Monday, 20 April 2020

অদ্বৈতবেদান্তে মায়াঃ-



অদ্বৈতবেদান্তে একমাত্র সর্বব্যাপক ব্রহ্মেরই পারমার্থিক সত্তা অঙ্গীকৃত হয়, তদ্ভিন্নের যাহা সত্তা, তাহা মায়ামাত্র। ইহাই শ্রুতি সিদ্ধান্ত-"আত্মার দ্বৈতসিদ্ধি নেই। আত্মা সিদ্ধ অদ্বিতীয়, মায়া দ্বারা তার দ্বিতীয় সত্তা অনুভূত হয়‌। এই আত্মাই সবকিছু।"-(অথর্ববেদীয় নৃসিংহ তাপনীয়োপনিষৎ, নবম খণ্ড-১)

ভগবান শ্রীদত্তাত্রেয় একই বাক্য বলিতেছেন- “এই সবই মরুভূমির মরীচিকার মত ইন্দ্রজাল। কেবল অখণ্ড ঘনাকার শিবই বর্তমান (সত্য)”-(অবধূত গীতা, ৭ম অধ্যায়-১৩)

আচার্য্য গৌড়পাদ্ মাণ্ডুক্য কারিকা বলিতেছেন-'জন্ম মায়োপমং তেষাং সা চ মায়া ন বিদ্যতে ॥'-(মাণ্ডুক্য কারিকা,৪। ৫৮) এই কারিকার ভাষ্যে আচার্য শঙ্কর বলিতেছেন-

'মায়া ইতি অবিদ্যমানস্য আখ্যা'-(শাঙ্করভাষ্য, মাণ্ডুক্য কারিকা,৪। ৫৮) অর্থাৎ 'সেই মায়ার কোন সত্তা নাই। অভিপ্রায় এই যে, অবিদ্যমান বা অসৎ পদার্থেরই নাম মায়া।'

শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণে ভগবান 'মায়া'র স্বরূপ নিরূপণ করিতেছেন এইভাবে-"বাস্তবিক যেখানে যা নাই সেখানে সেরকম কি এক পদার্থের নাম জ্ঞান হইতেছে, নিশ্চিতরূপে যা বলা হয় নি, আত্মার অধিষ্ঠানে তা যে কারণে প্রতীত হয়, কিংবা যা আছে তা বোঝা যাইতেছে না, এইরকম অভাবনীয় ব্যাপার যাহা থেকে হয়, তাহাকে আমার মায়া বলিয়া জানিবে। আকাশ-স্থিত চাঁদের দিকে ও কাঁচে প্রতিবিম্বিত চাঁদের দিকে দৃষ্টিপাত করিলে দুটি চাঁদ বলিয়া বোধ হয়। আকাশের চন্দ্র সত্য কিন্তু দ্বিতীয় চন্দ্র আকাশে নাই অথচ দেখা যাইতেছে। এই দ্বিতীয় চন্দ্র প্রকৃত চন্দ্রের মত হইলেও সত্য নহে কিন্তু দেখা যাইতেছে। সেইজন্য তাহাকে কি যেন এক বস্তু বলা হইতেছে। কাজেই এটি বাস্তব বস্তু ব্যতীত অন্য বস্তুর প্রতীতির দৃষ্টান্ত। আবার বাস্তব বস্তুর প্রতীতির অভাব বা অপ্রতীতির দৃষ্টান্ত তমঃ বা অন্ধকার। যেমন রাহু গ্রহমণ্ডলে থাকা সত্ত্বেও তাহাকে দেখা যায় না, সেইরূপ অন্ধকার গৃহে অনেক বস্তু থাকিলেও তাহা দেখা যায় না-অন্ধকারই এখানে না দেখতে পাওয়ার কারণ। প্রথমোক্ত দ্বিচন্দ্রদর্শন কিংবা গৃহস্থিত বস্তু দেখতে না পাওয়া-দুটোই অভাবনীয় ব্যাপার এবং এর মূল কারণ মায়া।"-(শ্রীধর স্বামী টীকা, শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ, দ্বিতীয় স্কন্দ, নবম অধ্যায়-৩৩)

মায়া অবিদ্যা অজ্ঞান প্রকৃতি আকাশ অক্ষর অব্যক্ত বীজশক্তি ও মহাসুপ্তি ইহারা পর্য্যায়শব্দরূপে ব্যবহৃত হয়। ব্রহ্মসূত্রের 'তদধীনত্বাদর্থবৎ৷৷১.৪.৩৷৷' এইসূত্রে তাহা স্পষ্ট। ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য্য উক্ত সূত্রের ভাষ্যে বলিতেছেন-

অবিদ্যারূপা যে প্রসিদ্ধা বীজশক্তি, তাহা 'অব্যক্ত' এই শব্দের দ্বারা নির্দ্দেশের যোগ্য, তাহা পরমেশ্বরকে আশ্রয়করতঃ অবস্থান করে, মায়াময়ী এবং মহাসুপ্তিস্বরূপা, যাহাতে স্বরূপজ্ঞানরহিত সংসারী জীবগণ শয়ন করে অর্থাৎ আবদ্ধ হইয়া জন্মমৃত্যু অনুভব করে। সেই এই অব্যক্ত কোন কোন স্থলে 'আকাশ' এই শব্দের দ্বারা নির্দিষ্ট হইয়াছে, যেহেতু এইপ্রকার শ্রুতি আছে-

'এতস্মিন্নু খল্বক্ষরে গার্গ্যাকাশ ওতশ্চ প্রোতশ্চ'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৩/৮/১১)

অর্থাৎ 'হে গার্গি, এই অক্ষরে (ক্ষয়রহিত ব্রহ্মে) 'আকাশ' ওতপ্রোতভাবে অবস্থিত আছে।'

কোন কোন স্থলে তাহা অক্ষরশব্দের দ্বারা বর্ণিত হইয়াছে, যেহেতু এইপ্রকার শ্রুতি আছে-

'অক্ষরাত্পরতঃ পরঃ'-(মুণ্ডক উপনিষৎ-২/১/২) অর্থাৎ 'স্বীয় কার্য্যপ্রপঞ্চ হইতে শ্রেষ্ঠ যে অক্ষর (-অব্যাকৃত), তদপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।'

আবার কোন কোন স্থলে 'মায়া' এইরূপে সূচিত হইয়াছে যেহেতু এইপ্রকার মন্ত্রবর্ণ আছে-

'মায়াং তু প্রকৃতিং বিদ্যান্মায়িনং তু মহেশ্বরম্'-(শ্বেতাশ্বতর উপনিষৎ-৪/১০)

অর্থাৎ 'প্রকৃতিকে মায়া বলিয়া জানিবে এবং মহেশ্বরকে মায়াধীশ বলিয়া জানিবে।'

সেই প্রসিদ্ধা মায়াই অব্যক্ত, কারণ তাহার তত্ত্ব বা অন্যত্ব নিরূপণ করিতে পারা যায় না।...... এইভাবে ভগবান ভাষ্যকার শঙ্কর এইসূত্রের ভাষ্যে চমৎকার যুক্তিসহকারে তাহা উপস্থাপন করেন।

এই মায়া সর্বজ্ঞ পরমেশ্বরের শক্তি, অনির্বচনীয় এবং সংসার প্রপঞ্চের পরিণামী বীজস্বরূপ। ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্যে আচার্য্য শঙ্কর তাহা স্পষ্ট করিতেছেন-

'সর্বজ্ঞ ঈশ্বরের যেন আত্মভূত (নিজস্বরূপ) যে অবিদ্যাকল্পিত নাম ও রূপ, যাহারা তত্ত্ব ও অন্যত্বের দ্বারা অনির্বচনীয় (অর্থাৎ যাহাকে সদ্ রূপে অথবা অসদ্ রূপে নির্ব্বচন করিতে পারা যায় না) এবং যাহারা সংসারপ্রপঞ্চের বীজস্বরূপ, তাহারা সর্বজ্ঞ ঈশ্বরের মায়াশক্তি ও প্রকৃতি, এইরূপে শ্রুতি এবং স্মৃতিতে বর্ণিত হইতেছে।'-(ব্রহ্মসূত্র-২।১।১৪, শাঙ্করভাষ্য)

এই মায়া ব্যতিরেকে পরমেশ্বরের জগৎস্রষ্টৃত্ব সম্ভব নহে। শারীরক মীমাংসাতে শঙ্করাচার্য্যের ইহাই অভিপ্রায়। 'আমরা কিন্তু জগতের এই (মায়াশক্তিরূপা) প্রাগবস্থাকে পরমেশ্বরের অধীনরূপে অঙ্গীকার করিয়া থাকি, স্বাধীনরূপে নহে। আর তাহা অবশ্যই স্বীকার্য্যা, যেহেতু তাহা প্রয়োজনসম্পাদিকা। তদ্ব্যতিরেকে পরমেশ্বরের স্রষ্টৃত্ব নিশ্চয়ই সিদ্ধ হয় না, কারণ যিনি শক্তিরহিত, তাহার (সৃষ্ট্যাদিকর্ম্মে) প্রবৃত্তি যুক্তি সঙ্গত নহে।'-(ব্রহ্মসূত্র-১।৪।৩, শাঙ্করভাষ্য)

এই মায়া অস্বতন্ত্র, কারণ নিজের আশ্রয় ও অবভাসক চৈতন্যব্যতিরেকে ইহা ব্যবহার সম্পাদিকা হয় না।  সেই মায়াকে তিন প্রকার দৃষ্টিতে তিনভাবে বুঝা যায়- "শ্রৌত দৃষ্টিতে তাহা তুচ্ছা, যুক্তির দৃষ্টিতে অনির্বচনীয়া এবং লৌকিক দৃষ্টিতে বাস্তবী।"-(বিদ্যারণ্য মুনি, পঞ্চদশী, ষষ্ঠ অধ্যায়-১৩০)

যেহেতু কোনবস্তু আলোক ও অন্ধকারের ন্যায় বিরূদ্ধ স্বভাবসম্পন্ন হইতে পারে না, আর তাদৃশ বিরুদ্ধধর্ম্মযুক্ত বস্তু কাহারও বুদ্ধিতে আরূঢ়ও হয় না। এইহেতু মায়া ও তাহার কার্য্য জগৎকে অদ্বৈতবেদান্তে 'মিথ্যা' বলা হয়।‘ব্রহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যা জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ’ - বিবেকচূড়ামণি গ্রন্থে পূজ্যপাদ শঙ্করের এতাদৃশ উক্তিতে তাহা পরিদৃষ্ট। তাছাড়া আত্মবোধে আচার্য বলিতেছেন-‘রাগ ও দ্বেষাদিযুক্ত এই সংসার স্বপ্নতুল্য, যেমন স্বপ্নসময়ে দৃশ্যমান বস্তু সত্য বলিয়া বোধ হয়, জাগ্রতকালে মিথ্যা বলিয়া জানা যায়, সেইরূপ যতকাল অজ্ঞান থাকে, ততকাল জগৎ সত্য বলিয়া প্রতীত হয়, কিন্তু তত্ত্বজ্ঞান উৎপন্ন হইলে জগতের মিথ্যাত্বই জ্ঞাত হওয়া যায়। যতকাল সকলের অধিষ্ঠানরূপ অদ্বিতীয় ব্রহ্মের জ্ঞান না হয়, তাবৎকাল শুক্তিকাতে (ঝিনুকে) রৌপ্যের ন্যায় জগৎ সত্য বলিয়া প্রতীত হয়।‘ -(শঙ্করাচার্য, আত্মবোধ-৬,৭)

এই 'মিথ্যা' শব্দের অর্থ-বন্ধ্যাপুত্রের ন্যায় অলীকত্ব নহে, পরন্তু অনির্বচনীয়ত্ব। বাস্তব সত্তারহিত যাহার প্রতীতি হয়, যাহার স্বরূপকে 'ইহা এই প্রকার' এইরূপে শৃঙ্গগ্রাহিতয়া নির্ব্বচন করা যায় না এবং বাক্যের দ্বারা বর্ণনা করা যায় না, তাহাকে বলে 'অনির্বচনীয়' বা 'মিথ্যা'। এই মিথ্যা শব্দ এই অর্থে এই দর্শনে পারিভাষিক। ভাষ্যকার আচার্য্য শঙ্কর তাঁহার অধ্যাসভাষ্যে "অধ্যাসো মিথ্যেতি ভবিতুং যুক্তম্'', 'অধ্যাস মিথ্যা হওয়াই উচিত' এইরূপে যে 'মিথ্যা' পদটির প্রয়োগ করিয়াছেন, তাহার ব্যাখ্যায় আচার্য পদ্মপাদ তাঁহার 'পঞ্চপাদিকায়' বলিয়াছেন, মিথ্যাশব্দের দুইটি অর্থ দেখা যায়—একটি অসম্ভব দ্বিতীয়টি অনির্বচনীয়তা। প্রথম অর্থে 'অধ্যাসো মিথ্যা', অর্থাৎ চিৎ ও অচিতের গ্রন্থিরূপ অধ্যাস সম্ভবপর নহে; দ্বিতীয় অর্থে অধ্যাস অনির্বচনীয়, ইহাই স্পষ্টতঃ বুঝা যায়। অনির্বচনীয়, অর্থাৎ সৎও নহে, অসৎও নহে; সদসৎও নহে; যে বস্তুকে সৎ বা সত্যরূপেও নির্বচন করা হয় না, অসত্যরূপেও নিরূপণ করা যায় না, সত্যাসত্যরূপেও ব্যাখ্যা করা সম্ভবপর হয় না; এরূপ বস্তুই অনির্বচনীয় আখ্যা লাভ করে। অনির্বচনীয় বস্তুমাত্রই মিথ্যা। ফলে, 'সদসদ্বিলক্ষণত্ব'ই মিথ্যাত্ব, এরূপ মিথ্যাত্বের লক্ষণই আসিয়া পড়ে।‌ আচার্য পদ্মপাদ্ এই দৃষ্টিতেই তাহার মিথ্যাত্বের লক্ষণ বা পরিচয় লিপিবদ্ধ করিয়াছেন। পদ্মপাদের এই লক্ষণটি চিৎসুখাচার্য তাঁহার গ্রন্থে মিথ্যাত্বের পঞ্চম লক্ষণ হিসেবে উল্লেখ করিয়াছেন।  তাছাড়া ইহা নিছক কল্পনা নহে, ইহা শ্রুতি সিদ্ধান্ত। যথা- অথর্ববেদীয় সর্বসারোপনিষৎ এ বর্ণিত আছে-

"অনাদিরন্তবতী প্রমাণাপ্রমাণসাধারণা ন সতী নাসতী ন সদসতী স্বয়মধিকা বিকাররহিতা নিরূপ্যমাণা সতীতরলক্ষণশূন্যা সা মায়েত্যুচ্যতে।"-(সর্বসারোপনিষৎ-১৩)

"শুরু নেই কিন্তু শেষ আছে, প্রমাণ আছে আবার প্রমাণ নাই, আছে বলা যায় না আবার নেইও বলা যায় না। সৎ ও অসৎ একসঙ্গে বলা যায় না, (ব্রহ্ম) স্বয়ং বিকারশূন্য হওয়ায় বিকারের হেতুরূপে নিরূপ্যমান (জ্ঞাত) হইলে নাই এবং বিকারের হেতুরূপে নিরূপিত না হইলে আছে-এইরূপ লক্ষণশূন্য যা (ভাব) তাহাই-ই মায়া বলে কথিত হয়।"

মায়াকে ব্রহ্মচৈতন্য হইতে বস্তুতঃ ভিন্ন বলা চলে না; কারণ ব্রহ্ম ভিন্ন অন্য বস্তুর অস্তিত্ব নাই। উহাকে অভিন্ন বলা চলে না; কারণ চৈতন্য ও জড়ের অভেদ অসম্ভব। ভিন্নাভিন্নও বলা চলে না; কারণ ইহা স্ববিরুদ্ধ। এইরূপে মায়া সৎ নহে, কারণ তাহা হইলে ব্রহ্মের অদ্বিতীয়ত্বের হানি হয়; অসৎ নহে কারণ তাহা হইলে মায়া হইতে জগৎ উৎপত্তি অসম্ভব হয়; সৎ-অসৎ নহে কারণ ইহা স্ববিরুদ্ধ। মায়া সাবয়বা নহে, কারণ তাহলে উহার আদি স্বীকার করিতে হয় এবং তাহার ফলে সাদি মায়ার প্রতিবিম্ব ঈশ্বরও সাদি ও বিনাশী হন, নিরবয়বা নহে, কারণ তাহলে উহা ভূতবর্গের উপাদান হইবে না, কেননা সাবয়ব বস্তুই অপরের উপাদান হইতে পারে; উভয়রূপাও নহে, কারণ উহা স্ববিরুদ্ধ। ফলতঃ মায়া অনির্বচনীয়।

যোগবাশিষ্ঠসারে শ্রীবশিষ্ঠ তাহাই বলিতেছেন-"হে রাম! (সংসারকারণ) এই মায়া স্বনাশে আনন্দ দান করে। উহার স্বভাব দেখা বা বুঝা যায় না; কারণ (বিচারদৃষ্টিতে) দেখিলে উহাকে পাওয়াই যায় না, উহার নাশ হয় (উহা তাই অনির্বচনীয়)।"-(যোগবাশিষ্ঠসারঃ, জগৎ মিথ্যাত্ব প্রকরণ-৬)

বেদান্তবাক্যের যথাযথ অর্থ বিচার দ্বারা যে উত্তম জ্ঞান উৎপন্ন হয়, তার দ্বারাই সংসার-দুঃখের সর্বোতভাবে নাশ হয়ে থাকে। "ভ্রান্তিরূপা, নিরাশ্রয়া, নিঃস্বভাবা ও প্রমাণাসিদ্ধা এই মায়া (বেদান্তার্থ) বিচারের আঘাত সহ্য করিতে পারে না। অন্ধকার যেরূপ সুর্য্য-সান্নিধ্য-সহিষ্ণু নহে, অজ্ঞানও সেই রূপ বিচার-অসহিষ্ণু।"-(সুরেশ্বরাচার্য, নৈষ্কর্ম্য সিদ্ধি-৩।৬৬) ব্যবহার দশাতে আবরণস্বভাব ইহা অভাবপদার্থ না হইলেও নির্বিশেষ ব্রহ্মজ্ঞানবলে বাধিত হইয়া পড়ে, মাত্র তখনই ইহার 'তুচ্ছত্য' ও নিত্য-নিবৃত্তস্বরূপতা' অবধারিত হয়, তৎপূর্ব্বে নহে।

এই মায়ারূপ উপাধি এবং তৎকৃত নামরূপাদি উপাধিযোগেই শুদ্ধ নির্গুণ ব্রহ্ম ঈশ্বর নামে অভিহিত হন (ব্রহ্মসূত্র-১।৪।৩, শাঙ্করভাষ্যে পরিলক্ষিত) এবং মায়া উপাধিযোগে তিনিই বিভিন্নরূপধারী নটের ন্যায় জগতের যাবতীয় কার্য্যরূপে ব্রহ্মবিদের দৃষ্টিতে প্রতিভাত হন। আচার্য্য শঙ্করও তাই বলিতেছেন- 'মূলকারণই (ব্রহ্মই) চরম কার্য্য পর্য্যন্ত সেই সেই কার্য্যরূপে নটের ন্যায় হন সকল প্রকার ব্যবহারের আশ্রয়।'-(ব্রহ্মসূত্র-২।১।১৮, শাঙ্করভাষ্য)

ভগবান শঙ্করাচার্য বলিতেছেন-"মায়ার আবরণ ও বিক্ষেপ নাম্নী দুইটি শক্তি আছে।"-(বাক্যসুধা-১৩) সদানন্দ যোগীন্দ্র সরস্বতী বেদান্ত সারে (৫২-৫৪) বলিতেছেন-"আবরণ শক্তি হল যেমন একখণ্ড ছোট মেঘ, দ্রষ্টা পুরুষের নয়নপথ আচ্ছাদিত করায় অনেক যোজন আয়তন বিশিষ্ট সূর্যমণ্ডল যেন আচ্ছন্ন হয়ে গেছে, সেরুপ অজ্ঞান পরিচ্ছন্ন (মেঘের মতো সসীম) হলেও দ্রষ্টা পুরুষের বুদ্ধিকে আচ্ছাদন করায় অসীম অসংসারী আত্মা যেন আচ্ছাদিত হয়েছে, এরূপ বোধ করার সামর্থ্যকে আবরণ শক্তি বলে। হস্তামলকাচার্য বলেছেন-'অতিমুঢ় যেমন মেঘের দ্বারা আবৃত সূর্যকে আচ্ছাদিত নিষ্প্রভ বলে মনে করে, সেরূপ যার বুদ্ধি আবৃত, তার কাছে যিনি বদ্ধ বলে মনে হয়, সেই নিত্য উপলব্ধিস্বরূপ আত্মাই আমি।'-(হস্তামলকম্-১০)"

অজ্ঞানের এই আবরণশক্তি দ্বারা আবৃত আত্মায় কর্তৃত্ব ভোক্তৃত্ব সুখিত্ব দুঃখিত্ব প্রভৃতি সংসার সম্ভাবনাও থাকে, যেমন নিজ অজ্ঞানের দ্বারা আবৃত রজ্জুতে সর্প ভাবনার সম্ভাবনা থাকে।

বিক্ষেপশক্তি হইলো, যেমন রজ্জুর অজ্ঞান রজ্জুকে আবৃত করিয়া রজ্জুতে নিজশক্তির দ্বারা সর্প প্রভৃতি কল্পনা করে, সেরূপ (আত্মাশ্রিত) অজ্ঞান আত্মাকে আবৃত করিয়া আত্মাকে নিজশক্তি বলে আকাশাদি জগৎ সৃষ্টি করে। (এভাবে কল্পনা-বলে) সৃষ্টি করার এই সামর্থ্যকে বিক্ষেপশক্তি বলে। এই সম্পর্কে বাক্যসুধায় শঙ্করাচার্য বলিতেছেন—বিক্ষেপশক্তি সূক্ষ্মশরীর থেকে আরম্ভ করিয়া ব্রহ্মাণ্ড পর্যন্ত জগৎ সৃষ্টি করে।'-(বাক্যসুধা-১৩)"

সর্বজ্ঞাত্ম মুনি তাহাই বলিতেছেন-"আত্মামাত্রের বিষয়তা ও আশ্রয়তা বলেই আবরণ ও বিক্ষেপ শক্তিদ্বয় দ্বারা অজ্ঞান স্বপ্রকাশ-আত্মস্বরূপকে আচ্ছাদিত করিয়া তাঁহাকে মিথ্যা (পরমার্থ সত্য নহে এইরূপ) জীব, ঈশ্বর ও জগৎরূপে বিক্ষিপ্ত করে।"-(সংক্ষেপ শারীরকম্-১।২০)



Saturday, 18 April 2020

অদ্বৈতের সংজ্ঞাঃ-




পূজ্যপাদ্ বার্ত্তিককার বৃহদারণ্যক ভাষ্যের বার্তিকে বলিয়াছেন-'দ্বিধেতং দ্বীতমিত্যাহুস্তদ্ভাবো দ্বৈতমুচ্যতে। তন্নিষেধন চাদ্বৈতং প্রত্যাগ্বস্ত্বভিধীয়তে।'-(বৃঃ ভাঃ বাঃ ৪।৩।১৮০৭)

ইহার ভাব এই যে-'যাহা দুইভাগযুক্ত তাহা দ্বিত, তাহার যে ভাব, তাহা দ্বৈত; সেই দ্বৈতের নিষেধদ্বারা (সর্ব্বাধিষ্ঠানভূত) যে প্রত্যাগাত্মা অবশিষ্ট থাকেন, তিনি অদ্বৈতরূপে কথিত হন।'

ইনি সজাতীয় বিজাতীয় এবং স্বগতভেদহীন, স্বতঃপরিপূর্ণ স্বভাব; তদ্ব্যতিরিক্ত কিছুই পরমার্থতঃ নাই। অর্থাৎ শ্রুতির সমর্থন ও ব্যাখ্যার জন্য স্মৃতির সহায়তা গৃহীত হইলেও, শ্রুতি-মাত্র অনুসরণকারী যে দর্শনে সর্ব্বাধিষ্ঠানভূত একমাত্র নিরাকার নির্গুণ নির্ব্বিশেষ ব্রহ্ম ব্যতিরেকে কোন পদার্থের পারমার্থিক সত্তা স্বীকৃত হয় না, তাহাই অদ্বৈতবেদান্ত।

স্বগত, স্বজাতীয় ও বিজাতীয় ভেদ কি? বিদ্যারণ্য স্বামী বলিতেছেন-"পত্র, পুষ্প, ফল প্রভৃতি দ্বারা বৃক্ষের স্ব-অবয়ব-মধ্যস্থ যে ভেদ তাহাকে স্বগতভেদ বলে। একবৃক্ষের অন্যবৃক্ষ হইতে যে ভেদ তাহা স্বজাতীয় ভেদ, আর শিলা প্রভৃতি হইতে বৃক্ষের যে ভেদ তাহা বিজাতীয় ভেদ।"-(পঞ্চদশী, পঞ্চভূতবিবেক-প্রকরণ, ২০)

Tuesday, 14 April 2020

হনুমৎ পঞ্চরত্নম্ঃ-



ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য্য প্রণীত হনুমৎ পঞ্চরত্নম্
শ্রীহনুমৎ পঞ্চরত্নম্ ॥
বীতাখিল-বিষয়েচ্ছং জাতানন্দাশ্রুপুলকমত্যচ্ছম্ ।
সীতাপতিদূতাদ্যং বাতাত্মজমদ্য ভাবয়ে হৃদ্যম্ ॥ ১॥

নিখিল-বিষয়-বীতস্পৃহ, আনন্দাশ্রু-পুলক-শোভিত, স্বচ্ছ-হৃদয়, সীতাপতিদূতাগ্রগণ্য হৃদ্য পবননন্দনকে ভাবনা করি।১
তরুণারুণ-মুখ-কমলং করুণা-রসপূর-পূরিতাপাঙ্গম্ ।
সঞ্জীবনমাশাসে মঞ্জুল-মহিমানমঞ্জনা-ভাগ্যম্ ॥ ২॥

যিনি তরুণারুণ মুখকমল অর্থাৎ যাঁহার মুখকমল বাল-সূর্য্যের ন্যায় রক্তবর্ণ অথবা উদীয়মান সূর্য্য যাঁহার মুখকমলে প্রবেশ করিতেছিলেন, যাঁহার অপাঙ্গ করুণারসপ্রবাহে পূর্ণ, মনোরম-মহিম-সম্পন্ন, সেই অঞ্জনা-সৌভাগ্যের নিকট সম্যক্ অর্থাৎ শ্রীরামভক্তিপূত জীবন প্রার্থনা করি। ২
শম্বরবৈরি-শরাতিগমম্বুজদল-বিপুল-লোচনোদারম্ ।
কম্বুগলমনিলদিষ্টম্ বিম্ব-জ্বলিতোষ্ঠমেকমবলম্বে ॥ ৩॥

যিনি কামশরের অতীত, যাঁহার নয়ন-যুগল কমলদলের ন্যায় আয়ত, যাঁহার ওষ্ঠ বিম্বফলের ন্যায় উজ্জ্বল, পবনের ভাগ্যরূপ সেই উদার কম্বুকণ্ঠকেই একমাত্র অবলম্বন করিতেছি। ৩
দূরীকৃত-সীতার্তিঃ প্রকটীকৃত-রামবৈভব-স্ফূর্তিঃ ।
দারিত-দশমুখ-কীর্তিঃ পুরতো মম ভাতু হনুমতো মূর্তিঃ ॥ ৪॥

যাঁহা হইতে সীতার ব্যথা দূর হইয়াছে, যাঁহার স্ফুর্তি অর্থাৎ প্রকাশ হইতেই শ্রীরামের প্রভাব ব্যক্ত হইয়াছে, দশাননের কীর্ত্তিবিনাশী হনুমানের সেই মূর্ত্তি আমার সম্মুখে প্রকাশিত হউক। ৪
বানর-নিকরাধ্যক্ষং দানবকুল-কুমুদ-রবিকর-সদৃশম্ ।
দীন-জনাবন-দীক্ষং পবন তপঃ পাকপুঞ্জমদ্রাক্ষম্ ॥ ৫॥

যিনি দানবকূলস্বরূপ কুমুদ-কুসুমের সূর্য্যকিরণ-সদৃশ, পবনদেবের তপঃফলস্বরূপ, দীনজনপালনব্রতী সেই বানরগণাধি-নায়ককে আমি দেখিতে পাইয়াছি। ৫
এতৎ-পবন-সুতস্য স্তোত্রং
যঃ পঠতি পঞ্চরত্নাখ্যম্ ।
চিরমিহ-নিখিলান্ ভোগান্ ভুক্ত্বা
শ্রীরাম-ভক্তি-ভাগ্-ভবতি ॥ ৬॥

পবননন্দনের এই পঞ্চরত্নাখ্য স্তোত্র যিনি পাঠ করে, সে ইহজীবনে দীর্ঘকাল বিবিধ সুখভোগ করিয়া পরিণামে শ্রীরামভক্তি লাভ করে।
ইতি শ্রীমচ্ছংকর-ভগবতঃ কৃতৌ হনুমত্-পঞ্চরত্নং সম্পূর্ণম্ ॥
ইতি ভগবান্ শঙ্করাচার্য বিরচিত হনুমৎ-পঞ্চরত্নম্ সম্পূর্ণ ॥

Saturday, 11 April 2020

নিরবয়ব ব্রহ্মই মায়ার আশ্রয়ঃ-



মহর্ষি বাদরায়ন ভগবৎ প্রণীতম্ বেদান্তমীমাংসা শাস্ত্রের সর্বোপেতাধিকরণের প্রতিপাদ্য বিষয়- 'নিরবয়ব হইলেও ব্রহ্মই মায়ার আশ্রয়।'

'সর্বোপেতা চ তদ্দর্শনাৎ৷৷ ব্রহ্মসূত্র ২.১.৩০৷৷

শাঙ্করভাষ্য অনুবাদঃ- ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য্য শারীরকভাষ্যে বলিতেছেন- বিচিত্রশক্তির সহিত সম্বন্ধবশতঃ এক হইলেও ব্রহ্ম হইতে বিচিত্র কার্য্য-প্রপঞ্চ অর্থাৎ বিবিধপ্রকার সৃষ্টি সঙ্গত, ইহা (২।১।২৮ সূত্র ও ইহার ভাষ্যে) বলা হইয়াছে। কিন্তু কি প্রকারে ইহা অবগত হওয়া যায় যে, পরব্রহ্ম বিচিত্র শক্তিযুক্ত? তাহা বলা হইতেছে-

'সর্বোপেতা চ তদ্দর্শনাৎ৷' অর্থাৎ আর শ্রেষ্ঠ দেবতা (ব্রহ্ম) সর্ব্বশক্তিযুক্ত, ইহা অঙ্গীকার করিতে হইবে। কোন হেতবলে? তাহা বলিতেছেন-'তদ্দর্শনাৎ' অর্থাৎ যেহেতু তিনি-

'সর্বকর্মা সর্বকামঃ সর্বরসঃ সর্বমিদমভ্যাত্তোবাক্যনাদরঃ'-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৩/১৪/২)।

অর্থাৎ তিনি সর্ব্বকর্ম্মা (এই বিশ্ব তাঁহার কর্ম্ম), সর্ব্ববিধ বিশুদ্ধ কামনাবান, সকল প্রকার সুখকর গন্ধযুক্ত, সর্ব্বপ্রকার উত্তম রসযুক্ত, এই সমগ্র জগৎব্যাপিয়া বর্তমান, বাগিন্দ্রিয় বিবর্জ্জিত এবং নিষ্কাম্।

'সত্যকামঃ সত্যসংকল্পঃ'-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৮/৭/১)।

অর্থাৎ তিনি সত্যকামও সত্যসঙ্কল্প।

'যঃ সর্বজ্ঞঃ সর্ববিৎ'-(মুণ্ডক উপনিষৎ-১/১/৯)।

যিনি সর্বজ্ঞ ও সর্ববিৎ।

'এতস্য বা অক্ষরস্য প্রশাসনে গার্গি সূর্যাচন্দ্রমসৌ বিধৃতৌ তিষ্ঠতঃ'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৩/৮/৯)।

'হে গার্গি, এই অক্ষরের (নাশরহিত পরমেশ্বরের) প্রকৃষ্ট শাসনে সূর্য্য ও চন্দ্রমা বিধৃত হইয়া অবস্থান করিতেছে।' ইত্যাদি এইজাতীয় শ্রুতি পরদেবতার সকলপ্রকার শক্তির সহিত সম্বন্ধ সেইপ্রকারেই প্রদর্শন করিতেছে।

টীকাঃ-তাছাড়া বহুশ্রুতিবচনই ঘোষণা করে যে, ব্রহ্ম শক্তিমান্। যেমন-'প্রকৃতিকে মায়া এবং পরমেশ্বরকে মায়াধীশ বলিয়া জানিবে।'-(শ্বেতাশ্বতর উপনিষৎ-৪.১০)

ভগবান বাদরায়ণকৃত পরবর্তী সূত্র হইল-

বিকরণত্বান্নেতি চেত্তদুক্তম্৷৷ ব্রহ্মসূত্র ২.১.৩১ ৷৷

শাঙ্করভাষ্য অনুবাদঃ- আচার্য্য শঙ্করভগবৎ এই সূত্রের ভাষ্যে বলিতেছেন- আচ্ছা, তাহা না হয় হইল, কিন্তু 'অচক্ষুষ্কমশ্রোত্রমবাগমনাঃ'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৩/৮/৮)। অর্থাৎ 'চক্ষুবিহীন, শ্রোত্রবিহীন, বাগিন্দ্রিয়রহিত, মনোবিহীন', ইত্যাদি এইজাতীয় শাস্ত্র পরদেবতা (ব্রহ্মকে) ইন্দ্রিয়রহিতরূপে উপদেশ করেন। সুতরাং তিনি সর্ব্বশক্তিযুক্ত হইলেও কি প্রকারে কার্য্যসম্পাদনে সমর্থ হইবেন? যেহেতু দেবতা প্রভৃতি চেতন ও সর্ব্বশক্তিযুক্ত হইলেও আধ্যাত্মিক শরীর ও ইন্দ্রিয়সম্পন্ন হইয়াই সেই সেই কার্য্যসম্পাদনে সমর্থরূপে বিজ্ঞাত হন। অতএব 'নেতি নেতি'(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৩/৯/২৬) 'ইহা নহে, ইহা নহে' এইপ্রকারে সকলপ্রকার বিশেষ যাঁহাতে প্রতিষিদ্ধ হইয়াছে, সেই দেবতার সকলপ্রকার শক্তির সহিত সম্বন্ধ কি প্রকারে সম্ভব হইবে?

তদুত্তরে বলিব, এই বিষয়ে যাহা বক্তব্য তাহা পূর্ব্বেই বলা হইয়াছে। (তদুত্তরে ব্রহ্মসূত্রের- ২।১।৩ বিলক্ষণত্বাধিকরণ প্রভৃতিতে ও ভাষ্যে আচার্য্য শঙ্কর স্পষ্ট করিয়াছেন) এই অতিগম্ভীর ব্রহ্মবস্তু শ্রুতিমাত্রগম্য, কিন্তু তর্কগম্য নহেন। একজনের যেপ্রকার সামর্থ্য দেখা গিয়াছে, অন্যেরও সেইপ্রকার সামর্থ্য হওয়া উচিত, এইপ্রকার কোন নিয়ম নাই। যাঁহাতে সকলপ্রকার বিশেষ প্রতিষিদ্ধ হইয়াছে, সেই ব্রহ্মেরও সকলপ্রকার শক্তির সহিত সম্বন্ধ সম্ভব, ইত্যাদি ইহাও অবিদ্যার দ্বারা কল্পিত যে রূপের বিভিন্নতা, তাহার উল্লেখের দ্বারা বলা হইয়াছে।

(ব্রহ্মসূত্রের-২।১।২৭ ভাষ্যে আচার্য্য শঙ্কর বলিতেছেন-অবিদ্যার দ্বারা কল্পিত রূপের বিভিন্নতা অঙ্গীকার করা হয়। তাছাড়া 'আত্মনিচৈবং বিচিত্রাশ্চ হি৷৷২.১.২৮৷৷' সূত্রের ভাষ্যে ভগবান ভাষ্যকার শঙ্কর স্পষ্ট করিতেছেন- আর দেখ এই বিষয়ে বিবাদ করা উচিত নহে যে, কিপ্রকারে স্বরূপের নাশ ব্যাতিরেকেই একব্রহ্মে অনেকপ্রকার আকারবিশিষ্ট সৃষ্টি হইবে? যেহেতু ''ন তত্র রথা ন রথযোগা ন পন্থানো ভবন্ত্যথ রথান্রথযোগান্পথঃ সৃজতে'-বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪/৩/১০, অর্থাৎ 'সেখানে (স্বপ্নে) রথসকল থাকে না, অশ্বসকল থাকে না এবং পথসকল থাকে না অথচ তিনি রথসকল অশ্বসকল ও পথসকলকে সৃষ্টি করেন।' ইত্যাদি শ্রুতিবাক্যের দ্বারা স্বপ্নদর্শী এক আত্মাতেও স্বরূপের নাশ ব্যাতিরেকেই অনেকপ্রকার আকারবিশিষ্ট সৃষ্টি পঠিত হইতেছে। আর লোকমধ্যেও দেবতা প্রভৃতিতে এবং মায়াবী প্রভৃতিতে স্বরূপের নাশ ব্যতিরেকেই হস্তী ও অশ্ব প্রভৃতি বিচিত্র সৃষ্টিসকল পরিদৃষ্ট হইতেছে। এই প্রকার এক ব্রহ্মেও স্বরূপের নাশ ব্যতিরেকেই অনেকপ্রকার আকার বিশিষ্ট সৃষ্টি হইবে।)

আর দেখ শাস্ত্রও 'অপাণিপাদো জবনো গ্রহীতা পশ্যত্যচক্ষুঃ স শ্রৃণোত্যকর্ণঃ' -(শ্বেতাশ্বতর উপনিষৎ-৩।১৯) অর্থাৎ 'হস্তপদ না থাকিলেও তিনি দ্রুত গমন করেন, চক্ষুবিহীন হইলেও দর্শন করেন, কর্ণবিহীন হইলেও শ্রবণ করেন।' এইপ্রকারে করণবিহীন অর্থাৎ দেহেন্দ্রিয়াদিরহিত ব্রহ্মের সকলপ্রকার শক্তির সহিত সম্বন্ধ প্রদর্শন করিতেছেন।

ইতি শাঙ্করভাষ্য অনুবাদ।

 

Wednesday, 8 April 2020

বিবেকচূড়ামণি (১-৬৫)




ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য্য বিরচিত বিবেকচূড়ামণিঃ

সর্ববেদান্তসিদ্ধান্তগোচরং তমগোচরম্ ।

গোবিন্দং পরমানন্দং সদ্গুরুং প্রণতোঽস্ম্যহম্ ॥ ১॥ 

সর্ববেদান্ত সিদ্ধান্তে যাঁর কথা বলা হয়েছে, যিনি বাক্যমনের অতীত পরমানন্দস্বরূপ সদ্ গুরু, সেই গোবিন্দকে (পরমাত্মা অথবা আচার্য্য গোবিন্দপাদ্) আমি প্রণাম করি।

জন্তূনাং নরজন্ম দুর্লভমতঃ পুংস্ত্বং ততো বিপ্রতা

তস্মাদ্বৈদিকধর্মমার্গপরতা বিদ্বত্ত্বমস্মাত্পরম্ ।

আত্মানাত্মবিবেচনং স্বনুভবো ব্রহ্মাত্মনা সংস্থিতিঃ

মুক্তির্নো শতজন্মকোটিসুকৃতৈঃ পুণ্যৈর্বিনা লভ্যতে ॥ ২॥ 

জীবগণের মনুষ্যজন্ম দুর্লভ, এর থেকেও দুর্লভ পুরুষদেহ প্রাপ্তি আবার তার থেকেও দুর্লভ বিপ্রদেহধারী হওয়া। ব্রাহ্মণ হলেও চাই বেদবিহিত ধর্মমার্গে নিষ্ঠা। আবার এর থেকেও শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি শাস্ত্রের তাৎপর্যজ্ঞান। আত্মা ও আনাত্ম বিষয়ের বিচার, এসবের সম্যক্ অনুভব, ব্রহ্মের সঙ্গে একাত্ম অবস্থায় স্থিতি ও এর ফলস্বরূপ মুক্তি- শতকোটি জন্মের সুকৃতি ও পূণ্যফল ব্যাতীত লাভ করা যায় না।

দুর্লভং ত্রয়মেবৈতদ্দেবানুগ্রহহেতুকম্ ।

মনুষ্যত্বং মুমুক্ষুত্বং মহাপুরুষসংশ্রয়ঃ ॥ ৩॥ 

মনু্ষ্য-জন্ম লাভ, সংসারবন্ধন থেকে মুক্তির ইচ্ছা ও ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের সঙ্গ, এই তিনটি এ জগতে দুর্লভ। ঈশ্বরের বিশেষ অনুগ্রহ হলে তবে এগুলি পাওয়া যায়।

লব্ধ্বা কথঞ্চিন্নরজন্ম দুর্লভং

তত্রাপি পুংস্ত্বং শ্রুতিপারদর্শনম্ ।

য়স্ত্বাত্মমুক্তৌ ন য়তেত মূঢধীঃ

স হ্যাত্মহা স্বং বিনিহন্ত্যসদ্গ্রহাত্ ॥ ৪॥

কোনও রকমে দুর্লভ নরজন্ম আর সেই জন্মে পুরুষশরীর ও বেদান্তবিচারে পারদর্শিতা লাভ করেও যে মূঢ়বুদ্ধির মানুষ নিজের মুক্তির জন্যে যত্ন করে না, সেই আত্মঘাতী পুরুষ অসৎ-বস্তু গ্রহণের ফলে নিজেকেই বিনষ্ট করে।

ইতঃ কো ন্বস্তি মূঢাত্মা য়স্তু স্বার্থে প্রমাদ্যতি ।

দুর্লভং মানুষং দেহং প্রাপ্য তত্রাপি পৌরুষম্ ॥ ৫॥

দুর্লভ মনুষ্যদেহ, তার ওপর আবার পুরুষশরীর পেয়েও যে নিজের স্বার্থ বুঝতে ভুল করে বসে তার থেকে বেশী নির্বোধ আর কে আছে?

বদন্তু শাস্ত্রাণি য়জন্তু দেবান্

কুর্বন্তু কর্মাণি ভজন্তু দেবতাঃ ।

আত্মৈক্যবোধেন বিনাপি মুক্তি-

র্ন সিধ্যতি ব্রহ্মশতান্তরেঽপি ॥ ৬॥ 

অনেকেই শাস্ত্র পাঠ করে শাস্ত্রালোচনা করতে পারে, দেবতাদের কৃপা লাভের জন্যে যজ্ঞ করতে পারে, শাস্ত্রবিহিত কর্মের অনুষ্ঠান করতে পারে, বহু দেব-দেবীর ভজনা করতে পারে কিন্তু ব্রহ্মের সঙ্গে একাত্মতা ছাড়া শত ব্রহ্মার আয়ুষ্কালের মধ্যেও মুক্তি লাভ হবে না।

অমৃতত্ত্বস্য নাশাস্তি বিত্তেনেত্যেব হি শ্রুতিঃ ।

ব্রবীতি কর্মণো মুক্তেরহেতুত্বং স্ফুটং য়তঃ ॥ ৭॥ 

বিত্ত লাভের দ্বারা মুক্তির আশা নেই, শ্রুতি এই কথা বলেছেন। এই কথা থেকে এটাই স্পষ্ট হয় যে শ্রুতির কাম্য কর্মকে মুক্তির কারণ বলে মনে করা যায় না।

অতো বিমুক্ত্যৈ প্রয়তেত বিদ্বান্

সন্ন্যস্তবাহ্যার্থসুখস্পৃহঃ সন্ ।

সন্তং মহান্তং সমুপেত্য দেশিকং

তেনোপদিষ্টার্থসমাহিতাত্মা ॥ ৮॥

এই জন্যে যিনি বুদ্ধিমান তিনি বাহ্যবিষয়ে থেকে সুখভোগের স্পৃহা সম্পূর্ণভাবে ত্যাগ করবেন আর সদগুণসম্পন্ন উদারচরিত দেশমান্য আত্মজ্ঞ পুরুষকে সদগুরুরূপে প্রাপ্ত হইয়া তাঁর উপদিষ্ট সাধনায় মনকে একাগ্র করিবেন এবং মুক্তির জন্যে প্রযত্ন করবেন।

উদ্ধরেদাত্মনাঽঽআত্মানং মগ্নং সংসারবারিধৌ ।

য়োগারূঢত্বমাসাদ্য সম্যগ্দর্শননিষ্ঠয়া ॥ ৯॥ 

শুদ্ধদর্শন ও নিষ্ঠা সহকারে যোগরূঢ় অবস্থা লাভ করে সংসারসাগরে নিমজ্জিত আত্মাকে নিজের শুদ্ধ আত্মার সাহায্যে উদ্ধার করতে হবে।

সন্ন্যস্য সর্বকর্মাণি ভববন্ধবিমুক্তয়ে ।

য়ত্যতাং পণ্ডিতৈর্ধীরৈরাত্মাভ্যাস উপস্থিতৈঃ ॥ ১০॥ 

আত্মচিন্তার অভ্যাসে স্থিত থেকে স্থিরবুদ্ধি, শাস্ত্রের মর্মগ্রাহী পণ্ডিতগণ সমস্ত সকাম কর্মের অনুষ্ঠান বর্জন করে সংসারবন্ধন থেকে মুক্তির জন্যে যত্নপরায়ণ হবেন।

চিত্তস্য শুদ্ধয়ে কর্ম ন তু বস্তূপলব্ধয়ে ।
বস্তুসিদ্ধির্বিচারেণ ন কিঞ্চিত্কর্মকোটিভিঃ ॥ ১১॥
নিষ্কাম কর্মের দ্বারা চিত্তশুদ্ধি হয় কিন্তু ব্রহ্মবস্তুর উপলদ্ধি হয় না। ব্রহ্মজ্ঞান বিচারের দ্বারা হয়। কোটি কর্মের অনুষ্ঠানে কিঞ্চিৎ মাত্রও হয় না।১১
সম্যগ্বিচারতঃ সিদ্ধা রজ্জুতত্ত্বাবধারণা ।
ভ্রান্তোদিতমহাসর্পভয়দুঃখবিনাশিনী ॥ ১২॥

অজ্ঞানের জন্যে ভ্রান্তিবশত রজ্জুতে মহাসর্পের মিথ্যাজ্ঞান থেকে ভয়, হৃদকম্প ইত্যাদি যেসব দুঃখের উদ্ভব হয় সেসবের নাশ হয় রজ্জুকে রজ্জু বলে জানলে। ঠিক ঠিক বিচারের দ্বারা জ্ঞানের উন্মেষ হলে সর্পের মিথ্যাজ্ঞানটা চলে গিয়ে রজ্জুর পরিচয়টাই সত্য হয়।১২
অর্থস্য নিশ্চয়ো দৃষ্টো বিচারেণ হিতোক্তিতঃ ।
ন স্নানেন ন দানেন প্রাণায়মশতেন বা ॥ ১৩॥

বিচারের দ্বারা আর সত্যদর্শী গুরুর কল্যাণকর উক্তি থেকে সত্যবস্তুর স্বরূপজ্ঞানের উপলদ্ধি হয়। স্নানের দ্বারা হয় না, দানের দ্বারা হয় না বা শত প্রাণায়ামের দ্বারাও হয় না।১৩
অধিকারিণমাশাস্তে ফলসিদ্ধির্বিশেষতঃ ।
উপায়া দেশকালাদ্যাঃ সন্ত্যস্মিন্সহকারিণঃ ॥ ১৪॥

বিচারের ফলস্বরূপ যে সিদ্ধি তাহা বিশেষত উপযুক্ত অধিকারীরই লাভ হয়ে থাকে। দেশ- কাল (নির্জন স্থানে বাস, ব্রাহ্মমুহূর্তাদি কাল) ইত্যাদি উপায়সমূহ এই ফলসিদ্ধি বিষয়ে সহায়ক কারণরূপে গণ্য হয়।১৪
অতো বিচারঃ কর্তব্যো জিজ্ঞাসোরাত্মবস্তুনঃ ॥
সমাসাদ্য দয়াসিন্ধুং গুরুং ব্রহ্মবিদুত্তমম্ ॥ ১৫॥

অতএব জিজ্ঞাসুর পক্ষে শ্রেষ্ঠ ব্রহ্মবিদ্ দয়ার সাগর গুরু লাভ করে আত্মবস্তুর বিচার করাই কর্তব্য।১৫
মেধাবী পুরুষো বিদ্বানূহাপোহবিচক্ষণঃ ।
অধিকার্যাত্মবিদ্যায়ামুক্তলক্ষণলক্ষিতঃ ॥ ১৬॥

মেধাবী, বিদ্বান ও শ্রুতি-সম্মত তর্কবিচারে পারদর্শী, এইসব লক্ষণযুক্ত পুরুষ আত্মবিদ্যা লাভের অধিকারী।১৬
বিবেকিনো বিরক্তস্য শমাদিগুণশালিনঃ ।
মুমুক্ষোরেব হি ব্রহ্মজিজ্ঞাসায়োগ্যতা মতা ॥ ১৭॥

ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষদের মতে ব্রহ্মজিজ্ঞাসার যোগ্যতা তাঁদেরই আছে যাঁরা নিত্য-অনিত্যবস্তু-বিচারশীল, বৈরাগ্যবান, শমাদিগুণসম্পন্ন, মুক্তিকামী সাধক।
.সাধনান্যত্র চৎবারি কথিতানি মনীষিভিঃ ।
যেষু সৎস্বেব সন্নিষ্ঠা যদভাবে ন সিধ্যতি ॥ ১৮॥
ব্রহ্মজিজ্ঞাসার বিষয়ে চারটি সাধনের কথা মনীষিগণ বলেছেন, যেগুলি থাকলে তবে সৎস্বরূপ আত্মবস্তুতে নিষ্ঠা হয়, না থাকলে হয় না।১৮
আদৌ নিত্যানিত্যবস্তুবিবেকঃ পরিগণ্যতে ।
ইহামুত্রফলভোগবিরাগস্তদনন্তরম্ ।
শমাদিষট্কসম্পত্তির্মুমুক্ষুৎবমিতি স্ফুটম্ ॥ ১৯॥
আগে যে চারটি সাধনার কথা বলেছেন তার প্রথমটি হচ্ছে নিত্যানিত্যবস্তু-বিবেক। তারপর, পর পর আসছে, ইহামুত্রফলভোগবিরাগ, শমাদিষট্ সম্পত্তি ও মুমুক্ষুত্ব। এইগুলি নিঃসংশয়ে ব্রহ্মজ্ঞান লাভের উপায়।১৯
ব্রহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যেত্যেবংরূপো বিনিশ্চয়ঃ ।
সোঽয়ং নিত্যানিত্যবস্তুবিবেকঃ সমুদাহৃতঃ ॥ ২০॥
ব্রহ্ম সত্য ও জগৎ মিথ্যা এই ধারণায় দৃঢ় প্রত্যয় হওয়াকেই নিত্য-অনিত্য-বস্তু-বিবেক বলে।২০
তদ্বৈরাগ্যং জিহাসা যা দর্শনশ্রবণাদিভিঃ।
দেহাদিব্রহ্মপর্যন্তে হ্যনিত্যে ভোগবস্তুনি ॥ ২১॥
নিজের দেহ থেকে আরম্ভ করে ব্রহ্মার দেহ-পর্যন্ত সমস্ত অনিত্য ভোগের সামগ্রীর দোষ-দর্শন ও সেসবের দোষের কথা শোনার ফলে ভোগ্যবস্তুতে যে অনীহা জাগে ও সে সমস্ত ত্যাগ করার ইচ্ছা জন্মায় তাকেই বৈরাগ্য বলা হয়।২১
বিরজ্য বিষয়ব্রাতাদ্দোষদৃষ্ট্যা মুহুর্মুহুঃ ।
স্বলক্ষ্যে নিয়তাবস্থা মনসঃ শম উচ্যতে ॥ ২২॥
মুহুর্মুহু বিষয়সমূহে দোষ দেখতে পাওয়ার ফলে বিষয়ে যে বৈরাগ্য আসে তা থেকে মনের নিজ লক্ষ্যস্থল ব্রহ্মে নিশ্চল স্থিতি লাভ হয়, একে শম বলা হয়।২২
বিষয়েভ্যঃ পরাবর্ত্য স্থাপনং স্বস্বগোলকে ।
উভয়েষামিন্দ্রিয়াণাং স দমঃ পরিকীর্তিতঃ ।
বাহ্যানালম্বনং বৃত্তেরেষোপরতিরুত্তমা ॥ ২৩॥
উভয় প্রকারের ইন্দ্রিয়গুলিকে (অর্থাৎ কর্মেন্দ্রিয় ও জ্ঞানেন্দ্রিয়কে) সমস্ত বিষয় থেকে বিমুখ করে তাদের নিজের নিজের জায়গায় নিশ্চল ভাবে ধরে রাখাকেই দম বলে। চিত্তবৃত্তিকে বাহ্যবিষয় অবলম্বন না করতে দেওয়াই শ্রেষ্ঠ উপরতি।২৩
সহনং সর্বদুঃখানামপ্রতীকারপূর্বকম্ ।
চিন্তাবিলাপরহিতং সা তিতিক্ষা নিগদ্যতে ॥ ২৪॥
কোন রকম চিন্তাভাবনা বা বিলাপ না করে সব রকমের দুঃখকেই গ্রহণ করে নেওয়া এবং বিনা প্রতিকারে তাদের সহ্য করে যাওয়াকে বলে তিতিক্ষা। ২৪
শাস্ত্রস্য গুরুবাক্যস্য সত্যবুদ্ধ্যবধারণম্ ।
সা শ্রদ্ধা কথিতা সদ্ভির্যযা বস্তূপলভ্যতে ॥ ২৫॥
শাস্ত্র ও গুরুবাক্যের সত্যতায় দৃঢ় বিশ্বাস রাখা ও অন্তরে সেই বিশ্বাসকে দৃঢ়ভাবে গ্রহণ করাকে জ্ঞানীরা শ্রদ্ধা বলেন। এই শ্রদ্ধার সাহায্যে আত্মবস্তু লাভ হয়।২৫
সর্বদা স্থাপনং বুদ্ধেঃ শুদ্ধে ব্রহ্মণি সর্বদা ।
তৎসমাধানমিত্যুক্তং ন তু চিত্তস্য লালনম্ ॥ ২৬॥
সর্বদা, সর্বপ্রকারে বুদ্ধিকে শুদ্ধব্রহ্মে লগ্ন করে রাখাকে সমাধান বলে। কিন্তু বেদান্ততত্ত্ব আলোচনা করে চিত্তের যে প্রসন্নতা হয়, তা সমাধান নয়।২৬
অহঙ্কারাদিদেহান্তান্ বন্ধানজ্ঞানকল্পিতান্ ।
স্বস্বরূপাববোধেন মোক্তুমিচ্ছা মুমুক্ষুতা ॥ ২৭॥
অহঙ্কার থেকে আরম্ভ করে স্থূল দেহ পর্যন্ত যেসব বন্ধন সেগুলো অজ্ঞান কল্পিত। নিজের স্বরূপজ্ঞানের দ্বারা সেইসব বন্ধন থেকে মুক্তি লাভের ইচ্ছাই মুমুক্ষুতা।২৭
মন্দমধ্যমরূপাপি বৈরাগ্যেণ শমাদিনা ।
প্রসাদেন গুরোঃ সেয়ং প্রবৃদ্ধা সূয়তে ফলম্ ॥ ২৮॥
সেই মুমুক্ষুতা অল্প বা মধ্যম পরিমাণের হলেও বৈরাগ্য ও শমদম ইত্যাদির দ্বারা এবং গুরুকৃপায় প্রকৃষ্টরূপে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে মোক্ষফল সৃজন করে।২৮
বৈরাগ্যং চ মুমুক্ষুৎবং তীব্রং যস্য তু বিদ্যতে ।
তস্মিন্নেবার্থবন্তঃ স্যুঃ ফলবন্তঃ শমাদয়ঃ ॥ ২৯॥
কিন্তু যার বৈরাগ্য ও মুমুক্ষা পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান থাকে তার পক্ষেই শমাদির সাধনা সার্থক হয়, মোক্ষের সাধনা ফলবতী হয়।২৯
এতয়োর্মন্দতা যত্র বিরক্তৎবমুমুক্ষয়োঃ ।
মরৌ সলিলবত্তত্র শমাদের্ভানমাত্রতা ॥ ৩০॥
যেখানে বৈরাগ্য ও মুমুক্ষুতা এই দুটির শিথিলতা থাকে সেখানে মরুভূমিতে জল দেখার মতো শমাদির সাধন যেন সাধনার একটা অভিনয়ের মতো হয়।৩০

মোক্ষকারণসামগ্র্যাং ভক্তিরেব গরীয়সী ।

স্বস্বরূপানুসন্ধানং ভক্তিরিত্যভিধীয়তে ॥ ৩১॥

স্বাত্মতত্ত্বানুসন্ধানং ভক্তিরিত্যপরে জগুঃ।

মোক্ষের সাধনসমূহের মধ্যে ভক্তিই শ্রেষ্ঠ। নিজের স্বরূপের অনুসন্ধানকেই ভক্তি বলে অভিহিত করা হয়। আবার অন্য অনেকে আত্মার ও পরমাত্মার তত্ত্ব-বিচারকেই ভক্তি বলে থাকেন।৩১

উক্তসাধন্সম্পন্নস্তত্ত্বজিজ্ঞাসুরাত্মনঃ।

উপসীদেদ্ গুরুং প্রাজ্ঞং যস্মাদ্ বন্ধবিমোচনম্।।৩২।।

আগে যেসব সাধনের কথা বলা হয়েছে সেইসব সাধনসম্পন্ন, আত্মতত্ত্বজিজ্ঞাসু ব্যাক্তি ব্রহ্মজ্ঞ গুরুর সমীপে যাবেন, কারণ গুরুর সাহায্যেই এই সংসারবন্ধন হইতে মুক্তি ঘটে।৩২

শ্রোত্রিয়োঽবৃজিনোঽকামহতো যো ব্রহ্মবিত্তমঃ ।

ব্রহ্মণ্যুপরতঃ শান্তো নিরিন্ধন ইবানলঃ ।

অহেতুকদয়াসিন্ধুর্বন্ধুরানমতাং সতাম্ ॥ ৩৩॥

যিনি বেদজ্ঞ, নিষ্পাপ, নিষ্কাম ও শ্রেষ্ঠ ব্রহ্মবিদ্, যাঁর মন বাহ্যবিষয় থেকে সরে এসে ব্রহ্মে স্থিত হয়ে আছে, যিনি ইন্ধনশূন্য জ্বলন্ত কাঠের আগুনের মতো শান্ত ও তেজস্বী, যিনি অহেতুক দয়াসিন্ধু তিনি প্রণত সজ্জন ব্যাক্তিদের কল্যাণকারী বন্ধু। ৩৩

তমারাধ্য গুরুং ভক্ত্যা প্রহ্ব- প্রশ্রয় -সেবনৈঃ।

প্রসন্নম্ তমনুপ্রাপ্য পৃচ্ছেৎ জ্ঞাতব্যমাত্মনঃ।।৩৪।।

সেই গুরুকে ভক্তিভরে প্রণাম করে বিনম্র সেবায় আরাধনা করে প্রসন্ন করবে, তারপর তাঁকে নিজের যা জানার আছে তা জিজ্ঞেস করবে।৩৪

স্বামিন্ নমস্তে নতলোকবন্ধো

করুণ্যসিন্ধো পতিতং ভবাব্ধৌ।

মামুদ্ধরাত্মীয়কটাক্ষদৃষ্ট্যা

ঋজ্বহতিকারুণ্যসুধাভিবৃষ্ট্যা।। ৩৫।।

প্রণতজনের বন্ধু, দয়াসিন্ধু হে প্রভু, তোমার করুণামৃতবর্ষী সরল, স্নিগ্ধ কৃপাকটাক্ষদৃষ্টি দ্বারা সংসারসমুদ্রে পতিত আমাকে উদ্ধার কর। ৩৫

দুর্বারসংসারদবাগ্নিতপ্তং

দোধূয়মানং দুরদৃষ্টবাতৈঃ ।

ভীতং প্রপন্নং পরিপাহি মৃত্যোঃ

শরণ্যমন্যদ্যদহং ন জানে ॥৩৬।।

যা থেকে রক্ষা পাওয়া অতীব দুষ্কর সেই সংসার দাবানলে আমি দগ্ধ,দুর্ভাগ্যের প্রবল ঝরে আমি বিদ্ধস্ত,কম্পিত,ভীত সন্ত্রস্ত। দয়া করে এই হতভাগ্য শরণাগতকে রক্ষা করুন। আপনি ছাড়া আর কোনো আশ্রয়স্থল আমি জানি না। ৩৬

শান্তা মহান্তো নিবসন্তি সন্তো

বসন্তবল্লোকহিতং চরন্তঃ ।

তীর্ণাঃ স্বয়ং ভীমভবার্ণবং জনা-

নহেতুনান্যানপি তারয়ন্তঃ ॥ ৩৭॥

আপনি স্বয়ং ভয়ংকর সংসার-সাগর থেকে উত্তীর্ণ হয়েছেন,অন্যদেরও বিনা কারণেই এই দুরন্ত সংসার-সাগর পার করিয়েছেন।জীব কল্যাণে আপনি সতত রত।আপনি শান্ত মহাপুরুষ এবং ঋতুরাজের মত মনোহর মূর্তিতে সর্বদা বিরাজিত। ৩৭

অয়ং স্বভাবঃ স্বত এব যৎপর-

শ্রমাপনোদপ্রবণং মহাত্মনাম্ ।

সুধাংশুরেষ স্বয়মর্ককর্কশ-

প্রভাভিতপ্তামবতি ক্ষিতিং কিল ॥ ৩৮

মহাত্নাগণের স্বভাবই এমন যে তাঁরা স্বেচ্ছায় অন্যদের শ্রম দূর করতে প্রবৃত্ত হন। প্রচন্ড সৌরতাপে তাপিত ধরণী যেমন সুশীতল চন্দ্রকিরণে শান্ত হয় তেমনি এই মহাত্নাগণ তাপিত প্রানীর তাপ নিবারণ করেন। ৩৮

ব্রহ্মানন্দরসানুভূতিকলিতৈঃ পূতৈঃ সুশীতৈর্যুতৈ-

র্যুষ্মদ্বাক্কলশোজ্ঝিতৈঃ শ্রুতিসুখৈর্বাক্যামৃতৈঃ সেচয়।

সন্তপ্তং ভবতাপদাবদহনজ্বালাভিরেনং প্রভো

ধন্যাস্তে ভবদীক্ষণক্ষণগতেঃ পাত্রীকৃতাঃ স্বীকৃতাঃ ॥ ৩৯॥

হে প্রভো! প্রচন্ড সংসার-দাবানলের দগ্ধ এই দীন শরণাগতকে আপনি আপনার ব্রহ্মানন্দরসানুভবযুক্ত পরম পুণ্যময়, সুশীতল,নির্মল বাক্যরূপ স্বর্ণকলস হতে নির্গত শ্রতিসুখকর বচনামৃত দ্বারা সিঞ্চন করুন অর্থাৎ এই সংসারের তাপ শান্ত করুন। তাঁরাই ধন্য যাঁরা ক্ষণকালের জন্যও আপনার এক মুহূর্তের করুণাদৃষ্টি লাভ করেছেন। ৩৯

কথং তরেয়ং ভবসিন্ধুমেতং

কা বা গতির্মে কতমোঽস্ত্যুপায়ঃ ।

জানে ন কিঞ্চিৎকৃপয়াঽব মাং প্রভো

সংসারদুঃখক্ষতিমাতনুষ্ব ॥ ৪০॥

'আমি কিভাবে এই সংসার-সমুদ্র উত্তীর্ণ হবো? আমার কি গতি হবে? তার কি উপায় আছে? - এসব আমি কিছুই জানি না।প্রভো!অনুগ্রহ করে আমাকে রক্ষা করুন আর আমার ভবদুঃখ ক্ষয়ের বিধান করুন। ৪০

তথা বদন্তং শরণাগতং স্বং

সংসারদাবানলতাপতপ্তম্ ।

নিরীক্ষ্য কারুণ্যরসার্দ্রদৃষ্ট্যা

দদ্যাদভীতিং সহসা মহাত্মা ॥ ৪১॥

ঐরূপ (প্রার্থনাপুর্ণ) কথায় তার শরণাগত সংসাররূপ দাবানলের জ্বালায় দগ্ধ,মুমুক্ষ শিষ্যকে করুণাভরা দৃষ্টিতে অবলোকন করে মহাত্না গুরুদেব অভয় প্রদান করবেন। ৪১

বিদ্বান্ স তস্মা উপসত্তিমীয়ুষে

মুমুক্ষবে সাধু যথোক্তকারিণে ।

প্রশান্তচিত্তায় শমান্বিতায়

তত্ত্বোপদেশং কৃপয়ৈব কুর্যাৎ ॥ ৪২॥

শরণার্থী, মুমুক্ষু, আদেশ পালনে তৎপর, শান্তচিত্ত, শমাদিযুক্ত সৎ শিষ্যকে গুরুদেব কৃপাপরবশ হয়ে তত্ত্বোপদেশ প্রদান করবেন। ৪২

মা ভৈষ্ট বিদ্বংস্তব নাস্ত্যপায়ঃ

সংসারসিন্ধোস্তরণেঽস্ত্যুপায়ঃ ।

যেনৈব যাতা যতয়োঽস্য পারং

তমেব মার্গং তব নির্দিশামি ॥ ৪৩॥

শ্রীগুরুদেব বললেন 'হে বিদ্বান! তুমি ভীত হয়ো না, তোমার বিনাশ হবে না। সংসার- সমুদ্র হতে ত্রাণের উপায় আছে। যে পথদ্বারা যতিগণ সংসার-সমুদ্রপার হয়েছেন, সেই পথই আমি তোমাকে জানাব।' ৪৩

অস্ত্যুপায়ো মহান্কশ্চিৎসংসারভয়নাশনঃ ।

তেন তীর্ত্বা ভবাম্ভোধিং পরমানন্দমাপ্স্যসি ॥ ৪৪॥

সংসারের ভয় নাশের কোন একটি মহাউত্তম উপায় আছে,যার দ্বারা তুমি সংসার-সাগর হতে উত্তীর্ণ হয়ে পরমানন্দ লাভ করবে। ৪৪

বেদান্তার্থবিচারেণ জায়তে জ্ঞানমুত্তমম্ ।

তেনাত্যন্তিকসংসারদুঃখনাশো ভবত্যনু ॥ ৪৫॥

বেদান্তবাক্যের যথাযথ অর্থ বিচার দ্বারা যে উত্তম জ্ঞান উৎপন্ন হয়,তার দ্বারাই সংসার-দুঃখের সর্বোতভাবে নাশ হয়ে থাকে। ৪৫

শ্রদ্ধাভক্তিধ্যানয়োগান্মুমুক্ষোঃ

মুক্তের্হেতূন্বক্তি সাক্ষাচ্ছ্রুতের্গীঃ ।

যো বা এতেষ্বেব তিষ্ঠত্যমুষ্য

মোক্ষোঽবিদ্যাকল্পিতাদ্দেহবন্ধাৎ ॥ ৪৬॥

শ্রুতিতে শ্রদ্ধা, ভক্তি, জ্ঞান ও যোগকে মুমুক্ষুর মুক্তির সাক্ষাৎ হেতু বলে বর্ণনা করা হয়েছে। যিনি এগুলোতে নিযুক্ত হন, তাঁর অবিদ্যাকল্পিত দেহবন্ধন হতে মুক্তিলাভ হয়। ৪৬

অজ্ঞানয়োগাৎপরমাত্মনস্তব

হ্যনাত্মবন্ধস্তত এব সংসৃতিঃ ।

তয়োর্বিবেকোদিতবোধবহ্নিঃ

অজ্ঞানকার্যং প্রদহেৎসমূলম্ ॥ ৪৭॥

অজ্ঞানতার কারণেই পরমাত্মারূপী তোমার এই অনাত্মবন্ধন, আর সেই কারণেই তোমার জন্মমরণরূপী সংসার প্রাপ্তি হয়েছে। সুতরাং ঐ আত্মা ও অনাত্মার বিবেক হতে উৎপন্ন বোধরূপ অগ্নি অজ্ঞানের কার্যস্বরূপ সংসারকে সমূলে ভস্মীভূত করবে। ৪৭

শিষ্য উবাচ ।

কৃপয়া শ্রূয়তাং স্বামিন্প্রশ্নোঽয়ং ক্রিয়তে ময়া

যদুত্তরমহং শ্রুত্বা কৃতার্থঃ স্যাং ভবন্মুখাৎ ॥ ৪৮॥

শিষ্যঃ 'হে প্রভু! আমি প্রশ্ন করছি, আপনি অনুগ্রহ করে আমার এই প্রশ্ন শুনুন। আপনার শ্রী-মুখ নিঃসৃত উত্তর পেয়ে আমি কৃতার্থ হব।' ৪৮

কো নাম বন্ধঃ কথমেষ আগতঃ

কথং প্রতিষ্ঠাস্য কথং বিমোক্ষঃ ।

কোঽসাবনাত্মা পরমঃ ক আত্মা

তয়োর্বিবেকঃ কথমেতদুচ্যতাম্ ॥ ৪৯॥

'বন্ধনের স্বরূপ কী? বন্ধন হয় কেন? কিভাবে এটি স্থিতিলাভ করে আর এ থেকে কিভাবে মুক্তিলাভ হয়? অনাত্মা কী? পরমাত্মা কাকে বলে আর তাঁর বিবেক বা পার্থক্যজ্ঞান কিভাবে ঘটে? আপনি অনুগ্রহ করে এসকল আমাকে বলুন।' ৪৯

শ্রীগুরুবাচ ।

ধন্যোঽসি কৃতকৃত্যোঽসি পাবিতং তে কুলং ত্বয়া ।

পাবিতং যদবিদ্যাবন্ধমুক্ত্যা ব্রহ্মীভবিতুমিচ্ছসি ॥ ৫০॥

শ্রীগুরুদেব বললেন- 'হে শিষ্য! তুমি ধন্য, তুমি কৃতার্থ, তোমার দ্বারা তোমার কুল পবিত্র হল; কেননা তুমি অবিদ্যারূপী বন্ধন হতে মুক্ত হয়ে ব্রহ্মভাব লাভে আগ্রহী।' ৫০

ঋণমোচনকর্তারঃ পিতুঃ সন্তি সুতাদয়ঃ ।

বন্ধমোচনকর্তা তু স্বস্মাদন্যো ন কশ্চন ॥ ৫১॥

পুত্রাদী পিতৃঋণ পরিশোধকারী হতে পারে, কিন্তু ভববন্ধন থেকে মুক্তি স্বয়ং ভিন্ন অন্য কেহ করতে পারে না। ৫১

মস্তকন্যস্তভারাদের্দুঃখমন্যৈর্নিবার্যতে ।

ক্ষুধাদিকৃতদুঃখং তু বিনা স্বেন ন কেনচিৎ ॥ ৫২॥

(যেমন) মাথার উপরে রাখা বোঝার কষ্ট বা দুঃখ (সেই বোঝাটি নামিয়ে) অন্য কেহ দুর করতে পারে, কিন্তু ক্ষুধা- তৃষ্ণা প্রভৃতির কষ্ট স্বয়ং ব্যতীত অন্য কেহ নিবারিত করতে পারে না। ৫২

পথ্যমৌষধসেবা চ ক্রিয়তে যেন রোগিণা ।

আরোগ্যসিদ্ধির্দৃষ্টাঽস্য নান্যানুষ্ঠিতকর্মণা ॥ ৫৩॥

অথবা রোগী স্বয়ং ঔষধ এবং পথ্য সেবনের দ্বারা আরোগ্য লাভ করে। অপর কেউ ঔষধ পথ্যাদি সেবন করলে রোগী নিরাময় হয় না। ৫৩

বস্তুস্বরূপং স্ফুটবোধচক্ষুষা

স্বেনৈব বেদ্যং ন তু পণ্ডিতেন ।

চন্দ্রস্বরূপং নিজচক্ষুষৈব

জ্ঞাতব্যমন্যৈরবগম্যতে কিম্ ॥ ৫৪॥

(তেমনি) বিবেকী পুরুষের আপন জ্ঞানচক্ষু দ্বারা বস্তুর স্বরূপ জানতে হবে (অন্য কারো দ্বারা নয়)। চাঁদের স্বরূপ আপন চোখের দ্বারাই জানা সম্ভব, অপরের চোখের দ্বারা কি সেটা জানা সম্ভব? ৫৬

অবিদ্যাকামকর্মাদিপাশবন্ধং বিমোচিতুম্ ।

কঃ শক্নুয়াদ্বিনাঽঽত্মানং কল্পকোটিশতৈরপি ॥ ৫৫॥

আপন চেষ্টা ছাড়া অবিদ্যা,কামনা আর কর্মাদির জাল কোটি কল্পেও কি ছিন্ন করা সম্ভব? অর্থাৎ অপর কেউ মুক্তি দিতে পারে না। ৫৫

ন যোগেন ন সাঙ্খ্যেন কর্মণা নো ন বিদ্যয়া ।

ব্রহ্মাত্মৈকৎববোধেন মোক্ষঃ সিধ্যতি নান্যথা ॥ ৫৬॥

যোগ বা সাংখ্য, কর্ম কিংবা বিদ্যা কোনো কিছুতেই মোক্ষ লাভ হয় না। ইহা কেবল ব্রহ্ম এবং আত্মার একত্ববোধ দ্বারাই সম্ভব, অন্য কোনো প্রকারে নয়। ৫৬

বীণায়া রূপসৌন্দর্যং তন্ত্রীবাদনসৌষ্ঠবম্ ।

প্রজারঞ্জনমাত্রং তন্ন সাম্রাজ্যায় কল্পতে ॥ ৫৭॥

বাগ্বৈখরী শব্দঝরী শাস্ত্রব্যাখ্যানকৌশলম্ ।

বৈদুষ্যং বিদুষাং তদ্বদ্ভুক্তয়ে ন তু মুক্তয়ে ॥ ৫৮॥

যেমন বীণার সৌন্দর্য এবং তার তালযুক্ত ঝংকার মানুষের মনোরঞ্জন করে কিন্তু তাতে কোনো সাম্রাজ্য লাভ হয় না। তেমনি পন্ডিতের বাক্যবিন্যাস, শব্দের বাগাড়ম্বর, শাস্ত্র-ব্যাখ্যায় নৈপুণ্য ও বিদ্যাবেত্তা ভোগ্য- সুখের কারণ হতে পারে মোক্ষের নয়। ৫৭, ৫৮

অবিজ্ঞাতে পরে তত্ত্বে শাস্ত্রাধীতিস্তু নিষ্ফলা।

বিজ্ঞাতেঽপি পরে তত্ত্বে শাস্ত্রাধীতিস্তু নিষ্ফলা ॥ ৫৯॥

আর পরমতত্ত্ব যদি জানা না যায়, তাহলে শাস্ত্রাধ্যয়ন নিষ্ফল বা ব্যর্থ। আবার পরমতত্ত্ব জ্ঞান যদি লাভ হয়, তাহলেও শাস্ত্রাধ্যয়ন নিষ্প্রয়োজন। ৫৯

শব্দজালং মহারণ্যং চিত্তভ্রমণকারণম্ ।

অতঃ প্রয়ত্নাজ্জ্ঞাতব্যং তত্ত্বজ্ঞৈস্তত্ত্বমাত্মনঃ ॥ ৬০॥

অজ্ঞানসর্পদষ্টস্য ব্রহ্মজ্ঞানৌষধং বিনা ।

কিমু বেদৈশ্চ শাস্ত্রৈশ্চ কিমু মন্ত্রৈঃ কিমৌষধৈঃ ॥ ৬১॥

গহন অরণ্যের ন্যায় শাস্ত্রসমূহে বর্ণিত বিষয়বস্তুতে চিত্তে সংশয় উৎপন্ন হয়। সেজন্য কোনো তত্ত্বজ্ঞানী মহাপুরুষের কাছ থেকেই সযত্নে আত্মতত্ত্ব জানা উচিত। অজ্ঞানতারূপী সর্পের দংশনে পীড়িত ব্যক্তির ব্রহ্মজ্ঞানরূপী ঔষধ ছাড়া বেদ, শাস্ত্র, মন্ত্রতন্ত্র বা ঔষধে কি লাভ? ৬০,৬১

ন গচ্ছতি বিনা পানং ব্যাধিরৌষধশব্দতঃ ।

বিনাঽপরোক্ষানুভবং ব্রহ্মশব্দৈর্ন মুচ্যতে ॥ ৬২॥

ঔষধ পান না করে শুধু 'ঔষধ,ঔষধ' শব্দে রোগ নিরাময় হয় না, সেইরূপ অপরোক্ষানুভূতি (প্রত্যক্ষ অনুভব) ছাড়া কেবলমাত্র 'ব্রহ্ম' 'ব্রহ্ম' বলে চিৎকার করলেই মুক্ত হওয়া যায় না। ৬৪

অকৃত্বা দৃশ্যবিলয়মজ্ঞাৎবা তত্ত্বমাত্মনঃ ।

ব্রহ্মশব্দৈঃ কুতো মুক্তিরুক্তিমাত্রফলৈর্নৃণাম্ ॥ ৬৩॥

অকৃত্বা শত্রুসংহারমগৎবাখিলভূশ্রিয়ম্ ।

রাজাহমিতি শব্দান্নো রাজা ভবিতুমর্হতি ॥ ৬৪॥

দৃশ্যপ্রপঞ্চের বিলয় এবং আত্মতত্ত্বজ্ঞান ব্যতীত শুধুমাত্র বাহ্যিক শব্দ উচ্চারণে (আমি 'ব্রহ্ম' এরূপ বলার দ্বারা) মনুষ্যগণের মুক্তিলাভ কিরূপে সম্ভব? প্রতিদ্বন্দ্বী শত্রু বিনাশ না করে এবং সমগ্র পৃথিবীর ঐশ্বর্য্য লাভ না করে 'আমি রাজা' এরূপ ঘোষণা করলেই কেউ রাজা হয়ে যাবে না। ৬৩, ৬৪

আপ্তোক্তিং খননং তথোপরিশিলাদ্যুৎকর্ষণং স্বীকৃতিং

নিক্ষেপঃ সমপেক্ষতে ন হি বহিঃশব্দৈস্তু নির্গচ্ছতি

তদ্বদ্ব্রহ্মবিদোপদেশমননধ্যানাদিভির্লভ্যতে

মায়াকার্যতিরোহিতং স্বমমলং তত্ত্বং ন দুর্যুক্তিভিঃ॥ ৬৫॥

যেমন ভূগর্ভে রক্ষিত সম্পদ পেতে হলে প্রথমে কোন বিশ্বস্ত লোকের কথায় মৃত্তিকা খনন এবং পাথর ইত্যাদি অপসারণ করে প্রাপ্ত সম্পদ আহরণ করার প্রয়োজন হয়, শুধু কথায় হয় না, তেমনি মায়াশূন্য নির্মল আত্মতত্ত্ব ব্রহ্মবিদ্ গুরুদেবের উপদেশ তথা মনন এবং নিদিধ্যাসন দ্বারাই প্রাপ্ত হওয়া সম্ভব কেবল তর্ক- বিচারের দ্বারা নয়। ৬৫

তস্মাৎসর্বপ্রয়ত্নেন ভববন্ধবিমুক্তয়ে ।

স্বৈরেব যত্নঃ কর্তব্যো রোগাদাবিব পণ্ডিতৈঃ ॥ ৬৬॥

রোগ হইতে আরোগ্য লাভের জন্য যেমন নিজেকে ঔষধসেবনাদি করিতে হয় সেই প্রকার ভববন্ধন হইতে মুক্তিলাভের জন্য উপযুক্ত সাধনসমূহ অবলম্বন করা পণ্ডিতগণের কর্তব্য। ৬৬

Monday, 6 April 2020

শ্রীভগবানের 'রাম' নাম মাহাত্ম্যঃ-


শ্রীমহাভারতে অনুশাসনপর্ব্বণি 'বিষ্ণুসহস্রনাম স্তোত্রম্' এ বর্ণিত আছে-
রামো বিরামো বিরতো মার্গো নেয়ো নয়োঽনয়ঃ ।
বীরঃ শক্তিমতাং শ্রেষ্ঠো ধর্মো ধর্মবিদুত্তমঃ ॥ ৪৩॥

শাঙ্করভাষ্যম্ঃ- নিত্যানন্দলক্ষণোহস্মিন্ যোগীনে রমন্ত ইতি রাম; 'রমন্তে যোগীনো যস্মিন্নিত্যানন্দে চিদাত্মনি। ইতি রামপদেনৈতত্পরং ব্রহ্মাভিধীয়তে।। ' সেচ্ছয়া রমণীয়ং বপূর্বহন্বা দাশরথী রামঃ।

শাঙ্কর ভাষ্যানুবাদঃ নিত্য আনন্দ স্বরূপ ভগবানের সহিত যোগীজন রমন করেন, সেজন্যই তিনি (বিষ্ণু) রাম। পদ্মপুরাণে বলা হয়েছে- যে নিত্যানন্দ স্বরূপ চিদাত্মায় যোগীজন রমন করেন সেই পরম ব্রহ্মকে 'রাম' এই নামে বলা হয়ে থাকে। নিজ ইচ্ছায় রমণীয় শরীর ধারণকারী দশরথ পুত্রই রাম।

তথ্যসূত্রঃ- ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্যের 'বিষ্ণুসহস্রনাম স্তোত্রম্' ভাষ্য।

শ্রীশুভ চৌধুরী।
রাম নবমী, ২০২০ খৃষ্টাব্দ



উপনিষৎপ্রসিদ্ধ মহাস্ত্র ওঙ্কারঃ-


অথর্ববেদের শৌনকীয় শাখার অন্তর্গত মুণ্ডক উপনিষদে বর্ণিত আছে-ধনুর্গৃহীত্বৌপনিষদং মহাস্ত্রং শরং হ্যুপাসানিশিতং সংধযীত৷ আযম্য তদ্ভাবগতেন চেতসা লক্ষ্যং তদেবাক্ষরং সোম্য বিদ্ধি৷৷ মুণ্ডক উপনিষৎ ২.২.৩ ৷
শাঙ্কর ভাষ্যানুবাদঃ- ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য্যের ভাষ্য হইল- এই অবিনাশী ব্রহ্মকে কিভাবে যে বিদ্ধ অর্থাৎ মনকে তাহাতে সমাহিত করিতে হইবে তাহা বলা হইতেছে। উপনিষৎসমূহে প্রসিদ্ধ মহাস্ত্র (প্রণব) অর্থাৎ মহৎও আবার তাহা অস্ত্রও, সেই মহাস্ত্র ধনু লইয়া তাহাতে (জীবরূপী) শরকে যোজনা কর। কিরূপ শরকে? ইহার উত্তরে বলিতেছেন-
উপাসনা দ্বারা শানিত অর্থাৎ নিরন্তর সম্যক্ ধ্যানের মাধ্যমে তীক্ষ্নীকৃত
অর্থাৎ বিষয়বৃত্তিশূন্য শরকে (জীবকে) সন্ধান অর্থাৎ ঐ ওঙ্কাররূপ ধনুতে যোজনা করিবে। আর শরসন্ধানপূর্ব্বক আকর্ষণ করিয়া অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ের সহিত মনকে নিজ নিজ বিষয় হইতে নিবৃত্ত করিয়া একমাত্র লক্ষ্যবিষয়েই একাগ্রতা সম্পন্ন করিয়া; কারণ এখানে হস্তের দ্বারা ধনু আকর্ষণের ন্যায় আকর্ষণ করা তো সম্ভব হয় না, সুতরাং ঐরূপ প্রত্যাহারপূর্ব্বক সেই অবিনাশী ব্রহ্মরূপ লক্ষ্যবিষয়ের ভাবপ্রাপ্ত চিত্তদ্বারা হে সৌম্য, সেই পূর্বোক্তলক্ষণ বিশিষ্ট ব্রহ্মরূপ লক্ষ্যকে বিদ্ধ কর।

ইতি ভাষ্যানুবাদ।

আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...