Thursday, 30 January 2020

'দশশ্লোকী' অথবা নির্বাণদশকস্তোত্রঃ-


শঙ্করাচার্য্য বিরচিত 'দশশ্লোকী' অথবা নির্বাণদশকস্তোত্রঃ-
কেদারনাথে আচার্য্যের অন্তর্ধানের পূর্ব্ব সময়কালগুলির একক্ষণে সুধন্বা মহারাজ জগদ্গুরু শঙ্করকে জিজ্ঞাসা করিলেন-'হে আচার্য্য ভগবন্! বেদান্তসিদ্ধ ব্রহ্মের স্বরূপ কি? স্বল্প কথায় আমায় আর একবার বলুন। এইবিষয়ে আপনার কৃপায় যথেষ্ট শুনিয়াছি। আপনি নানাশাস্ত্র ভাষ্যে, বহুকথায় এই শ্রুতিসিদ্ধ ব্রহ্মজ্ঞান আমাদের প্রদান করিয়াছেন। তারপরও সারকথায় আর একবার বলিলে আমরা সবাই কৃতার্থ হইব।'
আচার্য্য কিয়ৎক্ষণ নিরব থাকিয়া প্রসন্নচিত্তে বলিলেন-'মহারাজ! এই প্রশ্ন আমার গুরুদেব গোবিন্দভগবৎ তাঁহার দেহত্যাগের পূর্বে আমাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, আর আমি এতদুত্তরে যাহা বলিয়াছিলাম তাহাই বলিতেছি,শ্রবণ কর-
॥ অথ দশশ্লোকী ॥
ন ভূমির্ন তোয়ং ন তেজো ন বায়ুঃ
ন খং নেন্দ্রিয়ং বা ন তেষাং সমূহঃ ।
অনেকান্তিকত্বাত্ সুষুপ্ত্যেকসিদ্ধঃ
তদেকোঽবশিষ্টঃ শিবঃ কেবলোঽহম্ ॥ ১॥

অর্থাৎ ক্ষিতি বারি বহ্নি বায়ু ব্যোম "আমি" নয়।
অথবা নয়ন আদি ইন্দ্রিয়-নিচয়।।
পঞ্চভূত -দশেন্দ্রিয়-সমষ্টি যে দেহ।
এই সকলের মধ্যে "আমি" নহে কেহ।।
কেন না এদের নিত্য হয় রুপান্তর।
জনম্ বিনাশশীল ইহারা নশ্বর।।
অতিক্রমি এই সব সুষুপ্তি সময়।
নির্বিকল্প নির্বিকার নির্লিপ্ত যে রয়।।
"আমি"সেই নিত্যমুক্ত অতীত সকল।
এক অবশিষ্ট শিবস্বরুপ কেবল।। ১

ন বর্ণা ন বর্ণাশ্রমাচারধর্মা
ন মে ধারণাধ্যানয়োগাদয়োঽপি ।
অনাত্মাশ্রয়াহংমমাধ্যাসহানাত্
তদেকোঽবশিষ্টঃ শিবঃ কেবলোঽহম্ ॥ ২॥

অর্থাৎ ব্রাক্ষণাদি জাতিবর্ণ না আছে আমার।
অথবা আশ্রম-ধর্ম-বিহিত আচার।।
না আছে ধারণা ধ্যান যোগাদি অভ্যাস।
অনাত্মা-আশ্রয় আমি,আমার অধ্যাস।।
নাহি বলে "আমি" হই বর্জিত সকল।
এক অবশিষ্ট শিবস্বরুপ কেবল।। ২

ন মাতা পিতা বা ন দেবা ন লোকা
ন বেদা ন য়জ্ঞা ন তীর্থং ব্রুবন্তি ।
সুষুপ্তৌ নিরস্তাতিশূন্যাত্মকত্বাত্
তদেকোঽবশিষ্টঃ শিবঃ কেবলোঽহম্ ॥ ৩॥

অর্থাৎ না আছে আমার মাতা পিতা বা দেবতা।
স্বর্গাদি না চাহে "আমি" তপঃসার্থকতা।
বেদাভ্যাস যাগ যজ্ঞ তীর্থপর্যটন।
কিছুই না করে "আমি" শাস্ত্রের বচন।।
নিরস্ত হইলে মনোবুদ্ধি সুষুপ্তিতে।
সর্বভূতসাক্ষিরুপে থাকে সমাধিতে।।
স্বরুপাবস্থিত "আমি" অতীত সকল।
এক অবশিষ্ট শিবস্বরুপ কেবল।। ৩

ন সাঙ্খ্যং ন শৈবং ন তত্পাঞ্চরাত্রং
ন জৈনং ন মীমাংসকাদের্মতং বা ।
বিশিষ্টানুভূত্যা বিশুদ্ধাত্মকত্বাত্
তদেকোঽবশিষ্টঃ শিবঃ কেবলোঽহম্ ॥ ৪॥

অর্থাৎ সাংখ্য শৈব পাঞ্চরাত্র জৈন মীমাংসক।
আদি যত ধর্মমত পৃথক পৃথক।।
"আমি" তে কিছুতে তার না আছে আভাস।
অনুভূতি -বিশেষেই যাহার বিকাশ।।
"আমি" সেই নিত্য শুদ্ধ আত্মা নির্মল।
এক অবশিষ্ট শিবস্বরুপ কেবল।।৪

ন চোর্ধ্বং ন চাধো ন চান্তর্ন বাহ্যং
ন মধ্যং ন তির্যঙ্ ন পূর্বাঽপরা দিক্ ।
বিয়দ্ব্যাপকত্বাদখণ্ডৈকরূপঃ
তদেকোঽবশিষ্টঃ শিবঃ কেবলোঽহম্ ॥ ৫॥

অর্থাৎ ঊর্ধ্ব অধো নাহি যার বাহির অন্তর।
মধ্য পার্শ্ব কোণ কিংবা দিক পূর্বাপর।।
যে আছে ব্যাপিয়া ব্যোম বিশ্বচরাচরে।
অনন্ত অখণ্ড এক দিব্যরুপ ধরে।।
"আমি" সেই সর্বব্যাপী সর্বসুমঙ্গল।
এক অবশিষ্ট শিবস্বরুপ কেবল।। ৫

ন শুক্লং ন কৃষ্ণং ন রক্তং ন পীতং
ন কুব্জং ন পীনং ন হ্রস্বং ন দীর্ঘম্ ।
অরূপং তথা জ্যোতিরাকারকত্বাত্
তদেকোঽবশিষ্টঃ শিবঃ কেবলোঽহম্ ॥ ৬॥

অর্থাৎ শুক্ল কৃষ্ণ রক্ত পীত না আছে বরণ।
কুব্জ স্থূল হ্রস্ব দীর্ঘ নাহি আয়তন।।
নাহি যার কোনরুপ রুপে নির্ণয়।
যাবতীয় ভিন্নরুপ যাতে হয় লয়।।
"আমি" সেই শুদ্ধ জ্যোতিঃ নিত্য নির্মল।
এক অবশিষ্ট শিবস্বরুপ কেবল।। ৬

ন শাস্তা ন শাস্ত্রং ন শিষ্যো ন শিক্ষা
ন চ ত্বং ন চাহং ন চায়ং প্রপঞ্চঃ ।
স্বরূপাববোধো বিকল্পাসহিষ্ণুঃ
তদেকোঽবশিষ্টঃ শিবঃ কেবলোঽহম্ ॥ ৭॥

অর্থাৎ শাস্তা শাস্ত্র শিষ্য শিক্ষা কিছু নাহি যার।
"তুমি আমি" জ্ঞান নাহি প্রপঞ্চ-বিচার।
যে নিজ স্বরুপ জ্ঞানে স্বতন্ত্র প্রকাশ।
যাতে না সম্ভবে কভু বিকল্প আভাস।।
"আমি" সেই নিত্য শুদ্ধ আত্মা নির্মল।
এক অবশিষ্ট শিবস্বরুপ কেবল।। ৭

ন জাগ্রন্ ন মে স্বপ্নকো বা সুষুপ্তিঃ
ন বিশ্বো ন বা তৈজসঃ প্রাজ্ঞকো বা ।
অবিদ্যাত্মকত্বাত্ ত্রয়াণাং তুরীয়ঃ
তদেকোঽবশিষ্টঃ শিবঃ কেবলোঽহম্ ॥ ৮॥

অর্থাৎ জাগ্রত সুষুপ্তি স্বপ্ন তিন অবস্থার।
নাহি মোর অনুভূতি বিভিন্ন প্রকার।।
বিশ্ব বা তৈজস প্রাজ্ঞ "আমি" কভু নয়।
কেন না অবিদ্যারুপ এই তিন হয়।
সেহেতু তূরীয় আমি শুদ্ধ নির্মল।
এক অবশিষ্ট শিবস্বরুপ কেবল।। ৮

অপি ব্যাপকত্বাত্ হিতত্ত্বপ্রয়োগাত্
স্বতঃ সিদ্ধভাবাদনন্যাশ্রয়ত্বাত্ ।
জগত্ তুচ্ছমেতত্ সমস্তং তদন্যত্
তদেকোঽবশিষ্টঃ শিবঃ কেবলোঽহম্ ॥ ৯॥

অর্থাৎ বিশ্বচরাচর ব্যাপি যে আছে সতত।
তত্ত্বরুপ বলি যার প্রয়োগ বিদিত।।
স্বতঃসিদ্ধ, নাহি তুচ্ছ নিখিল সাংসার।।
"আমি" সেই নিত্য শুদ্ধ সর্ব সুমঙ্গল।
এক অবশিষ্ট শিবস্বরুপ কেবল।। ৯

ন চৈকং তদন্যদ্ দ্বিতীয়ং কুতঃ স্যাত্
ন কেবলত্বং ন চাকেবলত্বম্ ।
ন শূন্যং ন চাশূন্যমদ্বৈতকত্বাত্
কথং সর্ববেদান্তসিদ্ধং ব্রবীমি ॥ ১০॥

অর্থাৎ একত্বরহিত,কোথা দ্বিতীয় তাহার
কেবল বা অকেবল ভাব নাহি যার।।
শূন্য বা অশূন্য নহে অদ্বৈত বলিয়া।
কেমনে বেদান্ত-সিদ্ধ বলিয়া প্রকাশিয়া।।১০

ইতি শ্রীমত্পরমহংসপরিব্রাজকাচার্যস্য শ্রীগোবিন্দ-
ভগবত্পূজ্যপাদশিষ্যস্য শ্রীমচ্ছংকরভগবতঃ কৃতৌ
দশশ্লোকী সমাপ্তা৷৷

ইতি গোবিন্দভগবৎ শিষ্য শ্রীমৎ শংকরাচার্য্য বিরচিত দশশ্লোকী অথবা
নির্বাণদশকস্তোত্রং সমাপ্ত ॥

Monday, 27 January 2020

ব্রহ্মজিজ্ঞাসার উত্তরঃ-

সামবেদীয় কেন উপনিষদে ব্রহ্মজিজ্ঞাসু শিষ্যের ব্রহ্মনিষ্ঠ গুরুর প্রতি জিজ্ঞাসা হইল
-ॐ কেনেষিতং পততি প্রেষিতং মনঃ, কেন প্রাণঃ প্রথমঃ প্রৈতি যুক্তঃ। কেনেষিতাং বাচমিমাং বদন্তি, চক্ষুঃ শ্রোত্রং ক উ দেবো যুনক্তি।।১/১।।
ভগবৎপূজ্যপাদ্ শঙ্করাচার্য্যের শাঙ্করভাষ্য অনুসারে ভাবার্থঃ- মন কোন্‌ কর্ত্তার দ্বারা ইপ্সিত বা অভিপ্রেত হইয়া অর্থাৎ কাহার ইচ্ছা-নিয়োজিত হইয়া স্ব বিষয়াভিমুখে গমন করিতেছে? 'প্রথম' প্রাণ কাহার দ্বারা নিযুক্ত অর্থাৎ প্রেরিত হইয়া স্বীয় কার্য্যে প্রবৃত্ত হয়?
(সমস্ত ইন্দ্রিয়ের প্রবৃত্তি প্রাণকে অগ্রবর্ত্তী করিয়াই অর্থাৎ প্রাণের ক্রিয়া প্রথমে হইলে পরেই অনান্য ইন্দ্রিয়ের ক্রিয়া উৎপন্ন হয়; এই কারণে প্রাণকে ‘প্রথম’ বিশেষণে বিশেষিত করা হইয়াছে।)

আর কাঁহার ইচ্ছায় এই শব্দরূপ বাক্ কে লোকে উচ্চারণ করে? এবং কোন দেবতা (দ্যুতিমান্‌) চক্ষুঃ ও শ্রবণেন্দ্রিয়কে স্ব স্ব বিষয়ে নিযুক্ত অর্থাৎ প্রেরণ করেন?

এইরূপ প্রশ্নকারী যোগ্য শিষ্যকে ব্রহ্মজ্ঞ গুরু বলিলেন-তুমি যে জিজ্ঞাসা করিতেছ যে, বিষয়ের প্রতি মন প্রভৃতি ইন্দ্রিয় সমূহের প্রেরয়িতা কোন দেবতা এবং তিনি কি প্রকারেই বা প্রেরণ করেন তদুত্তর শ্রবণ কর-

শ্রোত্রস্য শ্রোত্রং মনসো মনো যদ্বাচো হ বাচংস উ প্রাণস্য প্রাণঃ ৷ 
চক্ষুষশ্চক্ষুরতিমুচ্য ধীরাঃ প্রেত্যাস্মাল্লোকাদমৃতা ভবন্তি ৷৷ ১.২ ৷
ভগবৎপূজ্যপাদ্ শঙ্করাচার্য্যের শাঙ্করভাষ্য অনুসারে ভাবার্থঃ- তিনি হইতেছেন শ্রোত্রের শ্রোত্র। যাহার দ্বারা শব্দ শ্রবণ করা যায় অর্থাৎ শব্দের শ্রবণে যাহা প্রধান সাধন, শব্দের অভিব্যক্তিকারী সেই ইন্দ্রিয়ই হইতেছে শ্রোত্র। আর তাহার অর্থাৎ শ্রোত্রেন্দ্রিয়েরও শ্রোত্র অর্থাৎ শ্রোত্রেন্দ্রিয়ের কার্য্যসামর্থ্যের হেতু হইতেছেন তিনি। শ্রবণেন্দ্রিয় যে নিজ বিষয়কে অর্থাৎ শব্দকে অভিব্যক্ত করিতে সমর্থ ইহা তো দেখাই যায়। তবে শ্রোত্রেন্দ্রিয়ের সেই নিজ বিষয় অভিব্যক্ত করিবার সামর্থ্য কিন্তু নিত্য, নিরবয়ব, সকলের অন্তঃস্থ চৈতন্যস্বরূপ আত্মজ্যোতি থাকিলেই হইয়া থাকে, না থাকিলে থাকে না।
অতএব চৈতন্যস্বরূপ আত্মজ্যোতিকে শ্রোত্রের শ্রোত্র বলা যথার্থই হয়। এইবিষয় সমর্থক অন্য শ্রুতিসকলও আছে-
'তখন অর্থাৎ বাহ্যজ্যোতি না থাকিলে এই পুরুষ আত্মজ্যোতি সহায়েই উপবেশনাদি করেন।'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪।৩।৬)
'তাহার দীপ্তিতেই এই সমস্ত জগৎ প্রকাশিত হয়।'-(কঠ উপনিষৎ-২।২।১৫)
'যাঁহার তেজের দ্বারা প্রদীপ্ত হইয়া সূর্য্য তাপ দিতেছেন।'-(তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ-৩।১২।৯।৭)

তাছাড়া শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাতেও বর্ণিত আছে-'যে জ্যোতিঃ সূর্যে, চন্দ্রে ও অগ্নিতে আছে এবং যাহা সমগ্র জগৎকে প্রকাশ করে, সেই জ্যোতিঃ আমার জানিবে। হে ভারত, যেরূপ একমাত্র সূর্য সমগ্র জগৎকে আলোকিত করেন, সেইরূপ ক্ষেত্রী অর্থাৎ আত্মা সকল দেহাদি ক্ষেত্রকে প্রকাশিত করেন।'-(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা-১৫।১২ ও ১৩।৩৪)
কঠ উপনিষদে আরও স্পষ্টভাবে আছে-'যিনি সমস্ত অনিত্য পদার্থের মধ্যে নিত্য এবং ব্রহ্মা আদি সমস্ত চেতনেরও প্রকাশক'(কঠ উপনিষৎ-২।২।১৩) অতএব শ্রোত্র প্রভৃতিরও শ্রোত্রাদিস্বরূপ অর্থাৎ শ্রোত্রাদি ইন্দ্রিয়সকলের সামর্থ্যের নিমিত্তস্বরূপ এমন কোন্ বস্তু আছে যাহা তত্ত্ববিদ্গণের বুদ্ধিগম্য, সকলের অন্তরতম, কূটস্থ, জন্মরহিত, জরারহিত, অমর এবং সর্বভয়নিবারক।
তিনি যেরূপ শ্রোত্রের শ্রোত্র সেইরূপ মনেরও অর্থাৎ অন্তঃকরণেরও মন। কারণ আত্মচৈতন্য জ্যোতির আলোক বিনা অন্তঃকরণ নিজবিষয়ে সঙ্কল্প ও নিশ্চয় করিতে সক্ষম হয় না। এইহেতু তিনি মনেরও মন। এখানে বুদ্ধি ও মনকে এক ধরিয়া 'মনসঃ' এই একপদে উভয়কে নির্দ্দেশ করা হইয়াছে।
তিনি সেইরূপ বাগিন্দ্রিয়েরও বাক্ অর্থাৎ শব্দোচ্চারণ সামর্থ্যের হেতু। তিনি সেইরূপ প্রাণের প্রাণ অর্থাৎ প্রাণ নামক ক্রিয়া বিশেষের মূল, যেহেতু তাহর দ্বারাই প্রাণের সক্রিয় থাকার সামর্থ্য হয়। কেননা আত্মার দ্বারা অধিষ্ঠিত অর্থাৎ পরিচালিত না হইলে প্রাণের সক্রিয় থাকা সম্ভব হয় না।
অন্য শ্রুতিসকল হইতেও ইহা সিদ্ধ হয়-'হৃদয় গুহাকাশে যদি এই আনন্দ ব্রহ্ম না থাকিতেন তবে কে-ই বা অপানক্রিয়া করিত, আর কে-ই বা প্রাণক্রিয়া করিত?'-(তৈত্তিরীয় উপনিষৎ-২।৭।১)
'তিনি প্রাণবায়ুকে উর্ধ্বদিকে সঞ্চালিত করেন এবং অপানবায়ুকে অধোদিকে নিক্ষেপ করেন।'-(কঠ উপনিষৎ-২।২।৩)
তাছাড়া এই উপনিষদেও কথিত হইবে-'যাহার দ্বারা প্রাণ পরিচালিত হয়, তাহাকেই তুমি ব্রহ্ম বলিয়া জানিও।'(কেন উপনিষৎ-১।৮)
সেইরূপ তিনি চক্ষুরও চক্ষু অর্থাৎ রূপের প্রকাশক চক্ষুরিন্দ্রিয়ের যে রূপগ্রহণের সামর্থ্য, তাহা আত্মচৈতন্য দ্বারা পরিচালিত হওয়ার ফলেই হয়।
অতএব শ্রোত্রাদির শ্রোত্রস্বরূপ ব্রহ্মই যে নিজের স্বরূপ ইহা জানিয়া অতিমুচ্য অর্থাৎ শ্রোত্রাদিতে আত্মবুদ্ধি পরিত্যাগ করিয়া ধীরগণ অর্থাৎ প্রশস্তবুদ্ধিসম্পন্নগণ প্রেত্য অর্থাৎ সম্পূর্ণ পৃথক হইয়া অর্থাৎ পুত্র, মিত্র, ভার্য্যা এবং বন্ধু প্রভৃতিতে আমি, আমার ব্যবহাররূপ ভাবনালোক হইতে পৃথক হইয়া অর্থাৎ সকল বাসনা পরিত্যাগ করিয়া অমৃত-অমরণ ধর্মবান হইয়া যান।
অন্যান্য শ্রুতিসকলেও এইরূপ আছে-'কর্ম্ম, সন্তান অথবা ধনের দ্বারা নহে, তবে কেহ কেহ কেবল দেহেতে আত্মবুদ্ধি ত্যাগের দ্বারাই অমৃতত্ব লাভ করিয়াছেন।'-(কৈবল্য উপনিষৎ-১।২)
'স্বয়ম্ভু পরমেশ্বর ইন্দ্রিয়গণকে বহির্মুখস্বভাব করিয়া জীবের প্রতি হিংসাই করিয়াছেন। সেইহেতু ইন্দ্রিয়গণ বাহ্যবস্তুই দর্শন করে, অন্তরাত্মাকে দর্শন করে না। কোন কোন বিবেকী মুক্তির ইচ্ছায় ইন্দ্রিয়সংযমপূর্ব্বক প্রত্যাগাত্মাকে দর্শন করেন।'-(কঠ উপনিষৎ-২।১।১)
'যে সময় ইহার হৃদিস্থিত কামনাসকল পরিত্যক্ত হয়..তখন এই দেহেই ব্রহ্মপ্রাপ্ত হয়।'(কঠ উপনিষৎ-২।৩।১৪)
অথবা 'অতিমুচ্য' পদের দ্বারাই সকল বাসনার ত্যাগ সিদ্ধ হওয়াতে 'অস্মাল্লোকাৎ প্রেত্য' অংশের অর্থ-বিদ্যমান শরীর হইতে সম্পূর্ণ পৃথক হইয়া অর্থাৎ মৃত্যলাভ করিয়া কৈবল্যমুক্ত হইয়া যান।

Saturday, 25 January 2020

সনৎ-সুজাতীয় সম্বাদে মান ও মৌনের বিষয়ে পার্থক্যঃ-


শ্রীমহাভারতের উদ্যোগপর্বের দ্বি-চত্বারিংশোহধ্যায়ের সনৎ-সুজাতীয় সম্বাদে পরমপ্রাচীন সনাতন ঋষি ভগবান সনৎ-সুজাত বলিতেছেন-
ন বৈ মানং চ মৌনং চ সহিতৌ বসতঃ সদা। 
অয়ং হি লোকো মানস্য হ্যসৌ মৌনস্য তদ্বিদুঃ।।৪১
ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য্যের শাঙ্করভাষ্য অনুসারে ভাবার্থঃ-মান ও মৌন সর্বদা সহাবস্থান করে না অর্থাৎ মান আর মৌন সহচারী নহে। যেহেতু এই প্রত্যক্ষগোচর জগৎ প্রপঞ্চ মানের বিষয় এবং মৌনের বিষয় হইল পরলোক যাহা 'তৎ' বা ব্রহ্মনামে নিশ্চিতরূপে বিদ্বানগণের অনুভব প্রসিদ্ধ। 'তৎ' শব্দবাচ্য ব্রহ্মই মৌনের বিষয়। 'তত্সদিতি নির্দেশো ব্রহ্মণস্ত্রিবিধঃ স্মৃতঃ৷-(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা-১৭।২৩) অর্থাৎ 'ॐ তৎ সৎ' এই তিনটি শব্দ ব্রহ্মের নির্দ্দেশ সূচক নাম স্বীকৃত হইয়া থাকে।
মান দ্বারা সংসার প্রাপ্তি ও মৌনদ্বারা ব্রহ্মভাব প্রাপ্তিই এখানে সূচিত হইল। হিরণ্যগর্ভ সংহিতাতেও বলা হইয়াছে-'অন্ন,অঙ্গনাদি ভোগ্যপদার্থে মনের প্রবৃত্তিই মান নামে কথিত হইয়া থাকে, আর মৌন ব্রহ্মানন্দ সুখ প্রাপ্তির হেতুরূপে প্রসিদ্ধ।' বস্তুত মান লোকানুরঞ্জনের সাধন। মৌনধারণ আত্মচিন্তনের সহায়ক বলিয়া উহা পরমার্থ বা ব্রহ্মানন্দ প্রাপ্তির সাধন। এইজন্য মানের বিষয় ইহলোক ও মৌনের বিষয় পরলোক-এইরূপে কথিত হইয়াছে।

Friday, 24 January 2020

সাংখ্যদর্শনের ত্রিগুণাত্মক অচেতন প্রধানের সর্বজ্ঞতা অসম্ভবঃ-


শ্রীমন্মহর্ষি বাদরায়ণ ভগবৎ প্রণীতম্ বেদান্তদর্শনের ‘ঈক্ষ্ণতের্ন অশব্দম্’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/১/৫) এই সূত্রের ভাষ্যে আচার্য্য শ্রীমৎ শঙ্কর ভগবৎপাদ্ লিখিতেছেন-
সাংখ্যমতালম্বীদের মতে অচেতন প্রধানের সর্ব্বজ্ঞতা সঙ্গত হয় এই প্রকারে-যাহাকে জ্ঞান মনে করিতেছ, তাহা সত্ত্বগুণের ধর্ম্ম, যেহেতু 'সত্ত্বগুণ হইতে জ্ঞান উৎপন্ন হয়'-(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ১৪।১৭), এই প্রকার স্মৃতি আছে। আর সত্ত্বগুণের ধর্ম্ম যে জ্ঞান, তাহার দ্বারাই শরীর ও ইন্দ্রিয়যুক্ত পুরুষগণ সর্ব্বজ্ঞ যোগিরূপে প্রসিদ্ধ হইয়া থাকেন। কেবল নির্লেপ, শরীর ও ইন্দ্রিয়রহিত এবং জ্ঞানমাত্রস্বরূপ যে পুরুষ, তাহার সর্ব্বজ্ঞত্ব অথবা কিঞ্চিৎ-জ্ঞত্ব কল্পনা করা যায় না। কিন্তু অচেতন প্রধান গুণত্রয়াত্মক হওয়ায় সকলপ্রকার জ্ঞানের কারণস্বরূপ যে সত্ত্বগুণ, তাহা প্রধানাবস্থাতেও অর্থাৎ সৃষ্টির প্রাক্ কালে গুণত্রয় যখন সাম্যাবস্থাতে থাকে তখনও বিদ্যমান থাকে, এইহেতু অচেতন হইলেও প্রধানের সর্ব্বজ্ঞতা উপচরিত হয়।.................................
কিন্তু তাহা যুক্তিসঙ্গত হইতেছে না। যেহেতু প্রধানাবস্থাতে গুণসকলের সমতা থাকে বলিয়া সত্ত্বগুণের ধর্ম্ম যে জ্ঞান, তাহা সম্ভব হয় না।
কিন্তু যদি বলা হয়, সর্ব্ববিষয়ক জ্ঞানোৎপত্তির অনুকূল শক্তিযুক্ত হওয়ায় প্রধান সর্ব্বজ্ঞ হইবে-তদুত্তরে বলিব, তাহাও সঙ্গত হইতেছে না। কারণ গুণসকলের সমতা সত্ত্বেও সত্ত্বগুণে আশ্রিত জ্ঞানোৎপত্তির অনুকূল শক্তিকে অবলম্বন করতঃ যদি সাংখ্যের অচেতন প্রধানকে সর্ব্বজ্ঞ বলা হয়, তাহা হইলে রজোগুণ ও তমোগুণে আশ্রিত যে জ্ঞানের প্রতিবন্ধকতা শক্তি, তাহাকে আশ্রয় করতঃ প্রধানকে স্বচ্ছন্দে অল্পজ্ঞও বলা চলিবে। ...
আবার অচেতন জড় পদার্থ প্রকাশক বা জ্ঞাতা হইতে পারে না বলিয়া প্রধানের সর্ব্বজ্ঞতা যুক্তিসঙ্গত নহে। কিন্তু চেতন হন বলিয়া সত্ত্বগুণের উৎকর্ষ বশতঃ যোগিগণের সর্ব্বজ্ঞতা হয় যুক্তিসঙ্গত, সেইহেতু জড় প্রধানের সর্ব্বজ্ঞতা বিষয়ে তাহা উদাহরণরূপে গৃহীত হইতে পারে না।

Friday, 17 January 2020

সর্ব্বজ্ঞ ব্রহ্মই জগৎ কারণ, সাংখ্যশাস্ত্রোক্ত অচেতন প্রধান নহেঃ-




সাংখ্যবাদীরা ত্রিগুণাত্মক অচেতন প্রধানকেই জগতের মূল কারণ বলে স্বীকার করেন। শ্রীমন্মহর্ষি বাদরায়ণ ভগবৎ প্রণীতম্ ব্রহ্মসূত্রের ৫-১১ সূত্রগুলিতে সাংখ্যবাদীদের মতকে খণ্ডন করে ব্রহ্মকেই জগৎ কারণ বলে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
‘ঈক্ষ্ণতের্ন অশব্দম্’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/১/৫)।।
ভগবৎপূজ্যপাদ্ শঙ্করাচার্য্যের 'শাঙ্করভাষ্য' অনুসারে ভাবার্থঃ- এই সূত্রের সিদ্ধান্ত হইল উপনিষৎ সকলে সাংখ্যমতাবলম্বিগণ কর্তৃক পরিকল্পিত অচেতন প্রধানকে জগতের কারণরূপে স্বীকার করিতে পারা যায় না। যেহেতু তাহা 'অশব্দ' অর্থাৎ বেদ তদ্বিষয়ে প্রমাণ নহে। যদি বলা হয় 'সদেব' (ছান্দোগ্যোপনিষদ্ ৬।২।১) ইত্যাদিস্থলে 'সৎ' শব্দের দ্বারা প্রধানই বর্ণিত হইয়াছে, সুতরাং তাহা অশব্দ হইবে কেন? তদুত্তরে বলিতেছেন- যেহেতু শ্রুতিতে এইপ্রকারই বর্ণিত হইতেছে,যথাঃ-
ছান্দোগ্যে ঋষি উদ্দালক আরুণি তাঁহার পুত্রকে ব্রহ্মজ্ঞান দান করিতে গিয়া বলিতেছেন-'সদেব সোম্যেদমগ্র আসীদেকমেবাদ্বিতীয়ম্'- (ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৬/২/১)।
‘হে প্রিয়দর্শন, এই জগৎ উৎপত্তির পূর্ব্বে এক অদ্বিতীয় সৎ রূপেই বিদ্যমান ছিল।

এইরূপ আরম্ভ করিয়া 'তদৈক্ষত বহু স্যাং প্রজায়েয়েতি তত্তেজোসৃজত'।-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৬/২/৩)।
'তিনি ইক্ষণ করিলেন, আমি বহু হইব, প্রকৃষ্টরূপে উৎপন্ন হইব, তিনি তেজকে সৃষ্টি করিলেন' ইত্যাদি।

উক্ত শ্রুতিবাক্যে ইদম্ শব্দবাচ্য এবং নাম ও রূপের দ্বারা অভিব্যক্ত এই জগৎকে উৎপত্তির পূর্ব্বে সৎস্বরূপ আত্মরূপে অবধারণ করিয়া সেই প্রস্তাবিত সৎশব্দবাচ্য ব্রহ্মের ইক্ষণপূর্ব্বক তেজঃ প্রভৃতির স্রষ্টৃত্ব প্রদর্শন করিতেছেন। এইরূপ অন্যস্থলেও শ্রুতি বলিতেছে-
'আত্মা বা ইদমেক এবাগ্র আসীত্৷ নান্যৎ কিঞ্চন মিষত্৷ সঃ ঈক্ষত লোকান্নু সৃজা ইতি৷ স ইমা্লোকানসৃজত।'-(ঐতরেয় উপনিষৎ-১/১/১,২)
'ইহা অর্থাৎ এই জগৎ উৎপত্তির পূর্ব্বে একমাত্র আত্মস্বরূপেই বিদ্যমান ছিল, ব্যাপারবান্ অন্য কিছুই ছিল না, সেই আত্মা ঈক্ষণ করিলেন, আমি লোকসমূহকে সৃজন করিব, তিনি এইলোক সকলকে সৃজন করিলেন।' এইপ্রকারে ঈক্ষণপূর্বক সৃষ্টির কথাই শ্রুতি বলিতেছেন।

আবার কোনস্থলে ষোড়শকলাযুক্ত পুরুষের প্রস্তাব করিয়া শ্রুতি বলিতেছেন-'স ঈক্ষাংচক্রে, স প্রাণমসৃজত'।-(প্রশ্ন উপনিষৎ-৬।৩-৪) 'তিনি ঈক্ষণ করিয়াছিলেন'।'তিনি প্রাণকে সৃষ্টি করিয়াছিলেন।'
আর সূত্রস্থ 'ঈক্ষতেঃ' এই পদে 'যজতে'(যাগক্রিয়া) এই পদের ধাতুর অর্থ যে ঈক্ষণক্রিয়া, তাহার নির্দ্দেশই অভিপ্রেত, কিন্তু 'ঈক্ষ্', এই ধাতুর নির্দ্দেশ নহে। (সূত্রস্থ 'ঈক্ষতি' শব্দের অর্থ ঈক্ষণক্রিয়া, তাহা অচেতন প্রধানে সম্ভব নহে।) সেইহেতু
যঃ সর্বজ্ঞঃ সর্ববিদ্যস্য জ্ঞানময়ং তপঃ৷ তস্মাদেতব্রহ্ম নাম রূপমন্নং চ জায়তে'।(মুণ্ডক উপনিষৎ-১।১।৯)
'যিনি সর্ব্বজ্ঞ এবং সর্ব্ববিৎ, যাহাঁর তপস্যা জ্ঞানময় অর্থাৎ জ্ঞানাত্মক ঈক্ষণক্রিয়াই যাহাঁর তপস্যা, তাঁহা হইতেই এই হিরণ্যগর্ভ, নামরূপ এবং অন্ন উৎপন্ন হয়।'

ইত্যাদি এইসকল যে শ্রুতিবাক্য, যাহারা সর্বজ্ঞ ঈশ্বরকেই জগৎকারণরূপে প্রতিপাদন করে, তাহাদিগকেও উদাহরণস্বরূপে গ্রহণ করিতে হইবে।
........................................

Thursday, 16 January 2020

ব্রহ্মের তটস্থ লক্ষণঃ-

পারমার্থিক দৃষ্টিতে জগৎ মিথ্যা হওয়ায় সেই কল্পিত জগতের কর্তৃত্ব ব্রহ্মে পরমার্থতঃ না থাকিলেও, ব্যবহারিক দৃষ্টিতে জগতের জন্মাদির কারণ হওয়া-রূপ লক্ষণটি অন্য বস্তু হইতে ভিন্নভাবে ব্রহ্মকে বোধ করায় বলিয়া ইহা ব্রহ্মের তটস্থলক্ষণ। জগতের সৃষ্টি-স্থিতি-লয় যাহা হইতে হয় তিনিই ব্রহ্ম। ইহাই ব্রহ্মের তটস্থ লক্ষণ। বাদরায়ণ ভগবৎ প্রণীত বেদান্তসূত্রে ব্রহ্মের লক্ষণ নিরূপণ হইতেছে এইভাবে

জন্মাদ্যস্য যতঃ।-(ব্রহ্মসূত্র ১।১।২)

ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য্য শারীরক ভাষ্যে বলিতেছেন

'জন্ম অর্থ উৎপত্তি, তাহা আদি ইহার', এইরূপে তদ্গুণসংবিজ্ঞান বহুব্রীহি সমাস বুঝিতে হইবে। জন্ম, স্থিতি লয়, ইহাই সমাসটীর অর্থ। আর জন্মের যে আদিত্ব, তাহা শ্রুতির নির্দ্দেশকে বস্তুর স্থিতিকে অপেক্ষা করে। মূলশ্রুতির নির্দ্দেশ এই'যতো বা ইমানি ভূতানি জায়ন্তে৷ যেন জাতানি জীবন্তি৷ যত্প্রয়ন্ত্যভিসংবিশন্তি৷ তদ্বিজিজ্ঞাসস্ব৷ তদ্ব্রহ্মেতি৷' এই শ্রুতিবাক্যটীতে জন্ম, স্থিতি এবং প্রলয়ের ক্রম পরিদৃষ্ট হয়। সূত্রস্থ 'অস্য' এই স্থলে, প্রত্যক্ষ প্রভৃতির দ্বারা উপস্থাপিত জগদ্ রূপ ধর্ম্মীর 'ইদম' শব্দের দ্বারা নির্দ্দেশ হইয়াছে। ষষ্ঠী বিভক্তিটী জন্ম প্রভৃতি ধর্ম্মের সম্বন্ধ বুঝাইবার জন্য। সূত্রস্থ 'যতঃ' এই পদটী জগতের কারণকে নির্দ্দেশ করিতেছে। এইরূপে বাক্যটীর অর্থ হইলনাম রূপের দ্বারা ব্যাকৃত অর্থাৎ অভিব্যক্ত এই জগৎ, যাহা অনেক কর্ত্তা এবং ভোক্তার সহিত সংযুক্ত, যাহা প্রতিনিয়ত দেশ কাল নিমিত্ত ক্রিয়া এবং ফলের আশ্রয়, যাহার রচনার স্বরূপ মনের দ্বারা চিন্তাও করা যায় না তাহার জন্ম স্থিতি লয় যে সর্বজ্ঞ সর্বশক্তিসস্পন্ন কারণ হইতে হয় তিনিই ব্রহ্ম।

কৃষ্ণযজুর্বেদের তৈত্তিরীয় শাখার অন্তর্গত তৈত্তিরীয় উপনিষদের ভৃগুবল্লীতে সেই শ্রুতিটি বর্ণিত আছেবরুণের পুত্র প্রসিদ্ধ ভৃগু পিতা বরুণের নিকট ব্রহ্মতত্ত্ব স্পষ্টরূপে জানিতে ইচ্ছা করিলে পিতা সেই ভৃগুকে ব্রহ্মের লক্ষণ বলিলেন'যতো বা ইমানি ভূতানি জায়ন্তে৷ যেন জাতানি জীবন্তি৷ যত্প্রয়ন্ত্যভিসংবিশন্তি৷ তদ্বিজিজ্ঞাসস্ব৷ তদ্ব্রহ্মেতি৷'-(তৈত্তিরীয় উপনিষৎ-৩।১।১)

অর্থাৎ  যাঁহা হইতে এই ব্রহ্মাদি তৃণপর্য্যন্ত দেহবর্গ উৎপন্ন হয়, উৎপন্ন হইয়া প্রাণধারণ করে অর্থাৎ বর্ধিত হয়, আবার বিনাশকালে যাঁহাকে প্রাপ্ত হয়, যাহাতে প্রবেশ করে অর্থাৎ অভেদ হইয়া যায় অর্থাৎ উৎপত্তি,স্থিতি লয়কালে দেহবর্গ যৎসত্তা ত্যাগ করে না, এইরূপ যে ব্রহ্মের লক্ষণ, সেই ব্রহ্মকে স্পষ্ট করিয়া জান।.....

তথ্যসূত্রঃ- ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্যের শারীরক-মীমাংসা ভাষ্য তৈত্তিরীয় উপনিষদ্ ভাষ্য।

শ্রীশুভ চৌধুরী

জানুয়ারি ১৫, ২০২০ খ্রিষ্টাব্দ।

Friday, 10 January 2020

বৃহদারণ্যকের 'নেতি নেতি' শ্রুতি ব্রহ্মে কল্পিত প্রপঞ্চকেই প্রতিষেধ করিতেছেন কিন্তু স্বয়ং ব্রহ্মকে অস্বীকার করে নাঃ-


শ্রীমন্মহর্ষি বাদরায়ণ ভগবৎ প্রণীতম্ উত্তর মীমাংসা বেদান্তদর্শনে বর্ণিত আছে-
'প্রকৃতৈতাবত্ত্বং হি প্রতিষেধতি ততো ব্রবীতি চ ভূয়ঃ।।'-ব্রহ্মসূত্র ৩।২।২২।।
শাঙ্করভাষ্য অনুসারে ভাবার্থঃ- ভগবৎপূজ্যপাদ্ শ্রীমৎ শঙ্করাচার্য্যের ভাষ্য হইল-
'ব্রহ্মের দুইটী মাত্ররূপ মূর্ত্ত এবং অমূর্ত্ত'-(বৃহদারণ্যক উপনিষদ্-২।৩।১) , এই প্রকার আরম্ভ করিয়া ক্ষিত্যাদি পাঁচটি মহাভূতকে দুইটী রাশিরূপে বিভক্ত করিয়া বায়ু ও আকাশরূপ অমূর্ত্ত ভূতের যাহা রস অর্থাৎ সার পদার্থ এবং যাহা 'পুরুষ', এই শব্দের দ্বারা কথিত, তাহার সমষ্টি করণাত্মা হিরণ্যগর্ভশরীরের এবং দক্ষিণ চক্ষুতে স্থিত ব্যষ্টি লিঙ্গশরীরের মাহারজনাদি রূপসকল (-হরিদ্রারঞ্জিত বস্ত্র প্রভৃতি বর্ণের নায় বর্ণসকল,বৃহদারণ্যক উপনিষদ্ঃ-২।৩।৬) প্রদর্শন করিয়া পূনরায় পঠিত হইতেছে-

'অথাত আদেশ নেতি নেতি'-(বৃহদারণ্যক উপনিষদ্-২।৫।৬)
'অথ (-সত্যের অর্থাৎ প্রপঞ্চের বর্ণনার অনন্তর) অতঃ (-যাহা সত্যেরও সত্য, তাহার বর্ণনা অবশিষ্ট থাকায়) নেতি নেতি অর্থাৎ 'ইহা নহে', 'ইহা নহে', এইরূপ সত্যের সত্য ব্রহ্মের আদেশ নির্দ্দেশ করা হইতেছে; এই নির্দ্দেশবাক্য হইতে ভিন্ন ব্রহ্মের শ্রেষ্ঠ নির্দ্দেশ অবশ্যই নাই।'

সেইস্থলে এই প্রতিষেধের বিষয় কি? ব্রহ্মের সপ্রপঞ্চ অর্থাৎ বিস্তৃতভাবে বর্ণিত মূর্ত্ত ও অমূর্ত্তাত্মক রূপদ্বয় এখানে সন্নিহিত অর্থাৎ নিকটে পঠিত হইয়াছে, আর দুইটী রূপ যাঁহার তিনিই ব্রহ্ম। সেইস্থলে বিশেষ কোন নিষেধ্য বস্তু উপলব্ধ না হওয়ায় আমাদের সংশয় উৎপন্ন হইতেছে-'নেতি নেতি' এই প্রতিষেধ কি রূপদ্বয়কে এবং যাঁহার রূপ তাঁহাকে, নাকি উভয়কেই প্রতিষেধ করিতেছে; অথবা দুইটির মধ্যে একটিকে প্রতিষেধ করিতেছে? যদি একটিকে প্রতিষেধ করিয়া থাকে, তাহা হইলে কি ব্রহ্মকে করিতেছে নাকি রূপদ্বয়কে?
রূপপ্রপঞ্চ ও ব্রহ্ম উভয়ের প্রতিষেধ যুক্তিসঙ্গত নহে, যেহেতু শূন্যবাদের প্রাপ্তি হইয়া পড়িবে। যদি বলা হয় শূন্যবাদইতো অভিপ্রেত তদুত্তরে বলিতেছেন-যেহেতু কোন পরমার্থ বস্তুকে অবলম্বন করিয়া অপরামার্থ বস্তু প্রতিষিদ্ধ হয়, যেমন রজ্জু প্রভৃতিতে সর্প প্রভৃতি। আর তাহা প্রতিষেধ কোন ভাববস্তু অবিশিষ্ট থাকিলে হয় সঙ্গত। কিন্তু উভয়ের প্রতিষধ হইলে অন্য কোন্ ভাববস্তু অবশিষ্ট থাকিবে?
প্রতিষেধের অধিষ্ঠানরূপে অন্য ভাববস্তু অবশিষ্ট না থাকিলে, অপর যে বস্তুকে প্রতিষেধ করিতে আরম্ভ করা হয়, প্রতিষেধ করিতে অসমর্থ হওয়ায় তাহারই পরমার্থতা প্রাপ্ত হইয়া পড়ে বলিয়া তাহার প্রতিষেধ যুক্তি সঙ্গত নহে।আবার ব্রহ্মের প্রতিষেধও যুক্তিসঙ্গত নহে, যেহেতু 'আপনাকে ব্রহ্মের কথা বলিব'-(বৃহদারণ্যক উপনিষদ্-২।১।১) ইত্যাদি উপক্রমর বিরোধ হইবে; 'যিনি ব্রহ্মকে অসৎ বলিয়া জানেন, তিনি অসৎই অর্থাৎ পুরুষার্থের সহিত সম্বন্ধশূন্যই হইয়া পড়েন।'-(তৈত্তিরীয় উপনিষদ্-২।৬।১) 'আত্মাকে আছেন, এইরূপেই উপলব্ধি করিতে হইবে।'-(কঠ উপনিষদ্-২।৩।১৩),এই প্রকার অবধারণের বিরোধ হইবে।এবং সকল উপনিষদের অর্থাৎ সমগ্র বেদান্ত সিদ্ধান্তের বিরোধ হইয়া পড়িবে।
আর যদি বলা হয় বাক্যমনের অতীত হওয়ায় ব্রহ্মই প্রতিষেধের যোগ্য তদুত্তরে বলিতেছেন- ব্রহ্মের অবাঙ্মনোগোচরতাও তাঁহার অভাবকে অভিপ্রায় করিয়া বিহিত হয় নাই। যেহেতু মহান পরিকরবন্ধের দ্বারা 'ব্রহ্মবিদ্ সর্ব্বসংসারধর্ম্মাতীত পরব্রহ্মকে প্রাপ্ত হন।'-(তৈত্তিরীয় উপনিষদ্-২।১।১), 'ব্রহ্ম সত্য, জ্ঞান ও অনন্তস্বরূপ।'-(তৈত্তিরীয় উপনিষদ্-২।১।১) ইতাদি এই সকলের দ্বারা উপনিষৎ সকলে ব্রহ্মকে প্রতিপাদন করিয়া পুনরায় তাঁহারই অভাব বর্ণিত হইতে পারে না।
যেহেতু 'শরীরে লিপ্ত পঙ্কের প্রক্ষালন অপেক্ষা দূরে থাকিয়া তাহাকে স্পর্শ না করাই শ্রেয়ঃ।' এইপ্রকার যুক্তি আছে, ব্রহ্মের প্রতিষেধই শ্রুতির অভিপ্রেত হইলে পঙ্কে লিপ্ত হওয়ার ন্যায় তাঁহাকে প্রতিপাদন করিয়া পুনরায় পঙ্ককে প্রক্ষালনের ন্যায় তাঁহার প্রতিষেধ সঙ্গত নহে।

আচ্ছা,'ব্রহ্ম বাক্য মনের অগোচর' এইপ্রকার কথন প্রতিষেধের জন্য না হইলে তাহার অর্থ কি? উত্তর 'যাঁহাকে প্রাপ্ত না হইয়া মনের সহ বাক্যসকল ফিরিয়া আসে'(তৈত্তিরীয় উপনিষদ্-২।৪।১), ইত্যাদি ইহা কিন্তু ব্রহ্মতত্ত্ব প্রতিপাদনের প্রক্রিয়া।উক্ত শ্রুতির মধ্যে ইহাই কথিত হইতেছে-ব্রহ্ম বাক্য ও মনের অগোচর, সুতরাং বিষয়কোটির মধ্যে অপ্রবিষ্ট, সেইহেতু প্রত্যাগাত্মস্বরূপ এবং নিত্যশুদ্ববুদ্ধমুক্ত স্বভাব।ব্রহ্ম প্রত্যাগাত্মস্বরূপ নিত্যশুদ্ধবুদ্ধমুক্ত হওয়াই বৃহদারণ্যকের 'নেতি নেতি' শ্রুতি ব্রহ্ম হইতে রূপপ্রপঞ্চকে অর্থাৎ স্থুল ও সুক্ষ্ম জগৎকে নিষেধ করিতেছেন, অধিষ্ঠানভূত ব্রহ্ম অবিশিষ্ট থাকিতেছেন। প্রস্তাবিত যে ব্রহ্মের 'ইহা এতটা', এইরূপে সীমিত মূর্ত্তামূর্ত্তাত্মক রূপ, তাহাকে 'নেতি নেতি' এই শব্দ প্রতিষেধ করিতেছে।কারণ ব্রহ্মের সেই মূর্ত্তামূর্ত্তাত্মক রূপদ্বয়ই অধিদৈবত এবং অধ্যাত্মরূপে পূর্ববর্ত্তী শ্রুতিসমূহে (বৃহদারণ্যক উপনিষদ্-২।৩।২-৫) প্রস্তাবিত ও বিস্তৃতভাবে বর্ণিত হইয়াছে।
কিন্তু 'এতস্মিন মণ্ডলে পুুরুষঃ'-(বৃহদারণ্যক উপনিষদ্-২।৩।৩) এইপ্রকারে পুরুষ শব্দের দ্বারা ব্রহ্মও তো বর্ণিত হইয়াছেন। তদুত্তরে বলিতেছেন আর তজ্জনিত মূর্ত্তামূর্ত্তাত্মক ভূতসূক্ষ্ম হইতে উৎপন্ন অমূর্ত্ত ভূতের সারভূত পুরুষ শব্দের দ্বারা বর্ণিত এবং লিঙ্গশরীরাশ্রিত যে বাসনাত্মক অপর রূপ, তাহাই মাহারজনাদি রূপসকল (-হরিদ্রারঞ্জিত বস্ত্র) প্রভৃতি উপমাসকলের দ্বারা প্রদর্শিত হইয়াছে, ব্রহ্ম বর্ণিত হন নাই।
ব্রহ্মের সেই এই সপ্রপঞ্চ অর্থাৎ বিস্তৃতভাবে বর্ণিত মূর্ত্ত ও অমূর্ত্তাত্মক রূপদ্বয়কে সন্নিহিতালম্বন ইতিকরণের দ্বারা প্রতিষেধক 'ন'কারের নিকট উপনীত করা হইতেছে। ব্রহ্মও নিষেধ্যরূপে উপস্থাপিত হইয়াছেন, এইপ্রকার আশঙ্কার উত্তরে বলিতেছেন পূর্ববর্তী শ্রুতিতে ব্রহ্ম কিন্তু ষষ্ঠী বিভক্তির দ্বারা (ব্রহ্মণঃ রূপে,বৃহদারণ্যক উপনিষদ্ ২।৩।১) রূপের বিশেষণভাবে নির্দিষ্ট হইয়াছেন, স্বপ্রধানভাবে নহে। আর তাহার রূপদ্বয় বিস্তৃতভাবে বর্ণিত হইলে পর, যিনি রূপবিশিষ্ট তাঁহার স্বরূপ বিষয়ক জিজ্ঞাসা হইলে 'অথাত আদেশ নেতি নেতি'(বৃহদারণ্যক উপনিষদ্-২।৫।৬) ইহা উপক্রান্ত বর্ণিত হইয়াছে।
কিন্তু প্রত্যক্ষগোচর জগৎপপঞ্চের নিষেধ তো সম্ভব নহে। তদুত্তরে বলিতেছেন-ছান্দোগ্যের এই শ্রুতি- 'হে সৌম্য, যেমন একটি মৃৎপিণ্ডের দ্বারা মৃত্তিকার পরিণামভূত সমস্তই জানা যাইতে পারে কারণ সমস্ত বিকারই বাচাবলম্বনে অবস্থিত নাম মাত্র, কেবল মৃত্তিকাই সত্য।'-(ছান্দোগ্য উপনিষদ্-৬।১।৪) প্রভৃতি হেতুসকল বশতঃ (ব্রহ্মসূত্র ২।১।১৪) কার্য্যবস্তুর অসত্তা যুক্তিসঙ্গত, এইহেতু 'নেতি নেতি' এইপ্রকারে তাহার প্রতিষেধ হইয়াছে।
আর শাস্ত্র নিজেই ব্রহ্মের দুইটীরূপ প্রদর্শন করিয়া নিজেই পুনরায় কি প্রকারে তাহা প্রতিষেধ করিতেছেন যেহেতু'পঙ্কের প্রক্ষালন অপেক্ষা দূরে থাকিয়া তাহাকে স্পর্শ না করাই শ্রেয়ঃ'; এখানে রূপদ্বয়ের নিষেধপক্ষে এইপ্রকার আশঙ্কা করা উচিত নহে। যেহেতু এই শাস্ত্রপ্রতিপাদ্য রূপে ব্রহ্মের রূপদ্বয়কে নির্দ্দেশ করিতেছেন না, কিন্তু ব্রহ্মে কল্পিত লোকপ্রসিদ্ধ এইরূপদ্বয়কে প্রতিষেধের জন্য এবং শুদ্ধব্রহ্মের স্বরূপ প্রতিপাদনের জন্য উল্লেখ করিতেছন, এইহেতু কোন দোষ হয় নাই।
অতএব বৃহদারণ্যকের 'নেতি নেতি' শ্রুতি ব্রহ্মে কল্পিত প্রপঞ্চকেই প্রতিষেধ করিতেছেন এবং প্রতিষেধের অবধি ও অধিষ্ঠানরূপে ব্রহ্ম অবশিষ্ট থাকিতেছেন, ইহাই সিদ্ধান্ত।
'নেতি নেতি' ইহার অর্থ কি? তাহা বলিতেছেন- যেহেতু এই ব্রহ্ম হইতে ব্যতিরিক্ত অর্থাৎ ভিন্ন কিছুই নাই, পরন্তু ব্রহ্মই আছেন এই হেতু 'নেতি নেতি' ইহা বলা হইতেছে, কিন্তু ব্রহ্ম স্বয়ংই নাই তাহা নহে।
'আর ব্রহ্মের নাম সত্যের সত্য, প্রাণসকলই সত্য, তাহাদের মধ্যে ইনি সত্য।'- (বৃহদারণ্যক উপনিষদ্ঃ-২।৩।৬) এইরূপ সত্যের সত্য ব্রহ্মের আদেশ নির্দ্দেশ করা হইতেছে। সেইহেতু 'নেতি নেতি' এই আদেশ ব্রহ্মাবসান, অভাবাবসান নহে। বৃহদারণ্যকের 'নেতি নেতি' শ্রুতির এই প্রতিষেধ ব্রহ্মেই পর্য্যবসিত হয়, অভাবে নহে।
(বিঃ দ্রঃ- ভাষ্যকার ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য্য এই সূত্রাবলম্বনে আরও অনেক বৈয়াকরণিক, দার্শনিক আর শাস্ত্রীয় যুক্তি প্রদর্শন করিয়াছেন, এখানে কিছু অংশ তুলে ধরা হইল মাত্র)

Wednesday, 8 January 2020

ব্রহ্মাত্মৈকত্ব জ্ঞান ও এই জ্ঞানের দ্বারা জগতের সত্যতা-বুদ্ধির বিলোপঃ-



শুক্লযজুর্বেদীয় বাজসনেয় সংহিতার শেষ অধ্যায় ঈশ উপনিষদে বর্ণিত আছে-

ঈশা ব্যসমিদং সর্বং যতকিঞ্চ জগত্যাং জগত্‍।।

তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা মা গৃধঃ কস্যস্বিদ্‌ ধনম্।। ১।।

'শাঙ্করভাষ্য' অনুবাদঃ- ভগবৎপূজ্যপাদ্ শ্রীমৎ শঙ্করাচার্য্যের ভাষ্য হইল-

‘ঈশ্‌’ ধাতুর অর্থ ঐশ্বর্য্য বা শাসন-ক্ষমতা; যিনি এই জগতের শাসনে সমর্থ পরমাত্মা পরমেশ্বর, তিনিই এখানে ‘ঈশা’-পদের প্রতিপাদ্য। তিনি প্রত্যকরূপে (জীবরূপে) সর্ব্ব বস্তুর অভ্যন্তরে থাকিয়া, সমস্ত জগৎ যথানিয়মে শাসিত ও পরিচালিত করিতেছেন। সেই সর্ব্বাত্মরূপী পরমেশ্বর দ্বারা পৃথিবীস্থ সমস্ত বস্তুকে আচ্ছাদিত করিবে,–সর্ব্বত্র তাঁহার সত্তা উপলব্ধি করিবে। [অভিপ্রায় এই যে] জগৎকারণ পরমেশ্বরই জীবরূপে সর্ব্বদেহে বর্ত্তমান আছেন; এবং তাঁহার সংকল্পপ্রসূত স্থাবর-জঙ্গমময় এই জগৎ বস্তুতঃ মিথ্যা হইয়াও তাঁহাকে আশ্রয় করিয়াই সত্যের ন্যায় প্রতিভাত হইতেছে। সেই পরমাত্মরূপী আমিই এই জগৎ, আমার সত্তাই জগতের সত্তা, তদ্ভিন্ন জগতের আর পৃথক সত্তা নাই; এইরূপ যথার্থ সত্য জ্ঞানের দ্বারা জগতের সত্যতা ঢাকিয়া ফেলিবে, অর্থাৎ ‘জগত সত্য’ বলিয়া যে ভ্রম ছিল, তাহা বিলুপ্ত করিবে। যেমন চন্দন ও অগুরু প্রভৃতি গন্ধদ্রব্যসমূহ জলাদি-সংস্পর্শে কখন কখন দুর্গন্ধযুক্ত বলিয়া মনে হয় সত্য; কিন্তু ঘর্ষণ করিলেই তাহার স্বভাবসিদ্ধ মনোহর সৌরভ প্রকাশ পায়, এবং আগন্তুক দুর্গন্ধ দূর করিয়া দেয়, ঠিক সেইরূপ, কর্ত্তৃত্ব-ভোক্তৃত্বপূর্ণ, ভিন্ন ভিন্ন নাম (সংজ্ঞা), রূপ (আকৃতি) ও চেষ্টা বা ক্রিয়া-সম্পন্ন এই সমস্ত জগৎ নিজে অসত্য হইয়াও, যথার্থ সত্যস্বরূপ পরমেশ্বরের আশ্রয়ে থাকিয়া সত্য বলিয়া প্রতীয়মান হইতেছে মাত্র; বস্তুতঃ উহা মিথ্যা—অধ্যস্ত মাত্র; এইরূপ সত্য ভাবনা দ্বারা জগতের সত্যতা-ভ্রম নিরস্ত হইয়া যায়।

এইপ্রকার নিয়ন্তাই চরাচর দেহাদির মূলসত্তা এই ভাবনাযুক্ত ব্যক্তির পুত্র, সম্পদ বা স্বর্গাদি লোক-লাভের এষণা বা কামনা থাকে না; সুতরাং তদর্থ কর্ম্মেও অধিকার থাকে না; একমাত্র বাসনাত্যাগরূপ সন্ন্যাসেই অধিকার থাকে; তাহার ফলে সেই লোক তখন সন্ন্যাস গ্রহণ করে। অতএব, তুমি তাদৃশ ভাবাপন্ন হইয়া, সন্ন্যাস দ্বারা আত্মাকে পরিপালন কর; অর্থাৎ জগতের মিথ্যাত্ব ভাবনাদ্বারা আত্মার আত্মত্ব (নির্ব্বাকারত্ব ও সত্যত্ব প্রভৃতি ভাবগুলি) রক্ষা কর। তুমি এইরূপে বাসনা পরিত্যাগপূর্ব্বক নিজের কিংবা পরের, কাহারো ধনের আকাঙ্খা করিও না। অথবা, ধন কাহার?—ধন তো কাহারও নহে, যাহা আকাঙ্খা করিতে পারা যায়। আত্মাই সমস্ত জগৎ, এবং সমস্ত জগৎই আত্মরূপ; সেইরূপ পরমেশ্বর-চিন্তা দ্বারা যখন সমস্ত বস্তুই মিথ্যা বলিয়া পরিত্যাগ করিয়াছ, তখন আর সেই মিথায় বিষয়ে আকাঙ্খা বা লোভ করা সঙ্গত হয় না। মন্ত্রে যে, ‘স্বিৎ’ কথাটি আছে, উহা অর্থহীন নিপাত শব্দ (বাক্যের শোভাবর্দ্ধকমাত্র)।।১।।


আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...