ভগবান
শ্রীদত্তাত্রেয় একই বাক্য বলিতেছেন- “এই সবই মরুভূমির মরীচিকার মত ইন্দ্রজাল। কেবল অখণ্ড ঘনাকার
শিবই বর্তমান (সত্য)”-(অবধূত গীতা, ৭ম অধ্যায়-১৩)
'মায়া
ইতি অবিদ্যমানস্য আখ্যা'-(শাঙ্করভাষ্য, মাণ্ডুক্য
কারিকা,৪। ৫৮) অর্থাৎ 'সেই মায়ার কোন সত্তা নাই। অভিপ্রায় এই
যে, অবিদ্যমান বা অসৎ পদার্থেরই নাম মায়া।'
শ্রীমদ্ভাগবত
পুরাণে ভগবান 'মায়া'র স্বরূপ নিরূপণ করিতেছেন এইভাবে-"বাস্তবিক যেখানে যা নাই সেখানে সেরকম
কি এক পদার্থের নাম জ্ঞান হইতেছে, নিশ্চিতরূপে যা বলা হয় নি, আত্মার অধিষ্ঠানে তা যে
কারণে প্রতীত হয়, কিংবা যা আছে তা বোঝা যাইতেছে না, এইরকম অভাবনীয় ব্যাপার যাহা থেকে
হয়, তাহাকে আমার মায়া বলিয়া জানিবে। আকাশ-স্থিত চাঁদের দিকে ও কাঁচে প্রতিবিম্বিত চাঁদের
দিকে দৃষ্টিপাত করিলে দুটি চাঁদ বলিয়া বোধ হয়। আকাশের চন্দ্র সত্য কিন্তু দ্বিতীয় চন্দ্র আকাশে
নাই অথচ দেখা যাইতেছে। এই দ্বিতীয় চন্দ্র প্রকৃত চন্দ্রের মত হইলেও সত্য নহে কিন্তু
দেখা যাইতেছে। সেইজন্য তাহাকে কি যেন এক বস্তু বলা হইতেছে। কাজেই এটি বাস্তব বস্তু ব্যতীত
অন্য বস্তুর প্রতীতির দৃষ্টান্ত। আবার বাস্তব বস্তুর প্রতীতির অভাব বা অপ্রতীতির দৃষ্টান্ত
তমঃ বা অন্ধকার। যেমন রাহু গ্রহমণ্ডলে থাকা সত্ত্বেও তাহাকে দেখা যায় না, সেইরূপ অন্ধকার
গৃহে অনেক বস্তু থাকিলেও তাহা দেখা যায় না-অন্ধকারই এখানে না দেখতে পাওয়ার কারণ। প্রথমোক্ত
দ্বিচন্দ্রদর্শন কিংবা গৃহস্থিত বস্তু দেখতে না পাওয়া-দুটোই অভাবনীয় ব্যাপার এবং
এর মূল কারণ মায়া।"
মায়া
অবিদ্যা অজ্ঞান প্রকৃতি আকাশ অক্ষর অব্যক্ত বীজশক্তি ও মহাসুপ্তি ইহারা পর্য্যায়শব্দরূপে
ব্যবহৃত হয়। ব্রহ্মসূত্রের 'তদধীনত্বাদর্থবৎ৷৷১.৪.৩৷৷' এইসূত্রে তাহা স্পষ্ট। ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য্য
উক্ত সূত্রের ভাষ্যে বলিতেছেন-
অবিদ্যারূপা
যে প্রসিদ্ধা বীজশক্তি, তাহা 'অব্যক্ত' এই শব্দের দ্বারা নির্দ্দেশের যোগ্য, তাহা পরমেশ্বরকে
আশ্রয়করতঃ অবস্থান করে, মায়াময়ী এবং মহাসুপ্তিস্বরূপা, যাহাতে স্বরূপজ্ঞানরহিত সংসারী
জীবগণ শয়ন করে অর্থাৎ আবদ্ধ হইয়া জন্মমৃত্যু অনুভব করে। সেই এই অব্যক্ত কোন কোন স্থলে
'আকাশ' এই শব্দের দ্বারা নির্দিষ্ট হইয়াছে, যেহেতু এইপ্রকার শ্রুতি আছে-
'এতস্মিন্নু
খল্বক্ষরে গার্গ্যাকাশ ওতশ্চ প্রোতশ্চ'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৩/৮/১১)
অর্থাৎ 'হে গার্গি, এই অক্ষরে (ক্ষয়রহিত ব্রহ্মে) 'আকাশ' ওতপ্রোতভাবে অবস্থিত আছে।'
কোন
কোন স্থলে তাহা অক্ষরশব্দের দ্বারা বর্ণিত হইয়াছে, যেহেতু এইপ্রকার শ্রুতি আছে-
'অক্ষরাত্পরতঃ পরঃ'-(মুণ্ডক উপনিষৎ-২/১/২) অর্থাৎ 'স্বীয় কার্য্যপ্রপঞ্চ হইতে শ্রেষ্ঠ যে অক্ষর (-অব্যাকৃত), তদপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।'
আবার
কোন কোন স্থলে 'মায়া' এইরূপে সূচিত হইয়াছে যেহেতু এইপ্রকার মন্ত্রবর্ণ আছে-
'মায়াং
তু প্রকৃতিং বিদ্যান্মায়িনং তু মহেশ্বরম্'-(শ্বেতাশ্বতর উপনিষৎ-৪/১০)
অর্থাৎ 'প্রকৃতিকে মায়া বলিয়া জানিবে এবং মহেশ্বরকে মায়াধীশ বলিয়া জানিবে।'
সেই
প্রসিদ্ধা মায়াই অব্যক্ত, কারণ তাহার তত্ত্ব বা অন্যত্ব নিরূপণ করিতে পারা যায় না।......
এইভাবে ভগবান ভাষ্যকার শঙ্কর এইসূত্রের ভাষ্যে চমৎকার যুক্তিসহকারে তাহা উপস্থাপন করেন।
এই
মায়া সর্বজ্ঞ পরমেশ্বরের শক্তি, অনির্বচনীয় এবং সংসার প্রপঞ্চের পরিণামী বীজস্বরূপ।
ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্যে আচার্য্য শঙ্কর তাহা স্পষ্ট করিতেছেন-
'সর্বজ্ঞ
ঈশ্বরের যেন আত্মভূত (নিজস্বরূপ) যে অবিদ্যাকল্পিত নাম ও রূপ, যাহারা তত্ত্ব ও অন্যত্বের
দ্বারা অনির্বচনীয় (অর্থাৎ যাহাকে সদ্ রূপে অথবা অসদ্ রূপে নির্ব্বচন করিতে পারা যায়
না) এবং যাহারা সংসারপ্রপঞ্চের বীজস্বরূপ, তাহারা সর্বজ্ঞ ঈশ্বরের মায়াশক্তি ও প্রকৃতি,
এইরূপে শ্রুতি এবং স্মৃতিতে বর্ণিত হইতেছে।'-(ব্রহ্মসূত্র-২।১।১৪, শাঙ্করভাষ্য)
এই মায়া ব্যতিরেকে পরমেশ্বরের জগৎস্রষ্টৃত্ব সম্ভব নহে। শারীরক মীমাংসাতে শঙ্করাচার্য্যের ইহাই অভিপ্রায়। 'আমরা কিন্তু জগতের এই (মায়াশক্তিরূপা) প্রাগবস্থাকে পরমেশ্বরের অধীনরূপে অঙ্গীকার করিয়া থাকি, স্বাধীনরূপে নহে। আর তাহা অবশ্যই স্বীকার্য্যা, যেহেতু তাহা প্রয়োজনসম্পাদিকা। তদ্ব্যতিরেকে পরমেশ্বরের স্রষ্টৃত্ব নিশ্চয়ই সিদ্ধ হয় না, কারণ যিনি শক্তিরহিত, তাহার (সৃষ্ট্যাদিকর্ম্মে) প্রবৃত্তি যুক্তি সঙ্গত নহে।'-(ব্রহ্মসূত্র-১।৪।৩, শাঙ্করভাষ্য)
এই মায়া অস্বতন্ত্র, কারণ নিজের আশ্রয় ও অবভাসক চৈতন্যব্যতিরেকে ইহা ব্যবহার সম্পাদিকা হয় না। সেই মায়াকে তিন প্রকার দৃষ্টিতে তিনভাবে বুঝা যায়- "শ্রৌত দৃষ্টিতে তাহা তুচ্ছা, যুক্তির দৃষ্টিতে অনির্বচনীয়া এবং লৌকিক দৃষ্টিতে বাস্তবী।"-(বিদ্যারণ্য মুনি, পঞ্চদশী, ষষ্ঠ অধ্যায়-১৩০)
যেহেতু কোনবস্তু আলোক ও অন্ধকারের ন্যায় বিরূদ্ধ স্বভাবসম্পন্ন হইতে পারে না, আর তাদৃশ বিরুদ্ধধর্ম্মযুক্ত বস্তু কাহারও বুদ্ধিতে আরূঢ়ও হয় না। এইহেতু মায়া ও তাহার কার্য্য জগৎকে অদ্বৈতবেদান্তে 'মিথ্যা' বলা হয়।‘ব্রহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যা জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ’ - বিবেকচূড়ামণি গ্রন্থে পূজ্যপাদ শঙ্করের এতাদৃশ উক্তিতে তাহা পরিদৃষ্ট। তাছাড়া আত্মবোধে আচার্য বলিতেছেন-‘রাগ ও দ্বেষাদিযুক্ত এই সংসার স্বপ্নতুল্য, যেমন স্বপ্নসময়ে দৃশ্যমান বস্তু সত্য বলিয়া বোধ হয়, জাগ্রতকালে মিথ্যা বলিয়া জানা যায়, সেইরূপ যতকাল অজ্ঞান থাকে, ততকাল জগৎ সত্য বলিয়া প্রতীত হয়, কিন্তু তত্ত্বজ্ঞান উৎপন্ন হইলে জগতের মিথ্যাত্বই জ্ঞাত হওয়া যায়। যতকাল সকলের অধিষ্ঠানরূপ অদ্বিতীয় ব্রহ্মের জ্ঞান না হয়, তাবৎকাল শুক্তিকাতে (ঝিনুকে) রৌপ্যের ন্যায় জগৎ সত্য বলিয়া প্রতীত হয়।‘ -(শঙ্করাচার্য, আত্মবোধ-৬,৭)
এই 'মিথ্যা' শব্দের অর্থ-বন্ধ্যাপুত্রের ন্যায় অলীকত্ব নহে, পরন্তু অনির্বচনীয়ত্ব। বাস্তব সত্তারহিত যাহার প্রতীতি হয়, যাহার স্বরূপকে 'ইহা এই প্রকার' এইরূপে শৃঙ্গগ্রাহিতয়া নির্ব্বচন করা যায় না এবং বাক্যের দ্বারা বর্ণনা করা যায় না, তাহাকে বলে 'অনির্বচনীয়' বা 'মিথ্যা'। এই মিথ্যা শব্দ এই অর্থে এই দর্শনে পারিভাষিক। ভাষ্যকার আচার্য্য শঙ্কর তাঁহার অধ্যাসভাষ্যে "অধ্যাসো মিথ্যেতি ভবিতুং যুক্তম্'', 'অধ্যাস মিথ্যা হওয়াই উচিত' এইরূপে যে 'মিথ্যা' পদটির প্রয়োগ করিয়াছেন, তাহার ব্যাখ্যায় আচার্য পদ্মপাদ তাঁহার 'পঞ্চপাদিকায়' বলিয়াছেন, মিথ্যাশব্দের দুইটি অর্থ দেখা যায়—একটি অসম্ভব দ্বিতীয়টি অনির্বচনীয়তা। প্রথম অর্থে 'অধ্যাসো মিথ্যা', অর্থাৎ চিৎ ও অচিতের গ্রন্থিরূপ অধ্যাস সম্ভবপর নহে; দ্বিতীয় অর্থে অধ্যাস অনির্বচনীয়, ইহাই স্পষ্টতঃ বুঝা যায়। অনির্বচনীয়, অর্থাৎ সৎও নহে, অসৎও নহে; সদসৎও নহে; যে বস্তুকে সৎ বা সত্যরূপেও নির্বচন করা হয় না, অসত্যরূপেও নিরূপণ করা যায় না, সত্যাসত্যরূপেও ব্যাখ্যা করা সম্ভবপর হয় না; এরূপ বস্তুই অনির্বচনীয় আখ্যা লাভ করে। অনির্বচনীয় বস্তুমাত্রই মিথ্যা। ফলে, 'সদসদ্বিলক্ষণত্ব'ই মিথ্যাত্ব, এরূপ মিথ্যাত্বের লক্ষণই আসিয়া পড়ে। আচার্য পদ্মপাদ্ এই দৃষ্টিতেই তাহার মিথ্যাত্বের লক্ষণ বা পরিচয় লিপিবদ্ধ করিয়াছেন। পদ্মপাদের এই লক্ষণটি চিৎসুখাচার্য তাঁহার গ্রন্থে মিথ্যাত্বের পঞ্চম লক্ষণ হিসেবে উল্লেখ করিয়াছেন। তাছাড়া ইহা নিছক কল্পনা নহে, ইহা শ্রুতি সিদ্ধান্ত। যথা- অথর্ববেদীয় সর্বসারোপনিষৎ এ বর্ণিত আছে-
"অনাদিরন্তবতী প্রমাণাপ্রমাণসাধারণা ন সতী নাসতী ন সদসতী স্বয়মধিকা বিকাররহিতা নিরূপ্যমাণা সতীতরলক্ষণশূন্যা সা মায়েত্যুচ্যতে।"-(সর্বসারোপনিষৎ-১৩)
"শুরু নেই কিন্তু শেষ আছে, প্রমাণ আছে আবার প্রমাণ নাই, আছে বলা যায় না আবার নেইও বলা যায় না। সৎ ও অসৎ একসঙ্গে বলা যায় না, (ব্রহ্ম) স্বয়ং বিকারশূন্য হওয়ায় বিকারের হেতুরূপে নিরূপ্যমান (জ্ঞাত) হইলে নাই এবং বিকারের হেতুরূপে নিরূপিত না হইলে আছে-এইরূপ লক্ষণশূন্য যা (ভাব) তাহাই-ই মায়া বলে কথিত হয়।"
মায়াকে ব্রহ্মচৈতন্য হইতে বস্তুতঃ ভিন্ন বলা চলে না; কারণ ব্রহ্ম ভিন্ন অন্য বস্তুর অস্তিত্ব নাই। উহাকে অভিন্ন বলা চলে না; কারণ চৈতন্য ও জড়ের অভেদ অসম্ভব। ভিন্নাভিন্নও বলা চলে না; কারণ ইহা স্ববিরুদ্ধ। এইরূপে মায়া সৎ নহে, কারণ তাহা হইলে ব্রহ্মের অদ্বিতীয়ত্বের হানি হয়; অসৎ নহে কারণ তাহা হইলে মায়া হইতে জগৎ উৎপত্তি অসম্ভব হয়; সৎ-অসৎ নহে কারণ ইহা স্ববিরুদ্ধ। মায়া সাবয়বা নহে, কারণ তাহলে উহার আদি স্বীকার করিতে হয় এবং তাহার ফলে সাদি মায়ার প্রতিবিম্ব ঈশ্বরও সাদি ও বিনাশী হন, নিরবয়বা নহে, কারণ তাহলে উহা ভূতবর্গের উপাদান হইবে না, কেননা সাবয়ব বস্তুই অপরের উপাদান হইতে পারে; উভয়রূপাও নহে, কারণ উহা স্ববিরুদ্ধ। ফলতঃ মায়া অনির্বচনীয়।
যোগবাশিষ্ঠসারে শ্রীবশিষ্ঠ তাহাই বলিতেছেন-"হে রাম! (সংসারকারণ) এই মায়া স্বনাশে আনন্দ দান করে। উহার স্বভাব দেখা বা বুঝা যায় না; কারণ (বিচারদৃষ্টিতে) দেখিলে উহাকে পাওয়াই যায় না, উহার নাশ হয় (উহা তাই অনির্বচনীয়)।"-(যোগবাশিষ্ঠসারঃ, জগৎ মিথ্যাত্ব প্রকরণ-৬)
বেদান্তবাক্যের যথাযথ অর্থ বিচার দ্বারা যে উত্তম জ্ঞান উৎপন্ন হয়, তার দ্বারাই সংসার-দুঃখের সর্বোতভাবে নাশ হয়ে থাকে। "ভ্রান্তিরূপা, নিরাশ্রয়া, নিঃস্বভাবা ও প্রমাণাসিদ্ধা এই মায়া (বেদান্তার্থ) বিচারের আঘাত সহ্য করিতে পারে না। অন্ধকার যেরূপ সুর্য্য-সান্নিধ্য-সহিষ্ণু নহে, অজ্ঞানও সেই রূপ বিচার-অসহিষ্ণু।"-(সুরেশ্বরাচার্য, নৈষ্কর্ম্য সিদ্ধি-৩।৬৬) ব্যবহার দশাতে আবরণস্বভাব ইহা অভাবপদার্থ না হইলেও নির্বিশেষ ব্রহ্মজ্ঞানবলে বাধিত হইয়া পড়ে, মাত্র তখনই ইহার 'তুচ্ছত্য' ও নিত্য-নিবৃত্তস্বরূপতা' অবধারিত হয়, তৎপূর্ব্বে নহে।
এই মায়ারূপ উপাধি এবং তৎকৃত নামরূপাদি উপাধিযোগেই শুদ্ধ নির্গুণ ব্রহ্ম ঈশ্বর নামে অভিহিত হন (ব্রহ্মসূত্র-১।৪।৩, শাঙ্করভাষ্যে পরিলক্ষিত) এবং মায়া উপাধিযোগে তিনিই বিভিন্নরূপধারী নটের ন্যায় জগতের যাবতীয় কার্য্যরূপে ব্রহ্মবিদের দৃষ্টিতে প্রতিভাত হন। আচার্য্য শঙ্করও তাই বলিতেছেন- 'মূলকারণই (ব্রহ্মই) চরম কার্য্য পর্য্যন্ত সেই সেই কার্য্যরূপে নটের ন্যায় হন সকল প্রকার ব্যবহারের আশ্রয়।'-(ব্রহ্মসূত্র-২।১।১৮, শাঙ্করভাষ্য)
ভগবান শঙ্করাচার্য বলিতেছেন-"মায়ার আবরণ ও বিক্ষেপ নাম্নী দুইটি শক্তি আছে।"-(বাক্যসুধা-১৩) সদানন্দ যোগীন্দ্র সরস্বতী বেদান্ত সারে (৫২-৫৪) বলিতেছেন-"আবরণ শক্তি হল যেমন একখণ্ড ছোট মেঘ, দ্রষ্টা পুরুষের নয়নপথ আচ্ছাদিত করায় অনেক যোজন আয়তন বিশিষ্ট সূর্যমণ্ডল যেন আচ্ছন্ন হয়ে গেছে, সেরুপ অজ্ঞান পরিচ্ছন্ন (মেঘের মতো সসীম) হলেও দ্রষ্টা পুরুষের বুদ্ধিকে আচ্ছাদন করায় অসীম অসংসারী আত্মা যেন আচ্ছাদিত হয়েছে, এরূপ বোধ করার সামর্থ্যকে আবরণ শক্তি বলে। হস্তামলকাচার্য বলেছেন-'অতিমুঢ় যেমন মেঘের দ্বারা আবৃত সূর্যকে আচ্ছাদিত নিষ্প্রভ বলে মনে করে, সেরূপ যার বুদ্ধি আবৃত, তার কাছে যিনি বদ্ধ বলে মনে হয়, সেই নিত্য উপলব্ধিস্বরূপ আত্মাই আমি।'-(হস্তামলকম্-১০)"
অজ্ঞানের এই আবরণশক্তি দ্বারা আবৃত আত্মায় কর্তৃত্ব ভোক্তৃত্ব সুখিত্ব দুঃখিত্ব প্রভৃতি সংসার সম্ভাবনাও থাকে, যেমন নিজ অজ্ঞানের দ্বারা আবৃত রজ্জুতে সর্প ভাবনার সম্ভাবনা থাকে।
বিক্ষেপশক্তি হইলো, যেমন রজ্জুর অজ্ঞান রজ্জুকে আবৃত করিয়া রজ্জুতে নিজশক্তির দ্বারা সর্প প্রভৃতি কল্পনা করে, সেরূপ (আত্মাশ্রিত) অজ্ঞান আত্মাকে আবৃত করিয়া আত্মাকে নিজশক্তি বলে আকাশাদি জগৎ সৃষ্টি করে। (এভাবে কল্পনা-বলে) সৃষ্টি করার এই সামর্থ্যকে বিক্ষেপশক্তি বলে। এই সম্পর্কে বাক্যসুধায় শঙ্করাচার্য বলিতেছেন—বিক্ষেপশক্তি সূক্ষ্মশরীর থেকে আরম্ভ করিয়া ব্রহ্মাণ্ড পর্যন্ত জগৎ সৃষ্টি করে।'-(বাক্যসুধা-১৩)"
সর্বজ্ঞাত্ম মুনি তাহাই বলিতেছেন-"আত্মামাত্রের বিষয়তা ও আশ্রয়তা বলেই আবরণ ও বিক্ষেপ শক্তিদ্বয় দ্বারা অজ্ঞান স্বপ্রকাশ-আত্মস্বরূপকে আচ্ছাদিত করিয়া তাঁহাকে মিথ্যা (পরমার্থ সত্য নহে এইরূপ) জীব, ঈশ্বর ও জগৎরূপে বিক্ষিপ্ত করে।"-(সংক্ষেপ শারীরকম্-১।২০)