"আত্মা বা অরে দ্রষ্টব্যঃ শ্রোতব্যো মন্তব্যো নিদিধ্যাসিতব্যো"-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-২/৪/৫) আচার্য শঙ্কর এই শ্রুতির ভাষ্যে বলছেন—"অতএব আত্মাই দ্রষ্টব্য—সাক্ষাৎকারের উপযুক্ত, অর্থাৎ আত্মবিষয়ক দর্শন সম্পাদন করা আবশ্যক। সেই জন্য শ্রোতব্য—প্রথমে শাস্ত্র ও আচার্য হতে জ্ঞাতব্য; পশ্চাৎ মন্তব্য, অর্থাৎ অনুকূল তর্ক দ্বারা তা সমর্থন করতে হবে; তারপর নিদিধ্যাসিতব্য অর্থাৎ নিসংশয়ঃরূপে তাকে ধ্যান করতে হবে। এইরূপে শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসনের সাহায্যে পরিশোধিত হলে পর, আত্মা প্রত্যক্ষগোচর হয়ে থাকে। যখন উক্ত সাধনগুলো একই আত্মবিষয়ে অনুগতভাবে প্রযুক্ত হয়, তখনই ব্রহ্মৈকত্ব-বিষয়ে সম্যক্ দর্শন উপস্থিত হয়, নচেৎ কেবল শ্রবণমাত্রে হয় না।"
এইপ্রকার
পাঠের পর শ্রুতিতে পঠিত হচ্ছে—"মৈত্রেয্যাত্মনে বা অরে দর্শনেন শ্রবণেন
মত্যা বিজ্ঞানেন ইদং সর্বং বিদিতম্" অরে মৈত্রেয়ী! আত্মবিষয়ে দর্শন, শ্রবণ,
মনন ও বিজ্ঞান হলেই এই দৃশ্যমান জগৎ বিজ্ঞাত হয়ে যায়।
শ্রবণ—তাৎপর্য
নির্ণায়ক ষড়বিধ লিঙ্গের দ্বারা উপনিষৎসকলের অদ্বিতীয় একরস ব্রহ্মে তাৎপর্য অবধারণের
অনুকূল মানসী ক্রিয়াকে বলে 'শ্রবণ'।
মনন—শ্রবণ
দ্বারা অবধারিত বিষয়ে প্রমাণান্তরের দ্বারা বিরোধের আশঙ্কা হলে, তা নিরাকরণের জন্য
শ্রুতির অনুকূল যুক্তিপ্রয়োগরূপ মানস ব্যাপারকে বলে 'মনন'।
নিদিধ্যাসন—যদ্বিষয়ে
শ্রবণ ও মনন করা হয়েছে, সেই অদ্বিতীয় ব্রহ্মবস্তুতে চিত্তস্থৈর্যের অনুকূল যে মানস
ব্যাপার, অর্থাৎ অনাদি দুর্বাসনাবশে রূপরসাদি বিষয়ে আকৃষ্ট চিত্তকে বিষয় হতে অপসরণকরতঃ
ব্রহ্মবস্তুতে যে তৎসজাতীয় প্রত্যয়প্রবাহ (-অবিচ্ছিন্নভাবে ধ্যান), তাকে বলে 'নিদিধ্যাসন'।
পূর্বেই
বলেছি ইহারা অসম্ভাবনা ও বিপরীতভাবনার নিবর্তক। এইযে ভেদজ্ঞানের প্রাবল্য, ইহাই বিপরীতভাবনা।
বস্তুতঃ দেহাদি পদার্থ সকল সত্য, তাহাতে আত্মবুদ্ধি, জীব ও ব্রহ্মের ভেদ সত্য, ইত্যাদি
এইপ্রকার যে বিপরীত বুদ্ধি, তাহাই 'বিপরীতভাবনা'। নিদিধ্যাসনের বলে ইহা নিরাকৃত হয়
এবং চিত্তের একাগ্রতা ও সুক্ষ্মবিষয়গ্রহণযোগ্যতা সম্পাদিত হয়।
বৃহদারণ্যক শ্রুতিতে বর্ণিত আছে—
তমেব ধীরো বিজ্ঞায় প্রজ্ঞাং কুর্বীত ব্রাহ্মণঃ। নানুধ্যায়াদ্বহূঞ্ছব্দান্ বাচো বিগ্লাপনꣳ হি তৎ।-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪/৪/২১)
"ধীর ও ব্রহ্মনিষ্ঠ পুরুষ সেই আত্মাকেই নিঃসংশয়রূপে অবগত হয়ে প্রজ্ঞালাভ করবেন অর্থাৎ অপরোক্ষ জ্ঞান লাভ করবেন। বহুশব্দের চিন্তা করবেন না, কারণ তাতে বাগিন্দ্রিয়ের অবসাদ জন্মে থাকে।"
অনন্যাশ্চিন্তয়ন্তো মাং যে জনাঃ পর্যুপাসতে৷ তেষাং নিত্যাভিযুক্তানাং যোগক্ষেমং বহাম্যহম্৷৷-(শ্রীগীতা -৯/২২)
"আমাকেই আত্মভাবে চিন্তাপূর্বক যে সর্বত্যাগীগণ আমার ধ্যান করেন, সেই নিত্য-সমাহিত
মুমুক্ষুগণের যোগ ও ক্ষেম আমি বহন করি।"
পূজ্যপাদ্
আচার্য বিদ্যারণ্য স্বামী "পঞ্চদশীতে" বলছেন—"এইরূপ শ্রুতিবচন ও স্মৃতিবচন বিপরীতভাবনার নিবৃত্তির জন্যই
আত্মাতে সর্বদা বুদ্ধির একাগ্রতার বিধান করছেন।"-(পঞ্চদশী-৭/১০৯)
শ্রীগীতার
টীকার প্রারম্ভে আচার্য পূজ্যপাদ মধুসূদন সরস্বতী বলেছেন—
"ততস্তৎপরিপাকেন নিদিধ্যাসননিষ্ঠতা। যোগশাস্ত্রস্তু সম্পূর্ণমুপক্ষীণং ভবেদিহ"।(১৭
শ্লোক) অতএব ধ্যান ধারণা ও সমাধি ইহারা (যোগসূত্র-৩/১-৩) এই নিদিধ্যাসনেরই অন্তর্গত।
প্রসঙ্গতঃ
শ্রবণ ও মননের দ্বারা নিরাকরণীয় অসম্ভাবনা কি, তা বলছি। অসম্ভাবনা দুইপ্রকার—১/
প্রমাণগত অসম্ভাবনা এবং ২/ প্রমেয়গত অসম্ভাবনা। 'বেদান্তবাক্য অদ্বিতীয় ব্রহ্মবস্তুকে
প্রতিপাদন করে, অথবা অন্য কিছুকে, অর্থাৎ 'উপনিষদ্বাক্যসকলের ব্রহ্মপ্রতিপাদকতা আছে,
অথবা নাই', এইপ্রকার যে উপনিদ্বাক্যরূপ প্রমাণবিষয়ক সংশয়, তাকে বলে ১/প্রমাণগত অসম্ভাবনা।
শ্রবণের দ্বারা এটি নিরাকৃত হয়।
আর জীব ও ব্রহ্মের ভিন্নতাই সত্য, অথবা অভিন্নতা;
ইন্দ্রিয়াগ্রাহ্য ব্রহ্মবস্তু আছেন, অথবা নাই; বুদ্ধিই আত্মা, অথবা তদতিরিক্ত কিছু
আছে; ইত্যাদি এই প্রকারে যে প্রমেয় ব্রহ্মবিষয়ক সন্দেহ, তাকে বলে ২/প্রমেয়গত অসম্ভাবনা।
মননের দ্বারা এটি নিরাকৃত হয়।.....ইতি
No comments:
Post a Comment