Saturday, 11 April 2020

নিরবয়ব ব্রহ্মই মায়ার আশ্রয়ঃ-



মহর্ষি বাদরায়ন ভগবৎ প্রণীতম্ বেদান্তমীমাংসা শাস্ত্রের সর্বোপেতাধিকরণের প্রতিপাদ্য বিষয়- 'নিরবয়ব হইলেও ব্রহ্মই মায়ার আশ্রয়।'

'সর্বোপেতা চ তদ্দর্শনাৎ৷৷ ব্রহ্মসূত্র ২.১.৩০৷৷

শাঙ্করভাষ্য অনুবাদঃ- ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য্য শারীরকভাষ্যে বলিতেছেন- বিচিত্রশক্তির সহিত সম্বন্ধবশতঃ এক হইলেও ব্রহ্ম হইতে বিচিত্র কার্য্য-প্রপঞ্চ অর্থাৎ বিবিধপ্রকার সৃষ্টি সঙ্গত, ইহা (২।১।২৮ সূত্র ও ইহার ভাষ্যে) বলা হইয়াছে। কিন্তু কি প্রকারে ইহা অবগত হওয়া যায় যে, পরব্রহ্ম বিচিত্র শক্তিযুক্ত? তাহা বলা হইতেছে-

'সর্বোপেতা চ তদ্দর্শনাৎ৷' অর্থাৎ আর শ্রেষ্ঠ দেবতা (ব্রহ্ম) সর্ব্বশক্তিযুক্ত, ইহা অঙ্গীকার করিতে হইবে। কোন হেতবলে? তাহা বলিতেছেন-'তদ্দর্শনাৎ' অর্থাৎ যেহেতু তিনি-

'সর্বকর্মা সর্বকামঃ সর্বরসঃ সর্বমিদমভ্যাত্তোবাক্যনাদরঃ'-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৩/১৪/২)।

অর্থাৎ তিনি সর্ব্বকর্ম্মা (এই বিশ্ব তাঁহার কর্ম্ম), সর্ব্ববিধ বিশুদ্ধ কামনাবান, সকল প্রকার সুখকর গন্ধযুক্ত, সর্ব্বপ্রকার উত্তম রসযুক্ত, এই সমগ্র জগৎব্যাপিয়া বর্তমান, বাগিন্দ্রিয় বিবর্জ্জিত এবং নিষ্কাম্।

'সত্যকামঃ সত্যসংকল্পঃ'-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৮/৭/১)।

অর্থাৎ তিনি সত্যকামও সত্যসঙ্কল্প।

'যঃ সর্বজ্ঞঃ সর্ববিৎ'-(মুণ্ডক উপনিষৎ-১/১/৯)।

যিনি সর্বজ্ঞ ও সর্ববিৎ।

'এতস্য বা অক্ষরস্য প্রশাসনে গার্গি সূর্যাচন্দ্রমসৌ বিধৃতৌ তিষ্ঠতঃ'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৩/৮/৯)।

'হে গার্গি, এই অক্ষরের (নাশরহিত পরমেশ্বরের) প্রকৃষ্ট শাসনে সূর্য্য ও চন্দ্রমা বিধৃত হইয়া অবস্থান করিতেছে।' ইত্যাদি এইজাতীয় শ্রুতি পরদেবতার সকলপ্রকার শক্তির সহিত সম্বন্ধ সেইপ্রকারেই প্রদর্শন করিতেছে।

টীকাঃ-তাছাড়া বহুশ্রুতিবচনই ঘোষণা করে যে, ব্রহ্ম শক্তিমান্। যেমন-'প্রকৃতিকে মায়া এবং পরমেশ্বরকে মায়াধীশ বলিয়া জানিবে।'-(শ্বেতাশ্বতর উপনিষৎ-৪.১০)

ভগবান বাদরায়ণকৃত পরবর্তী সূত্র হইল-

বিকরণত্বান্নেতি চেত্তদুক্তম্৷৷ ব্রহ্মসূত্র ২.১.৩১ ৷৷

শাঙ্করভাষ্য অনুবাদঃ- আচার্য্য শঙ্করভগবৎ এই সূত্রের ভাষ্যে বলিতেছেন- আচ্ছা, তাহা না হয় হইল, কিন্তু 'অচক্ষুষ্কমশ্রোত্রমবাগমনাঃ'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৩/৮/৮)। অর্থাৎ 'চক্ষুবিহীন, শ্রোত্রবিহীন, বাগিন্দ্রিয়রহিত, মনোবিহীন', ইত্যাদি এইজাতীয় শাস্ত্র পরদেবতা (ব্রহ্মকে) ইন্দ্রিয়রহিতরূপে উপদেশ করেন। সুতরাং তিনি সর্ব্বশক্তিযুক্ত হইলেও কি প্রকারে কার্য্যসম্পাদনে সমর্থ হইবেন? যেহেতু দেবতা প্রভৃতি চেতন ও সর্ব্বশক্তিযুক্ত হইলেও আধ্যাত্মিক শরীর ও ইন্দ্রিয়সম্পন্ন হইয়াই সেই সেই কার্য্যসম্পাদনে সমর্থরূপে বিজ্ঞাত হন। অতএব 'নেতি নেতি'(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৩/৯/২৬) 'ইহা নহে, ইহা নহে' এইপ্রকারে সকলপ্রকার বিশেষ যাঁহাতে প্রতিষিদ্ধ হইয়াছে, সেই দেবতার সকলপ্রকার শক্তির সহিত সম্বন্ধ কি প্রকারে সম্ভব হইবে?

তদুত্তরে বলিব, এই বিষয়ে যাহা বক্তব্য তাহা পূর্ব্বেই বলা হইয়াছে। (তদুত্তরে ব্রহ্মসূত্রের- ২।১।৩ বিলক্ষণত্বাধিকরণ প্রভৃতিতে ও ভাষ্যে আচার্য্য শঙ্কর স্পষ্ট করিয়াছেন) এই অতিগম্ভীর ব্রহ্মবস্তু শ্রুতিমাত্রগম্য, কিন্তু তর্কগম্য নহেন। একজনের যেপ্রকার সামর্থ্য দেখা গিয়াছে, অন্যেরও সেইপ্রকার সামর্থ্য হওয়া উচিত, এইপ্রকার কোন নিয়ম নাই। যাঁহাতে সকলপ্রকার বিশেষ প্রতিষিদ্ধ হইয়াছে, সেই ব্রহ্মেরও সকলপ্রকার শক্তির সহিত সম্বন্ধ সম্ভব, ইত্যাদি ইহাও অবিদ্যার দ্বারা কল্পিত যে রূপের বিভিন্নতা, তাহার উল্লেখের দ্বারা বলা হইয়াছে।

(ব্রহ্মসূত্রের-২।১।২৭ ভাষ্যে আচার্য্য শঙ্কর বলিতেছেন-অবিদ্যার দ্বারা কল্পিত রূপের বিভিন্নতা অঙ্গীকার করা হয়। তাছাড়া 'আত্মনিচৈবং বিচিত্রাশ্চ হি৷৷২.১.২৮৷৷' সূত্রের ভাষ্যে ভগবান ভাষ্যকার শঙ্কর স্পষ্ট করিতেছেন- আর দেখ এই বিষয়ে বিবাদ করা উচিত নহে যে, কিপ্রকারে স্বরূপের নাশ ব্যাতিরেকেই একব্রহ্মে অনেকপ্রকার আকারবিশিষ্ট সৃষ্টি হইবে? যেহেতু ''ন তত্র রথা ন রথযোগা ন পন্থানো ভবন্ত্যথ রথান্রথযোগান্পথঃ সৃজতে'-বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪/৩/১০, অর্থাৎ 'সেখানে (স্বপ্নে) রথসকল থাকে না, অশ্বসকল থাকে না এবং পথসকল থাকে না অথচ তিনি রথসকল অশ্বসকল ও পথসকলকে সৃষ্টি করেন।' ইত্যাদি শ্রুতিবাক্যের দ্বারা স্বপ্নদর্শী এক আত্মাতেও স্বরূপের নাশ ব্যাতিরেকেই অনেকপ্রকার আকারবিশিষ্ট সৃষ্টি পঠিত হইতেছে। আর লোকমধ্যেও দেবতা প্রভৃতিতে এবং মায়াবী প্রভৃতিতে স্বরূপের নাশ ব্যতিরেকেই হস্তী ও অশ্ব প্রভৃতি বিচিত্র সৃষ্টিসকল পরিদৃষ্ট হইতেছে। এই প্রকার এক ব্রহ্মেও স্বরূপের নাশ ব্যতিরেকেই অনেকপ্রকার আকার বিশিষ্ট সৃষ্টি হইবে।)

আর দেখ শাস্ত্রও 'অপাণিপাদো জবনো গ্রহীতা পশ্যত্যচক্ষুঃ স শ্রৃণোত্যকর্ণঃ' -(শ্বেতাশ্বতর উপনিষৎ-৩।১৯) অর্থাৎ 'হস্তপদ না থাকিলেও তিনি দ্রুত গমন করেন, চক্ষুবিহীন হইলেও দর্শন করেন, কর্ণবিহীন হইলেও শ্রবণ করেন।' এইপ্রকারে করণবিহীন অর্থাৎ দেহেন্দ্রিয়াদিরহিত ব্রহ্মের সকলপ্রকার শক্তির সহিত সম্বন্ধ প্রদর্শন করিতেছেন।

ইতি শাঙ্করভাষ্য অনুবাদ।

 

No comments:

আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...