পরমেশ্বরের যে সৃজনীবৃত্তি অর্থাৎ জগৎ সৃষ্টি করবার ইচ্ছা আছে, সেই সৃজনী-বৃত্তিবশতঃ এক ব্রহ্ম বহুনামে বহুরূপে প্রকাশিত হয়ে থাকেন। 'তদৈক্ষত বহু স্যাং প্রজায়েয়েতি তত্তেজোসৃজত'।-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৬/২/৩) অর্থাৎ 'তিনি ইক্ষণ করলেন, আমি বহু হব, প্রকৃষ্টরূপে উৎপন্ন হব, তিনি তেজকে সৃষ্টি করলেন' ইত্যাদি।
এক
আমি, বহু হব, ঈশ্বরের এরূপ সৃজনীবৃত্তিই মায়া। এই মায়া পরমেশ্বরেরই শক্তি। মায়াই
সংসার প্রপঞ্চের বীজ। মায়াই বিশ্বজননী প্রকৃতি। অবিদ্যারূপ এই বীজশক্তি প্রলয়কালে
অব্যক্ত ভাবে পরমেশ্বরকে আশ্রয় করে অবস্থান করে। জগৎপ্রপঞ্চ মায়ার গর্ভে বিলীন থাকে।
সৃষ্টির প্রারম্ভে এই প্রকৃতি সৃজনীশক্তিরূপে যখন আত্মপ্রকাশ লাভ করে, তখন পরমেশ্বর
মায়ার উদরে বিলীন জগৎ আবির্ভাব করিয়ে থাকেন। মায়াশক্তিমান্ ব্রহ্মই ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞরূপে,
জীব ও জগৎরূপে প্রকাশিত হন। শঙ্করাচার্য শারীরকমীমাংসা ভাষ্যে বলেছেন—"সর্বজ্ঞস্যেশ্বরস্যাত্মভূতে
ইবাবিদ্যাকল্পিতে নামরূপে তত্ত্বান্যত্বাভ্যামনির্বচনীযে সংসারপ্রপঞ্চবীজভূতে সর্বজ্ঞস্যেশ্বরস্য
মাযাশক্তিঃ প্রকৃতিরিতি ন শ্রুতিস্মৃত্যোরভিলপ্যেতে"।'-(ব্রহ্মসূত্র-২।১।১৪, শাঙ্করভাষ্য)
অর্থাৎ সর্বজ্ঞ ঈশ্বরের যেন আত্মভূত (নিজস্বরূপ) যে অবিদ্যাকল্পিত নাম ও রূপ, যারা
তত্ত্ব ও অন্যত্বের দ্বারা অনির্বচনীয় (অর্থাৎ যাকে সদ্ রূপে অথবা অসদ্ রূপে নির্ব্বচন
করতে পারা যায় না) এবং যারা সংসারপ্রপঞ্চের বীজস্বরূপ, তারা সর্বজ্ঞ ঈশ্বরের মায়াশক্তি
ও প্রকৃতি, এরূপে শ্রুতি এবং স্মৃতিতে বর্ণিত হচ্ছে।
এই
মায়া ব্যতিরেকে পরমেশ্বরের জগৎস্রষ্টৃত্ব সম্ভব নয়। শারীরক মীমাংসাতে শঙ্করাচার্য্যের
এটাই অভিপ্রায়। 'আমরা কিন্তু জগতের এই (মায়াশক্তিরূপা) প্রাগবস্থাকে পরমেশ্বরের অধীনরূপে
অঙ্গীকার করে থাকি, স্বাধীনরূপে নয়। আর তা অবশ্যই স্বীকার্য্যা, যেহেতু তা প্রয়োজনসম্পাদিকা।
তদ্ব্যতিরেকে পরমেশ্বরের স্রষ্টৃত্ব নিশ্চয়ই সিদ্ধ হয় না, কারণ যিনি শক্তিরহিত, তার
(সৃষ্ট্যাদিকর্ম্মে) প্রবৃত্তি যুক্তি সঙ্গত নয়।'-(ব্রহ্মসূত্র-১।৪।৩, শাঙ্করভাষ্য)
সেই
ব্রহ্ম যিনি অদৃশ্য, অগ্রাহ্য, নিত্য, বিভু ও সর্বগত সেই নির্বিশেষ ব্রহ্মের সৃষ্টিকারণতা
কিরূপে হতে পারে? তদুত্তরে শ্রতি প্রসিদ্ধ দৃষ্টান্ত প্রদর্শন করছে এইভাবে-
যথোর্ণনাভিঃ
সৃজতে গৃহ্ণতে চ যথা পৃথিব্যামোষধযঃ সংভবন্তি৷ যথা সতঃ পুরূষাত্কেশলোমানি তথাক্ষরাত্সংভবতীহ
বিশ্বম্৷৷-(মুণ্ডক উপনিষৎ-১.১.৭)
অর্থাৎ
মাকড়সা কোন অন্যকারণের অপেক্ষা না করে নিজেই সৃষ্টি করে অর্থাৎ নিজ শরীর হতে অভিন্ন
তন্তুরাশিকে বাইরে প্রসারিত করে, আবার সেই সকলকে গ্রহণও করে অর্থাৎ নিজের সহিত একীভূত
করে ফেলে এবং যেরূপ ওষুধিসকল অর্থাৎ ধান্যাদি হতে আরম্ভ করে বৃক্ষসমূহ পর্যন্ত পৃথিবীতে
তদভিন্নরূপেই উৎপন্ন হয় এবং যেরূপ বিদ্যমান-সজীব পুরুষ হতে বিজাতীয় কেশ ও লোম উৎপন্ন
হয় অর্থাৎ এই দৃষ্টান্ত সকল যেরূপ সেইরূপ ব্রহ্মের বিসদৃশ (জড়জগৎ) ও সদৃশ (চেতনজীববিশিষ্ট)
সমস্ত জগৎপ্রপঞ্চ অন্য নিমিত্তনিরপেক্ষ পূর্বোক্ত লক্ষণবিশিষ্ট অব্যয় ব্রহ্ম নিমিত্ত
সংসারচক্রে উৎপন্ন হয়।
মায়াধীশ
পরমেশ্বরই জগতের নিমিত্তকারণ। ঈশ্বরের অধ্যক্ষতায়ই মায়ার বিকাশ হয়ে থাকে এবং এই
মায়ার সহায়তায় তিনি চরাচর জগতের সৃষ্টি করে থাকেন। নির্বিশেষ পরব্রহ্মই মায়ার এবং
মায়িক নাম-রূপ-প্রপঞ্চের একমাত্র অধিষ্ঠান বা আশ্রয়। এক ব্রহ্মই বহু হয়েছেন, বহুনামে
বহুরূপে প্রতিভাত হচ্ছেন। তাঁর এই ভাতি বা প্রকাশের দ্বারা তিনি কিছুমাত্র রূপান্তরিত
বা বিকৃত হন নি, সম্পূর্ণ অবিকারী ভাবেই অজ্ঞানলীলার ভিত্তিরূপে বিরাজ করছেন। ব্রহ্ম-ভিত্তি
সদা বিদ্যমান আছে বলেই মায়ার এরূপ বিচিত্র খেলা চলছে এবং মায়িক জগৎ সত্য বলে বোধ
হচ্ছে। এই অবিকারী কূটস্থ ব্রহ্মই জড় জগতের অপরিণামী উপাদান বা বিবর্তকারণ। এই অপরিণামী
উপাদানকারণকে আশ্রয় করে অনির্বচনীয় অবিদ্যা বিবিধ অনির্বচনীয় নামরূপে পরিণত হচ্ছে,
সুতরাং অবিদ্যা জড়জগতের পরিণামী উপাদান। অতএব ব্রহ্ম কেবল জগতের নিমিত্তকারণই নন।
তিনি নিমিত্তকারণও বটেন, উপাদানকারণও বটেন।........
তথ্যসূত্রঃ-
১.
ভগবান্ শঙ্করাচার্যের মুণ্ডক উপনিষৎ ভাষ্য।
২.
ভগবান্ শঙ্করাচার্যের ব্রহ্মসূত্র শারীরকমীমাংসা ভাষ্য।
৩.
"বেদান্তদর্শন-অদ্বৈতবাদ্", কাব্য-ব্যাকরণ-সাংখ্য-বেদান্ততীর্থ, বিদ্যাবাচস্পতি
শ্রীআশুতোষ ভট্টাচার্য শাস্ত্রী।
...............................................….....…..............
শ্রীশুভ
চৌধুরী।
নভেম্বর
২০, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দ।