Thursday, 30 January 2020

'দশশ্লোকী' অথবা নির্বাণদশকস্তোত্রঃ-


শঙ্করাচার্য্য বিরচিত 'দশশ্লোকী' অথবা নির্বাণদশকস্তোত্রঃ-
কেদারনাথে আচার্য্যের অন্তর্ধানের পূর্ব্ব সময়কালগুলির একক্ষণে সুধন্বা মহারাজ জগদ্গুরু শঙ্করকে জিজ্ঞাসা করিলেন-'হে আচার্য্য ভগবন্! বেদান্তসিদ্ধ ব্রহ্মের স্বরূপ কি? স্বল্প কথায় আমায় আর একবার বলুন। এইবিষয়ে আপনার কৃপায় যথেষ্ট শুনিয়াছি। আপনি নানাশাস্ত্র ভাষ্যে, বহুকথায় এই শ্রুতিসিদ্ধ ব্রহ্মজ্ঞান আমাদের প্রদান করিয়াছেন। তারপরও সারকথায় আর একবার বলিলে আমরা সবাই কৃতার্থ হইব।'
আচার্য্য কিয়ৎক্ষণ নিরব থাকিয়া প্রসন্নচিত্তে বলিলেন-'মহারাজ! এই প্রশ্ন আমার গুরুদেব গোবিন্দভগবৎ তাঁহার দেহত্যাগের পূর্বে আমাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, আর আমি এতদুত্তরে যাহা বলিয়াছিলাম তাহাই বলিতেছি,শ্রবণ কর-
॥ অথ দশশ্লোকী ॥
ন ভূমির্ন তোয়ং ন তেজো ন বায়ুঃ
ন খং নেন্দ্রিয়ং বা ন তেষাং সমূহঃ ।
অনেকান্তিকত্বাত্ সুষুপ্ত্যেকসিদ্ধঃ
তদেকোঽবশিষ্টঃ শিবঃ কেবলোঽহম্ ॥ ১॥

অর্থাৎ ক্ষিতি বারি বহ্নি বায়ু ব্যোম "আমি" নয়।
অথবা নয়ন আদি ইন্দ্রিয়-নিচয়।।
পঞ্চভূত -দশেন্দ্রিয়-সমষ্টি যে দেহ।
এই সকলের মধ্যে "আমি" নহে কেহ।।
কেন না এদের নিত্য হয় রুপান্তর।
জনম্ বিনাশশীল ইহারা নশ্বর।।
অতিক্রমি এই সব সুষুপ্তি সময়।
নির্বিকল্প নির্বিকার নির্লিপ্ত যে রয়।।
"আমি"সেই নিত্যমুক্ত অতীত সকল।
এক অবশিষ্ট শিবস্বরুপ কেবল।। ১

ন বর্ণা ন বর্ণাশ্রমাচারধর্মা
ন মে ধারণাধ্যানয়োগাদয়োঽপি ।
অনাত্মাশ্রয়াহংমমাধ্যাসহানাত্
তদেকোঽবশিষ্টঃ শিবঃ কেবলোঽহম্ ॥ ২॥

অর্থাৎ ব্রাক্ষণাদি জাতিবর্ণ না আছে আমার।
অথবা আশ্রম-ধর্ম-বিহিত আচার।।
না আছে ধারণা ধ্যান যোগাদি অভ্যাস।
অনাত্মা-আশ্রয় আমি,আমার অধ্যাস।।
নাহি বলে "আমি" হই বর্জিত সকল।
এক অবশিষ্ট শিবস্বরুপ কেবল।। ২

ন মাতা পিতা বা ন দেবা ন লোকা
ন বেদা ন য়জ্ঞা ন তীর্থং ব্রুবন্তি ।
সুষুপ্তৌ নিরস্তাতিশূন্যাত্মকত্বাত্
তদেকোঽবশিষ্টঃ শিবঃ কেবলোঽহম্ ॥ ৩॥

অর্থাৎ না আছে আমার মাতা পিতা বা দেবতা।
স্বর্গাদি না চাহে "আমি" তপঃসার্থকতা।
বেদাভ্যাস যাগ যজ্ঞ তীর্থপর্যটন।
কিছুই না করে "আমি" শাস্ত্রের বচন।।
নিরস্ত হইলে মনোবুদ্ধি সুষুপ্তিতে।
সর্বভূতসাক্ষিরুপে থাকে সমাধিতে।।
স্বরুপাবস্থিত "আমি" অতীত সকল।
এক অবশিষ্ট শিবস্বরুপ কেবল।। ৩

ন সাঙ্খ্যং ন শৈবং ন তত্পাঞ্চরাত্রং
ন জৈনং ন মীমাংসকাদের্মতং বা ।
বিশিষ্টানুভূত্যা বিশুদ্ধাত্মকত্বাত্
তদেকোঽবশিষ্টঃ শিবঃ কেবলোঽহম্ ॥ ৪॥

অর্থাৎ সাংখ্য শৈব পাঞ্চরাত্র জৈন মীমাংসক।
আদি যত ধর্মমত পৃথক পৃথক।।
"আমি" তে কিছুতে তার না আছে আভাস।
অনুভূতি -বিশেষেই যাহার বিকাশ।।
"আমি" সেই নিত্য শুদ্ধ আত্মা নির্মল।
এক অবশিষ্ট শিবস্বরুপ কেবল।।৪

ন চোর্ধ্বং ন চাধো ন চান্তর্ন বাহ্যং
ন মধ্যং ন তির্যঙ্ ন পূর্বাঽপরা দিক্ ।
বিয়দ্ব্যাপকত্বাদখণ্ডৈকরূপঃ
তদেকোঽবশিষ্টঃ শিবঃ কেবলোঽহম্ ॥ ৫॥

অর্থাৎ ঊর্ধ্ব অধো নাহি যার বাহির অন্তর।
মধ্য পার্শ্ব কোণ কিংবা দিক পূর্বাপর।।
যে আছে ব্যাপিয়া ব্যোম বিশ্বচরাচরে।
অনন্ত অখণ্ড এক দিব্যরুপ ধরে।।
"আমি" সেই সর্বব্যাপী সর্বসুমঙ্গল।
এক অবশিষ্ট শিবস্বরুপ কেবল।। ৫

ন শুক্লং ন কৃষ্ণং ন রক্তং ন পীতং
ন কুব্জং ন পীনং ন হ্রস্বং ন দীর্ঘম্ ।
অরূপং তথা জ্যোতিরাকারকত্বাত্
তদেকোঽবশিষ্টঃ শিবঃ কেবলোঽহম্ ॥ ৬॥

অর্থাৎ শুক্ল কৃষ্ণ রক্ত পীত না আছে বরণ।
কুব্জ স্থূল হ্রস্ব দীর্ঘ নাহি আয়তন।।
নাহি যার কোনরুপ রুপে নির্ণয়।
যাবতীয় ভিন্নরুপ যাতে হয় লয়।।
"আমি" সেই শুদ্ধ জ্যোতিঃ নিত্য নির্মল।
এক অবশিষ্ট শিবস্বরুপ কেবল।। ৬

ন শাস্তা ন শাস্ত্রং ন শিষ্যো ন শিক্ষা
ন চ ত্বং ন চাহং ন চায়ং প্রপঞ্চঃ ।
স্বরূপাববোধো বিকল্পাসহিষ্ণুঃ
তদেকোঽবশিষ্টঃ শিবঃ কেবলোঽহম্ ॥ ৭॥

অর্থাৎ শাস্তা শাস্ত্র শিষ্য শিক্ষা কিছু নাহি যার।
"তুমি আমি" জ্ঞান নাহি প্রপঞ্চ-বিচার।
যে নিজ স্বরুপ জ্ঞানে স্বতন্ত্র প্রকাশ।
যাতে না সম্ভবে কভু বিকল্প আভাস।।
"আমি" সেই নিত্য শুদ্ধ আত্মা নির্মল।
এক অবশিষ্ট শিবস্বরুপ কেবল।। ৭

ন জাগ্রন্ ন মে স্বপ্নকো বা সুষুপ্তিঃ
ন বিশ্বো ন বা তৈজসঃ প্রাজ্ঞকো বা ।
অবিদ্যাত্মকত্বাত্ ত্রয়াণাং তুরীয়ঃ
তদেকোঽবশিষ্টঃ শিবঃ কেবলোঽহম্ ॥ ৮॥

অর্থাৎ জাগ্রত সুষুপ্তি স্বপ্ন তিন অবস্থার।
নাহি মোর অনুভূতি বিভিন্ন প্রকার।।
বিশ্ব বা তৈজস প্রাজ্ঞ "আমি" কভু নয়।
কেন না অবিদ্যারুপ এই তিন হয়।
সেহেতু তূরীয় আমি শুদ্ধ নির্মল।
এক অবশিষ্ট শিবস্বরুপ কেবল।। ৮

অপি ব্যাপকত্বাত্ হিতত্ত্বপ্রয়োগাত্
স্বতঃ সিদ্ধভাবাদনন্যাশ্রয়ত্বাত্ ।
জগত্ তুচ্ছমেতত্ সমস্তং তদন্যত্
তদেকোঽবশিষ্টঃ শিবঃ কেবলোঽহম্ ॥ ৯॥

অর্থাৎ বিশ্বচরাচর ব্যাপি যে আছে সতত।
তত্ত্বরুপ বলি যার প্রয়োগ বিদিত।।
স্বতঃসিদ্ধ, নাহি তুচ্ছ নিখিল সাংসার।।
"আমি" সেই নিত্য শুদ্ধ সর্ব সুমঙ্গল।
এক অবশিষ্ট শিবস্বরুপ কেবল।। ৯

ন চৈকং তদন্যদ্ দ্বিতীয়ং কুতঃ স্যাত্
ন কেবলত্বং ন চাকেবলত্বম্ ।
ন শূন্যং ন চাশূন্যমদ্বৈতকত্বাত্
কথং সর্ববেদান্তসিদ্ধং ব্রবীমি ॥ ১০॥

অর্থাৎ একত্বরহিত,কোথা দ্বিতীয় তাহার
কেবল বা অকেবল ভাব নাহি যার।।
শূন্য বা অশূন্য নহে অদ্বৈত বলিয়া।
কেমনে বেদান্ত-সিদ্ধ বলিয়া প্রকাশিয়া।।১০

ইতি শ্রীমত্পরমহংসপরিব্রাজকাচার্যস্য শ্রীগোবিন্দ-
ভগবত্পূজ্যপাদশিষ্যস্য শ্রীমচ্ছংকরভগবতঃ কৃতৌ
দশশ্লোকী সমাপ্তা৷৷

ইতি গোবিন্দভগবৎ শিষ্য শ্রীমৎ শংকরাচার্য্য বিরচিত দশশ্লোকী অথবা
নির্বাণদশকস্তোত্রং সমাপ্ত ॥

No comments:

আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...