জাগ্রৎ এবং স্বপ্নাবস্থার চেতনার মধ্যে পার্থক্য আছে বলিয়া, জাগ্রৎ অবস্থার অভিজ্ঞা স্বপ্নাবস্থার অভিজ্ঞার অনুরূপ নহে। শ্রীমণ্মহর্ষি বাদরায়ণ ভগবৎ প্রণীত বেদান্ত মীমাংসা শাস্ত্রে বর্ণিত আছে-
বৈধর্ম্যাচ্চ ন স্বপ্নাদিবৎ৷৷ -(ব্রহ্মসূত্র ২।২।২৯)
শারীরকভাষ্য অনুসারে ভাবার্থঃ- ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য্য স্বীয়ভাষ্যে বিজ্ঞানবাদী বৌদ্ধ মত খণ্ডন করিয়াছেন। ভগবান্ ভাষ্যকার শঙ্কর ভাষ্যে বলিতেছেন-
বাহ্য পদার্থ অস্বীকারকারী (বিজ্ঞানবাদী বৌদ্ধ) কর্ত্তৃক যে কথিত হইয়াছে-স্বপ্নকালীন জ্ঞানের ন্যায় জাগ্রৎকালীন স্তম্ভাদি বিষয়ক জ্ঞানসকলও বাহ্য পদার্থ ব্যতিরেকেই হইবে, যেহেতু তাহারা অবিশেষভাবে জ্ঞানই,..ইত্যাদি। তাহাকে প্রত্যাখ্যান করিতে হইবে। এই বিষয়ে বলা হইতেছে-জাগ্রৎকালীন জ্ঞানসকল স্বপ্নাদিকালীন জ্ঞানের ন্যায় হইতে পারে না। তাহাতে হেতু কি? উত্তর হইল- যেহেতু স্বপ্নকালীন ও জাগ্রৎকালীন জ্ঞানদ্বয়ের বৈধর্ম্য (বিভিন্নধর্ম্মযুক্ততারূপ পার্থক্য) আছে। আচ্ছা বৈধর্ম্মটী কি?
উত্তর হইল- বাধিত হওয়া এবং অবাধিত হওয়াই সেই বৈধর্ম্য, ইহা বলিতেছি। যেহেতু প্রতিবুদ্ধ (জাগরিত) ব্যক্তির স্বপ্নকালে উপলব্ধ বস্তু বাধিত হয়, (তিনি বলেন-'স্বপ্নকালে) মৎকর্ত্তৃক উপলব্ধ মহাত্মা ব্যক্তিগণের সমাগম মিথ্যা, কারণ আমার নিকট মহাত্মা ব্যক্তিগণের সমাগম হয় নাই; কিন্তু আমার মন নিদ্রারূপ গ্লানিযুক্ত ছিল, সেইহেতু এই ভ্রান্তি উপলব্ধ হইয়াছিল', ইত্যাদি। এইপ্রকারে মায়া (-ইন্দ্রজাল) প্রভৃতি স্থলেও যথাযোগ্য বাধ হইবে। জাগরিতকালে উপলব্ধ স্তম্ভ প্রভৃতি বস্তু কিন্তু কোন অবস্থাতেও (মায়া প্রভৃতির ন্যায়) এইপ্রকারে বাধিত হয় না।
আর এক কথা, এই যে স্বপ্নদর্শন, ইহা স্মৃতি। জাগ্রতকালীন দর্শন(-জ্ঞান) কিন্তু উপলব্ধি। আর বিষয়ের বিপ্রয়োগ এবং সম্প্রয়োগাত্মক (-অবিদ্যমানতা এবং বিদ্যমানতারূপ) যে স্মৃতি ও উপলব্ধির প্রত্যক্ষ অন্তর (-ভেদ), তাহা স্বয়ম্ অনুভূত হয়, যথা 'প্রিয় পুত্রকে স্মরণ করিতেছি', তাহাকে উপলব্ধি করিতেছি না', ' তাহাকে উপলব্ধি করিতে ইচ্ছা করিতেছি', ইত্যাদি।
সেইস্থলে এইপ্রকার হইলে উভয়ের বিভিন্নতা যিনি স্বয়ং অনুভব করেন, তৎকর্ত্তৃক ইহা কথিত হইতে পারে না যে,"জাগ্রৎকালীন উপলব্ধি মিথ্যা (-আলম্বনহীন), যেহেতু তাহা উপলব্ধি, যেমন স্বপ্নোলব্ধি" ইত্যাদি। যেহেতু যাঁহারা নিজদিগকে প্রাজ্ঞ মনে করেন, তাঁহাদিগকর্ত্তূক নিজের অনুভবের অপলোপ করা যুক্তিসঙ্গত নহে।
আবার অনুভবের বিরোধ হইয়া পড়ে বলিয়া "জাগ্রৎকালীন জ্ঞানসকল স্বভাবতঃই অবলম্বনহীন", ইহা বলিতে যে বিজ্ঞানবাদী বৌদ্ধ অসমর্থ, তিনি স্বপ্নকালীন জ্ঞানের সাধর্ম্ম্যবশতঃ (-আলম্বনহীনতারূপ সমানধর্ম্মযুক্তাবশতঃ, জাগ্রৎকালীন জ্ঞানসকলের নিরালম্বনতা) বলিতে ইচ্ছা করিতেছেন। কিন্তু যাহা যাহার স্বাভাবিক ধর্ম্ম নহে, তাহা অন্যের স্বাধর্ম্ম্যবশতঃ তাহার নিজের ধর্ম্ম হইবে, ইহা সম্ভব নহে। দেখ, যে অগ্নি উষ্ণরূপে অনুভূত হয়, জলের শৈত্যরূপ সাধর্ম্ম্যবশতঃ তাহা নিশচয়ই শীতল হইয়া পড়িবে না। স্বপ্ন ও জাগ্রদবস্থার বৈধর্ম্ম্য কিন্তু ইতোপূর্ব্বে প্রদর্শিত হইয়াছে।.............
No comments:
Post a Comment