সামবেদীয় কেন উপনিষদে ব্রহ্মজিজ্ঞাসু শিষ্যের ব্রহ্মনিষ্ঠ গুরুর প্রতি জিজ্ঞাসা হইল
-ॐ কেনেষিতং পততি প্রেষিতং মনঃ, কেন প্রাণঃ প্রথমঃ প্রৈতি যুক্তঃ। কেনেষিতাং বাচমিমাং বদন্তি, চক্ষুঃ শ্রোত্রং ক উ দেবো যুনক্তি।।১/১।।
ভগবৎপূজ্যপাদ্ শঙ্করাচার্য্যের শাঙ্করভাষ্য অনুসারে ভাবার্থঃ- মন কোন্ কর্ত্তার দ্বারা ইপ্সিত বা অভিপ্রেত হইয়া অর্থাৎ কাহার ইচ্ছা-নিয়োজিত হইয়া স্ব বিষয়াভিমুখে গমন করিতেছে? 'প্রথম' প্রাণ কাহার দ্বারা নিযুক্ত অর্থাৎ প্রেরিত হইয়া স্বীয় কার্য্যে প্রবৃত্ত হয়?
(সমস্ত ইন্দ্রিয়ের প্রবৃত্তি প্রাণকে অগ্রবর্ত্তী করিয়াই অর্থাৎ প্রাণের ক্রিয়া প্রথমে হইলে পরেই অনান্য ইন্দ্রিয়ের ক্রিয়া উৎপন্ন হয়; এই কারণে প্রাণকে ‘প্রথম’ বিশেষণে বিশেষিত করা হইয়াছে।)
আর কাঁহার ইচ্ছায় এই শব্দরূপ বাক্ কে লোকে উচ্চারণ করে? এবং কোন দেবতা (দ্যুতিমান্) চক্ষুঃ ও শ্রবণেন্দ্রিয়কে স্ব স্ব বিষয়ে নিযুক্ত অর্থাৎ প্রেরণ করেন?
এইরূপ প্রশ্নকারী যোগ্য শিষ্যকে ব্রহ্মজ্ঞ গুরু বলিলেন-তুমি যে জিজ্ঞাসা করিতেছ যে, বিষয়ের প্রতি মন প্রভৃতি ইন্দ্রিয় সমূহের প্রেরয়িতা কোন দেবতা এবং তিনি কি প্রকারেই বা প্রেরণ করেন তদুত্তর শ্রবণ কর-
শ্রোত্রস্য শ্রোত্রং মনসো মনো যদ্বাচো হ বাচংস উ প্রাণস্য প্রাণঃ ৷
চক্ষুষশ্চক্ষুরতিমুচ্য ধীরাঃ প্রেত্যাস্মাল্লোকাদমৃতা ভবন্তি ৷৷ ১.২ ৷
অতএব চৈতন্যস্বরূপ আত্মজ্যোতিকে শ্রোত্রের শ্রোত্র বলা যথার্থই হয়। এইবিষয় সমর্থক অন্য শ্রুতিসকলও আছে-
'তখন অর্থাৎ বাহ্যজ্যোতি না থাকিলে এই পুরুষ আত্মজ্যোতি সহায়েই উপবেশনাদি করেন।'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪।৩।৬)
'তাহার দীপ্তিতেই এই সমস্ত জগৎ প্রকাশিত হয়।'-(কঠ উপনিষৎ-২।২।১৫)
'যাঁহার তেজের দ্বারা প্রদীপ্ত হইয়া সূর্য্য তাপ দিতেছেন।'-(তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ-৩।১২।৯।৭)
তাছাড়া শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাতেও বর্ণিত আছে-'যে জ্যোতিঃ সূর্যে, চন্দ্রে ও অগ্নিতে আছে এবং যাহা সমগ্র জগৎকে প্রকাশ করে, সেই জ্যোতিঃ আমার জানিবে। হে ভারত, যেরূপ একমাত্র সূর্য সমগ্র জগৎকে আলোকিত করেন, সেইরূপ ক্ষেত্রী অর্থাৎ আত্মা সকল দেহাদি ক্ষেত্রকে প্রকাশিত করেন।'-(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা-১৫।১২ ও ১৩।৩৪)
কঠ উপনিষদে আরও স্পষ্টভাবে আছে-'যিনি সমস্ত অনিত্য পদার্থের মধ্যে নিত্য এবং ব্রহ্মা আদি সমস্ত চেতনেরও প্রকাশক'(কঠ উপনিষৎ-২।২।১৩) অতএব শ্রোত্র প্রভৃতিরও শ্রোত্রাদিস্বরূপ অর্থাৎ শ্রোত্রাদি ইন্দ্রিয়সকলের সামর্থ্যের নিমিত্তস্বরূপ এমন কোন্ বস্তু আছে যাহা তত্ত্ববিদ্গণের বুদ্ধিগম্য, সকলের অন্তরতম, কূটস্থ, জন্মরহিত, জরারহিত, অমর এবং সর্বভয়নিবারক।
তিনি যেরূপ শ্রোত্রের শ্রোত্র সেইরূপ মনেরও অর্থাৎ অন্তঃকরণেরও মন। কারণ আত্মচৈতন্য জ্যোতির আলোক বিনা অন্তঃকরণ নিজবিষয়ে সঙ্কল্প ও নিশ্চয় করিতে সক্ষম হয় না। এইহেতু তিনি মনেরও মন। এখানে বুদ্ধি ও মনকে এক ধরিয়া 'মনসঃ' এই একপদে উভয়কে নির্দ্দেশ করা হইয়াছে।
তিনি সেইরূপ বাগিন্দ্রিয়েরও বাক্ অর্থাৎ শব্দোচ্চারণ সামর্থ্যের হেতু। তিনি সেইরূপ প্রাণের প্রাণ অর্থাৎ প্রাণ নামক ক্রিয়া বিশেষের মূল, যেহেতু তাহর দ্বারাই প্রাণের সক্রিয় থাকার সামর্থ্য হয়। কেননা আত্মার দ্বারা অধিষ্ঠিত অর্থাৎ পরিচালিত না হইলে প্রাণের সক্রিয় থাকা সম্ভব হয় না।
অন্য শ্রুতিসকল হইতেও ইহা সিদ্ধ হয়-'হৃদয় গুহাকাশে যদি এই আনন্দ ব্রহ্ম না থাকিতেন তবে কে-ই বা অপানক্রিয়া করিত, আর কে-ই বা প্রাণক্রিয়া করিত?'-(তৈত্তিরীয় উপনিষৎ-২।৭।১)
'তিনি প্রাণবায়ুকে উর্ধ্বদিকে সঞ্চালিত করেন এবং অপানবায়ুকে অধোদিকে নিক্ষেপ করেন।'-(কঠ উপনিষৎ-২।২।৩)
তাছাড়া এই উপনিষদেও কথিত হইবে-'যাহার দ্বারা প্রাণ পরিচালিত হয়, তাহাকেই তুমি ব্রহ্ম বলিয়া জানিও।'(কেন উপনিষৎ-১।৮)
সেইরূপ তিনি চক্ষুরও চক্ষু অর্থাৎ রূপের প্রকাশক চক্ষুরিন্দ্রিয়ের যে রূপগ্রহণের সামর্থ্য, তাহা আত্মচৈতন্য দ্বারা পরিচালিত হওয়ার ফলেই হয়।
অতএব শ্রোত্রাদির শ্রোত্রস্বরূপ ব্রহ্মই যে নিজের স্বরূপ ইহা জানিয়া অতিমুচ্য অর্থাৎ শ্রোত্রাদিতে আত্মবুদ্ধি পরিত্যাগ করিয়া ধীরগণ অর্থাৎ প্রশস্তবুদ্ধিসম্পন্নগণ প্রেত্য অর্থাৎ সম্পূর্ণ পৃথক হইয়া অর্থাৎ পুত্র, মিত্র, ভার্য্যা এবং বন্ধু প্রভৃতিতে আমি, আমার ব্যবহাররূপ ভাবনালোক হইতে পৃথক হইয়া অর্থাৎ সকল বাসনা পরিত্যাগ করিয়া অমৃত-অমরণ ধর্মবান হইয়া যান।
অন্যান্য শ্রুতিসকলেও এইরূপ আছে-'কর্ম্ম, সন্তান অথবা ধনের দ্বারা নহে, তবে কেহ কেহ কেবল দেহেতে আত্মবুদ্ধি ত্যাগের দ্বারাই অমৃতত্ব লাভ করিয়াছেন।'-(কৈবল্য উপনিষৎ-১।২)
'স্বয়ম্ভু পরমেশ্বর ইন্দ্রিয়গণকে বহির্মুখস্বভাব করিয়া জীবের প্রতি হিংসাই করিয়াছেন। সেইহেতু ইন্দ্রিয়গণ বাহ্যবস্তুই দর্শন করে, অন্তরাত্মাকে দর্শন করে না। কোন কোন বিবেকী মুক্তির ইচ্ছায় ইন্দ্রিয়সংযমপূর্ব্বক প্রত্যাগাত্মাকে দর্শন করেন।'-(কঠ উপনিষৎ-২।১।১)
'যে সময় ইহার হৃদিস্থিত কামনাসকল পরিত্যক্ত হয়..তখন এই দেহেই ব্রহ্মপ্রাপ্ত হয়।'(কঠ উপনিষৎ-২।৩।১৪)
অথবা 'অতিমুচ্য' পদের দ্বারাই সকল বাসনার ত্যাগ সিদ্ধ হওয়াতে 'অস্মাল্লোকাৎ প্রেত্য' অংশের অর্থ-বিদ্যমান শরীর হইতে সম্পূর্ণ পৃথক হইয়া অর্থাৎ মৃত্যলাভ করিয়া কৈবল্যমুক্ত হইয়া যান।
No comments:
Post a Comment