ইতোমধ্যে আলোচনা করিয়াছি অদ্বৈতবেদান্ত সিদ্ধান্ত মতে সর্বদুঃখের বীজভূতা অবিদ্যার আত্যন্তিক নিবৃত্তি উপলক্ষিত পরমানন্দস্বরূপ শুদ্ধব্রহ্মাভিন্নতাই মোক্ষ (সদ্যোমুক্তি)। অদ্য প্রতিপাদ্য বিষয় সদ্যোমুক্তির স্বরূপ। পূর্বসিদ্ধ স্বস্বরূপে অবস্থিতিই মুক্তি।
'এবমেবৈষ
সংপ্রসাদোস্মাচ্ছরীরাত্সমুত্থায় পরং জ্যোতিরুপসংপদ্য স্বেন রূপেণাভিনিষ্পদ্যতে'-(ছান্দোগ্য
উপনিষৎ- ৮/১২/৩)
"এই
প্রকারেই এই সম্প্রসাদ (—উপাধিকালুষ্যরহিত জীব) এই শরীর হইতে উত্থিত (—স্থুল, সূক্ষ্ম
ও কারণ, এই শরীরত্রয়াভিমানবর্জিত) হইয়া পরম জ্যোতিঃকে (—পরমাত্মাকে) প্রাপ্ত হইয়া
(—সাক্ষাৎ অনুভব করিয়া) স্বস্বরূপে অভিব্যক্ত হন", শ্রুতিতে এই প্রকার পঠিত হইতেছে।
সেই স্থলে কি স্বর্গাদিতে পুণ্যকারিগণের ন্যায় নির্গুণব্রহ্মবিদের আগন্তুক (শরীর ও
ভোগাদি) কোনপ্রকার বিশেষের দ্বারা উৎপত্তি বর্ণিত হইতেছে, অথবা আত্মমাত্ররূপে স্থিতি?
এই প্রকার সংশয় হইলে ভগবান সূত্রকার বলিতেছেন—
"সম্পদ্যাবির্ভাবঃ
স্বেন শব্দাৎ"-(ব্রহ্মসূত্র-৪/৪/১) অর্থাৎ 'অবিশেষভাবে ফল হওয়ায় স্বর্গের ন্যায়
(বিশেষ শরীরাদির) উৎপত্তি', ইহা পূর্ব্বপক্ষীয়গণ বলিয়া থাকেন। আমাদিগের সিদ্ধান্ত
কিন্তু এই— "সম্পদ্য" –স্বয়ংপ্রকাশ আত্মাকে সাক্ষাদ্ভাবে অনুভব করিয়া
(সেই আত্মারূপেই বিদ্বানের) "আবির্ভাবঃ" –অভিব্যক্তি হইয়া থাকে। (তাহাতে
প্রমাণ কি? উত্তর—)"স্বেন" —যেহেতু "স্বস্বরূপে অভিব্যক্ত হয়"
এইপ্রকারে "শব্দাৎ"—স্বশব্দের প্রয়োগ হইয়াছে, ইহাই ভাব।
এখন
আবার সংশয় হইল যিনি পরম জ্যোতিঃকে প্রাপ্ত হইয়া স্বস্বরূপে অবস্থান করেন, তিনি কি পরমাত্মা
হইতে পৃথক্ই হন, অথবা অভিন্নভাবেই অবস্থান করেন, ইহা বিচার করিলে 'স তত্র পর্যেতি'-(ছান্দোগ্য
উপনিষৎ-৮।১২।৩) অর্থাৎ 'তিনি সেখানে পরিভ্রমণ করেন', এইপ্রকার আধার-আধেয়ভাবের নির্দ্দেশ
থাকায় এবং 'জ্যোতিরুপসংপদ্য'(ঐ) অর্থাৎ 'জ্যোতিঃকে প্রাপ্ত হইয়া', এইপ্রকার কর্ত্তৃ-কর্ম্মভাবের
নির্দ্দেশ থাকায় ব্রহ্ম হইতে মুক্তপুরুষের ভিন্নভাবেই অবস্থিতি হয়, এইপ্রকার যাঁহার
মতি সেইপূর্বপক্ষকে সিদ্ধান্তী বুঝাইতেছেন-
'অবিভাগেন
দৃষ্টত্বাৎ৷৷'-(ব্রহ্মসূত্র ৪.৪.৪)
ভগবৎপূজ্যপাদ
শঙ্করাচার্য্য উক্তসূত্রের ভাষ্যে বর্ণনা করিতেছেন-মুক্তপুরুষ পরমাত্মার সহিত অবিভক্তভাবেই
অবস্থান করেন। তাহাতে প্রমাণ কি? যেহেতু পরিদৃষ্ট হইতেছে-যেমন দেখ
'তত্ত্বমসি'-(ছান্দোগ্য
উপনিষৎ-৬।৮।৭)
অর্থাৎ
'তুমি তৎস্বরূপ'।
''অহং
ব্রহ্মাস্মি'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ- ১।৪।১০)
অর্থাৎ
আমিই ব্রহ্ম।
'যত্র
নান্যত্পশ্যতি'-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৭।২৪।১)
অর্থাৎ
যাঁহাতে অন্য কিছু দর্শন করে না।
'ন
তু তদ্দ্বিতীযমস্তি ততোন্যদ্বিভক্তং যত্পশ্যেৎ'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ- ৪।৩।২৩)
অর্থাৎ
কিন্তু তাঁহা (সেই দ্রষ্টা) হইতে ভিন্ন বিভক্ত সেই দ্বিতীয় বস্তু নাই, যাহাকে দর্শন
করিবে।
ইত্যাদি
এই শ্রুতিবাক্যসকল পরমাত্মাকে মুক্তজীবের সহিত অবিভক্তভাবেই প্রদর্শন করিতেছে। আর
'তৎক্রতুন্যায়' থাকায় যে প্রকার দর্শন, সেইপ্রকার ফলই সঙ্গত।
আর
'যথোদকং শুদ্ধে শুদ্ধমাসিক্তং তাদৃগেব ভবতি ৷ এবং মুনের্বিজানত আত্মা ভবতি গৌতম ৷৷-(কঠ
উপনিষৎ ২.১.১৫)
অর্থাৎ
যে বিদ্বানের উপাধিকৃত ভেদদর্শন নষ্ট হইয়া গিয়াছে এবং যিনি বিশুদ্ধ বিজ্ঞানঘন একরস
অদ্বিতীয় আত্মাকেই কেবল দর্শন করেন, সেই মননশীল অর্থাৎ জ্ঞানীর আত্মার স্বরূপ কি হয়?-ইহাই
বলিতেছেন-
যেইরূপ
শুদ্ধ অর্থাৎ নির্ম্মল উদকে (জলে) প্রক্ষিপ্ত নির্ম্মল জল একরসই হয় অর্থাৎ অন্যপ্রকার
হয় না কিন্তু তদ্রূপই হয়, সেইরূপ হে গৌতম! আত্মৈকদর্শী জ্ঞানীর আত্মাও ঠিক এইরূপই হয়।
ইহাই এই শ্রুতির তাৎপর্য্য।
ইত্যাদি
মুক্তপুরুষের স্বরূপ নিরূপণপর এই শ্রুতি বাক্যসকল পরমাত্মার সহিত মুক্তপুরুষের অবিভক্ততাই
প্রদর্শন করিতেছে।
আবার
এই বিষয়ে নদী ও সমুদ্রের দৃষ্টান্তসকলও ইহাই প্রদর্শন করিতেছে। যেমন-
যথা
নদ্যঃ স্যন্দমানাঃ সমুদ্রেস্তং গচ্ছন্তি নামরূপে বিহায৷ তথা বিদ্বান্নমরূপাদ্বিমুক্তঃ
পরাত্পরং পুরূষমুপৈতি দিব্যম্৷৷-(মুণ্ডক উপনিষৎ ৩.২.৮) ৷৷
অর্থাৎ
আর যেরূপ গঙ্গাদি নদীসমূহ প্রবাহিত হইয়া সমুদ্রকে প্রাপ্ত হইয়া নাম ও রূপের পরিত্যাগপূর্ব্বক
অস্ত- নিধর্ম্মক অর্থাৎ অভেদাত্মকসত্তা প্রাপ্ত হয় সেইরূপ অবিদ্যাজনিত নাম ও রূপ হইতে
বিমুক্ত হইয়া জ্ঞানী পূর্বোক্ত অক্ষর অর্থাৎ অব্যক্ত হইতে শ্রেষ্ঠ পূর্বোক্ত লক্ষণবিশিষ্ট
স্বপ্রকাশ প্রত্যক্ চৈতন্য পুরুষকে (ব্রহ্মকে) প্রাপ্ত হন।
আবার
প্রশ্ন উপনিষদেও একই ধ্বনি ধ্বনিত হইতেছে-
'স
যথমো নদ্যঃ সন্দ্যমানাঃ সমুদ্রায়ণাঃ সমুদ্রং প্রাপ্যাস্তং গচ্ছন্তি-ভিদ্যতে তাসাং নামরূপে,
সমুদ্র ইত্যেবং প্রোচ্যতে- এবমেবাস্য পরিদ্রষ্টুরিমাঃ ষোড়শ কলাঃ পুরুষায়ণাঃ পুরুষং
প্রাপ্যাস্তং গচ্ছন্তি, ভিদ্যতে চাসাং নামরূপে, পুরুষ ইত্যেবং প্রোচ্যতে। স এষোহকলোহমৃতো
ভবতি। তদেষ শ্লোকঃ।।'-(প্রশ্নোপনিষৎ ৬।৫)
অর্থাৎ
যদ্রুপ এই প্রবহমাণ নদীসমূহ সমুদ্রে পতিত হইলে অদৃশ্য হইয়া যায়, তাহাদের নাম ও রূপ
বিনষ্ট হয় এবং সমুদ্র নামেই নির্দিষ্ট হইয়া থাকে। ঠিক সেইরূপে পূর্বোক্ত পরিদ্রষ্টা
পুরুষের (পঞ্চভূত, ইন্দ্রিয়াদি, লোকসমূহ এবং নাম রূপ ইত্যাদি) এই ষোড়শ কলাও পুরুষকে
প্রাপ্ত হইয়া বিলীন হয় এবং উহাদের নাম ও রূপ বিনষ্ট হয়। তখন তাদের অধিষ্ঠানভূত অবশিষ্ট
তত্ত্বটি পুরুষ নামেই অভিহিত হয়।...
কিন্তু
কর্ত্তৃকর্ম্মাদিভাবে উক্তপ্রকার ভেদ নির্দ্দেশের গতি কি? উত্তর- ভেদের নির্দ্দেশ কিন্তু
অভিন্নতাতেও গৌণভাবে প্রযুক্ত হয়, যেহেতু
'স
ভগবঃ কস্মিন্প্রতিষ্ঠিত ইতি স্বে মহিম্নি'-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৭।২৪।১)
অর্থাৎ
'হে ভগবন্, তিনি কোথায় প্রতিষ্ঠিত? স্বমহিমাতে প্রতিষ্ঠিত।' ইত্যাদি শ্রুতি এবং
'আত্মরতিরাত্মক্রীড়ঃ'-(ছান্দোগ্য
উপনিষৎ-৭।২৫।২)
অর্থাৎ
'আত্মাতেই যাঁহার আনন্দ, আত্মাতেই যাঁহার ক্রীড়া।' ইত্যাদি এই সকল শ্রুতি পরিদৃষ্ট
হয়।
No comments:
Post a Comment