অদ্বৈতবেদান্তের সৃষ্টিক্রম বিষয়ক ধারাবাহিক আলোচনায় আজকের আলোচ্য বিষয় হইল-পরমেশ্বরের ধ্যানের দ্বারাই সৃষ্টি-ক্রমের ধারা চলিতেছে। ব্রহ্মই আকাশাদির অন্তরাত্মারূপে বর্ত্তমান থাকিয়া পর পর সৃষ্টি রচনা করেন। ব্রহ্মেরই একমাত্র সৃষ্টিকর্ত্তার লক্ষণ আছে, আকাশাদির নাই। আকাশাদির স্রষ্টৃত্ব মূলত ব্রহ্মেরই কর্ত্তৃত্ব। বেদান্তমীমাংসা শাস্ত্রের তদভিধ্যানাধিকরণের প্রতিপাদ্য বিষয় পূর্ব্বকার্য্যরূপ উপাধিযুক্ত ব্রহ্ম হইতে উত্তরকার্য্যোৎপত্তি।
তদভিধ্যানাদেব
তু তল্লিঙ্গাত্সঃ ৷৷ ব্রহ্মসূত্র ২.৩.১৩ ৷৷
ভগবান্
ভাষ্যকার শঙ্করাচার্য্য ভাষ্যে বলিতেছেন- এই আকাশাদি ভূতসকল কি নিজেই নিজের কার্য্যসকলকে
সৃজন করে, অথবা পরমেশ্বরই সেই সেই স্বরূপে অবস্থানকরতঃ অভিধ্যান করিয়া সেই সেই কার্য্যকে
সৃজন করেন, এইপ্রকার সন্দেহ হইলে, একপক্ষ বলেন-আকাশাদি ভূতসকল নিজেই নিজ নিজ কার্য্যকে
সৃজন করে, কিভাবে?- যেহেতু 'আকাশ হইতে বায়ু উৎপন্ন হইল', 'বায়ু হইতে অগ্নি উৎপন্ন হইল'-(তৈত্তিরীয়
উপনিষৎ-২।১), ইত্যাদিরূপে স্বাতন্ত্র্য শ্রুত হইতেছে। কিন্তু স্বতন্ত্র অচেতন ভূতসকলের
প্রবৃত্তি প্রতিষিদ্ধ হইয়াছে, তদুত্তরে তাহারা বলিতেছেন-ইহা দোষ নহে, যেহেতু 'সেই তেজঃ
ঈক্ষণ করিলেন', 'সেই জল ঈক্ষণ করিলেন'-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৬।২।৩,৪)-এই প্রকারে ভূতসকলের
চৈতন্য শ্রুত হইতেছে।
এইপ্রকার
অপসিদ্ধান্ত প্রাপ্ত হইলে কথিত হইতেছে, সেই পরমেশ্বরই সেই সেই স্বরূপে (-তত্তৎ ভূতরূপ
উপাধিযুক্তরূপে) অবস্থান করিয়া অভিধ্যান (-ঈক্ষণ) করতঃ সেই সেই পরবর্ত্তী কার্য্যকে
সৃষ্টি করেন। কোন প্রমাণ বলে? যেহেতু তদ্বোধক লিঙ্গপ্রমাণ আছে। সেই বিষয়ে শাস্ত্র এই-
'যঃ
পৃথিব্যাং তিষ্ঠন্যঃ পৃথিব্যা অন্তরো যং পৃথিবী ন বেদ যস্য পৃথিবী শরীরং যঃ পৃথিবীমন্তরো
যময়তি' -(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৩।৭।৩)
"যিনি
পৃথিবীতে অবস্থান করেন, যিনি পৃথিবীর অভ্যন্তরবর্ত্তী, পৃথিবীদেবতা যাঁহাকে জানেন না,
পৃথিবী যাঁহার শরীর, যিনি অভ্যন্তরে থাকিয়া পৃথিবীদেবতাকে নিয়মন করেন", ইত্যাদি
এইজাতীয় শাস্ত্র অধ্যক্ষবিশিষ্ট ভূতসকলেরই প্রবৃত্তি প্রদর্শন করিতেছেন।
'সোকামযত
বহু স্যাং প্রজাযেযেতি' ইতি প্রস্তুত্য, 'সচ্চ ত্যচ্চাভবৎ"-(তৈত্তিরীয় উপনিষৎ-২।৬)
এইরূপে
"তিনি কামনা করিয়াছিলেন-বহু হইব, প্রকৃষ্টরূপ উৎপন্ন হইব", এইরূপ আরম্ভ করিয়া
"তিনি সৎ (-স্থুল) এবং ত্যৎ (-সূক্ষ্ম) হইলেন।' এবং
'তদাত্মানং
স্বয়মকুরুত'-(তৈত্তিরীয় উপনিষৎ-২।৭)
"তিনি
নিজেই নিজেকে এইরূপ করিয়াছিলেন", ইত্যাদি শ্রুতিসকল তাঁহারই সর্ব্বাত্মভাব প্রদর্শন
করিতেছেন।
আর
জল ও তেজের যে ঈক্ষণের কথা শ্রুতিতে বর্ণিত হইয়াছে, তাহাকে পরমেশ্বরের আবেশ (-অন্তর্যামিরূপে
সম্বন্ধ) বশতঃই অবগত হইতে হইবে, যেহেতু-
'নান্যোতোস্তি
দ্রষ্টা'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৩।৭।২৩)
"ইঁহা
হইতে ভিন্ন দ্রষ্টা কেহ নাই", এই প্রকারে অন্য ঈক্ষণকর্ত্তারও প্রতিষেধ হইয়াছে।
আর যেহেতু-
'তদৈক্ষত
বহু স্যাং প্রজায়েয়েতি'-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৬।২।৩)
'"তিনি
(-সেই সদ্রূপ পরমেশ্বর) ঈক্ষণ করিলেন-বহু হইব প্রকৃষ্টরূপে উৎপন্ন হইব", ইত্যাদি
এইস্থলে সৎস্বরূপ ঈক্ষণকর্ত্তা (-পরমেশ্বর) প্রস্তাবিত হইয়াছেন।
No comments:
Post a Comment