বৈষ্ণববেদান্তী রামানুজাচার্য, মধ্বাচার্য প্রভৃতির মতে ব্রহ্ম অনন্ত-গুণময়, তিনি কোন মতেই নির্গুণ নির্বিশেষ হতে পারে না। 'নির্গুণং নিষ্ক্রিয়ং শান্তং নিরবদ্যং নিরঞ্জনম্' প্রভৃতি শ্রুতি ব্রহ্মের গুণশূন্যতা বুঝায় না। ব্রহ্মে কোনরূপ নিকৃষ্ট গুণ বা নীচ ক্রিয়া নেই, ব্রহ্মে নিরতিশয় অসংখ্য কল্যাণগুণেরই সমাবেশ আছে, এটাই বোঝায়। 'নির্' শব্দের স্বাভাবিক 'নিষেধ' অর্থ পরিত্যাগ করে 'নিকৃষ্ট' অর্থ গ্রহণ করায়, রামানুজ প্রভৃতি আচার্যরা যে শব্দার্থের সহজবোধ্য রীতি পরিত্যাগ করে কষ্ট কল্পনার আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন, তা সুধী পাঠক অবশ্য লক্ষ্য করবেন।
উপনিষদে
ব্রহ্মের সগুণ ও নির্গুণ
এই দ্বিবিধভাবেরই পরিচয় পাওয়া যায়। এই দুটি বিভাব
আলোক অন্ধকারের মত পরস্পর বিরোধী।
দুইটি কখনই সমানভাবে সত্য
হতে পারে না। নির্গুণ
নির্বিশেষ ব্রহ্মই পারমার্থিক সত্য; ব্রহ্মের সগুণভাব মায়িক। স্থূলদর্শী সাধকের উপাসনার সুবিধার জন্য ব্রহ্মের সগুণ
ভাবের কল্পনা করা হয়ে থাকে।
এই বিষয়ে শাস্ত্রপ্রমাণ —
প্রত্যস্তমিতভেদং
যৎ সত্তামাত্রমগোচরম্।
বচসামাত্মসংবেদ্যং
তজ্জ্ঞানং ব্রহ্ম সংজ্ঞিতম্।।
তচ্চ
বিষ্ণোঃ পরং রূপমরূপস্যাজমক্ষরং।
বিশ্বরূপাচ্চ
বৈরূপ্যলক্ষণং পরমাত্মনঃ।।
ন
তদ্যোগযুজা শক্যং নৃপ চিন্তয়িতুং যতঃ।
ততঃ
স্থূলং হরে রূপং চিন্তয়েদ্
বিশ্বগোচরম্।
-(বিষ্ণুপুরাণ-৬/৭/৫৩-৫৫)
—যা সর্বপ্রকার
ভেদ—সম্পর্করহিত, কেবল সৎস্বরূপ, বাক্যের
অগোচর এবং আত্মপ্রত্যয়-বেদ্য,
সেই জ্ঞানই ব্রহ্ম নামে পরিচিত। রূপহীন
বিষ্ণুর এটাই নিত্য ও
পরমরূপ এবং তা সমস্ত
বিশ্বরূপ হতে বিলক্ষণ। প্রথমতঃ
যোগী ব্যক্তি সেই পরমরূপ চিন্তা
করতে সমর্থ হন না বলেই
পরমাত্মা শ্রীহরির স্থূলরূপই চিন্তা করবেন।
তর্কের
ভিত্তিতে বিচার করলে দেখা যায়
যে, নির্গুণকে বুঝতে গেলেই সগুণকে জানা প্রয়োজন হয়।
যিনি ঘট জানেন না,
এরূপ ব্যক্তি ঘটের অভাব বুঝতে
পারেন না। অভাবের জ্ঞান
তার প্রতিযোগীর জ্ঞানকে অপেক্ষা করে। যার অভাব
বুঝা যায়, তাকে অভাবের প্রতিযোগী
বলে। নির্গুণ বাক্য দ্বারা উপনিষদে ব্রহ্মে সর্ববিধ গুণের নিষেধ করা হয়েছে। নিষেধের
কোন বিষয় না থাকলে, কার
নিষেধ তা না বুঝালে,
নিষেধের সেক্ষেত্রে কোনই অর্থ হয়
না। সগুণ বাক্যের দ্বারা
ব্রহ্মের যে সকল গুণরাজি
বর্ণিত হয়েছে, নির্গুণ বাক্যে সেই সমুদয় গুণেরই
নিষেধ সূচিত হয়েছে। সগুণ বাক্য না
থাকলে, নির্গুণ বাক্যের অবতারণাই অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়।
ব্রহ্মের
গুণ-সম্পর্ক কল্পিত না হলে, সত্য
স্বাভাবিক গুণের নিষেধ কোন মতেই সম্ভবপর
হয় না। সে অবস্থায়
গুণের নিষেধে গুণীরও নিষেধ হয়ে যায়। আবার
সগুণবাক্যের প্রাধান্য দিলে, উপনিষদে যে অসংখ্য নির্গুণবাক্য
দেখতে পাওয়া যায়, তা নির্বিষয় এবং
অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়। এমতাবস্থায়
অদ্বৈতবাদীর দৃষ্টিতে নির্গুণ বাক্যের প্রাধান্য স্বীকার করলে, উপাসনা জগতে সগুণ ব্রহ্মবোধক
বাক্যেরও নির্দিষ্ট স্থান পাওয়া যায়। সগুণ এবং নির্গুণ
কোনরূপ উপনিষদের উক্তিই মিথ্যা এবং অপ্রমাণ হয়
না। আচার্য মধুসূদন সরস্বতী বলেছেন— "সগুণবাক্যানাম্ ঔপাধিকগুণবিষয়েত্বেন স্বাভাবিকনির্ধর্মকত্বশ্রুতের্নবিরোধঃ।
(অদ্বৈতসিদ্ধি)
এই
অবস্থায় প্রথমতঃ সগুণ ব্রহ্মবাদ স্বীকার
করে নিয়ে, চরমভূমিতে নির্গুণ নির্বিশেষ ব্রহ্মবোধক বাক্যকেই প্রমাণ বলে গ্রহণ করা
সমধিক যুক্তিসঙ্গত নয় কি? ব্রহ্মের
সগুণভাবই সত্য, নির্গুণভাব মিথ্যা, এইরূপ কল্পনা নিতান্তই অসঙ্গত।
'সর্বকর্মা
সর্বকামঃ সর্বগন্ধঃ সর্বরসঃ'-(ছান্দোগ্য উপনিষদ্-৩।১৪।২) প্রভৃতি শ্রুতি ব্রহ্মের সগুণভাব প্রকাশ করছে। "নিষ্কলং নিষ্ক্রিয়ং শান্তং নিরবদ্যং নিরঞ্জনম্"-( শ্বেতাশ্বতর উপনিষৎ-৬।১৯) ইত্যাদি শ্রুতি দ্বারা ব্রহ্মের নির্বিশেষ ভাব প্রতিপাদিত হয়েছে।
এই অবস্থায় কোন শ্রুতিবাক্য দুর্বল,
কোনটি প্রবল? তা বিচার করতে
গেলে দেখা যায় যে,
প্রথমতঃ ব্রহ্মের গুণ বর্ণনা না
করলে, নির্গুণ বাক্যে গুণের যে নিষেধ করা
হয়েছে, তার তো কোন
অর্থ হয় না। সুতরাং
গুণ থাকলে তবেই তো ওটার
নিষেধ হবে? গুণ না
থাকলে নিষেধ হবে কার? নির্গুণ
সুতরাং সগুণকে অপেক্ষা করে। এই অবস্থায়
"অপচ্ছেদ" ন্যায় অনুসারে গুণসাপেক্ষ নির্গুণ বাক্য যে সগুণ বাক্য
অপেক্ষা প্রবল, তাতে সন্দেহ কি?
সেই প্রবল নির্গুণ বাক্যের দ্বারা সগুণ বাক্যের বাধ
হবে, এটাই তো স্বাভাবিক।
ননু নির্গুণবাক্যং সগুণবাক্যং বাধতে, ন তু সগুণবাক্যং
তদিতি কিমত্র নিয়ামকম্? ন চ নিষেধকতয়া
নির্গুণবাক্যং প্রবলম্, 'অসদ্বা' ইত্যাদিবাক্যস্য সদেব ইত্যাদিবাক্যাৎ প্রাবল্যাপত্তেরিতি
চেন্ন, অপচ্ছেদন্যায়েন প্রাবলস্য প্রাগেবোক্তেঃ। (অদ্বৈতসিদ্ধি)
"অপচ্ছেদ" ন্যায়টি
মীমাংসা দর্শনের একটি ন্যায়। অপচ্ছেদ
শব্দের অর্থ বিরোধ বা
ব্যাঘাত। পূর্ববর্তী ও পরবর্তী উক্তির
মধ্যে অপচ্ছেদ ঘটলে, পূর্বটি দুর্বল এবং পরবর্তী উক্তিটি
সবল হয়ে থাকে। উপরিউক্ত
ছান্দোগ্য শ্রুতির ব্রহ্মের সবিশেষতা সম্পাদক গন্ধ ও রূপরসাদি
উপাধিসকল অবিদ্যা কর্তৃক প্রত্যুপস্থাপিত। সুতরাং নির্বিশেষ ব্রহ্মই বেদান্ত প্রতিপাদ্য, সবিশেষতা উপাসনার সৌকর্যের জন্য। যেহেতু সকল স্থলেই অর্থাৎ
উপনিষদ্ সকলে ব্রহ্মস্বরূপ প্রতিপাদনপর
'অশব্দমস্পর্শমরূপমব্যয়ম্'-(কঠ উপনিষৎ-১।৩।১৫)
অর্থাৎ 'শব্দরহিত, স্পর্শরহিত, রূপবিহীন, ক্ষয়রহিত' ইত্যাদি এই বাক্যসকলে যা
হতে সমস্ত বিশেষ নিরাকৃত হয়েছে, সেই ব্রহ্মই উপদিষ্ট
হচ্ছেন। কিন্তু সাকার অর্থাৎ সপ্রপঞ্চ সবিশেষ ব্রহ্মবিষয়ক অন্যান্য বাক্যসকল তৎপ্রধান নয় অর্থাৎ প্রধানভাবে
সবিশেষতা প্রতিপাদন করে না, যেহেতু
তারা প্রধানভাবে উপাসনাবিধি প্রতিপাদন করে অর্থাৎ বিধিবোধিত
উপাসনার অঙ্গরূপে ব্রহ্মকে সমর্পন করে।
আরেকটি
বিষয় এই যে, সগুণ
ও নির্গুণ ব্রহ্ম ভিন্ন তত্ত্ব নয়। যিনি স্বতঃ
নির্গুণ নির্বিশেষ, তিনিই মায়া উপাধি গ্রহণ করে সগুণ সবিশেষ
হন। এই সগুণভাব তাঁর
লীলা মাত্র। লীলাময়, সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান পরমেশ্বরই প্রাণিগণের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে স্বেচ্ছানুরূপ মায়িক
দেহ ধারণ করে জগতের
রঙ্গমঞ্চে অবতীর্ণ হন, 'স্যাৎ পরমেশ্বরস্য
অপি ইচ্ছাবশাৎ মায়াময়ং রূপং সাধকানুগ্রহার্থম্'-(ব্রহ্মসূত্র শাঙ্করভাষ্য-১.১.২০)
অর্থাৎ সাধকদের অনুগ্রহ করবার জন্য পরমেশ্বরেরও মায়াময়রূপ
সম্ভব হয়। ত্রিগুণময়ী জগজ্জননী
মায়াকে বশীভূত করে জগতের সৃষ্টিলীলায়
প্রবৃত্ত হন। স্বয়ং ভগবান্
বলেছেন—
"অজোঽপি সন্নব্যয়াত্মা
ভূতানামীশ্বরোঽপি সন্। প্রকৃতিং স্বামধিষ্ঠায়
সম্ভবাম্যাত্মমায়য়া"-(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা-৪/৬)
অর্থাৎ
'আমি অজ অর্থাৎ জন্মরহিত
হয়েও; অব্যয়াত্মা অর্থাৎ যাঁর জ্ঞানশক্তির ক্ষয়
নেই এইরূপ অক্ষীণ জ্ঞানশক্তি স্বভাব হয়েও; ব্রহ্মাদি থেকে তৃণ পর্য্যন্ত
সর্ব্বভূতের ঈশ্বর হয়েও; আমার যে স্বপ্রকৃতি,
অর্থাৎ ত্রিগুণাত্মিকা বৈষ্ণবী মায়া, সমস্ত জগৎ যার বশে
বর্তমান, যদ্দ্বারা মোহিত হয়ে লোকে নিজের
আত্মা বাসুদেবকে জানতে পারে না, সেই
নিজ প্রকৃতিতে অধিষ্ঠিত হয়ে অর্থাৎ তাঁকে
বশীভূত করে আমি সম্ভাবিত
হই অর্থাৎ আত্মমায়ার দ্বারা যেন লোকবৎ দেহধারণ
করে জন্মগ্রহণ করি; কিন্তু পরমার্থতঃ
নয়।'
তিনি
দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন
ও ধর্মের গ্লানি দূর করবার জন্য
জগতের বক্ষে আবির্ভূত হন। "ধর্ম্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে"-(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা-৪/৮) অর্থাৎ
'ধর্ম্মের সম্যক্ স্থাপনের জন্য প্রতিযুগে আমি
সম্ভাবিত হই অর্থাৎ অবতীর্ণ
হই।'
তিনি
মায়াধীশ তাঁর উপর মায়ার
কোন প্রভাব নেই। তিনি মায়ার
সাক্ষী মাত্র। এইজন্য ব্রহ্মের এই সগুণলীলা দ্বারা
তাঁর নিত্য-শুদ্ধ-বুদ্ধ-মুক্তস্বভাবের কোন বিচ্যুতি হয়
না।
যেহেতু
'মায়া হ্যেষা ময়া সৃষ্টা যন্মাং
পশ্যসি নারদ৷ সর্বভূতগুণৈর্যুক্তং মৈবং মাং জ্ঞাতুমর্হসি'-(মহাভারত শান্তিপর্ব-৩৩৯/৪৫-৪৬)
অর্থাৎ
"হে নারদ! সর্বভূতের গুণসকলের দ্বারা যুক্তরূপে তুমি যে আমাকে
দেখছ, এটা মৎকর্তৃক সৃষ্টা
মায়ামাত্র, এপ্রকারে তুমি আমাকে সম্যগ্
রূপে জানতে পারবে না, (কারণ তত্ত্বতঃ
আমি মায়াতীত নির্গুণস্বরূপ)," এইপ্রকার স্মৃতিবাক্য আছে।.......
তথ্যসূত্রঃ-
১.
ভগবান্ শঙ্করাচার্যের ব্রহ্মসূত্র ও শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ভাষ্য।
২.
আচার্য মধুসূদন সরস্বতীর "অদ্বৈতসিদ্ধি"।
৩.
বেদান্তদর্শন—অদ্বৈতবাদ, তৃতীয় খণ্ড, কাব্য-ব্যাকরণ-সাংখ্য-বেদান্ততীর্থ বিদ্যাবাচস্পতি আশুতোষ ভট্টাচার্য শাস্ত্রী।
৪.
বিষ্ণু পুরাণ, পণ্ডিতপ্রবর পঞ্চানন তর্করত্ন সম্পাদিত।
শ্রীশুভ
চৌধুরী
আগস্ট
২৯, শুক্রবার, ২০২৫
খৃষ্টাব্দ।
No comments:
Post a Comment