত্রই
ক্ষণিক, এবং ক্ষণিক অর্থই
অনিত্য; সুতরাং সৎ বা অস্তিত্বের
অর্থই দাঁড়াচ্ছে অনিত্য। নিত্যবস্তুর এইমতে কোনরূপ অস্তিত্বই নেই। এই বিষয়ে
সর্বদর্শনসংগ্রহে মাধবাচার্য (বিদ্যারণ্য স্বামী) কর্তৃক উদ্ধৃত বৌদ্ধাচার্য জ্ঞানশ্রীর কারিকা দ্রষ্টব্য। অদ্বৈতমত এটার সম্পূর্ণ বিপরীত।
অদ্বৈত সিদ্ধান্তে অস্তিত্ব অর্থই নিত্য। অনিত্য বস্তুর কোনপ্রকার বাস্তব অস্তিত্ব থাকতেই পারে না। যা
বাস্তবিকই সৎ, তার বিলোপ,
বিকার বা বিবর্তন ঘটতে
পারে না। এই অবস্থায়
দৃশ্যমান বিশ্বপ্রপঞ্চের তাত্ত্বিক অস্তিত্ব অস্বীকার করায় এবং একমাত্র ভূমা
বিজ্ঞানেরই সত্যতা স্বীকার করায় যদি অদ্বৈতবাদীকে বিজ্ঞানবাদী
বলে ধরে নি, তথাপি
একথা মানতে হবে যে, বিজ্ঞানবাদী
বৌদ্ধ অদ্বৈতবাদী নন, তাঁরা বহুত্ববাদী।
অপরপক্ষে, অদ্বৈতবাদীরাই কেবল অবিমিশ্র একত্ববাদী—
যা বৌদ্ধসম্মত বহুত্ববাদের সম্পূর্ণ বিপরীত।
ভগবান্
ভাষ্যকার শঙ্করাচার্য এই কথা বিচার
করেই বললেন—প্রদীপ যেমন অন্য জ্ঞাতার
জ্ঞানে ভাসে এবং প্রকাশিত
হয়, বৌদ্ধোক্ত ক্ষণিক বিজ্ঞানও সেইরূপ অপরের জ্ঞানে ভাসবে এবং প্রকাশিত হবে।
এইরূপ বিজ্ঞান স্বপ্রকাশ নয়, পরপ্রকাশ; জ্ঞানস্বরূপ
নয়, জ্ঞেয়। এইরূপ বিজ্ঞান অদ্বৈতবেদান্তীর ব্রহ্মবিজ্ঞানের মর্যাদা লাভ করতে পারে
কি করে?
সাক্ষিণোবগন্তুঃ
স্বয়ংসিদ্ধতামুপক্ষিপতা,
স্বয়ং প্রথতে বিজ্ঞানম্ ইত্যেষ এব মম পক্ষস্ত্বয়া
বাচোযুক্ত্যন্তরেণাশ্রিত
ইতি চেৎ, ন; বিজ্ঞানস্যোৎপত্তিপ্রধ্বংসানেকত্বাদিবিশেষবত্ত্বাভ্যুপগমাৎ;
অতঃ প্রদীপবদ্বিজ্ঞানস্যাপি ব্যতিরিক্তাবগম্যত্বমস্মাভিঃ প্রসাধিতম্ ৷৷ -(ব্রহ্মসূত্র-২/২/২৮, শাঙ্করভাষ্য
দ্রষ্টব্য)
অর্থাৎ
বৌদ্ধ যদি বলেন বেদান্তী
ভঙ্গীক্রমে বিজ্ঞানবাদই স্বীকার করছেন, ফলতঃ তা নয়।
কারণ এই যে, বৌদ্ধরা
বিজ্ঞানের উৎপত্তি বিনাশ ও নানাত্ব স্বীকার
করে থাকেন। আমরা বেদান্তী, আমরা
সর্ব-জ্ঞাতা সাক্ষীর উৎপত্ত্যাদি স্বীকার করি না। সাক্ষী
ও বিজ্ঞানের মধ্যে প্রভেদ থাকায় প্রদীপের ন্যায় বিজ্ঞানও স্বভিন্ন বস্তুকর্তৃক বিজ্ঞাত হয়, এটা আমরা
প্রকৃষ্টরূপে প্রতিপাদন করলাম।
ভাষ্যের
নিগূঢ় উক্তির ব্যাখ্যায় ভামতীকার বাচস্পতি মিশ্র বলছেন—"বিজ্ঞানবাদীরা বিজ্ঞানের উৎপত্তি ও বিনাশরূপ ধর্ম
স্বীকার করেন। তাহলে বিজ্ঞান ফল বা কার্য
হয়ে দাঁড়ায়। যে নিজেই ফলস্বরূপ,
তার জ্ঞাতৃত্ব থাকতে পারে না; অর্থাৎ
ক্ষণিক বিজ্ঞান কোনমতেই জ্ঞাতা হতে পারে না,
ওটা স্বপ্রকাশ এবং স্বয়ংসিদ্ধও হতে
পারে না। "
অতএব
বিজ্ঞানবাদীদের বিজ্ঞান উৎপত্তিবিনাশশীল, সুতরাং কার্যবস্তু, সেহেতু জড়পদার্থ। যা জড়, তা
অবশ্যই অন্যকর্তৃক প্রকাশিত হয়, যেমন প্রদীপ।
অদ্বৈতবেদান্তে সাক্ষী কিন্তু স্বয়ংপ্রকাশ চৈতন্যস্বরূপ, উৎপত্তিনাশরহিত, সুতরাং কূটস্থ। তাঁর আর অন্য
প্রকাশকের অপেক্ষা নেই।
বৌদ্ধ
শূন্যবাদের সহিত অদ্বৈতবাদের বৈসাদৃশ্য
আরও পরিস্ফুট। শূন্যবাদীর মতে বিজ্ঞান বা
বিজ্ঞেয় কারও কোনরূপ বাস্তব
সত্তা নেই। তত্ত্বের রাজ্যে
মহাশূন্যতায় বিরাজ করে। এই শূন্যই
একমাত্র তত্ত্ব। শূন্যবাদী বলেন যে, বিজ্ঞান
বা বিজ্ঞেয় বিশ্বপ্রপঞ্চ কারও পারমার্থিক সত্যতা
নিরূপণ করা যায় না।
সুতরাং তত্ত্ব নিরূপণ দুরূহ। পারমার্থিক তত্ত্ব নেই, শূন্যবাদীর এই
উক্তিও পরমার্থ কিনা; সকলই শূন্য এই
মতবাদও শূন্য কিনা? বৌদ্ধতার্কিক নাগার্জুন তাঁর 'বিগ্রহব্যাবর্তনী' গ্রন্থে উল্লিখিত প্রশ্নের সুনিপুণ সমাধান করেছেন। শ্রীহর্ষ প্রমুখ অদ্বৈত আচার্যগণ নাগার্জুনের যুক্তি ও বিচারশৈলী হতে
যথেষ্ট অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। কারণ, অদ্বৈতবাদের বিরুদ্ধেও অনুরূপ প্রশ্নই উঠেছে—'জগৎ মিথ্যা', এই
উক্তিটিও মিথ্যা কিনা? এই উক্তি মিথ্যা
হলে জগৎ সত্য হয়ে
দাঁড়ায়। আচার্য শ্রীহর্ষ খণ্ডনখণ্ডখাদ্যে, আচার্য মধুসূদন সরস্বতী 'অদ্বৈতসিদ্ধিতে' আলোচ্য প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। বিশেষতঃ শ্রীহর্ষের খণ্ডনরীতি যে অনেকাংশে নাগার্জুনের
খণ্ডনশৈলীরই অনুরূপ তাতে সন্দেহের অবকাশ
নেই। অদ্বৈতবাদকে বৌদ্ধ মতবাদরূপে অভিযুক্ত করার পিছনে এটাও
একটা কারণ বলে আমাদের
মনে হয়।
শূন্যবাদের
সিদ্ধান্তে বস্তুতত্ত্বের সত্যতা অসম্ভব পরিকল্পনা। অদ্বৈতবাদে পরমার্থ সত্যতা শুধু সম্ভব তাই
নয়, এটা স্বয়ংভব, স্বয়ংজ্যোতিঃ,
ধ্রুব, নিত্য এবং আনন্দঘন বিজ্ঞানস্বরূপ
ব্রহ্ম। শূন্যবাদের খণ্ডন প্রসঙ্গে বাচস্পতি মিশ্র বলেছেন— শূন্যবাদীর দর্শনে ভ্রমের বা নিষেধের কোনও
প্রকার নিশ্চিত ভিত্তি নেই। কিন্তু অদ্বৈতবেদান্তী
ভ্রমের অধিষ্ঠানরূপে এক অদ্বিতীয় ভূমা
বিজ্ঞানসত্তা স্বীকার করেছেন।
আচার্য
শ্রীহর্ষ 'খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্' গ্রন্থে বলেছেন— এইভাবে প্রমাণাদি প্রপঞ্চের অসত্তা স্বীকার করলেও সৌগত (বৌদ্ধ) ও ব্রহ্মবাদীর (বেদান্তীর)
মধ্যে পার্থক্য এই যে, শূন্যবাদী
বৌদ্ধগণ জ্ঞান জ্ঞেয়াত্মক নিখিল প্রপঞ্চকেই অনির্বচনীয় (মিথ্যা) রূপে বর্ণনা করেন,
যা বুদ্ধদেবের লঙ্কাবতার সূত্রে বর্ণিত আছে—'বুদ্ধি হতে
বিবেচিত অর্থাৎ জ্ঞান হতে ভিন্নরূপে বিষয়ীভূত
পদার্থসমূহের কোন স্বভাব অর্থাৎ
স্বরূপ নির্ণয় করা যায় না,
তেমনি বুদ্ধিও (জ্ঞানও) বিচারসহ নয়। অতএব তারা
(জ্ঞান ও জ্ঞেয়) উভয়ই
নিরভিলপ্য অর্থাৎ অনির্বচনীয় এবং নিঃস্বভাব (স্বরূপহীন)।'
কিন্তু
অদ্বৈতবাদীগণ বলেন যে, বিজ্ঞেয়
মিথ্যা হলেও বিজ্ঞান সত্য,
স্বয়ংজ্যোতিঃ এবং ধ্রুব। বিজ্ঞান
ব্যতিরিক্ত এই বিশ্বপ্রপঞ্চ সদসদ্বিলক্ষণ
অর্থাৎ অনির্বাচ্য (মিথ্যা)। যুক্তি এই
যে, এই বিশ্ব সৎ
হতে পারে না, যেহেতু
বক্ষ্যমাণ বহুদোষ কলুষিত। শশশৃঙ্গাদির ন্যায় অসৎও হতে পারে
না, কেননা তাহলে লৌকিক ও বিচারকগণের সমস্ত
ব্যবহারের ব্যাঘাত ঘটে।
অদ্বৈত
ও বৌদ্ধ দর্শনে আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈসাদৃশ্য হল তত্ত্ব ও
তর্কের মধ্যে সম্পর্ক বিষয়ে। মাধ্যমিক বৌদ্ধাচার্য নাগার্জুনও তত্ত্বের ব্যাখ্যায় বিচার ও বিশ্লেষণের গণ্ডীর
বাইরে যেতে চান নি।
তর্কের বাইরে তত্ত্ব নেই, এটা তাঁরও
অভিমত। কিন্তু অদ্বৈতসিদ্ধান্তে তত্ত্ব তর্কের সীমার বাইরে। তর্কের পটভূমিতে সত্যের প্রতিষ্ঠা সম্ভবপর নয় বলেই, অদ্বৈতবেদান্তী
দৃশ্যমান অনির্বচনীয় বিশ্বপ্রপঞ্চের আধাররূপেও এক অদ্বিতীয় স্বপ্রকাশ
বিজ্ঞানময় তত্ত্ব স্বীকার করেছেন। ঐ বেদান্তবেদ্য তত্ত্ব
তর্কের অগম্য।
সুতরাং
দুইটি সম্পূর্ণ ভিন্ন দার্শনিক প্রস্থানের মধ্যে কোন সিদ্ধান্তে আংশিক
সাদৃশ্য থাকলেই যদি দুটি দর্শন
এক হয়ে যেত, তবে
পৃথিবীর সকল দার্শনিক মতবাদই
মিলেমিশে একাকার হয়ে যেত। দ্বৈতবাদীরাও
স্বীকার করে থাকেন যে,
বিজ্ঞানে বিজ্ঞেয় বিষয় প্রতিভাসিত হয়, যেটা বৌদ্ধ
বিজ্ঞানবাদীরা স্বীকার করে। তাহলে তো
দ্বৈতবাদীরাও বিজ্ঞানবাদী। বহির্জগতের বস্তুসত্ত্বা অস্বীকার করার জন্য যদি
বিজ্ঞানবাদ ও অদ্বৈতবাদ এক
হয়ে যায়, তবে পরিদৃশ্যমান বিশ্বের
বাস্তব সত্তা স্বীকার করার জন্য চার্বাকদর্শন
ও দ্বৈতদর্শন এক বা অভিন্ন
হয়ে যায় না কেন?
প্রভাকরের মতে অনুভূতিই প্রমাণ।
বৌদ্ধ ও জৈন মতে
জ্ঞানই প্রমাণ, তাহলে কি বৌদ্ধ ও
জৈন দর্শন এক? জৈনগণ ভেদাভেদবাদী,
কুমারিলও ভেদাভেদবাদী। চার্বাক সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বর মানে না, পূর্বমীমাংসকেরাও
সর্বজ্ঞ ঈশ্বর মানে না। অতএব
যেই যুক্তিতে অদ্বৈত ও বৌদ্ধ এক
দর্শন, সেই একই যুক্তিতে
প্রভাকর অর্ধেক চার্বাকপন্থী এবং অর্ধেক বৌদ্ধপন্থী।
কুমারীল অর্ধেক জৈনপন্থী ও অর্ধেক চার্বাকপন্থী।
এইরূপে প্রতিবাদীর যুক্তির অসারতা প্রদর্শন করে, যাঁরা অদ্বৈতবেদান্তকে
প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধমত বলে উপহাস করেছেন,
তাঁদেরকে আচার্য প্রকাশাত্মযতি তদীয় পঞ্চপাদিকা বিবরণে কঠোর ভাষায় তিরস্কার
করেছেন।.......
তথ্যসূত্রঃ-
১.
ভগবান শঙ্করাচার্যের "শারীরকমীমাংসা ভাষ্য", আচার্য প্রকাশাত্ম যতির "পঞ্চপাদিকা বিবরণ" ও বাচস্পতি মিশ্রের
"ভামতী"।
২.
আচার্য শ্রীহর্ষের "খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্"।
৩.
"বেদান্তদর্শন—অদ্বৈতবাদ", তৃতীয় খণ্ড, আশুতোষ শাস্ত্রী।
শ্রীশুভ
চৌধুরী
নভেম্বর
১৪, ২০২৪ খৃষ্টাব্দ।