অদ্বৈতবেদান্তে সৃষ্টিক্রম বিষয়ক ধারাবাহিক আলোচনায় আজকের আলোচ্যবিষয় পৃথিবীর উৎপত্তি। ভগবান্ বাদরায়ণের বেদান্তমীমাংসা শাস্ত্রের 'পৃথিব্যধিকরণম্' এর প্রতিপাদ্য বিষয় জলভাবাপন্ন ব্রহ্ম হইতে পৃথিবীর উৎপত্তি হয়।
পৃথিব্যধিকাররূপশব্দান্তরেভ্যঃ
৷৷ ব্রহ্মসূত্র-২।৩।১২৷৷
এই
সূত্রে ভগবান ভাষ্যকার শঙ্করাচার্য্যের ভাষ্য হইল-'তা আপ ঐক্ষন্ত বহ্ব্যঃ স্যাম প্রজাযেমহীতি
তা অন্নমসৃজন্ত'-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৬।২।৪) "তাহা (-সেই জল) ঈক্ষণ করিল 'বহু হইব,
প্রকৃষ্টরূপে উৎপন্ন হইব', তাহা অন্নকে সৃষ্টি করিল", এইপ্রকার শ্রুত হইতেছে।
সেই স্থলে সংশয় হয়-এই 'অন্ন' শব্দের দ্বারা কি ধান্য ও যবাদি এবং ভক্ষণযোগ্য ভোজ্যবস্তু
প্রভৃতি কথিত হইতেছে, অথবা পৃথিবী কথিত হইতেছে?
পূর্বপক্ষীয়গণ
(ভিন্ন মতাবলম্বী) বলেন যে সেই স্থলে ধান্য যবাদি ও ভোগ্যবস্তু প্রভৃতিকে গ্রহণ করিতে
হইবে, যেহেতু লোকমধ্যে তাহাতে 'অন্ন' শব্দের প্রসিদ্ধি আছে। আর এই শ্রুতিবাক্যশেষও
এই অর্থকে পুষ্ট করিতেছে, যথা-'তস্মাদ্যত্র ক্বচন বর্ষতি তদেব ভূযিষ্ঠমন্নং ভবতি'-(ছান্দোগ্য
উপনিষৎ-৬।২।৪) "সেইহেতু যেখানেই বর্ষণ হয়, সেখানেই প্রচুর অন্ন উৎপন্ন হয়",
ইত্যাদি। দেখ, বর্ষণ হইলে ধান্য ও যবাদিই প্রচুর হয়, পৃথিবী নহে।
এইপ্রকার
পূর্বপক্ষ প্রাপ্ত হইলে বলিতেছি- জল হইতে উৎপদ্যমানরূপে এই পৃথিবীই অন্ন শব্দের দ্বারা
বিবক্ষিত হইতেছে। কোন হেতুবলে বলিতেছ? যেহেতু অধিকার (-প্রকরণপ্রমাণ) আছে, রূপ (-লিঙ্গপ্রমাণ)
আছে এবং অন্য শ্রুতিবাক্যও আছে।
'তত্তেজোসৃজত'
'তদপোসৃজত'-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৬।২।৩)
"তিনি
তেজকে সৃষ্টি করিলেন", "তিনি জলকে সৃষ্টি করিলেন", এইপ্রকার মহাভূতবিষয়ক
তদুৎপত্তিপ্রতিপাদক প্রকরণপ্রমাণ বর্ত্তমান আছে। সেইস্থলে ক্রমপ্রাপ্ত পৃথিবীরূপ মহাভূতকে
লঙ্ঘন করিয়া অকস্মাৎ ধান্য প্রভৃতির গ্রহণ ন্যায্য নহে।
আবার
এইরূপে বাক্যশেষে পৃথিবীর অনুগুণ (অনুকূল) রূপও পরিদৃষ্ট হইতেছে-
'যত্কৃষ্ণং
তদন্নস্য'-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৬।৪।১) "যাহা কৃষ্ণবর্ণ তাহা অন্নের", ইত্যাদি।
ভক্ষণযোগ্য অন্ন প্রভৃতির কৃষ্ণত্বনিয়ম অর্থাৎ তাহাদের বর্ণ কৃষ্ণই হইবে এইপ্রকার নিয়ম
নিশ্চয় নাই, আর ধান্য প্রভৃতিরও তাহা নাই। কিন্তু পৃথিবীরও কৃষ্ণত্বনিয়ম নিশ্চয়ই নাই,
যেহেতু দুগ্ধের ন্যায় শ্বেতবর্ণ ও অঙ্গারের ন্যায় লোহিতবর্ণ ক্ষেত্রপরিদৃষ্ট হয়। তদুত্তরে
বলিব, ইহা দোষ নহে, যেহেতু বাহুল্যকে অপেক্ষা করে। যেহেতু পৃথিবীরই কৃষ্ণবর্ণের প্রাচুর্য্য
আছে, শ্বেত ও লোহিতবর্ণের তাদৃশ প্রাচুর্য্য নাই। পৌরাণিকগণও পৃথিবীর ছায়াকে শর্বরীরূপে
(রাত্রিরূপে) উপদেশ করেন; আর তাহা কৃষ্ণবর্ণা এইহেতু পৃথিবীর বর্ণ কৃষ্ণ, ইহা যুক্তিসঙ্গত।
আবার
মহাভূতের উৎপত্তিবিষয়ক সমান প্রকরণে পঠিত অন্য শ্রুতিও আছে, যথা-
'অদ্ভ্যঃ
পৃথিবী'-(তৈত্তিরীয় উপনিষৎ-২।১)
"জল
হইতে পৃথিবী উৎপন্ন হইল" এবং
'তদ্যদপাং
শর আসীত্তত্সমহন্যত সা পৃথিব্যভবত্'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-১।২।২)
"সেইস্থলে
জলের উপর শরের ন্যায় যাহা ছিল, তাহা গাঢ়তা প্রাপ্ত হইল, তাহাই হইল পৃথিবী", ইত্যাদি।
কিন্তু
পৃথিবী হইতে ধান্য প্রভৃতির উৎপত্তি শ্রুতি প্রদর্শন করিতেছেন-
'পৃথিব্যাঃ
ওষধয়ঃ ওষধীভ্যোন্নম্'-(তৈত্তিরীয় উপনিষৎ-২।১)
"পৃথিবী
হইতে ওষধিসকল এবং ওষধিসকল হইতে অন্ন উৎপন্ন হইল।"
এইপ্রকারে পৃথিবীর প্রতিপাদক প্রকরণ, লিঙ্গ ও অন্যশ্রুতিপ্রমাণ বর্ত্তমান থাকায় ছান্দোগ্যপঠিত 'অন্ন' শব্দ হইতে ব্রীহি প্রভৃতির জ্ঞান কি প্রকারে হইবে? লৌকিক প্রসিদ্ধিও উক্তপ্রকরণ প্রমাণাদির দ্বারা বাধিত হইতেছে। আর ঐ ছান্দোগ্য শ্রুতির বাক্যশেষও ভক্ষণীয় অন্ন পৃথিবী হইতে উৎপন্ন হওয়ায় তাহাকে দ্বার করিয়া পৃথিবীরই জল হইতে উৎপত্তি সূচনা করিতেছে, এইপ্রকার বুঝিতে হইবে। সেইহেতু এই পৃথিবীই অন্ন শব্দবাচ্য।
No comments:
Post a Comment