শ্রীমন্মহর্ষি বাদরায়ণ ভগবৎ প্রণীতম্ উত্তর মীমাংসা বেদান্তদর্শনে বর্ণিত আছে-
'প্রকৃতৈতাবত্ত্বং হি প্রতিষেধতি ততো ব্রবীতি চ ভূয়ঃ।।'-ব্রহ্মসূত্র ৩।২।২২।।
শাঙ্করভাষ্য অনুসারে ভাবার্থঃ- ভগবৎপূজ্যপাদ্ শ্রীমৎ শঙ্করাচার্য্যের ভাষ্য হইল-
'ব্রহ্মের দুইটী মাত্ররূপ মূর্ত্ত এবং অমূর্ত্ত'-(বৃহদারণ্যক উপনিষদ্-২।৩।১) , এই প্রকার আরম্ভ করিয়া ক্ষিত্যাদি পাঁচটি মহাভূতকে দুইটী রাশিরূপে বিভক্ত করিয়া বায়ু ও আকাশরূপ অমূর্ত্ত ভূতের যাহা রস অর্থাৎ সার পদার্থ এবং যাহা 'পুরুষ', এই শব্দের দ্বারা কথিত, তাহার সমষ্টি করণাত্মা হিরণ্যগর্ভশরীরের এবং দক্ষিণ চক্ষুতে স্থিত ব্যষ্টি লিঙ্গশরীরের মাহারজনাদি রূপসকল (-হরিদ্রারঞ্জিত বস্ত্র প্রভৃতি বর্ণের নায় বর্ণসকল,বৃহদারণ্যক উপনিষদ্ঃ-২।৩।৬) প্রদর্শন করিয়া পূনরায় পঠিত হইতেছে-
'অথাত আদেশ নেতি নেতি'-(বৃহদারণ্যক উপনিষদ্-২।৫।৬)
'অথ (-সত্যের অর্থাৎ প্রপঞ্চের বর্ণনার অনন্তর) অতঃ (-যাহা সত্যেরও সত্য, তাহার বর্ণনা অবশিষ্ট থাকায়) নেতি নেতি অর্থাৎ 'ইহা নহে', 'ইহা নহে', এইরূপ সত্যের সত্য ব্রহ্মের আদেশ নির্দ্দেশ করা হইতেছে; এই নির্দ্দেশবাক্য হইতে ভিন্ন ব্রহ্মের শ্রেষ্ঠ নির্দ্দেশ অবশ্যই নাই।'
সেইস্থলে এই প্রতিষেধের বিষয় কি? ব্রহ্মের সপ্রপঞ্চ অর্থাৎ বিস্তৃতভাবে বর্ণিত মূর্ত্ত ও অমূর্ত্তাত্মক রূপদ্বয় এখানে সন্নিহিত অর্থাৎ নিকটে পঠিত হইয়াছে, আর দুইটী রূপ যাঁহার তিনিই ব্রহ্ম। সেইস্থলে বিশেষ কোন নিষেধ্য বস্তু উপলব্ধ না হওয়ায় আমাদের সংশয় উৎপন্ন হইতেছে-'নেতি নেতি' এই প্রতিষেধ কি রূপদ্বয়কে এবং যাঁহার রূপ তাঁহাকে, নাকি উভয়কেই প্রতিষেধ করিতেছে; অথবা দুইটির মধ্যে একটিকে প্রতিষেধ করিতেছে? যদি একটিকে প্রতিষেধ করিয়া থাকে, তাহা হইলে কি ব্রহ্মকে করিতেছে নাকি রূপদ্বয়কে?
রূপপ্রপঞ্চ ও ব্রহ্ম উভয়ের প্রতিষেধ যুক্তিসঙ্গত নহে, যেহেতু শূন্যবাদের প্রাপ্তি হইয়া পড়িবে। যদি বলা হয় শূন্যবাদইতো অভিপ্রেত তদুত্তরে বলিতেছেন-যেহেতু কোন পরমার্থ বস্তুকে অবলম্বন করিয়া অপরামার্থ বস্তু প্রতিষিদ্ধ হয়, যেমন রজ্জু প্রভৃতিতে সর্প প্রভৃতি। আর তাহা প্রতিষেধ কোন ভাববস্তু অবিশিষ্ট থাকিলে হয় সঙ্গত। কিন্তু উভয়ের প্রতিষধ হইলে অন্য কোন্ ভাববস্তু অবশিষ্ট থাকিবে?
প্রতিষেধের অধিষ্ঠানরূপে অন্য ভাববস্তু অবশিষ্ট না থাকিলে, অপর যে বস্তুকে প্রতিষেধ করিতে আরম্ভ করা হয়, প্রতিষেধ করিতে অসমর্থ হওয়ায় তাহারই পরমার্থতা প্রাপ্ত হইয়া পড়ে বলিয়া তাহার প্রতিষেধ যুক্তি সঙ্গত নহে।আবার ব্রহ্মের প্রতিষেধও যুক্তিসঙ্গত নহে, যেহেতু 'আপনাকে ব্রহ্মের কথা বলিব'-(বৃহদারণ্যক উপনিষদ্-২।১।১) ইত্যাদি উপক্রমর বিরোধ হইবে; 'যিনি ব্রহ্মকে অসৎ বলিয়া জানেন, তিনি অসৎই অর্থাৎ পুরুষার্থের সহিত সম্বন্ধশূন্যই হইয়া পড়েন।'-(তৈত্তিরীয় উপনিষদ্-২।৬।১) 'আত্মাকে আছেন, এইরূপেই উপলব্ধি করিতে হইবে।'-(কঠ উপনিষদ্-২।৩।১৩),এই প্রকার অবধারণের বিরোধ হইবে।এবং সকল উপনিষদের অর্থাৎ সমগ্র বেদান্ত সিদ্ধান্তের বিরোধ হইয়া পড়িবে।
আর যদি বলা হয় বাক্যমনের অতীত হওয়ায় ব্রহ্মই প্রতিষেধের যোগ্য তদুত্তরে বলিতেছেন- ব্রহ্মের অবাঙ্মনোগোচরতাও তাঁহার অভাবকে অভিপ্রায় করিয়া বিহিত হয় নাই। যেহেতু মহান পরিকরবন্ধের দ্বারা 'ব্রহ্মবিদ্ সর্ব্বসংসারধর্ম্মাতীত পরব্রহ্মকে প্রাপ্ত হন।'-(তৈত্তিরীয় উপনিষদ্-২।১।১), 'ব্রহ্ম সত্য, জ্ঞান ও অনন্তস্বরূপ।'-(তৈত্তিরীয় উপনিষদ্-২।১।১) ইতাদি এই সকলের দ্বারা উপনিষৎ সকলে ব্রহ্মকে প্রতিপাদন করিয়া পুনরায় তাঁহারই অভাব বর্ণিত হইতে পারে না।
যেহেতু 'শরীরে লিপ্ত পঙ্কের প্রক্ষালন অপেক্ষা দূরে থাকিয়া তাহাকে স্পর্শ না করাই শ্রেয়ঃ।' এইপ্রকার যুক্তি আছে, ব্রহ্মের প্রতিষেধই শ্রুতির অভিপ্রেত হইলে পঙ্কে লিপ্ত হওয়ার ন্যায় তাঁহাকে প্রতিপাদন করিয়া পুনরায় পঙ্ককে প্রক্ষালনের ন্যায় তাঁহার প্রতিষেধ সঙ্গত নহে।
আচ্ছা,'ব্রহ্ম বাক্য মনের অগোচর' এইপ্রকার কথন প্রতিষেধের জন্য না হইলে তাহার অর্থ কি? উত্তর 'যাঁহাকে প্রাপ্ত না হইয়া মনের সহ বাক্যসকল ফিরিয়া আসে'(তৈত্তিরীয় উপনিষদ্-২।৪।১), ইত্যাদি ইহা কিন্তু ব্রহ্মতত্ত্ব প্রতিপাদনের প্রক্রিয়া।উক্ত শ্রুতির মধ্যে ইহাই কথিত হইতেছে-ব্রহ্ম বাক্য ও মনের অগোচর, সুতরাং বিষয়কোটির মধ্যে অপ্রবিষ্ট, সেইহেতু প্রত্যাগাত্মস্বরূপ এবং নিত্যশুদ্ববুদ্ধমুক্ত স্বভাব।ব্রহ্ম প্রত্যাগাত্মস্বরূপ নিত্যশুদ্ধবুদ্ধমুক্ত হওয়াই বৃহদারণ্যকের 'নেতি নেতি' শ্রুতি ব্রহ্ম হইতে রূপপ্রপঞ্চকে অর্থাৎ স্থুল ও সুক্ষ্ম জগৎকে নিষেধ করিতেছেন, অধিষ্ঠানভূত ব্রহ্ম অবিশিষ্ট থাকিতেছেন। প্রস্তাবিত যে ব্রহ্মের 'ইহা এতটা', এইরূপে সীমিত মূর্ত্তামূর্ত্তাত্মক রূপ, তাহাকে 'নেতি নেতি' এই শব্দ প্রতিষেধ করিতেছে।কারণ ব্রহ্মের সেই মূর্ত্তামূর্ত্তাত্মক রূপদ্বয়ই অধিদৈবত এবং অধ্যাত্মরূপে পূর্ববর্ত্তী শ্রুতিসমূহে (বৃহদারণ্যক উপনিষদ্-২।৩।২-৫) প্রস্তাবিত ও বিস্তৃতভাবে বর্ণিত হইয়াছে।
কিন্তু 'এতস্মিন মণ্ডলে পুুরুষঃ'-(বৃহদারণ্যক উপনিষদ্-২।৩।৩) এইপ্রকারে পুরুষ শব্দের দ্বারা ব্রহ্মও তো বর্ণিত হইয়াছেন। তদুত্তরে বলিতেছেন আর তজ্জনিত মূর্ত্তামূর্ত্তাত্মক ভূতসূক্ষ্ম হইতে উৎপন্ন অমূর্ত্ত ভূতের সারভূত পুরুষ শব্দের দ্বারা বর্ণিত এবং লিঙ্গশরীরাশ্রিত যে বাসনাত্মক অপর রূপ, তাহাই মাহারজনাদি রূপসকল (-হরিদ্রারঞ্জিত বস্ত্র) প্রভৃতি উপমাসকলের দ্বারা প্রদর্শিত হইয়াছে, ব্রহ্ম বর্ণিত হন নাই।
ব্রহ্মের সেই এই সপ্রপঞ্চ অর্থাৎ বিস্তৃতভাবে বর্ণিত মূর্ত্ত ও অমূর্ত্তাত্মক রূপদ্বয়কে সন্নিহিতালম্বন ইতিকরণের দ্বারা প্রতিষেধক 'ন'কারের নিকট উপনীত করা হইতেছে। ব্রহ্মও নিষেধ্যরূপে উপস্থাপিত হইয়াছেন, এইপ্রকার আশঙ্কার উত্তরে বলিতেছেন পূর্ববর্তী শ্রুতিতে ব্রহ্ম কিন্তু ষষ্ঠী বিভক্তির দ্বারা (ব্রহ্মণঃ রূপে,বৃহদারণ্যক উপনিষদ্ ২।৩।১) রূপের বিশেষণভাবে নির্দিষ্ট হইয়াছেন, স্বপ্রধানভাবে নহে। আর তাহার রূপদ্বয় বিস্তৃতভাবে বর্ণিত হইলে পর, যিনি রূপবিশিষ্ট তাঁহার স্বরূপ বিষয়ক জিজ্ঞাসা হইলে 'অথাত আদেশ নেতি নেতি'(বৃহদারণ্যক উপনিষদ্-২।৫।৬) ইহা উপক্রান্ত বর্ণিত হইয়াছে।
কিন্তু প্রত্যক্ষগোচর জগৎপপঞ্চের নিষেধ তো সম্ভব নহে। তদুত্তরে বলিতেছেন-ছান্দোগ্যের এই শ্রুতি- 'হে সৌম্য, যেমন একটি মৃৎপিণ্ডের দ্বারা মৃত্তিকার পরিণামভূত সমস্তই জানা যাইতে পারে কারণ সমস্ত বিকারই বাচাবলম্বনে অবস্থিত নাম মাত্র, কেবল মৃত্তিকাই সত্য।'-(ছান্দোগ্য উপনিষদ্-৬।১।৪) প্রভৃতি হেতুসকল বশতঃ (ব্রহ্মসূত্র ২।১।১৪) কার্য্যবস্তুর অসত্তা যুক্তিসঙ্গত, এইহেতু 'নেতি নেতি' এইপ্রকারে তাহার প্রতিষেধ হইয়াছে।
আর শাস্ত্র নিজেই ব্রহ্মের দুইটীরূপ প্রদর্শন করিয়া নিজেই পুনরায় কি প্রকারে তাহা প্রতিষেধ করিতেছেন যেহেতু'পঙ্কের প্রক্ষালন অপেক্ষা দূরে থাকিয়া তাহাকে স্পর্শ না করাই শ্রেয়ঃ'; এখানে রূপদ্বয়ের নিষেধপক্ষে এইপ্রকার আশঙ্কা করা উচিত নহে। যেহেতু এই শাস্ত্রপ্রতিপাদ্য রূপে ব্রহ্মের রূপদ্বয়কে নির্দ্দেশ করিতেছেন না, কিন্তু ব্রহ্মে কল্পিত লোকপ্রসিদ্ধ এইরূপদ্বয়কে প্রতিষেধের জন্য এবং শুদ্ধব্রহ্মের স্বরূপ প্রতিপাদনের জন্য উল্লেখ করিতেছন, এইহেতু কোন দোষ হয় নাই।
অতএব বৃহদারণ্যকের 'নেতি নেতি' শ্রুতি ব্রহ্মে কল্পিত প্রপঞ্চকেই প্রতিষেধ করিতেছেন এবং প্রতিষেধের অবধি ও অধিষ্ঠানরূপে ব্রহ্ম অবশিষ্ট থাকিতেছেন, ইহাই সিদ্ধান্ত।
'নেতি নেতি' ইহার অর্থ কি? তাহা বলিতেছেন- যেহেতু এই ব্রহ্ম হইতে ব্যতিরিক্ত অর্থাৎ ভিন্ন কিছুই নাই, পরন্তু ব্রহ্মই আছেন এই হেতু 'নেতি নেতি' ইহা বলা হইতেছে, কিন্তু ব্রহ্ম স্বয়ংই নাই তাহা নহে।
'আর ব্রহ্মের নাম সত্যের সত্য, প্রাণসকলই সত্য, তাহাদের মধ্যে ইনি সত্য।'- (বৃহদারণ্যক উপনিষদ্ঃ-২।৩।৬) এইরূপ সত্যের সত্য ব্রহ্মের আদেশ নির্দ্দেশ করা হইতেছে। সেইহেতু 'নেতি নেতি' এই আদেশ ব্রহ্মাবসান, অভাবাবসান নহে। বৃহদারণ্যকের 'নেতি নেতি' শ্রুতির এই প্রতিষেধ ব্রহ্মেই পর্য্যবসিত হয়, অভাবে নহে।
(বিঃ দ্রঃ- ভাষ্যকার ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য্য এই সূত্রাবলম্বনে আরও অনেক বৈয়াকরণিক, দার্শনিক আর শাস্ত্রীয় যুক্তি প্রদর্শন করিয়াছেন, এখানে কিছু অংশ তুলে ধরা হইল মাত্র)
No comments:
Post a Comment