Sunday, 20 September 2020

ব্রহ্মের তৈজস-সংজ্ঞক দ্বিতীয় পাদ কথনঃ-



অথর্ববেদীয়া মাণ্ডুক্য শ্রুতিতে আত্মার দ্বিতীয় পাদ কথিত হইতেছে—স্বপ্নদর্শন ইহার স্থান, অন্তরে (অবাহ্য বিষয়ে) ইহার জ্ঞান, সুতেজঃপ্রভৃতি পূর্বোক্ত সাতটি ইহার অঙ্গ, এবং পূর্ব্বোক্ত জ্ঞানেন্দ্রিয়াদি একশটি ইহার মুখ, কেবল সংস্কারোপস্থাপিত বিষয়ভোগী এই তৈজস (তেজোময় অন্তঃকরণস্বামী [আত্মার] দ্বিতীয় পাদ।।

স্বপ্নস্থানোঽন্তঃ প্রজ্ঞাঃ সপ্তাঙ্গ একোনবিংশতিমুখঃ
প্রবিবিক্তভুক্তৈজসো দ্বিতীয়ঃ পাদঃ।।-(মাণ্ডুক্য উপনিষৎ-৪)
'শাঙ্করভাষ্য' অনুসারে ভাবার্থঃ- স্বপ্নই এই তৈজসের স্থান, এইজন্য ইহাকে স্বপ্নস্থান বলা হইয়া থাকে; অনেকবিধ সাধন-সাধ্য জাগ্রৎকালীন জ্ঞান কেবল মন ব্যাপার হইলেও, যেন বাহ্য বিষয়-গত হইয়াই প্রতীত হইয়া মনেতে তাদৃশ সংস্কার সমুৎপাদন করে। চিত্রিত বস্ত্রের ন্যায় তথাবিধ সংস্কার সম্পন্ন সেই মনই অবিদ্যা, বাসনা ও তৎকৃত কর্ম্ম-প্রেরিত হইয়া বাহ্য সাধননিরপেক্ষভাবে জাগ্রৎ অবস্থার ন্যায় প্রতিভাত হইয়া থাকে। অন্যত্রও ইহা উক্ত আছে-
'সর্ব্বাবৎ (সর্ব্বপ্রকার সাধন সম্পন্ন) এই জাগরিত অবস্থার বাসনা গ্রহণ করিয়া স্বপ্ন দর্শন করে'-ইত্যাদি। সেইরূপ 'অপরাপর ইন্দ্রিয়াপেক্ষা শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ স্বভাব মনে (স্বপ্নকালে সমস্তই) একীভূত হইয়া থাকে।' এইরূপ ভূমিকার পর আথর্ব্বণ শ্রুতিতে বলা হইয়াছে যে-'এই স্বপ্নাবস্থায় এই স্বপ্রকাশ দ্রষ্টা মহিমা-মনের বিভূতি অনুভব করিয়া থাকে।'
মন স্বভাবতঃই ইন্দ্রিয়াপেক্ষা অন্তঃস্থ, স্বপ্নাবস্থায় তাঁহার স্থান সেই মানস-বাসনাময় হয়, এইকারণে তিনি অন্তঃপ্রজ্ঞ; আর শব্দাদি বিষয়বিহীন-কেবলই প্রকাশময় প্রজ্ঞার (জ্ঞানের) বিষয়ী হয় বলিয়া, তাহার নাম তৈজস। পূর্বোক্ত 'বিশ্ব' সংজ্ঞক প্রথম পাদের শব্দাদি বাহ্য বিষয়ে ভোগ বিদ্যমান থাকে, এই জন্য স্থূল প্রজ্ঞা তাহার ভোজ্য; কিন্তু এই তৈজসের কেবল বাসনাময় প্রজ্ঞাই একমাত্র ভোগ্য, এইজন্য ইহার ভোগও প্রবিবিক্ত (সূক্ষ্ম)। অপর সপ্তাঙ্গ একোনবিংশতিমুখাদি বিষয়ে ভগবান ভাষ্যকার শঙ্করাচার্য্য পূর্বশ্রুতিতে ব্যাখ্যা করিয়াছেন।
এই তৈজসই আত্মার দ্বিতীয় পাদ।.................

Friday, 18 September 2020

বৈশ্বানরই আত্মার প্রথমপাদঃ-



ইতোমধ্যে আলোচনা করিয়াছি ব্রহ্ম চতুষ্পাৎ এবং ব্রহ্ম যখন নিষ্কল, নিরংশ, তখন বাস্তবিকপক্ষে তাহারও 'পাদ' ব্যবহার আরোপ মাত্র, সত্য নহে। ব্রহ্ম চতুষ্পাৎ কি প্রকারে?-অথর্ববেদীয়া মাণ্ডুক্য শ্রুতি বলিতেছে-

জাগরিতস্থানো বহিঃপ্রজ্ঞঃ সপ্তাঙ্গ একোনবিংশতিমুখঃ স্থূল
ভুগ্বৈশ্বানরঃ প্রথমঃ পাদঃ ।।-(মাণ্ডুক্য উপনিষৎ- ৩)
ভগবৎপাদ্ শ্রী শঙ্করাচার্য্যের 'শাঙ্করভাষ্য' অনুসারে ভাবার্থঃ- জাগরণ যাহার স্থান অর্থাৎ কার্য্যভূমি তিনি জাগরিত স্থান; স্বীয় আত্মাতিরিক্ত বিষয়ে যাঁহার প্রজ্ঞা বা বুদ্ধিবৃত্তি, তিনিই বহিঃপ্রজ্ঞ। অভিপ্রায় এই যে, তাঁহার অবিদ্যাজনিত জ্ঞান বাহ্যবিষয়াবলম্বীর ন্যায় প্রতিভাত হয়। সেইরূপ সাতটি যাঁহার অঙ্গ, অর্থাৎ 'সেই এই বৈশ্বানর নামক আত্মার সম্বন্ধে এই সুতেজা (দ্যুলোকই) শীর্ষস্বরূপ, বিশ্বরূপ (সূর্য্য) তাঁহার চক্ষু, পৃথগ্ বর্ত্মাত্মা (বায়ু) তাঁহার প্রাণ, বহুল (আকাশ) তাঁহার দেহ, রয়ি (অন্ন বা জল) তাঁহার বস্তি (মূত্রাশয়) এবং পৃথিবীই তাঁহার পাদ', এই শ্রুতিতেই কল্পিত অগ্নিহোত্র যজ্ঞের অঙ্গরূপে অগ্নিকে মুখরূপ আহবনীয় (হোমকুণ্ড) বলা হইয়াছে, উক্তপ্রকার সাতটি যাঁহার অঙ্গ, তিনি 'সপ্তাঙ্গ'।
সেইরূপ একোনবিংশতিটি (ঊনিশটি) যাঁহার মুখ, অর্থাৎ পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় ও পঞ্চ কর্ম্মেন্দ্রিয় মিলাইয়া দশ, প্রাণাদি পঞ্চ বায়ু, মন,বুদ্ধি, অহঙ্কার ও চিত্ত, এই (ঊনিশটি) যাঁহার মুখ-মুখের ন্যায় অর্থাৎ উপলব্ধির উপায়। এবংবিধ বিশেষণ বিশিষ্ট বৈশ্বানর উক্ত দ্বারসমূহ দ্বারা স্থুল বিষয়সমূহ ভোগ করেন বলিয়া 'স্থূলভূক্'। সমস্ত নরগণের অনেক প্রকার সুখাদি সম্পাদন করেন বলিয়া 'বিশ্বানর' অথবা সর্ব্বনরস্বরূপ বলিয়া তিনি বিশ্বানর; বিশ্বানরই 'বৈশ্বানর'। সমস্ত দেহ হইতে অপৃথক বা অভিন্ন বলিয়া তিনি প্রথম পাদ। পরবর্তী পাদত্রয়ের পূর্বেই ইঁহাকে জানিতে হয়, এইজন্য ইঁহার প্রাথমিকত্ব।
'অয়ম্ আত্মা' এই শ্রুতি প্রতিপাদিত প্রত্যক্ আত্মার পাদ-চতুষ্টয় প্রতিপান করাই এখানে প্রস্তুত বা বর্ণনীয় বিষয়, তবে দ্যুলোক প্রভৃতিকে মূর্দ্ধপ্রভৃতি অঙ্গরূপে বর্ণনা করা হইতেছে কেন? না-এ দোষ হয় না; কারণ আধিদৈবিকের সহিত সমস্ত জগৎপ্রপঞ্চকে এই আত্মা দ্বারা চতুষ্পাদরূপে বর্ণনা করাই এখানে বিবক্ষিত। এইরূপ হইলেই সমস্ত জগৎপ্রপঞ্চের নিবৃত্তিতে অদ্বৈতভাব সিদ্ধ হইতে পারে এবং সর্ব্বভূতস্থিত আত্মার একত্ব এবং আত্মাতেও সর্ব্বভূতের অবস্থিতি সাক্ষাৎকৃত হইতে পারে।...........
..............এই বিষয়ে ভগবান ভাষ্যকার শঙ্করের ভাষ্য অতিবৃহৎ। এখানে মর্মার্থটুকু তুলে ধরা হইল মাত্র।

স্বপ্নকালীন ও জাগ্রৎকালীন জ্ঞানদ্বয়ের বৈধর্ম্য আছেঃ-



জাগ্রৎ এবং স্বপ্নাবস্থার চেতনার মধ্যে পার্থক্য আছে বলিয়া, জাগ্রৎ অবস্থার অভিজ্ঞা স্বপ্নাবস্থার অভিজ্ঞার অনুরূপ নহে। শ্রীমণ্মহর্ষি বাদরায়ণ ভগবৎ প্রণীত বেদান্ত মীমাংসা শাস্ত্রে বর্ণিত আছে-

বৈধর্ম্যাচ্চ ন স্বপ্নাদিবৎ৷৷ -(ব্রহ্মসূত্র ২।২।২৯)
শারীরকভাষ্য অনুসারে ভাবার্থঃ- ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য্য স্বীয়ভাষ্যে বিজ্ঞানবাদী বৌদ্ধ মত খণ্ডন করিয়াছেন। ভগবান্ ভাষ্যকার শঙ্কর ভাষ্যে বলিতেছেন-
বাহ্য পদার্থ অস্বীকারকারী (বিজ্ঞানবাদী বৌদ্ধ) কর্ত্তৃক যে কথিত হইয়াছে-স্বপ্নকালীন জ্ঞানের ন্যায় জাগ্রৎকালীন স্তম্ভাদি বিষয়ক জ্ঞানসকলও বাহ্য পদার্থ ব্যতিরেকেই হইবে, যেহেতু তাহারা অবিশেষভাবে জ্ঞানই,..ইত্যাদি। তাহাকে প্রত্যাখ্যান করিতে হইবে। এই বিষয়ে বলা হইতেছে-জাগ্রৎকালীন জ্ঞানসকল স্বপ্নাদিকালীন জ্ঞানের ন্যায় হইতে পারে না। তাহাতে হেতু কি? উত্তর হইল- যেহেতু স্বপ্নকালীন ও জাগ্রৎকালীন জ্ঞানদ্বয়ের বৈধর্ম্য (বিভিন্নধর্ম্মযুক্ততারূপ পার্থক্য) আছে। আচ্ছা বৈধর্ম্মটী কি?
উত্তর হইল- বাধিত হওয়া এবং অবাধিত হওয়াই সেই বৈধর্ম্য, ইহা বলিতেছি। যেহেতু প্রতিবুদ্ধ (জাগরিত) ব্যক্তির স্বপ্নকালে উপলব্ধ বস্তু বাধিত হয়, (তিনি বলেন-'স্বপ্নকালে) মৎকর্ত্তৃক উপলব্ধ মহাত্মা ব্যক্তিগণের সমাগম মিথ্যা, কারণ আমার নিকট মহাত্মা ব্যক্তিগণের সমাগম হয় নাই; কিন্তু আমার মন নিদ্রারূপ গ্লানিযুক্ত ছিল, সেইহেতু এই ভ্রান্তি উপলব্ধ হইয়াছিল', ইত্যাদি। এইপ্রকারে মায়া (-ইন্দ্রজাল) প্রভৃতি স্থলেও যথাযোগ্য বাধ হইবে। জাগরিতকালে উপলব্ধ স্তম্ভ প্রভৃতি বস্তু কিন্তু কোন অবস্থাতেও (মায়া প্রভৃতির ন্যায়) এইপ্রকারে বাধিত হয় না।
আর এক কথা, এই যে স্বপ্নদর্শন, ইহা স্মৃতি। জাগ্রতকালীন দর্শন(-জ্ঞান) কিন্তু উপলব্ধি। আর বিষয়ের বিপ্রয়োগ এবং সম্প্রয়োগাত্মক (-অবিদ্যমানতা এবং বিদ্যমানতারূপ) যে স্মৃতি ও উপলব্ধির প্রত্যক্ষ অন্তর (-ভেদ), তাহা স্বয়ম্ অনুভূত হয়, যথা 'প্রিয় পুত্রকে স্মরণ করিতেছি', তাহাকে উপলব্ধি করিতেছি না', ' তাহাকে উপলব্ধি করিতে ইচ্ছা করিতেছি', ইত্যাদি।
সেইস্থলে এইপ্রকার হইলে উভয়ের বিভিন্নতা যিনি স্বয়ং অনুভব করেন, তৎকর্ত্তৃক ইহা কথিত হইতে পারে না যে,"জাগ্রৎকালীন উপলব্ধি মিথ্যা (-আলম্বনহীন), যেহেতু তাহা উপলব্ধি, যেমন স্বপ্নোলব্ধি" ইত্যাদি। যেহেতু যাঁহারা নিজদিগকে প্রাজ্ঞ মনে করেন, তাঁহাদিগকর্ত্তূক নিজের অনুভবের অপলোপ করা যুক্তিসঙ্গত নহে।
আবার অনুভবের বিরোধ হইয়া পড়ে বলিয়া "জাগ্রৎকালীন জ্ঞানসকল স্বভাবতঃই অবলম্বনহীন", ইহা বলিতে যে বিজ্ঞানবাদী বৌদ্ধ অসমর্থ, তিনি স্বপ্নকালীন জ্ঞানের সাধর্ম্ম্যবশতঃ (-আলম্বনহীনতারূপ সমানধর্ম্মযুক্তাবশতঃ, জাগ্রৎকালীন জ্ঞানসকলের নিরালম্বনতা) বলিতে ইচ্ছা করিতেছেন। কিন্তু যাহা যাহার স্বাভাবিক ধর্ম্ম নহে, তাহা অন্যের স্বাধর্ম্ম্যবশতঃ তাহার নিজের ধর্ম্ম হইবে, ইহা সম্ভব নহে। দেখ, যে অগ্নি উষ্ণরূপে অনুভূত হয়, জলের শৈত্যরূপ সাধর্ম্ম্যবশতঃ তাহা নিশচয়ই শীতল হইয়া পড়িবে না। স্বপ্ন ও জাগ্রদবস্থার বৈধর্ম্ম্য কিন্তু ইতোপূর্ব্বে প্রদর্শিত হইয়াছে।.............

জাগ্রদবস্থাঃ-



ইতোমধ্যে আলোচনা করিয়াছি জাগ্রদবস্থা যাহার স্থান বা ভোগক্ষেত্র সেই বৈশ্বানরই আত্মার প্রথমপাদ। শুক্ল-যজুর্ব্বেদীয় বৃহদারণ্যক শ্রুতিতে জাগ্রৎ অবস্থাকে 'বুদ্ধান্ত' অবস্থা বলা হইয়াছে-

‘স বা এষ এতস্মিন্ স্বপ্নে রত্বা চরিত্বা দৃষ্টৈবব পুণ্যঞ্চ পাপঞ্চ পুনঃ প্রতিন্যায়ং প্রতিযোন্যাদ্রবতি বুদ্ধান্তায়ৈব। স যত্তত্র কিঞ্চিৎ পশ্যতি অনন্বাগতস্তেন ভবত্যসঙ্গো হি অয়ং পুরুষ ইতি…’।। (বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪/৩/১৬)।।
ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য্যের 'শাঙ্করভাষ্য' অনুসারে ভাবার্থঃ- সেই এই পুরুষ, যিনি সুষুপ্তি অবস্থা হইতে প্রত্যাগত হইয়াছে, স্বপ্নাবস্থায় স্বেচ্ছায় রমণ ও পরিভ্রমণ করিয়া এবং পূণ্য ও পাপ দর্শন করিয়া বুদ্ধান্ত বা জাগ্রৎ অবস্থার উদ্দেশ্যে (প্রতিগমন করে)। (স্বপ্নে তিনি যা কিছুই দেখুন না কেন, তাহাতে তাঁহার কোন আসক্তি থাকে না) কেননা পুরুষ যদি স্বপ্নাবস্থায় সঙ্গবান্ কামনাবিশিষ্টই হইত, তাহা হইলে জাগরিত অবস্থায় প্রত্যাগমনের পরেও নিশ্চয়ই স্বপ্নদৃষ্ট বিষয়ের সঙ্গজনিত পাপ পূণ্য দ্বারা অবশ্যই লিপ্ত হইত, তাহা যখন হয় না তখন পুরুষ নিশ্চয়ই 'অসঙ্গ'।.....
আবার পরবর্তী শ্রুতিতে বলা হইতেছে- "বুদ্ধান্তে অর্থাৎ জাগ্রৎ অবস্থায় এই দৃশ্যমান জগতে রমণ ও পরিভ্রমণ করিয়া এবং পাপ-পুণ্য দর্শন করিয়া পুনর্ব্বার সেই পুরুষ স্বপ্নান্তের (স্বপ্নাবস্থার) উদ্দেশ্যে ধাবিত হয়। স্বপ্নান্তে উপস্থিত হইয়া সেই পুরুষ জাগ্রদবস্থার দোষে বা গুণে লিপ্ত হয় না, এতে সেই পুরুষের অসঙ্গত্ব সিদ্ধির কোন বাধা ঘটিতেছে না।"-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪/৩/১৭)।।
তদ্বিষয়ে পরবর্তী শ্রুতি অপূর্ব দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করিতেছে-"নদীর জলে এক মহামৎস্য অর্থাৎ যে মৎস্য নদীর স্রোতাবেগে চালিত হয় না, বরং নিজে স্রোতোবেগকে স্থগিত করিতে সমর্থ, এমন স্বচ্ছন্দগতিশীল মৎস্য যেরূপ এপাড় থেকে ওপাড়ে আবার এপাড়ে বিচরণ করিলেও নদীগর্ভস্থ স্রোতোবেগের বশীভূত হয় না, এই পুরুষও ঠিক সেইভাবেই এই উভয় অন্তে (স্বপ্ন ও জাগ্রত অবস্থায়) যথাক্রমে সঞ্চরণ করিয়া থাকেন।-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪/৩/১৮)।..............
ভগবান ভাষ্যকার আচার্য্য শঙ্কর উক্ত শ্রুতির ভাষ্যান্তে বলিতেছেন-"উক্ত দৃষ্টান্ত প্রদর্শনের ফল এই যে, পূর্বোক্ত দেহেন্দ্রিয় সংঘাতরূপ মৃত্যু এবং দেহেন্দ্রিয়াদির প্রবর্তক কাম ও কর্ম্ম, এই সমস্তই অনাত্ম-ধর্ম্ম, অর্থাৎ আত্মার ধর্ম্ম নহে; এই আত্মা দেহেন্দ্রিয়াদি হইতে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকার।".......

Wednesday, 16 September 2020

ব্রহ্মের পাদ-চতুষ্টয় নিরূপণঃ-



অথর্ববেদীয় মাণ্ডুক্য উপনিষদে ব্রহ্মের সর্ব্বাত্মকতা, আত্মস্বরূপতা নিরূপণ করার পর ব্রহ্মের পাদ-চতুষ্টয় নিরূপণ করা হইয়াছে-

....সোঽয়মাত্মা চতুষ্পাৎ ।। -(মাণ্ডুক্য উপনিষৎ-২)

ভগবৎপাদ্ শ্রী শঙ্করাচার্য্য প্রণীত 'শাঙ্করভাষ্য' অনুসারে ভাবার্থঃ- পরাপর ব্রহ্মভাবে অবস্থিত ওঙ্কার শব্দার্থ সেই এই আত্মা কার্যাপণের (কাহণের ন্যায়) চতুষ্পাৎ (চারি অংশ বিশিষ্ট)। 'বিশ্ব' প্রভৃতি পাদত্রয়ের মধ্যে পূর্ব্ব পূর্ব্ব পাদের বিলোপ সাধন দ্বারা (অসত্যতা প্রতিপাদন দ্বারা) তুরীয় ব্রহ্মের উপলব্ধি হইয়া থাকে; এইজন্য 'পাদ' শব্দটি করণবাচ্যে নিষ্পন্ন করিতে হয়; কিন্তু 'পাদ' শব্দটি যখন তুরীয়ের বোধক হয় তখন 'যাহা প্রাপ্ত হওয়া যায়' এই অর্থে উহা কর্ম্মবাচ্যে নিষ্পন্ন করিতে হয়।

টীকাঃ- ষোল পণে এক কাহণ কড়ি হয়। তাহার প্রত্যেক চারি পণকে একপাদ বলিয়া ব্যবহার করা হয়; বস্তুত ঐ কাহণ ও পাদ ব্যবহার কড়িতে আরোপিত হয় মাত্র। উহা কড়ির স্বাভাবিক ধর্ম্ম নহে। ব্রহ্ম যখন নিষ্কল, নিরংশ, তখন বাস্তবিকপক্ষে তাহারও পাদ ব্যবহার আরোপ মাত্র, সত্য নহে।

'বিশ্বাদি' পদে বিশ্ব, বৈশ্বানর, তৈজস ও প্রাজ্ঞ এই চারিটী পাদ বুঝিতে হইবে। এখানে আশঙ্খা হইয়াছিল যে, 'পদ্যতে যেন (যাহা দ্বারা পাওয়া যায়), এইরূপ 'করণ' অর্থে যদি 'পাদ' শব্দ নিষ্পন্ন করা হয়, তাহা হইলে 'পাদ' শব্দে ব্রহ্মপ্রাপ্তির সাধন (করণ) বিশ্বাদিকে মাত্র বুঝাইতে পারে; কিন্তু তুরীয় ব্রহ্মকে আর 'পাদ' বলা যাইতে পারে না। কারণ তুরীয় ব্রহ্ম স্বয়ং জ্ঞেয় স্বরূপই বটে, জ্ঞানসাধন নহে। আবার 'পাদ' শব্দটি যদি 'পদ্যতে'যঃ, স পাদঃ (যাহা প্রাপ্ত হওয়া যায়, তাহাই পাদ), এইরূপ কর্ম্মবাচ্যে নিষ্পন্ন করা হয়, তাহা হইলে 'পাদ' শব্দে কেবল তুরীয়কেই বুঝাইতে পারে, বিশ্ব তৈজসাদিকে আর বুঝাইতে পারে না; কারণ বিশ্বাদিরা কেবলই জ্ঞান সাধন, কিন্তু জ্ঞেয় নহে। তাই ভাষ্যকার ভগবান শঙ্কর বলিলেন যে 'পাদ' শব্দটি বিশ্বাদি অর্থে করণসাধন, আর তুরীয় অর্থে কর্ম্ম সাধন।


Tuesday, 15 September 2020

অদ্বৈতই পরমার্থঃ-


অথর্ববেদীয় মাণ্ডুক্য উপনিষৎ-৭ এর উপর পরমগুরু আচার্য্য গৌড়পাদ্ বিরচিত মাণ্ডুক্যকারিকায় বর্ণিত আছে-

প্রপঞ্চো যদি বিদ্যেত নিবর্তেত ন সংশয়ঃ ।

মায়ামাত্রমিদং দ্বৈতমদ্বৈতং পরমার্থতঃ ॥ ১৭॥

ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য্য প্রণীত 'শাঙ্করভাষ্য' অনুবাদঃ- প্রপঞ্চ নিবৃত্তিতে যদি প্রতিবোধ হয়, তবে প্রপঞ্চ নিবৃত্তি না হইলে অদ্বৈত হয় কি রূপে? উত্তর বলা হইতেছে- নিশ্চয় এই আপত্তি হইতে পারিত, প্রপঞ্চ যদি বিদ্যমান থাকিত অর্থাৎ সত্য হইত; বাস্তবিক পক্ষে ইহা নাই-রজ্জুতে কল্পিত সর্পের ন্যায় ইহা অসৎ। আর যদি বিদ্যমানই থাকিত, তাহা হইলে নিশ্চয় নিবৃত্ত হইত, ইহাতেও সংশয় নাই।

দেখ ভ্রমবশতঃ রজ্জুতে যে সর্প কল্পিত হয়, সেই সর্প কখনই সেখানে সত্তা লাভ করিয়া বিবেকজ্ঞানের সাহায্যে নিবৃত্ত হয় না,; এবং মায়াবী ঐন্দ্রজালিক কর্তৃক প্রযুক্ত মায়া (ভেল্কী) প্রথমে সত্তা লাভ করিয়া যে, দর্শকবৃন্দের চক্ষুদোষ অপনীত হইলে নিবৃত্ত (অদৃশ্য) হইয়া যায় তাহা নহে।

এই প্রপঞ্চ নামক দ্বৈতও ঠিক তদ্রূপ কেবল মায়ামাত্র (অসৎ), আর উক্ত রজ্জু ও মায়াবীর ন্যায় অদ্বৈতই পরমার্থ সৎ। অভিপ্রায় এই যে প্রপঞ্চ বলিয়া কোন পদার্থ প্রবৃত্ত বা নিবৃত্ত নাই।....

স্বামী নিগমানন্দ সরস্বতী তাঁহার 'জ্ঞানীগুরু' শীর্ষক গ্রন্থে বলিয়াছেন-

"নানাবিধ শ্রুতিপ্রমাণে জানা যায়, অদ্বৈতই পরমার্থ এবং দ্বৈত সেই অদ্বৈতের কার্য। যখন সমাধি উপস্থিত হয় তখন দ্বৈতবুদ্ধি থাকে না। যাঁহারা দ্বৈতবাদী, তাঁহারা ভ্রান্ত; কারণ শ্রুতিতে উক্ত আছে যে 'একমেবাদ্বিতীয়ম্'-সেই পরমাত্মা এক  অদ্বিতীয়, সুতরাং অদ্বৈত বৈদিক মত সর্বথা অবিরুদ্ধ।"

আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...