ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য্য বিরচিত বিবেকচূড়ামণিঃ
সর্ববেদান্তসিদ্ধান্তগোচরং তমগোচরম্ ।
গোবিন্দং পরমানন্দং সদ্গুরুং প্রণতোঽস্ম্যহম্ ॥ ১॥
সর্ববেদান্ত সিদ্ধান্তে যাঁর কথা বলা হয়েছে, যিনি
বাক্যমনের অতীত পরমানন্দস্বরূপ সদ্ গুরু, সেই গোবিন্দকে (পরমাত্মা অথবা আচার্য্য গোবিন্দপাদ্)
আমি প্রণাম করি।
জন্তূনাং নরজন্ম দুর্লভমতঃ পুংস্ত্বং ততো বিপ্রতা
তস্মাদ্বৈদিকধর্মমার্গপরতা বিদ্বত্ত্বমস্মাত্পরম্
।
আত্মানাত্মবিবেচনং স্বনুভবো ব্রহ্মাত্মনা সংস্থিতিঃ
মুক্তির্নো শতজন্মকোটিসুকৃতৈঃ পুণ্যৈর্বিনা লভ্যতে ॥ ২॥
জীবগণের মনুষ্যজন্ম দুর্লভ, এর থেকেও দুর্লভ পুরুষদেহ
প্রাপ্তি আবার তার থেকেও দুর্লভ বিপ্রদেহধারী হওয়া। ব্রাহ্মণ হলেও চাই বেদবিহিত ধর্মমার্গে
নিষ্ঠা। আবার এর থেকেও শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি শাস্ত্রের তাৎপর্যজ্ঞান। আত্মা ও আনাত্ম বিষয়ের
বিচার, এসবের সম্যক্ অনুভব, ব্রহ্মের সঙ্গে একাত্ম অবস্থায় স্থিতি ও এর ফলস্বরূপ মুক্তি-
শতকোটি জন্মের সুকৃতি ও পূণ্যফল ব্যাতীত লাভ করা যায় না।
দুর্লভং ত্রয়মেবৈতদ্দেবানুগ্রহহেতুকম্ ।
মনুষ্যত্বং মুমুক্ষুত্বং মহাপুরুষসংশ্রয়ঃ ॥ ৩॥
মনু্ষ্য-জন্ম লাভ, সংসারবন্ধন থেকে মুক্তির ইচ্ছা
ও ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের সঙ্গ, এই তিনটি এ জগতে দুর্লভ। ঈশ্বরের বিশেষ অনুগ্রহ হলে তবে
এগুলি পাওয়া যায়।
লব্ধ্বা কথঞ্চিন্নরজন্ম দুর্লভং
তত্রাপি পুংস্ত্বং শ্রুতিপারদর্শনম্ ।
য়স্ত্বাত্মমুক্তৌ ন য়তেত মূঢধীঃ
স হ্যাত্মহা স্বং বিনিহন্ত্যসদ্গ্রহাত্ ॥ ৪॥
কোনও রকমে দুর্লভ নরজন্ম আর সেই জন্মে পুরুষশরীর
ও বেদান্তবিচারে পারদর্শিতা লাভ করেও যে মূঢ়বুদ্ধির মানুষ নিজের মুক্তির জন্যে যত্ন
করে না, সেই আত্মঘাতী পুরুষ অসৎ-বস্তু গ্রহণের ফলে নিজেকেই বিনষ্ট করে।
ইতঃ কো ন্বস্তি মূঢাত্মা য়স্তু স্বার্থে প্রমাদ্যতি
।
দুর্লভং মানুষং দেহং প্রাপ্য তত্রাপি পৌরুষম্ ॥ ৫॥
দুর্লভ মনুষ্যদেহ, তার ওপর আবার পুরুষশরীর পেয়েও
যে নিজের স্বার্থ বুঝতে ভুল করে বসে তার থেকে বেশী নির্বোধ আর কে আছে?
বদন্তু শাস্ত্রাণি য়জন্তু দেবান্
কুর্বন্তু কর্মাণি ভজন্তু দেবতাঃ ।
আত্মৈক্যবোধেন বিনাপি মুক্তি-
র্ন সিধ্যতি ব্রহ্মশতান্তরেঽপি ॥ ৬॥
অনেকেই শাস্ত্র পাঠ করে শাস্ত্রালোচনা করতে পারে,
দেবতাদের কৃপা লাভের জন্যে যজ্ঞ করতে পারে, শাস্ত্রবিহিত কর্মের অনুষ্ঠান করতে পারে,
বহু দেব-দেবীর ভজনা করতে পারে কিন্তু ব্রহ্মের সঙ্গে একাত্মতা ছাড়া শত ব্রহ্মার আয়ুষ্কালের
মধ্যেও মুক্তি লাভ হবে না।
অমৃতত্ত্বস্য নাশাস্তি বিত্তেনেত্যেব হি শ্রুতিঃ
।
ব্রবীতি কর্মণো মুক্তেরহেতুত্বং স্ফুটং য়তঃ ॥ ৭॥
বিত্ত লাভের দ্বারা মুক্তির আশা নেই, শ্রুতি এই
কথা বলেছেন। এই কথা থেকে এটাই স্পষ্ট হয় যে শ্রুতির কাম্য কর্মকে মুক্তির কারণ বলে
মনে করা যায় না।
অতো বিমুক্ত্যৈ প্রয়তেত বিদ্বান্
সন্ন্যস্তবাহ্যার্থসুখস্পৃহঃ সন্ ।
সন্তং মহান্তং সমুপেত্য দেশিকং
তেনোপদিষ্টার্থসমাহিতাত্মা ॥ ৮॥
এই জন্যে যিনি বুদ্ধিমান তিনি বাহ্যবিষয়ে থেকে
সুখভোগের স্পৃহা সম্পূর্ণভাবে ত্যাগ করবেন আর সদগুণসম্পন্ন উদারচরিত দেশমান্য আত্মজ্ঞ
পুরুষকে সদগুরুরূপে প্রাপ্ত হইয়া তাঁর উপদিষ্ট সাধনায় মনকে একাগ্র করিবেন এবং মুক্তির
জন্যে প্রযত্ন করবেন।
উদ্ধরেদাত্মনাঽঽআত্মানং মগ্নং সংসারবারিধৌ ।
য়োগারূঢত্বমাসাদ্য সম্যগ্দর্শননিষ্ঠয়া ॥ ৯॥
শুদ্ধদর্শন ও নিষ্ঠা সহকারে যোগরূঢ় অবস্থা লাভ
করে সংসারসাগরে নিমজ্জিত আত্মাকে নিজের শুদ্ধ আত্মার সাহায্যে উদ্ধার করতে হবে।
সন্ন্যস্য সর্বকর্মাণি ভববন্ধবিমুক্তয়ে ।
য়ত্যতাং পণ্ডিতৈর্ধীরৈরাত্মাভ্যাস উপস্থিতৈঃ ॥ ১০॥
আত্মচিন্তার অভ্যাসে স্থিত থেকে স্থিরবুদ্ধি, শাস্ত্রের মর্মগ্রাহী পণ্ডিতগণ সমস্ত সকাম কর্মের অনুষ্ঠান বর্জন করে সংসারবন্ধন থেকে মুক্তির জন্যে যত্নপরায়ণ হবেন।
মোক্ষকারণসামগ্র্যাং ভক্তিরেব গরীয়সী ।
স্বস্বরূপানুসন্ধানং ভক্তিরিত্যভিধীয়তে ॥ ৩১॥
স্বাত্মতত্ত্বানুসন্ধানং ভক্তিরিত্যপরে জগুঃ।
মোক্ষের সাধনসমূহের মধ্যে ভক্তিই শ্রেষ্ঠ। নিজের স্বরূপের অনুসন্ধানকেই ভক্তি বলে অভিহিত করা হয়। আবার অন্য অনেকে আত্মার ও পরমাত্মার তত্ত্ব-বিচারকেই ভক্তি বলে থাকেন।৩১
উক্তসাধন্সম্পন্নস্তত্ত্বজিজ্ঞাসুরাত্মনঃ।
উপসীদেদ্ গুরুং প্রাজ্ঞং যস্মাদ্ বন্ধবিমোচনম্।।৩২।।
আগে যেসব সাধনের কথা বলা হয়েছে সেইসব সাধনসম্পন্ন, আত্মতত্ত্বজিজ্ঞাসু ব্যাক্তি ব্রহ্মজ্ঞ গুরুর সমীপে যাবেন, কারণ গুরুর সাহায্যেই এই সংসারবন্ধন হইতে মুক্তি ঘটে।৩২
শ্রোত্রিয়োঽবৃজিনোঽকামহতো যো ব্রহ্মবিত্তমঃ ।
ব্রহ্মণ্যুপরতঃ শান্তো নিরিন্ধন ইবানলঃ ।
অহেতুকদয়াসিন্ধুর্বন্ধুরানমতাং সতাম্ ॥ ৩৩॥
যিনি বেদজ্ঞ, নিষ্পাপ, নিষ্কাম ও শ্রেষ্ঠ ব্রহ্মবিদ্, যাঁর মন বাহ্যবিষয় থেকে সরে এসে ব্রহ্মে স্থিত হয়ে আছে, যিনি ইন্ধনশূন্য জ্বলন্ত কাঠের আগুনের মতো শান্ত ও তেজস্বী, যিনি অহেতুক দয়াসিন্ধু তিনি প্রণত সজ্জন ব্যাক্তিদের কল্যাণকারী বন্ধু। ৩৩
তমারাধ্য গুরুং ভক্ত্যা প্রহ্ব- প্রশ্রয় -সেবনৈঃ।
প্রসন্নম্ তমনুপ্রাপ্য পৃচ্ছেৎ জ্ঞাতব্যমাত্মনঃ।।৩৪।।
সেই গুরুকে ভক্তিভরে প্রণাম করে বিনম্র সেবায় আরাধনা করে প্রসন্ন করবে, তারপর তাঁকে নিজের যা জানার আছে তা জিজ্ঞেস করবে।৩৪
স্বামিন্ নমস্তে নতলোকবন্ধো
করুণ্যসিন্ধো পতিতং ভবাব্ধৌ।
মামুদ্ধরাত্মীয়কটাক্ষদৃষ্ট্যা
ঋজ্বহতিকারুণ্যসুধাভিবৃষ্ট্যা।। ৩৫।।
প্রণতজনের বন্ধু, দয়াসিন্ধু হে প্রভু, তোমার করুণামৃতবর্ষী সরল, স্নিগ্ধ কৃপাকটাক্ষদৃষ্টি দ্বারা সংসারসমুদ্রে পতিত আমাকে উদ্ধার কর। ৩৫
দুর্বারসংসারদবাগ্নিতপ্তং
দোধূয়মানং দুরদৃষ্টবাতৈঃ ।
ভীতং প্রপন্নং পরিপাহি মৃত্যোঃ
শরণ্যমন্যদ্যদহং ন জানে ॥৩৬।।
যা থেকে রক্ষা পাওয়া অতীব দুষ্কর সেই সংসার দাবানলে আমি দগ্ধ,দুর্ভাগ্যের প্রবল ঝরে আমি বিদ্ধস্ত,কম্পিত,ভীত সন্ত্রস্ত। দয়া করে এই হতভাগ্য শরণাগতকে রক্ষা করুন। আপনি ছাড়া আর কোনো আশ্রয়স্থল আমি জানি না। ৩৬
শান্তা মহান্তো নিবসন্তি সন্তো
বসন্তবল্লোকহিতং চরন্তঃ ।
তীর্ণাঃ স্বয়ং ভীমভবার্ণবং জনা-
নহেতুনান্যানপি তারয়ন্তঃ ॥ ৩৭॥
আপনি স্বয়ং ভয়ংকর সংসার-সাগর থেকে উত্তীর্ণ হয়েছেন,অন্যদেরও বিনা কারণেই এই দুরন্ত সংসার-সাগর পার করিয়েছেন।জীব কল্যাণে আপনি সতত রত।আপনি শান্ত মহাপুরুষ এবং ঋতুরাজের মত মনোহর মূর্তিতে সর্বদা বিরাজিত। ৩৭
অয়ং স্বভাবঃ স্বত এব যৎপর-
শ্রমাপনোদপ্রবণং মহাত্মনাম্ ।
সুধাংশুরেষ স্বয়মর্ককর্কশ-
প্রভাভিতপ্তামবতি ক্ষিতিং কিল ॥ ৩৮
মহাত্নাগণের স্বভাবই এমন যে তাঁরা স্বেচ্ছায় অন্যদের শ্রম দূর করতে প্রবৃত্ত হন। প্রচন্ড সৌরতাপে তাপিত ধরণী যেমন সুশীতল চন্দ্রকিরণে শান্ত হয় তেমনি এই মহাত্নাগণ তাপিত প্রানীর তাপ নিবারণ করেন। ৩৮
ব্রহ্মানন্দরসানুভূতিকলিতৈঃ পূতৈঃ সুশীতৈর্যুতৈ-
র্যুষ্মদ্বাক্কলশোজ্ঝিতৈঃ শ্রুতিসুখৈর্বাক্যামৃতৈঃ সেচয়।
সন্তপ্তং ভবতাপদাবদহনজ্বালাভিরেনং প্রভো
ধন্যাস্তে ভবদীক্ষণক্ষণগতেঃ পাত্রীকৃতাঃ স্বীকৃতাঃ ॥ ৩৯॥
হে প্রভো! প্রচন্ড সংসার-দাবানলের দগ্ধ এই দীন শরণাগতকে আপনি আপনার ব্রহ্মানন্দরসানুভবযুক্ত পরম পুণ্যময়, সুশীতল,নির্মল বাক্যরূপ স্বর্ণকলস হতে নির্গত শ্রতিসুখকর বচনামৃত দ্বারা সিঞ্চন করুন অর্থাৎ এই সংসারের তাপ শান্ত করুন। তাঁরাই ধন্য যাঁরা ক্ষণকালের জন্যও আপনার এক মুহূর্তের করুণাদৃষ্টি লাভ করেছেন। ৩৯
কথং তরেয়ং ভবসিন্ধুমেতং
কা বা গতির্মে কতমোঽস্ত্যুপায়ঃ ।
জানে ন কিঞ্চিৎকৃপয়াঽব মাং প্রভো
সংসারদুঃখক্ষতিমাতনুষ্ব ॥ ৪০॥
'আমি কিভাবে এই সংসার-সমুদ্র উত্তীর্ণ হবো? আমার কি গতি হবে? তার কি উপায় আছে? - এসব আমি কিছুই জানি না।প্রভো!অনুগ্রহ করে আমাকে রক্ষা করুন আর আমার ভবদুঃখ ক্ষয়ের বিধান করুন। ৪০
তথা বদন্তং শরণাগতং স্বং
সংসারদাবানলতাপতপ্তম্ ।
নিরীক্ষ্য কারুণ্যরসার্দ্রদৃষ্ট্যা
দদ্যাদভীতিং সহসা মহাত্মা ॥ ৪১॥
ঐরূপ (প্রার্থনাপুর্ণ) কথায় তার শরণাগত সংসাররূপ দাবানলের জ্বালায় দগ্ধ,মুমুক্ষ শিষ্যকে করুণাভরা দৃষ্টিতে অবলোকন করে মহাত্না গুরুদেব অভয় প্রদান করবেন। ৪১
বিদ্বান্ স তস্মা উপসত্তিমীয়ুষে
মুমুক্ষবে সাধু যথোক্তকারিণে ।
প্রশান্তচিত্তায় শমান্বিতায়
তত্ত্বোপদেশং কৃপয়ৈব কুর্যাৎ ॥ ৪২॥
শরণার্থী, মুমুক্ষু, আদেশ পালনে তৎপর, শান্তচিত্ত, শমাদিযুক্ত সৎ শিষ্যকে গুরুদেব কৃপাপরবশ হয়ে তত্ত্বোপদেশ প্রদান করবেন। ৪২
মা ভৈষ্ট বিদ্বংস্তব নাস্ত্যপায়ঃ
সংসারসিন্ধোস্তরণেঽস্ত্যুপায়ঃ ।
যেনৈব যাতা যতয়োঽস্য পারং
তমেব মার্গং তব নির্দিশামি ॥ ৪৩॥
শ্রীগুরুদেব বললেন 'হে বিদ্বান! তুমি ভীত হয়ো না, তোমার বিনাশ হবে না। সংসার- সমুদ্র হতে ত্রাণের উপায় আছে। যে পথদ্বারা যতিগণ সংসার-সমুদ্রপার হয়েছেন, সেই পথই আমি তোমাকে জানাব।' ৪৩
অস্ত্যুপায়ো মহান্কশ্চিৎসংসারভয়নাশনঃ ।
তেন তীর্ত্বা ভবাম্ভোধিং পরমানন্দমাপ্স্যসি ॥ ৪৪॥
সংসারের ভয় নাশের কোন একটি মহাউত্তম উপায় আছে,যার দ্বারা তুমি সংসার-সাগর হতে উত্তীর্ণ হয়ে পরমানন্দ লাভ করবে। ৪৪
বেদান্তার্থবিচারেণ জায়তে জ্ঞানমুত্তমম্ ।
তেনাত্যন্তিকসংসারদুঃখনাশো ভবত্যনু ॥ ৪৫॥
বেদান্তবাক্যের যথাযথ অর্থ বিচার দ্বারা যে উত্তম জ্ঞান উৎপন্ন হয়,তার দ্বারাই সংসার-দুঃখের সর্বোতভাবে নাশ হয়ে থাকে। ৪৫
শ্রদ্ধাভক্তিধ্যানয়োগান্মুমুক্ষোঃ
মুক্তের্হেতূন্বক্তি সাক্ষাচ্ছ্রুতের্গীঃ ।
যো বা এতেষ্বেব তিষ্ঠত্যমুষ্য
মোক্ষোঽবিদ্যাকল্পিতাদ্দেহবন্ধাৎ ॥ ৪৬॥
শ্রুতিতে শ্রদ্ধা, ভক্তি, জ্ঞান ও যোগকে মুমুক্ষুর মুক্তির সাক্ষাৎ হেতু বলে বর্ণনা করা হয়েছে। যিনি এগুলোতে নিযুক্ত হন, তাঁর অবিদ্যাকল্পিত দেহবন্ধন হতে মুক্তিলাভ হয়। ৪৬
অজ্ঞানয়োগাৎপরমাত্মনস্তব
হ্যনাত্মবন্ধস্তত এব সংসৃতিঃ ।
তয়োর্বিবেকোদিতবোধবহ্নিঃ
অজ্ঞানকার্যং প্রদহেৎসমূলম্ ॥ ৪৭॥
অজ্ঞানতার কারণেই পরমাত্মারূপী তোমার এই অনাত্মবন্ধন, আর সেই কারণেই তোমার জন্মমরণরূপী সংসার প্রাপ্তি হয়েছে। সুতরাং ঐ আত্মা ও অনাত্মার বিবেক হতে উৎপন্ন বোধরূপ অগ্নি অজ্ঞানের কার্যস্বরূপ সংসারকে সমূলে ভস্মীভূত করবে। ৪৭
শিষ্য উবাচ ।
কৃপয়া শ্রূয়তাং স্বামিন্প্রশ্নোঽয়ং ক্রিয়তে ময়া
যদুত্তরমহং শ্রুত্বা কৃতার্থঃ স্যাং ভবন্মুখাৎ ॥ ৪৮॥
শিষ্যঃ 'হে প্রভু! আমি প্রশ্ন করছি, আপনি অনুগ্রহ করে আমার এই প্রশ্ন শুনুন। আপনার শ্রী-মুখ নিঃসৃত উত্তর পেয়ে আমি কৃতার্থ হব।' ৪৮
কো নাম বন্ধঃ কথমেষ আগতঃ
কথং প্রতিষ্ঠাস্য কথং বিমোক্ষঃ ।
কোঽসাবনাত্মা পরমঃ ক আত্মা
তয়োর্বিবেকঃ কথমেতদুচ্যতাম্ ॥ ৪৯॥
'বন্ধনের স্বরূপ কী? বন্ধন হয় কেন? কিভাবে এটি স্থিতিলাভ করে আর এ থেকে কিভাবে মুক্তিলাভ হয়? অনাত্মা কী? পরমাত্মা কাকে বলে আর তাঁর বিবেক বা পার্থক্যজ্ঞান কিভাবে ঘটে? আপনি অনুগ্রহ করে এসকল আমাকে বলুন।' ৪৯
শ্রীগুরুবাচ ।
ধন্যোঽসি কৃতকৃত্যোঽসি পাবিতং তে কুলং ত্বয়া ।
পাবিতং যদবিদ্যাবন্ধমুক্ত্যা ব্রহ্মীভবিতুমিচ্ছসি ॥ ৫০॥
শ্রীগুরুদেব বললেন- 'হে শিষ্য! তুমি ধন্য, তুমি কৃতার্থ, তোমার দ্বারা তোমার কুল পবিত্র হল; কেননা তুমি অবিদ্যারূপী বন্ধন হতে মুক্ত হয়ে ব্রহ্মভাব লাভে আগ্রহী।' ৫০
ঋণমোচনকর্তারঃ পিতুঃ সন্তি সুতাদয়ঃ ।
বন্ধমোচনকর্তা তু স্বস্মাদন্যো ন কশ্চন ॥ ৫১॥
পুত্রাদী পিতৃঋণ পরিশোধকারী হতে পারে, কিন্তু ভববন্ধন থেকে মুক্তি স্বয়ং ভিন্ন অন্য কেহ করতে পারে না। ৫১
মস্তকন্যস্তভারাদের্দুঃখমন্যৈর্নিবার্যতে ।
ক্ষুধাদিকৃতদুঃখং তু বিনা স্বেন ন কেনচিৎ ॥ ৫২॥
(যেমন) মাথার উপরে রাখা বোঝার কষ্ট বা দুঃখ (সেই বোঝাটি নামিয়ে) অন্য কেহ দুর করতে পারে, কিন্তু ক্ষুধা- তৃষ্ণা প্রভৃতির কষ্ট স্বয়ং ব্যতীত অন্য কেহ নিবারিত করতে পারে না। ৫২
পথ্যমৌষধসেবা চ ক্রিয়তে যেন রোগিণা ।
আরোগ্যসিদ্ধির্দৃষ্টাঽস্য নান্যানুষ্ঠিতকর্মণা ॥ ৫৩॥
অথবা রোগী স্বয়ং ঔষধ এবং পথ্য সেবনের দ্বারা আরোগ্য লাভ করে। অপর কেউ ঔষধ পথ্যাদি সেবন করলে রোগী নিরাময় হয় না। ৫৩
বস্তুস্বরূপং স্ফুটবোধচক্ষুষা
স্বেনৈব বেদ্যং ন তু পণ্ডিতেন ।
চন্দ্রস্বরূপং নিজচক্ষুষৈব
জ্ঞাতব্যমন্যৈরবগম্যতে কিম্ ॥ ৫৪॥
(তেমনি) বিবেকী পুরুষের আপন জ্ঞানচক্ষু দ্বারা বস্তুর স্বরূপ জানতে হবে (অন্য কারো দ্বারা নয়)। চাঁদের স্বরূপ আপন চোখের দ্বারাই জানা সম্ভব, অপরের চোখের দ্বারা কি সেটা জানা সম্ভব? ৫৬
অবিদ্যাকামকর্মাদিপাশবন্ধং বিমোচিতুম্ ।
কঃ শক্নুয়াদ্বিনাঽঽত্মানং কল্পকোটিশতৈরপি ॥ ৫৫॥
আপন চেষ্টা ছাড়া অবিদ্যা,কামনা আর কর্মাদির জাল কোটি কল্পেও কি ছিন্ন করা সম্ভব? অর্থাৎ অপর কেউ মুক্তি দিতে পারে না। ৫৫
ন যোগেন ন সাঙ্খ্যেন কর্মণা নো ন বিদ্যয়া ।
ব্রহ্মাত্মৈকৎববোধেন মোক্ষঃ সিধ্যতি নান্যথা ॥ ৫৬॥
যোগ বা সাংখ্য, কর্ম কিংবা বিদ্যা কোনো কিছুতেই মোক্ষ লাভ হয় না। ইহা কেবল ব্রহ্ম এবং আত্মার একত্ববোধ দ্বারাই সম্ভব, অন্য কোনো প্রকারে নয়। ৫৬
বীণায়া রূপসৌন্দর্যং তন্ত্রীবাদনসৌষ্ঠবম্ ।
প্রজারঞ্জনমাত্রং তন্ন সাম্রাজ্যায় কল্পতে ॥ ৫৭॥
বাগ্বৈখরী শব্দঝরী শাস্ত্রব্যাখ্যানকৌশলম্ ।
বৈদুষ্যং বিদুষাং তদ্বদ্ভুক্তয়ে ন তু মুক্তয়ে ॥ ৫৮॥
যেমন বীণার সৌন্দর্য এবং তার তালযুক্ত ঝংকার মানুষের মনোরঞ্জন করে কিন্তু তাতে কোনো সাম্রাজ্য লাভ হয় না। তেমনি পন্ডিতের বাক্যবিন্যাস, শব্দের বাগাড়ম্বর, শাস্ত্র-ব্যাখ্যায় নৈপুণ্য ও বিদ্যাবেত্তা ভোগ্য- সুখের কারণ হতে পারে মোক্ষের নয়। ৫৭, ৫৮
অবিজ্ঞাতে পরে তত্ত্বে শাস্ত্রাধীতিস্তু নিষ্ফলা।
বিজ্ঞাতেঽপি পরে তত্ত্বে শাস্ত্রাধীতিস্তু নিষ্ফলা ॥ ৫৯॥
আর পরমতত্ত্ব যদি জানা না যায়, তাহলে শাস্ত্রাধ্যয়ন নিষ্ফল বা ব্যর্থ। আবার পরমতত্ত্ব জ্ঞান যদি লাভ হয়, তাহলেও শাস্ত্রাধ্যয়ন নিষ্প্রয়োজন। ৫৯
শব্দজালং মহারণ্যং চিত্তভ্রমণকারণম্ ।
অতঃ প্রয়ত্নাজ্জ্ঞাতব্যং তত্ত্বজ্ঞৈস্তত্ত্বমাত্মনঃ ॥ ৬০॥
অজ্ঞানসর্পদষ্টস্য ব্রহ্মজ্ঞানৌষধং বিনা ।
কিমু বেদৈশ্চ শাস্ত্রৈশ্চ কিমু মন্ত্রৈঃ কিমৌষধৈঃ ॥ ৬১॥
গহন অরণ্যের ন্যায় শাস্ত্রসমূহে বর্ণিত বিষয়বস্তুতে চিত্তে সংশয় উৎপন্ন হয়। সেজন্য কোনো তত্ত্বজ্ঞানী মহাপুরুষের কাছ থেকেই সযত্নে আত্মতত্ত্ব জানা উচিত। অজ্ঞানতারূপী সর্পের দংশনে পীড়িত ব্যক্তির ব্রহ্মজ্ঞানরূপী ঔষধ ছাড়া বেদ, শাস্ত্র, মন্ত্রতন্ত্র বা ঔষধে কি লাভ? ৬০,৬১
ন গচ্ছতি বিনা পানং ব্যাধিরৌষধশব্দতঃ ।
বিনাঽপরোক্ষানুভবং ব্রহ্মশব্দৈর্ন মুচ্যতে ॥ ৬২॥
ঔষধ পান না করে শুধু 'ঔষধ,ঔষধ' শব্দে রোগ নিরাময় হয় না, সেইরূপ অপরোক্ষানুভূতি (প্রত্যক্ষ অনুভব) ছাড়া কেবলমাত্র 'ব্রহ্ম' 'ব্রহ্ম' বলে চিৎকার করলেই মুক্ত হওয়া যায় না। ৬৪
অকৃত্বা দৃশ্যবিলয়মজ্ঞাৎবা তত্ত্বমাত্মনঃ ।
ব্রহ্মশব্দৈঃ কুতো মুক্তিরুক্তিমাত্রফলৈর্নৃণাম্ ॥ ৬৩॥
অকৃত্বা শত্রুসংহারমগৎবাখিলভূশ্রিয়ম্ ।
রাজাহমিতি শব্দান্নো রাজা ভবিতুমর্হতি ॥ ৬৪॥
দৃশ্যপ্রপঞ্চের বিলয় এবং আত্মতত্ত্বজ্ঞান ব্যতীত শুধুমাত্র বাহ্যিক শব্দ উচ্চারণে (আমি 'ব্রহ্ম' এরূপ বলার দ্বারা) মনুষ্যগণের মুক্তিলাভ কিরূপে সম্ভব? প্রতিদ্বন্দ্বী শত্রু বিনাশ না করে এবং সমগ্র পৃথিবীর ঐশ্বর্য্য লাভ না করে 'আমি রাজা' এরূপ ঘোষণা করলেই কেউ রাজা হয়ে যাবে না। ৬৩, ৬৪
আপ্তোক্তিং খননং তথোপরিশিলাদ্যুৎকর্ষণং স্বীকৃতিং
নিক্ষেপঃ সমপেক্ষতে ন হি বহিঃশব্দৈস্তু নির্গচ্ছতি
তদ্বদ্ব্রহ্মবিদোপদেশমননধ্যানাদিভির্লভ্যতে
মায়াকার্যতিরোহিতং স্বমমলং তত্ত্বং ন দুর্যুক্তিভিঃ॥ ৬৫॥
যেমন ভূগর্ভে রক্ষিত সম্পদ পেতে হলে প্রথমে কোন বিশ্বস্ত লোকের কথায় মৃত্তিকা খনন এবং পাথর ইত্যাদি অপসারণ করে প্রাপ্ত সম্পদ আহরণ করার প্রয়োজন হয়, শুধু কথায় হয় না, তেমনি মায়াশূন্য নির্মল আত্মতত্ত্ব ব্রহ্মবিদ্ গুরুদেবের উপদেশ তথা মনন এবং নিদিধ্যাসন দ্বারাই প্রাপ্ত হওয়া সম্ভব কেবল তর্ক- বিচারের দ্বারা নয়। ৬৫
তস্মাৎসর্বপ্রয়ত্নেন ভববন্ধবিমুক্তয়ে ।
স্বৈরেব যত্নঃ কর্তব্যো রোগাদাবিব পণ্ডিতৈঃ ॥ ৬৬॥
রোগ হইতে আরোগ্য লাভের জন্য যেমন নিজেকে ঔষধসেবনাদি করিতে হয় সেই প্রকার ভববন্ধন হইতে মুক্তিলাভের জন্য উপযুক্ত সাধনসমূহ অবলম্বন করা পণ্ডিতগণের কর্তব্য। ৬৬
No comments:
Post a Comment