সাংখ্যবাদীরা ত্রিগুণাত্মক অচেতন প্রধানকেই জগতের মূল কারণ বলে স্বীকার করেন। শ্রীমন্মহর্ষি বাদরায়ণ ভগবৎ প্রণীতম্ ব্রহ্মসূত্রের ৫-১১ সূত্রগুলিতে সাংখ্যবাদীদের মতকে খণ্ডন করে ব্রহ্মকেই জগৎ কারণ বলে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
‘ঈক্ষ্ণতের্ন অশব্দম্’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/১/৫)।।
ভগবৎপূজ্যপাদ্ শঙ্করাচার্য্যের 'শাঙ্করভাষ্য' অনুসারে ভাবার্থঃ- এই সূত্রের সিদ্ধান্ত হইল উপনিষৎ সকলে সাংখ্যমতাবলম্বিগণ কর্তৃক পরিকল্পিত অচেতন প্রধানকে জগতের কারণরূপে স্বীকার করিতে পারা যায় না। যেহেতু তাহা 'অশব্দ' অর্থাৎ বেদ তদ্বিষয়ে প্রমাণ নহে। যদি বলা হয় 'সদেব' (ছান্দোগ্যোপনিষদ্ ৬।২।১) ইত্যাদিস্থলে 'সৎ' শব্দের দ্বারা প্রধানই বর্ণিত হইয়াছে, সুতরাং তাহা অশব্দ হইবে কেন? তদুত্তরে বলিতেছেন- যেহেতু শ্রুতিতে এইপ্রকারই বর্ণিত হইতেছে,যথাঃ-
ছান্দোগ্যে ঋষি উদ্দালক আরুণি তাঁহার পুত্রকে ব্রহ্মজ্ঞান দান করিতে গিয়া বলিতেছেন-'সদেব সোম্যেদমগ্র আসীদেকমেবাদ্বিতীয়ম্'- (ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৬/২/১)।
‘হে প্রিয়দর্শন, এই জগৎ উৎপত্তির পূর্ব্বে এক অদ্বিতীয় সৎ রূপেই বিদ্যমান ছিল।
এইরূপ আরম্ভ করিয়া 'তদৈক্ষত বহু স্যাং প্রজায়েয়েতি তত্তেজোসৃজত'।-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৬/২/৩)।
'তিনি ইক্ষণ করিলেন, আমি বহু হইব, প্রকৃষ্টরূপে উৎপন্ন হইব, তিনি তেজকে সৃষ্টি করিলেন' ইত্যাদি।
উক্ত শ্রুতিবাক্যে ইদম্ শব্দবাচ্য এবং নাম ও রূপের দ্বারা অভিব্যক্ত এই জগৎকে উৎপত্তির পূর্ব্বে সৎস্বরূপ আত্মরূপে অবধারণ করিয়া সেই প্রস্তাবিত সৎশব্দবাচ্য ব্রহ্মের ইক্ষণপূর্ব্বক তেজঃ প্রভৃতির স্রষ্টৃত্ব প্রদর্শন করিতেছেন। এইরূপ অন্যস্থলেও শ্রুতি বলিতেছে-
'আত্মা বা ইদমেক এবাগ্র আসীত্৷ নান্যৎ কিঞ্চন মিষত্৷ সঃ ঈক্ষত লোকান্নু সৃজা ইতি৷ স ইমা্লোকানসৃজত।'-(ঐতরেয় উপনিষৎ-১/১/১,২)
'ইহা অর্থাৎ এই জগৎ উৎপত্তির পূর্ব্বে একমাত্র আত্মস্বরূপেই বিদ্যমান ছিল, ব্যাপারবান্ অন্য কিছুই ছিল না, সেই আত্মা ঈক্ষণ করিলেন, আমি লোকসমূহকে সৃজন করিব, তিনি এইলোক সকলকে সৃজন করিলেন।' এইপ্রকারে ঈক্ষণপূর্বক সৃষ্টির কথাই শ্রুতি বলিতেছেন।
আবার কোনস্থলে ষোড়শকলাযুক্ত পুরুষের প্রস্তাব করিয়া শ্রুতি বলিতেছেন-'স ঈক্ষাংচক্রে, স প্রাণমসৃজত'।-(প্রশ্ন উপনিষৎ-৬।৩-৪) 'তিনি ঈক্ষণ করিয়াছিলেন'।'তিনি প্রাণকে সৃষ্টি করিয়াছিলেন।'
আর সূত্রস্থ 'ঈক্ষতেঃ' এই পদে 'যজতে'(যাগক্রিয়া) এই পদের ধাতুর অর্থ যে ঈক্ষণক্রিয়া, তাহার নির্দ্দেশই অভিপ্রেত, কিন্তু 'ঈক্ষ্', এই ধাতুর নির্দ্দেশ নহে। (সূত্রস্থ 'ঈক্ষতি' শব্দের অর্থ ঈক্ষণক্রিয়া, তাহা অচেতন প্রধানে সম্ভব নহে।) সেইহেতু
যঃ সর্বজ্ঞঃ সর্ববিদ্যস্য জ্ঞানময়ং তপঃ৷ তস্মাদেতব্রহ্ম নাম রূপমন্নং চ জায়তে'।(মুণ্ডক উপনিষৎ-১।১।৯)
'যিনি সর্ব্বজ্ঞ এবং সর্ব্ববিৎ, যাহাঁর তপস্যা জ্ঞানময় অর্থাৎ জ্ঞানাত্মক ঈক্ষণক্রিয়াই যাহাঁর তপস্যা, তাঁহা হইতেই এই হিরণ্যগর্ভ, নামরূপ এবং অন্ন উৎপন্ন হয়।'
ইত্যাদি এইসকল যে শ্রুতিবাক্য, যাহারা সর্বজ্ঞ ঈশ্বরকেই জগৎকারণরূপে প্রতিপাদন করে, তাহাদিগকেও উদাহরণস্বরূপে গ্রহণ করিতে হইবে।
........................................
No comments:
Post a Comment