Saturday, 27 September 2025

অমলানন্দ স্বামী—

 


অদ্বৈতবেদান্তের আরেকটি উজ্জ্বল নক্ষত্র হলো অমলানন্দ স্বামী। বেদান্ত কল্পতরুর রচয়িতা অমলানন্দ স্বামী খৃষ্টীয় ত্রয়োদশ শতকের শেষভাগে দক্ষিণ ভারতে জন্মগ্রহণ করেন। আচার্যের অপর নাম ব্যাসাশ্রম। যাদববংশীয় রাজা শ্রীকৃষ্ণের সময় অমলানন্দ কল্পতরু রচনা করেন। তিনি কল্পতরুর আরম্ভে গ্রন্থের রচনাকাল নির্দেশ করেছেন। তিনি রাজা শ্রীকৃষ্ণ বলে সম্ভবতঃ যাদবরাজ রামচন্দ্রকে গ্রহণ করেছেন। রাজা রামচন্দ্র মহাদেবের ভ্রাতা। রামচন্দ্রের পূর্বে মহাদেব দেবগিরির রাজা ছিলেন মহাদেবের নামও অমলানন্দ কল্পতরুর আরম্ভ শ্লোকে উল্লেখ করেছেন। এটা দ্বারা অমলানন্দ উভয়ের রাজত্বকালেই গ্রন্থ রচনা করেছিলেন, এরূপ মনে করা অস্বাভাবিক নয়। মহাদেব ১২৬০ থেকে ১২৭১ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন, পরে রামচন্দ্র রাজা হন। এটা হতে অমলানন্দ স্বামীর আবির্ভাবকালও খৃষ্টীয় ত্রয়োদশ শতকের শেষ ভাগ বলে নিশ্চয় করা যায়।

অমলানন্দের গুরুর নাম অনুভবানন্দ, আর বিদ্যাগুরু সুখপ্রকাশ। সুখপ্রকাশ চিৎসুখাচার্যের শিষ্য, সুতরাং অমলানন্দ চিৎসুখাচার্যের প্রশিষ্য ছিলেন। অমলানন্দ বাচস্পতি মিশ্রের ভামতী টীকার উপর 'বেদান্তকল্পতরু' নামে এক পূর্ণাঙ্গ টীকা প্রণয়ন করেন। কল্পতরু ব্যতীত অমলানন্দ 'শাস্ত্রদর্পণ' নামে একখানা গ্রন্থ রচনা করেন। শাস্ত্রদর্পণে ব্রহ্মসূত্রের প্রত্যেক অধিকরণের বাচস্পতি-মতানুযায়ী তাৎপর্য অতি প্রাঞ্জল ভাষায় অমলানন্দ বিবৃত করেছেন। তাছাড়া পদ্মপাদাচার্যের পঞ্চপাদিকার উপর 'পঞ্চপাদিকা-দর্পণ' নামে একখানা টীকা রচনা করে অমলানন্দ স্বামী ভগবান্ শঙ্করাচার্যের ভাষ্যধারার বিশেষ পুষ্টিসাধন করেছিলেন বলে জানা যায়। এই কল্পতরুর উপর অপ্পয় দীক্ষিত 'কল্পতরু-পরিমল' খৃষ্টীয় ১৭শ শতকে কোণ্ডভট্টের পুত্র লক্ষ্মীনৃসিংহ 'আভোগ' নামে টীকা রচনা করে কল্পতরুর দানভাণ্ডার পূর্ণ করেছেন। লক্ষ্মীনৃসিংহ তদীয় টীকা রচনায় অনেক স্থলে অপ্পয় দীক্ষিতের বেদান্ত-কল্পতরু-পরিমলের প্রভাবে প্রভাবিত হয়েছিল বলে মনে হয়।.....

তথ্যসূত্রঃ-

. বেদান্তদর্শনঅদ্বৈতবাদ, প্রথম খণ্ড, আশুতোষ ভট্টাচার্য শাস্ত্রী বিদ্যাবাচস্পতি।

. অদ্বৈতসিদ্ধি মধুসূদন সরস্বতী, শ্রীব্যোমকেশ ভট্টাচার্য, ভাগবত-রত্ন।

শ্রীশুভ চৌধুরী

সেপ্টেম্বর ১৯, শুক্রবার, ২০২৫ খৃষ্টাব্দ।

শ্রীধর স্বামী—

 


শ্রীমদ্ভাগবতের প্রাচীনতম প্রসিদ্ধ টীকাকার ছিলেন শ্রীধর স্বামী। শ্রীধর স্বামীকৃত ভাগবতের এই অপূর্ব টীকাই ব্যাস-বিরচিত শ্রীমদ্ভাগবতকে আরও মাধুর্যমণ্ডিত করে তুলেছিল। তাঁর রচিত এই টীকার নাম 'ভাবার্থদীপিকা' তিনি ভাগবতের পাশাপাশি বিষ্ণুপুরাণের 'আত্মপ্রকাশ' টীকা শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার 'সুবোধিনী' টীকা রচনা করেন। তাঁকে ভট্টিকাব্যের রচয়িতা বলা হয়। তিনি 'ব্রজবিহার' প্রভৃতি গ্রন্থের রচয়িতা বলেও কথিত হয়। এতদ্ব্যতীত শ্রীধর স্বামী রচিত শ্রীকৃষ্ণ নাম প্রেম মাহাত্ম্য সূচক কয়েকটি শ্লোক শ্রীরূপগোস্বামী শ্রীপদ্যাবলীতে আহরণ করেছেন।

শ্রীধর স্বামীর টীকায় চিৎসুখাচার্যের নাম বিদ্যারণ্য মুনীশ্বরের বৃহদারণ্যক বার্তিকসারের উদ্ধৃতির উল্লেখ পাওয়া যায়, তাই তাঁর সময়কাল খৃষ্টীয় ১৪শ শতকে বলা যেতে পারে। তিনি গুর্জর দেশবাসী মহারাষ্ট্রীয় ব্রাহ্মণ। তিনি ছিলেন ধনাঢ্য ব্যক্তি। একদা গৃহে প্রত্যাবর্তন কালে দস্যু কর্তৃক আক্রান্ত হলে ধনুর্ধারী শ্রীধর তাঁকে রক্ষা করেন। প্রভুর লীলা দর্শনে তিনি হরি ভজনার্থ সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। তৎকৃত গ্রন্থ হতে জানা যায় যে, তিনি কেবলাদ্বৈতবাদী কাশীবাসী দণ্ডী সন্ন্যাসী ছিলেন। তাঁর গুরুর নাম পরমানন্দ পুরী। ভাগবতের টীকার মঙ্গলাচরণে তিনি শ্রীগুরুর নাম উল্লেখ করেছেন

"মূকং করোতি বাচালং পঙ্গুং লঙ্ঘয়তে গিরিম্।

যৎ কৃপা তমহং বন্দে পরমানন্দ মাধবম্।"

যাঁর কৃপা মূককে বাচাল করে, পঙ্গুকে গিরি লঙ্ঘন করায়, সেই পরমানন্দরূপী গুরুদেব ইষ্টদেব  মাধবকে আমি বন্দনা করি।

তিনি ভগবান্ নৃসিংহদেবের উপাসক ছিলেন। কাশীতে বিন্দুমাধবের মন্দিরে অবস্থানকরতঃ তাঁর সন্তোষার্থ অদ্বৈতবাদী চিৎ-সুখাচার্যের ব্যাখ্যা আলোচনা করে বিষ্ণুপুরাণের 'আত্মপ্রকাশ' টীকা রচনা করেন। তিনি এই টীকার মঙ্গলাচরণে স্পষ্ট বলেছেন

শ্রীবিন্দুমাধবং বন্দে পরমানন্দবিগ্রহম্।

বাচং বিশ্বেশ্বরং গঙ্গাং পরাশরমুখান্ মুনীন্।।

শ্রীমচ্চিৎসুখযোগিমুখ্যরচিতব্যাখ্যাং নিরীক্ষ্য স্ফুটং

তন্মার্গেণ সুবোধসংগ্রহবতীমাত্মপ্রকাশাভিধাম্।

পরমানন্দমূর্তি শ্রীবিন্দুমাধবকে বন্দনা করছি। সরস্বতী, বিশ্বেশ্বর শিব, গঙ্গা, পরাশরাদি মুখ্য মুনীদেরও বন্দনা করছি। শ্রীমদ্ চিৎসুখযোগী রচিত মুখ্য ব্যাখ্যা নিরীক্ষণ করে তদ্দ্বারা স্ফুটিত মার্গের দ্বারা সুবোধ সংগ্রহবতী এই ব্যাখ্যা প্রকাশ করাই অভিধেয়।

অতএব শ্রীধর স্বামী যে ভগবান্ শঙ্করাচার্যের ভাষ্যধারার অনুগামী তা সুস্পষ্ট। বিষ্ণুপুরাণের টীকায় চিৎসুখাচার্যের নামের পাশাপাশি তাঁর রচিত শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার সুবোধিনী টীকায় সুরেশ্বরাচার্যের নৈষ্কর্মসিদ্ধি, বিদ্যারণ্য মুনীশ্বরের বৃহদারণ্যক বার্তিকসারের উদ্ধৃতির স্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায়। তাছাড়া তিনি 'সুবোধিনী' টীকার মঙ্গলাচরণে স্পষ্ট বলেছেন ভগবান্ ভাষ্যকার শঙ্করাচার্য তদীয় পরম্পরার ব্যাখ্যাকারীর মত অবগত হয়ে এই গীতা শাস্ত্রের ব্যাখ্যা তিনি প্রারম্ভ করেছেন।

ভাষ্যকারমতং সম্যক্ তদ্ব্যাখ্যাতুর্গিরস্তথা।

যথামতি সমালোক্য গীতাব্যাখ্যাং সমারভে ।।

আমি ভাষ্যকারের (শঙ্করাচার্যের) মত তাঁর ব্যাখ্যাকারীর বাক্য যথাযথভাবে অবগত হয়ে এই গীতাশাস্ত্রের ব্যাখ্যা আরম্ভ করলাম। 

তবে উল্লেখ্য যে, শ্রীধর স্বামী কি শঙ্কর পরম্পরার কেবলাদ্বৈতবাদী ছিলেন? না বিষ্ণুস্বামী পরম্পরার শুদ্ধাদ্বৈতবাদী ছিলেন?—এটা নিয়ে সম্প্রদায়ভিত্তিক বাদবিতণ্ডা রয়েছে। সর্বোপরি তিনি নিঃসন্দেহে ভারতের অদ্বিতীয় পণ্ডিত ছিলেন। অদ্যাবধি তাঁর টীকার উপর মন্তব্য করার সাহস কারও হয় নি। স্বয়ং শ্রীচৈতন্যদেব ভাগবতের টীকার ক্ষেত্রে শ্রীধরস্বামীর টীকাকেই অভ্রান্তভাবে অনুমোদন করে গেছেন তাকে গুরুপদে মেনেছিলেন। শ্রীধরস্বামীর অনুগত ভাষ্য না লেখায় তিনি বল্লভাচার্যকে তিরস্কার করে বলেছিলেন

"শ্রীধরস্বামী প্রসাদেতে ভাগবত জানি।

জগৎগুরু শ্রীধরস্বামী গুরু করি মানি।।

শ্রীধর উপরে গর্বে যে কিছু লিখিবে।

অর্থ-ব্যস্ত লিখন সেই, লোকে না মানিবে।।

শ্রীধরের আনুগত্যে যে করে লিখন।

সব লোক মান্য করি করিবে গ্রহণ।।

শ্রীধরানুগত্যে কর ভাগবতব্যাখ্যান্।

অভিমান ছাড়ি ভজ কৃষ্ণ ভগবান।।"

-(চৈতন্য চরিতামৃত)...

তথ্যসূত্রঃ-

. "অদ্বৈতসিদ্ধি মধুসূদন সরস্বতী", শ্রীব্যোমকেশ ভট্টাচার্য, ভাগবত-রত্ন।

. "অদ্বৈতসিদ্ধিঃ", প্রথমভাগ,পণ্ডিত রাজেন্দ্রনাথ ঘোষের ভূমিকা।

. শ্রীমদ্ভাগবতম্ শ্রীধরী টীকা সমেত, প্রথম স্কন্ধ, উদ্বোধন কার্যালয়।

শ্রীশুভ চৌধুরী

সেপ্টেম্বর ১৫, সোমবার, ২০২৫ খৃষ্টাব্দ।

Photo editing credit Thākur Vishāl

Saturday, 6 September 2025

'শঙ্করাচার্যের অনির্বাচ্যবাদ বৌদ্ধের নিকট ধার করা'—এই অপবাদের নিরসনঃ-

 


অনেকে মনে করেন ভগবান্ শঙ্করাচার্যের অনির্বাচ্যবাদ্ বৌদ্ধোক্ত মায়াবাদ বা চতুষ্কোটি বিনির্মুক্ত শূন্যবাদ হতে গৃহীত হয়েছে। 'লঙ্কাবতারসূত্র', 'প্রজ্ঞাপারমিতা' প্রভৃতি গ্রন্থে অনির্বাচ্য মায়াবাদের বিবরণ দেখতে পাওয়া যায়। এই সকল প্রাচীন বৌদ্ধগ্রন্থ হতেই আচার্য শঙ্কর অনির্বাচ্যবাদ এবং জগন্মিথ্যাত্ববাদ্ গ্রহণ করে, তাঁর অদ্বৈতবেদান্ত মত প্রচার করেছেন বলে ধারণা এদের। অদ্বৈতদর্শনের ব্যাখ্যায় শঙ্করের নিজস্ব কোন দান নেই বলে দাবি করেন এরা।

এই অপবাদের নিরসনে বলবভারতীয় দর্শন চিন্তায় ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্যের অবদান কতখানি তা নিশ্চয়ই সুধীপাঠকের অজানা নয়। স্বীকারই করলাম যে অনির্বাচ্যবাদ শঙ্করের উদ্ভাবিত নয়, কিন্তু তার জন্য বৌদ্ধের নিকট ধার করতে হবে কেন? ঋগ্বেদীয় প্রসিদ্ধ 'নাসদীয় সূক্তে' অনির্বাচ্যবাদের মূলসূত্র নিহিত আছে।

নাসদাসীন্নোসদাসীত্তদানীম্।। আনীদবাতং স্বধয়া তদেকং তস্মাদ্ধান্যন্নপরং কিঞ্চনাস। ঋগ্বেদ্ ১০ম মণ্ডল, ১৩৯ সূক্ত, ১ম ২য় মন্ত্র।

উল্লেখিত মন্ত্রের ব্যাখ্যায় সায়নাচার্য স্পষ্টই বলেছেন যে, সৃষ্টির ঊষায় জাগতিক বস্তুসকল সত্যরূপেও নির্ধারণের যোগ্য ছিল না, আবার আকাশ কুসুমের ন্যায় অসৎও ছিল না। সমস্ত বস্তুরাজিই তখন অনির্বাচ্য ছিল—"উভয়বিলক্ষণমনির্বাচ্যমাসীৎ' সায়নভাষ্য আলোচ্য শ্রুতিতেই অনির্বাচ্যবাদের স্পষ্ট নির্দেশ আছে। আচার্য মধুসূদন সরস্বতী উল্লেখিত শ্রুতিদ্বয়কেই অনির্বাচ্যের শ্রৌত প্রমাণরূপে  'অদ্বৈতসিদ্ধিতে' উল্লেখ করেছেন।......

তথ্যসূত্রঃ- বেদান্তদর্শনঅদ্বৈতবাদ, তৃতীয় খণ্ড, আশুতোষ শাস্ত্রী বিদ্যাবাচস্পতি।

শ্রীশুভ চৌধুরী

আগস্ট ২২, শুক্রবার, ২০২৫ খৃষ্টাব্দ।

'ব্রহ্ম অনন্ত-গুণময়, তিনি কোনমতেই নির্গুণ নির্বিশেষ হতে পারেন না'—এই আপত্তির খণ্ডনঃ-

বৈষ্ণববেদান্তী রামানুজাচার্য, মধ্বাচার্য প্রভৃতির মতে ব্রহ্ম অনন্ত-গুণময়, তিনি কোন মতেই নির্গুণ নির্বিশেষ হতে পারে না। 'নির্গুণং নিষ্ক্রিয়ং শান্তং নিরবদ্যং নিরঞ্জনম্' প্রভৃতি শ্রুতি ব্রহ্মের গুণশূন্যতা বুঝায় না। ব্রহ্মে কোনরূপ নিকৃষ্ট গুণ বা নীচ ক্রিয়া নেই, ব্রহ্মে নিরতিশয় অসংখ্য কল্যাণগুণেরই সমাবেশ আছে, এটাই বোঝায়। 'নির্' শব্দের স্বাভাবিক 'নিষেধ' অর্থ পরিত্যাগ করে 'নিকৃষ্ট' অর্থ গ্রহণ করায়, রামানুজ প্রভৃতি আচার্যরা যে শব্দার্থের সহজবোধ্য রীতি পরিত্যাগ করে কষ্ট কল্পনার আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন, তা সুধী পাঠক অবশ্য লক্ষ্য করবেন।

উপনিষদে ব্রহ্মের সগুণ নির্গুণ এই দ্বিবিধভাবেরই পরিচয় পাওয়া যায়। এই দুটি বিভাব আলোক অন্ধকারের মত পরস্পর বিরোধী। দুইটি কখনই সমানভাবে সত্য হতে পারে না। নির্গুণ নির্বিশেষ ব্রহ্মই পারমার্থিক সত্য; ব্রহ্মের সগুণভাব মায়িক। স্থূলদর্শী সাধকের উপাসনার সুবিধার জন্য ব্রহ্মের সগুণ ভাবের কল্পনা করা হয়ে থাকে। এই বিষয়ে শাস্ত্রপ্রমাণ

প্রত্যস্তমিতভেদং যৎ সত্তামাত্রমগোচরম্।

বচসামাত্মসংবেদ্যং তজ্জ্ঞানং ব্রহ্ম সংজ্ঞিতম্।।

তচ্চ বিষ্ণোঃ পরং রূপমরূপস্যাজমক্ষরং।

বিশ্বরূপাচ্চ বৈরূপ্যলক্ষণং পরমাত্মনঃ।।

তদ্যোগযুজা শক্যং নৃপ চিন্তয়িতুং যতঃ।

ততঃ স্থূলং হরে রূপং চিন্তয়েদ্ বিশ্বগোচরম্।

-(বিষ্ণুপুরাণ-//৫৩-৫৫)

যা সর্বপ্রকার ভেদসম্পর্করহিত, কেবল সৎস্বরূপ, বাক্যের অগোচর এবং আত্মপ্রত্যয়-বেদ্য, সেই জ্ঞানই ব্রহ্ম নামে পরিচিত। রূপহীন বিষ্ণুর এটাই নিত্য পরমরূপ এবং তা সমস্ত বিশ্বরূপ হতে বিলক্ষণ। প্রথমতঃ যোগী ব্যক্তি সেই পরমরূপ চিন্তা করতে সমর্থ হন না বলেই পরমাত্মা শ্রীহরির স্থূলরূপই চিন্তা করবেন।

তর্কের ভিত্তিতে বিচার করলে দেখা যায় যে, নির্গুণকে বুঝতে গেলেই সগুণকে জানা প্রয়োজন হয়। যিনি ঘট জানেন না, এরূপ ব্যক্তি ঘটের অভাব বুঝতে পারেন না। অভাবের জ্ঞান তার প্রতিযোগীর জ্ঞানকে অপেক্ষা করে। যার অভাব বুঝা যায়, তাকে অভাবের প্রতিযোগী বলে। নির্গুণ বাক্য দ্বারা উপনিষদে ব্রহ্মে সর্ববিধ গুণের নিষেধ করা হয়েছে। নিষেধের কোন বিষয় না থাকলে, কার নিষেধ তা না বুঝালে, নিষেধের সেক্ষেত্রে কোনই অর্থ হয় না। সগুণ বাক্যের দ্বারা ব্রহ্মের যে সকল গুণরাজি বর্ণিত হয়েছে, নির্গুণ বাক্যে সেই সমুদয় গুণেরই নিষেধ সূচিত হয়েছে। সগুণ বাক্য না থাকলে, নির্গুণ বাক্যের অবতারণাই অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়।

ব্রহ্মের গুণ-সম্পর্ক কল্পিত না হলে, সত্য স্বাভাবিক গুণের নিষেধ কোন মতেই সম্ভবপর হয় না। সে অবস্থায় গুণের নিষেধে গুণীরও নিষেধ হয়ে যায়। আবার সগুণবাক্যের প্রাধান্য দিলে, উপনিষদে যে অসংখ্য নির্গুণবাক্য দেখতে পাওয়া যায়, তা নির্বিষয় এবং অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়। এমতাবস্থায় অদ্বৈতবাদীর দৃষ্টিতে নির্গুণ বাক্যের প্রাধান্য স্বীকার করলে, উপাসনা জগতে সগুণ ব্রহ্মবোধক বাক্যেরও নির্দিষ্ট স্থান পাওয়া যায়। সগুণ এবং নির্গুণ কোনরূপ উপনিষদের উক্তিই মিথ্যা এবং অপ্রমাণ হয় না। আচার্য মধুসূদন সরস্বতী বলেছেন"সগুণবাক্যানাম্ ঔপাধিকগুণবিষয়েত্বেন স্বাভাবিকনির্ধর্মকত্বশ্রুতের্নবিরোধঃ। (অদ্বৈতসিদ্ধি)

এই অবস্থায় প্রথমতঃ সগুণ ব্রহ্মবাদ স্বীকার করে নিয়ে, চরমভূমিতে নির্গুণ নির্বিশেষ ব্রহ্মবোধক বাক্যকেই প্রমাণ বলে গ্রহণ করা সমধিক যুক্তিসঙ্গত নয় কি? ব্রহ্মের সগুণভাবই সত্য, নির্গুণভাব মিথ্যা, এইরূপ কল্পনা নিতান্তই অসঙ্গত।

 'সর্বকর্মা সর্বকামঃ সর্বগন্ধঃ সর্বরসঃ'-(ছান্দোগ্য উপনিষদ্-৩।১৪।২) প্রভৃতি শ্রুতি ব্রহ্মের সগুণভাব প্রকাশ করছে। "নিষ্কলং নিষ্ক্রিয়ং শান্তং নিরবদ্যং নিরঞ্জনম্"-( শ্বেতাশ্বতর উপনিষৎ-৬।১৯) ইত্যাদি শ্রুতি দ্বারা ব্রহ্মের নির্বিশেষ ভাব প্রতিপাদিত হয়েছে। এই অবস্থায় কোন শ্রুতিবাক্য দুর্বল, কোনটি প্রবল? তা বিচার করতে গেলে দেখা যায় যে, প্রথমতঃ ব্রহ্মের গুণ বর্ণনা না করলে, নির্গুণ বাক্যে গুণের যে নিষেধ করা হয়েছে, তার তো কোন অর্থ হয় না। সুতরাং গুণ থাকলে তবেই তো ওটার নিষেধ হবে? গুণ না থাকলে নিষেধ হবে কার? নির্গুণ সুতরাং সগুণকে অপেক্ষা করে। এই অবস্থায় "অপচ্ছেদ" ন্যায় অনুসারে গুণসাপেক্ষ নির্গুণ বাক্য যে সগুণ বাক্য অপেক্ষা প্রবল, তাতে সন্দেহ কি? সেই প্রবল নির্গুণ বাক্যের দ্বারা সগুণ বাক্যের বাধ হবে, এটাই তো স্বাভাবিক। ননু নির্গুণবাক্যং সগুণবাক্যং বাধতে, তু সগুণবাক্যং তদিতি কিমত্র নিয়ামকম্? নিষেধকতয়া নির্গুণবাক্যং প্রবলম্, 'অসদ্বা' ইত্যাদিবাক্যস্য সদেব ইত্যাদিবাক্যাৎ প্রাবল্যাপত্তেরিতি চেন্ন, অপচ্ছেদন্যায়েন প্রাবলস্য প্রাগেবোক্তেঃ। (অদ্বৈতসিদ্ধি)

"অপচ্ছেদ" ন্যায়টি মীমাংসা দর্শনের একটি ন্যায়। অপচ্ছেদ শব্দের অর্থ বিরোধ বা ব্যাঘাত। পূর্ববর্তী পরবর্তী উক্তির মধ্যে অপচ্ছেদ ঘটলে, পূর্বটি দুর্বল এবং পরবর্তী উক্তিটি সবল হয়ে থাকে। উপরিউক্ত ছান্দোগ্য শ্রুতির ব্রহ্মের সবিশেষতা সম্পাদক গন্ধ রূপরসাদি উপাধিসকল অবিদ্যা কর্তৃক প্রত্যুপস্থাপিত। সুতরাং নির্বিশেষ ব্রহ্মই বেদান্ত প্রতিপাদ্য, সবিশেষতা উপাসনার সৌকর্যের জন্য। যেহেতু সকল স্থলেই অর্থাৎ উপনিষদ্ সকলে ব্রহ্মস্বরূপ প্রতিপাদনপর 'অশব্দমস্পর্শমরূপমব্যয়ম্'-(কঠ উপনিষৎ-১।৩।১৫) অর্থাৎ 'শব্দরহিত, স্পর্শরহিত, রূপবিহীন, ক্ষয়রহিত' ইত্যাদি এই বাক্যসকলে যা হতে সমস্ত বিশেষ নিরাকৃত হয়েছে, সেই ব্রহ্মই উপদিষ্ট হচ্ছেন। কিন্তু সাকার অর্থাৎ সপ্রপঞ্চ সবিশেষ ব্রহ্মবিষয়ক অন্যান্য বাক্যসকল তৎপ্রধান নয় অর্থাৎ প্রধানভাবে সবিশেষতা প্রতিপাদন করে না, যেহেতু তারা প্রধানভাবে উপাসনাবিধি প্রতিপাদন করে অর্থাৎ বিধিবোধিত উপাসনার অঙ্গরূপে ব্রহ্মকে সমর্পন করে।

আরেকটি বিষয় এই যে, সগুণ নির্গুণ ব্রহ্ম ভিন্ন তত্ত্ব নয়। যিনি স্বতঃ নির্গুণ নির্বিশেষ, তিনিই মায়া উপাধি গ্রহণ করে সগুণ সবিশেষ হন। এই সগুণভাব তাঁর লীলা মাত্র। লীলাময়, সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান পরমেশ্বরই প্রাণিগণের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে স্বেচ্ছানুরূপ মায়িক দেহ ধারণ করে জগতের রঙ্গমঞ্চে অবতীর্ণ হন, 'স্যাৎ পরমেশ্বরস্য অপি ইচ্ছাবশাৎ মায়াময়ং রূপং সাধকানুগ্রহার্থম্'-(ব্রহ্মসূত্র শাঙ্করভাষ্য-..২০) অর্থাৎ সাধকদের অনুগ্রহ করবার জন্য পরমেশ্বরেরও মায়াময়রূপ সম্ভব হয়। ত্রিগুণময়ী জগজ্জননী মায়াকে বশীভূত করে জগতের সৃষ্টিলীলায় প্রবৃত্ত হন। স্বয়ং ভগবান্ বলেছেন

"অজোঽপি সন্নব্যয়াত্মা ভূতানামীশ্বরোঽপি সন্। প্রকৃতিং স্বামধিষ্ঠায় সম্ভবাম্যাত্মমায়য়া"-(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা-/)

অর্থাৎ 'আমি অজ অর্থাৎ জন্মরহিত হয়েও; অব্যয়াত্মা অর্থাৎ যাঁর জ্ঞানশক্তির ক্ষয় নেই এইরূপ অক্ষীণ জ্ঞানশক্তি স্বভাব হয়েও; ব্রহ্মাদি থেকে তৃণ পর্য্যন্ত সর্ব্বভূতের ঈশ্বর হয়েও; আমার যে স্বপ্রকৃতি, অর্থাৎ ত্রিগুণাত্মিকা বৈষ্ণবী মায়া, সমস্ত জগৎ যার বশে বর্তমান, যদ্দ্বারা মোহিত হয়ে লোকে নিজের আত্মা বাসুদেবকে জানতে পারে না, সেই নিজ প্রকৃতিতে অধিষ্ঠিত হয়ে অর্থাৎ তাঁকে বশীভূত করে আমি সম্ভাবিত হই অর্থাৎ আত্মমায়ার দ্বারা যেন লোকবৎ দেহধারণ করে জন্মগ্রহণ করি; কিন্তু পরমার্থতঃ নয়।'

তিনি দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন ধর্মের গ্লানি দূর করবার জন্য জগতের বক্ষে আবির্ভূত হন। "ধর্ম্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে"-(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা-/) অর্থাৎ 'ধর্ম্মের সম্যক্ স্থাপনের জন্য প্রতিযুগে আমি সম্ভাবিত হই অর্থাৎ অবতীর্ণ হই।'

তিনি মায়াধীশ তাঁর উপর মায়ার কোন প্রভাব নেই। তিনি মায়ার সাক্ষী মাত্র। এইজন্য ব্রহ্মের এই সগুণলীলা দ্বারা তাঁর নিত্য-শুদ্ধ-বুদ্ধ-মুক্তস্বভাবের কোন বিচ্যুতি হয় না।

যেহেতু 'মায়া হ্যেষা ময়া সৃষ্টা যন্মাং পশ্যসি নারদ৷ সর্বভূতগুণৈর্যুক্তং মৈবং মাং জ্ঞাতুমর্হসি'-(মহাভারত শান্তিপর্ব-৩৩৯/৪৫-৪৬)

অর্থাৎ "হে নারদ! সর্বভূতের গুণসকলের দ্বারা যুক্তরূপে তুমি যে আমাকে দেখছ, এটা মৎকর্তৃক সৃষ্টা মায়ামাত্র, এপ্রকারে তুমি আমাকে সম্যগ্ রূপে জানতে পারবে না, (কারণ তত্ত্বতঃ আমি মায়াতীত নির্গুণস্বরূপ)," এইপ্রকার স্মৃতিবাক্য আছে।.......

তথ্যসূত্রঃ-

. ভগবান্ শঙ্করাচার্যের ব্রহ্মসূত্র শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ভাষ্য।

. আচার্য মধুসূদন সরস্বতীর "অদ্বৈতসিদ্ধি"

. বেদান্তদর্শনঅদ্বৈতবাদ, তৃতীয় খণ্ড, কাব্য-ব্যাকরণ-সাংখ্য-বেদান্ততীর্থ বিদ্যাবাচস্পতি আশুতোষ ভট্টাচার্য শাস্ত্রী।

. বিষ্ণু পুরাণ, পণ্ডিতপ্রবর পঞ্চানন তর্করত্ন সম্পাদিত।

শ্রীশুভ চৌধুরী

আগস্ট ২৯, শুক্রবার,  ২০২৫ খৃষ্টাব্দ।

তুরীয় ব্রহ্মের স্বরূপঃ-

  মাণ্ডুক্য উপনিষদে তুরীয় ব্রহ্মতত্ত্বের উপদেশ রয়েছে। ঐ দুর্জ্ঞেয় তুরীয় তত্ত্ব বুঝানোর জন্য ওঁকার বা প্রণবকে ব্রহ্মের প্...