Sunday, 20 November 2022

নির্বিশেষ ব্রহ্ম কেমন করে কার্যবর্গরূপে অর্থাৎ জগৎরূপে আত্মপ্রকাশ লাভ করলেন?

 


পরমেশ্বরের যে সৃজনীবৃত্তি অর্থাৎ জগৎ সৃষ্টি করবার ইচ্ছা আছে, সেই সৃজনী-বৃত্তিবশতঃ এক ব্রহ্ম বহুনামে বহুরূপে প্রকাশিত হয়ে থাকেন। 'তদৈক্ষত বহু স্যাং প্রজায়েয়েতি তত্তেজোসৃজত'।-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৬/২/৩) অর্থাৎ 'তিনি ইক্ষণ করলেন, আমি বহু হব, প্রকৃষ্টরূপে উৎপন্ন হব, তিনি তেজকে সৃষ্টি করলেন' ইত্যাদি।

এক আমি, বহু হব, ঈশ্বরের এরূপ সৃজনীবৃত্তিই মায়া। এই মায়া পরমেশ্বরেরই শক্তি। মায়াই সংসার প্রপঞ্চের বীজ। মায়াই বিশ্বজননী প্রকৃতি। অবিদ্যারূপ এই বীজশক্তি প্রলয়কালে অব্যক্ত ভাবে পরমেশ্বরকে আশ্রয় করে অবস্থান করে। জগৎপ্রপঞ্চ মায়ার গর্ভে বিলীন থাকে। সৃষ্টির প্রারম্ভে এই প্রকৃতি সৃজনীশক্তিরূপে যখন আত্মপ্রকাশ লাভ করে, তখন পরমেশ্বর মায়ার উদরে বিলীন জগৎ আবির্ভাব করিয়ে থাকেন। মায়াশক্তিমান্ ব্রহ্মই ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞরূপে, জীব ও জগৎরূপে প্রকাশিত হন। শঙ্করাচার্য শারীরকমীমাংসা ভাষ্যে বলেছেন"সর্বজ্ঞস্যেশ্বরস্যাত্মভূতে ইবাবিদ্যাকল্পিতে নামরূপে তত্ত্বান্যত্বাভ্যামনির্বচনীযে সংসারপ্রপঞ্চবীজভূতে সর্বজ্ঞস্যেশ্বরস্য মাযাশক্তিঃ প্রকৃতিরিতি ন শ্রুতিস্মৃত্যোরভিলপ্যেতে"।'-(ব্রহ্মসূত্র-২।১।১৪, শাঙ্করভাষ্য) অর্থাৎ সর্বজ্ঞ ঈশ্বরের যেন আত্মভূত (নিজস্বরূপ) যে অবিদ্যাকল্পিত নাম ও রূপ, যারা তত্ত্ব ও অন্যত্বের দ্বারা অনির্বচনীয় (অর্থাৎ যাকে সদ্ রূপে অথবা অসদ্ রূপে নির্ব্বচন করতে পারা যায় না) এবং যারা সংসারপ্রপঞ্চের বীজস্বরূপ, তারা সর্বজ্ঞ ঈশ্বরের মায়াশক্তি ও প্রকৃতি, এরূপে শ্রুতি এবং স্মৃতিতে বর্ণিত হচ্ছে।

এই মায়া ব্যতিরেকে পরমেশ্বরের জগৎস্রষ্টৃত্ব সম্ভব নয়। শারীরক মীমাংসাতে শঙ্করাচার্য্যের এটাই অভিপ্রায়। 'আমরা কিন্তু জগতের এই (মায়াশক্তিরূপা) প্রাগবস্থাকে পরমেশ্বরের অধীনরূপে অঙ্গীকার করে থাকি, স্বাধীনরূপে নয়। আর তা অবশ্যই স্বীকার্য্যা, যেহেতু তা প্রয়োজনসম্পাদিকা। তদ্ব্যতিরেকে পরমেশ্বরের স্রষ্টৃত্ব নিশ্চয়ই সিদ্ধ হয় না, কারণ যিনি শক্তিরহিত, তার (সৃষ্ট্যাদিকর্ম্মে) প্রবৃত্তি যুক্তি সঙ্গত নয়।'-(ব্রহ্মসূত্র-১।৪।৩, শাঙ্করভাষ্য)

সেই ব্রহ্ম যিনি অদৃশ্য, অগ্রাহ্য, নিত্য, বিভু ও সর্বগত সেই নির্বিশেষ ব্রহ্মের সৃষ্টিকারণতা কিরূপে হতে পারে? তদুত্তরে শ্রতি প্রসিদ্ধ দৃষ্টান্ত প্রদর্শন করছে এইভাবে-

যথোর্ণনাভিঃ সৃজতে গৃহ্ণতে চ যথা পৃথিব্যামোষধযঃ সংভবন্তি৷ যথা সতঃ পুরূষাত্কেশলোমানি তথাক্ষরাত্সংভবতীহ বিশ্বম্৷৷-(মুণ্ডক উপনিষৎ-১.১.৭)

অর্থাৎ মাকড়সা কোন অন্যকারণের অপেক্ষা না করে নিজেই সৃষ্টি করে অর্থাৎ নিজ শরীর হতে অভিন্ন তন্তুরাশিকে বাইরে প্রসারিত করে, আবার সেই সকলকে গ্রহণও করে অর্থাৎ নিজের সহিত একীভূত করে ফেলে এবং যেরূপ ওষুধিসকল অর্থাৎ ধান্যাদি হতে আরম্ভ করে বৃক্ষসমূহ পর্যন্ত পৃথিবীতে তদভিন্নরূপেই উৎপন্ন হয় এবং যেরূপ বিদ্যমান-সজীব পুরুষ হতে বিজাতীয় কেশ ও লোম উৎপন্ন হয় অর্থাৎ এই দৃষ্টান্ত সকল যেরূপ সেইরূপ ব্রহ্মের বিসদৃশ (জড়জগৎ) ও সদৃশ (চেতনজীববিশিষ্ট) সমস্ত জগৎপ্রপঞ্চ অন্য নিমিত্তনিরপেক্ষ পূর্বোক্ত লক্ষণবিশিষ্ট অব্যয় ব্রহ্ম নিমিত্ত সংসারচক্রে উৎপন্ন হয়।

মায়াধীশ পরমেশ্বরই জগতের নিমিত্তকারণ। ঈশ্বরের অধ্যক্ষতায়ই মায়ার বিকাশ হয়ে থাকে এবং এই মায়ার সহায়তায় তিনি চরাচর জগতের সৃষ্টি করে থাকেন। নির্বিশেষ পরব্রহ্মই মায়ার এবং মায়িক নাম-রূপ-প্রপঞ্চের একমাত্র অধিষ্ঠান বা আশ্রয়। এক ব্রহ্মই বহু হয়েছেন, বহুনামে বহুরূপে প্রতিভাত হচ্ছেন। তাঁর এই ভাতি বা প্রকাশের দ্বারা তিনি কিছুমাত্র রূপান্তরিত বা বিকৃত হন নি, সম্পূর্ণ অবিকারী ভাবেই অজ্ঞানলীলার ভিত্তিরূপে বিরাজ করছেন। ব্রহ্ম-ভিত্তি সদা বিদ্যমান আছে বলেই মায়ার এরূপ বিচিত্র খেলা চলছে এবং মায়িক জগৎ সত্য বলে বোধ হচ্ছে। এই অবিকারী কূটস্থ ব্রহ্মই জড় জগতের অপরিণামী উপাদান বা বিবর্তকারণ। এই অপরিণামী উপাদানকারণকে আশ্রয় করে অনির্বচনীয় অবিদ্যা বিবিধ অনির্বচনীয় নামরূপে পরিণত হচ্ছে, সুতরাং অবিদ্যা জড়জগতের পরিণামী উপাদান। অতএব ব্রহ্ম কেবল জগতের নিমিত্তকারণই নন। তিনি নিমিত্তকারণও বটেন, উপাদানকারণও বটেন।........

তথ্যসূত্রঃ-

১. ভগবান্ শঙ্করাচার্যের মুণ্ডক উপনিষৎ ভাষ্য।

২. ভগবান্ শঙ্করাচার্যের ব্রহ্মসূত্র শারীরকমীমাংসা ভাষ্য।

৩. "বেদান্তদর্শন-অদ্বৈতবাদ্", কাব্য-ব্যাকরণ-সাংখ্য-বেদান্ততীর্থ, বিদ্যাবাচস্পতি শ্রীআশুতোষ ভট্টাচার্য শাস্ত্রী।

...............................................….....…..............

শ্রীশুভ চৌধুরী।

নভেম্বর ২০, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দ।

নির্বিশেষ ব্রহ্ম

 


ব্রহ্ম স্বতঃ নির্গুণ নির্বিশেষ।  ব্রহ্ম নির্বিশেষ বলেই তো শ্রুতি কেবল "নেতি নেতি"-(বৃহদারণ্যক উপনিষদ্-২।৫।৬) অর্থাৎ "ইহা ব্রহ্ম নহে", "উহা ব্রহ্ম নহে", এইরূপে নিষেধমুখে নির্বিশেষ ব্রহ্মের স্বরূপ বুঝাইতে চেষ্টা করিয়াছেন ; ব্রহ্মের স্বরূপ বুঝাইবার জন্য নিষেধসূচক 'ন'-এর অসংখ্য প্রয়োগ করিয়াছেন। কঠ শ্রুতি স্পষ্ট বলিতেছেন-

অশব্দমস্পর্শমরূপমব্যয়ং তথারসং নিত্যমগন্ধবচ্চ যত্ ৷ অনাদ্যনন্তং মহতঃ পরং ধ্রুবং নিচায্য তন্মৃত্যুমুখাত্ প্রমুচ্যতে ৷৷- (কঠ উপনিষদ্-১।৩।১৫)

ভগবান্ শঙ্করাচার্য এই শ্রুতির ভাষ্যে বলিতেছেন- 'অশব্দমস্পর্শমরূপমরসমগন্ধবচ্চ যত্' এতদ্ব্যাখ্যায় ব্রহ্ম অব্যয়; কারণ যাহা শব্দাদি বিশিষ্ট তাহাই ব্যয়িত অর্থাৎ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। এই ব্রহ্ম শব্দাদি রহিত বলিয়া অব্যয়, ব্যয়িত অর্থাৎ ক্ষয়প্রাপ্ত হয় না; অতএব তিনি নিত্য। ইহাছাড়া এই জন্যও তিনি নিত্য যেহেতু তিনি অনাদি, তাহার আদি কারণ অবিদ্যমান-এইজন্য অনাদি। কারণ যে বস্তু আদিমান্ তাহাই কার্য্যবস্তু বলিয়া অনিত্য,কেননা কার্য্য নিজ কারণে লয় হয় যথা পৃথিব্যাদি। কিন্তু এই প্রত্যাগ্রাত্মা সর্বকারণ বলিয়া অকার্য্য এবং অকার্য্য বলিয়া নিত্য; তাহার কোন কারণই নাই যাহাতে তিনি লীন হইবেন৷ সেইরূপ তিনি অনন্তও। তাহার অন্ত অর্থাৎ কার্য্যও নাই তাই তিনি অনন্ত৷ যেভাবে ফলাদি কার্য উত্পাদনহতু কদলী প্রভৃতি বৃক্ষের অনিত্যতা দৃষ্ট হয়, সেইরূপ অন্তবত্ত্বও এই ব্রহ্মের নাই; এইজন্যও তিনি নিত্য৷

নিত্য বিজ্ঞপ্তিস্বরূপ বলিয়া তিনি জড়বুদ্ধি সংজ্ঞক মহৎ তত্ত্ব হইতেও পর অর্থাৎ বিলক্ষণ; কারণ সর্বভূতের অন্তরাত্মা বলিয়া ব্রহ্ম সর্বসাক্ষি অর্থাৎ সকলের প্রকাশক। 'এষ সর্বেষু ভূতেষু' অর্থাৎ তিনি যে সর্বভূতের গূঢ় আত্মা ইত্যাদি মন্ত্রে পূর্বেই বলা হইয়াছে ৷ আর তিনি ধ্রুব অ্থাৎ কূটস্থ নিত্য, পৃথিব্যাদির ন্যায় তাহার নিত্যত্ব আপেক্ষিক নহে ৷ এইরূপ সেই ব্রহ্মস্বরূপ প্রত্যগাত্মাকে উপলব্ধি করিয়া মুমুক্ষু প্রেয়, তন্নিমিত্ত কামনা ও তন্নিমিত্ত কর্মরূপ মৃত্যুর নাগাল হইতে মুক্ত অর্থাৎ বিযুক্ত হইয়া যান।

ব্রহ্ম নিত্য, শুদ্ধ, বুদ্ধ এবং মুক্তস্বভাব। যত্তদদ্রেশ্যমগ্রাহ্যমগোত্রমবর্ণমচক্ষুঃশ্রোত্রং তদপাণিপাদম্৷ নিত্যং বিভুং সর্বগতং সুসূক্ষ্মং তদব্যযং যদ্ভূতযোনিং পরিপশ্যন্তি ধীরাঃ৷৷-(মুণ্ডক উপনিষৎ-১.১.৬)

শঙ্করাচার্য এই শ্রুতির ভাষ্যে বলিতেছেন-"সেই ব্রহ্ম যিনি অদৃশ্য অর্থাৎ সকল জ্ঞানেন্দ্রিয়ের অবিষয়, কেননা যেহেতু বহির্জগতের উৎপন্ন জ্ঞান পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে সম্পন্ন হইয়া থাকে। তিনি অগ্রাহ্য অর্থাৎ কর্ম্মেন্দ্রিয়ের অবিষয় এবং অগোত্র-গোত্র, অন্বয় বা মূল ইত্যাদি সমার্থক বলিয়া অগোত্রম্ অর্থাৎ অনন্বয়। কেননা ব্রহ্মের কোন মূল নাই যাহার সহিত উহা অন্বিত হইবে। তিনি অবর্ণ অর্থাৎ যাহার বর্ণনা করা যায় সেই স্থূলত্বাদি বা শুক্লত্বাদিরূপ বস্তুর বিভিন্ন ধর্ম্মসমূহ বর্ণসংজ্ঞক, সেই বর্ণসকল যাহার নাই তিনিই অবর্ণ অর্থাৎ অক্ষর। তিনি অচক্ষুঃশ্রোত্রম্ অর্থাৎ শোত্র ও চক্ষু-এই ইন্দ্রিয়দ্বয় সর্ব্বজীবের নাম ও রূপের গ্রাহক, এই দুটি যাহর নাই তিনিই অচক্ষুঃশ্রোত্রম্।তিনি অপাণিপাদম্ অর্থাৎ হস্তপদাদি কর্মেন্দ্রিয়রহিত। যেহেতু তিনি এইরূপ অর্থাৎ জ্ঞেয় কিংবা জ্ঞাতা হন না বলিয়া নিত্য বা অবিনাশিস্বরূপ। তিনি বিভু- বিবিধরূপে অর্থাৎ ব্রহ্মা হইতে স্থাবর পর্যন্ত বিভিন্ন প্রাণিরূপে সৃষ্ট হন বলিয়া বিভুসংজ্ঞক।

তিনি সর্ব্বগত অর্থাৎ আকাশের মতো ব্যাপক এবং সুসূক্ষ্ম অর্থাৎ স্থূলত্বাদির কারণ যে শব্দাদি সেই শব্দাদি ধর্ম্মরহিত। এই শব্দ প্রভৃতিগুণই আকাশ, বায়ু প্রভৃতি ভূতের ক্রমশঃ এক হইতে অপরের অধিক স্থুলতার কারণ, সুতরাং সই শব্দাদির অভাববশত ব্রহ্ম সুসূক্ষ্মম্। উক্ত ধর্ম্মবশতঃ তাহার ক্ষয় নাই বলিয়া তিনি অব্যয়। কারণ নিরবয়ব ব্রহ্মের পক্ষে শরীরের ক্ষয় হওয়ার ন্যায় স্বীয় অবয়ব-হ্রাসরূপ ক্ষয় হওয়াও সম্ভব হয় না এবং নির্বিশেষ ব্রহ্মের পক্ষে রাজার ধনাগার হ্রাস হওয়ার ন্যায় হ্রাস হওয়ারূপ ক্ষয় হওয়াও সম্ভব হয় না। আর নির্গুণ ও সর্বাত্মক বলিয়া গূণহ্রাসদ্বারাও তাঁহার ক্ষয় হওয়া সম্ভব হয় না। এইরূপ লক্ষণবিশিষ্ট ভূতযোনি অর্থাৎ প্রাণিগণের সৃষ্টির কারণস্বরূপ, স্থাবর-জঙ্গমের কারণস্বরূপ পৃথিবীর ন্যায় যাঁহাকে তথা সকলের স্বরূপভূত সেই অব্যয়কে বিবেকিগণ সর্বত্র উপলব্ধি করেন এবং যে তত্ত্বোপলব্ধির মাধ্যমে এইরূপ অবিনশ্বর ব্রহ্ম উপলব্ধ হন সেই অনুভূতিই হইতেছে পরাবিদ্যা।"


Saturday, 19 November 2022

অষ্টাঙ্গযোগে "নিয়ম" অঙ্গ সাধনঃ-



"সজাতীয়প্রবাহশ্চ বিজাতীয়তিরস্কৃতিঃ নিয়মো হি পরানন্দো নিয়মাৎক্রিয়তে বুধৈঃ" অর্থাৎ 'অহম্ ব্রহ্মাস্মি' এই চিন্তা বা প্রত্যয়ের একতানতা ব্রহ্মবিজ্ঞানের সহায়ক সমধর্মী চিন্তাপ্রবাহ ও বিপরীতধর্মী চিন্তার নিবৃত্তি 'নিয়ম' বলে কথিত। পরমানন্দস্বরূপ জ্ঞানিগণকর্তৃক এটা নিয়মিত কৃত হয়। অপরোক্ষানুভূতিতে ভগবান্ শঙ্করাচার্যের এটাই অভিপ্রায়।

শ্রীপাতঞ্জলে সাংখ্যপ্রবচনে বৈয়াসিকে সাধনপাদে বর্ণিত আছে—

'শৌচ-সন্তোষ-তপঃ-স্বাধ্যায়েশ্বরপ্রণিধানানি নিয়মাঃ'

-বাহ্য ও অন্তঃশৌচ, সন্তোষ, তপস্যা, স্বাধ্যায় (মন্ত্রজপ বা অধ্যাত্ম-শাস্ত্রপাঠ) ও ঈশ্বরোপাসনা এইগুলি ‘নিয়ম’।

এই সূত্রের ব্যাসভাষ্যে বর্ণিত আছে—'এদের মধ্যে শৌচ হলো, মাটি ও জলাদি প্রয়োগে শুচিতা ও মেধ্য আহারাদি গ্রহণ, এগুলি বাহ্য শুচিতা। আভ্যন্তর হলো, চিত্তগত মলগুলি দূর করা। সন্তোষ হলো, কাছে এসে যাওয়া ইপ্সিত বস্তু প্রাপ্তির অধিক কিছু না চাওয়া-পাওয়ার মনোভাবনা। তপঃ হলো গ্রীষ্ম-শীত জাত সুখ-দুঃখ রূপ দ্বন্দ্ব সহ্য করা। দ্বন্দ্ব হলো ক্ষুধা ও তৃষ্ণা, শীত ও উষ্ণ এবং আসনে স্থিরভাবে থাকা, কাঠের মতো নিশ্চলতায় মৌন থাকা ও মাত্র আকার ইঙ্গিতে জানানো। ব্রতগুলি হলো, যোগানুশাসন অনুযায়ী কৃচ্ছতায় ও চান্দ্রায়ণাদিতে সম্যক্ তপ্ত হওয়ারূপ তপস্যাগুলি। স্বাধ্যায় হলো, মোক্ষ শাস্ত্রগুলির অধ্যয়ন বা প্রণব জপ।

পরমগুরুতে সমস্ত কর্ম্ম সমর্পন হলো ঈশ্বর-প্রণিধান। শুয়ে থাকা, বসে থাকা বা রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো-আদি অবস্থাতে যে আত্মাতে স্থিত পুরুষ, যাঁর সংশয়-বিপর্যয়াদি বিতর্কজাল সম্পূর্ণরূপে তিরোহিত, যিনি সংসারের বীজভূতা অবিদ্যার নাশ অনুভব করেন, তিনিই নিত্যমুক্ত, অমৃত ভোগ-ভাগী। এই অনুযায়ী সূত্রকারের মাধ্যমে কথিত হয়েছে, ঈশ্বর প্রণিধানহেতু প্রত্যক্ চৈতন্যের সাক্ষাৎকার হয়ে যায়, ও যুগপৎ অন্তরায়গুলি বিলীন হয়।'

এখন নিয়মের সিদ্ধিসকল যোগ সূত্রানুসারে আলোচনা করব। শৌচ প্রতিষ্ঠিত হলে নিজের শরীরের প্রতি ঘৃণার উদ্রেক হয়, অন্যের সঙ্গ করতেও আর প্রবৃত্তি থাকে না। স্বকীয় শরীরে হেয়তাবুদ্ধিযুক্ত ব্যক্তি নিজ কায়কে মৃজ্জলাদির দ্বারা ক্ষালন করেও যখন শুদ্ধি দেখতে পান না, তখন অত্যন্তমলিন পরকায়ের সাথে কিরূপ সংসর্গ করবেন?

এই শৌচ হতে সত্ত্ব-শুদ্ধি (অন্তঃকরণের নির্মলতা), সৌমনস্য অর্থাৎ মনের প্রফুল্ল ভাব, একাগ্রতা, ইন্দ্রিয় জয় ও আত্মদর্শনের যোগ্যতা লাভ হয়ে থাকে। সন্তোষ হতে পরম সুখলাভ হয়। অশুদ্ধি-ক্ষয়-নিবন্ধন তপস্যা হতে দেহ ও ইন্দ্রিয়ের নানাপ্রকার শক্তি আসে। মন্ত্রাদির পুনঃপুনঃ উচ্চারণ বা অভ্যাস দ্বারা ইষ্টদেবতার দর্শনলাভ হয়ে থাকে। ঈশ্বরে সমুদয় অর্পণ করিলে সমাধিলাভ হয়ে থাকে। ঈশ্বরে সর্বভাবার্পিত যোগীর সমাধি সিদ্ধি হয়। ঈশ্বরে সর্বভাবার্পণ অর্থে ভাবনা দ্বারা ঈশ্বরে নিজেকে ডুবিয়ে রাখা। এই ঈশ্বরপ্রণিধানই সমাধিসিদ্ধির সাক্ষাৎ হেতু।

তাছাড়া পাঁচপ্রকার নিয়ম যে ব্রাহ্মণের স্বভাবজাত তা শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাতেও স্পষ্টভাবে বর্ণিত আছে-

'শমো দমস্তপঃ শৌচং ক্ষান্তিরার্জবমেব চ৷ জ্ঞানং বিজ্ঞানমাস্তিক্যং ব্রহ্মকর্ম স্বভাবজম্'-(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা-১৮।৪২)

অর্থাৎ বাহ্যেন্দ্রিয় ও অন্তরিন্দ্রিয়ের সংযম, কায়িক, বাচিক ও মানসিক তপস্যা; অন্তর্বহিঃ শৌচ, ক্ষমা, সরলতা, শাস্ত্রজ্ঞান ও তত্ত্বানুভূতি এবং শাস্ত্রে ও ভগবানে বিশ্বাস - এই সকল নিয়ম ব্রাহ্মণের স্বভাব জাত। এইভাবে তপস্যাদি নিয়মের দ্বারা নিষ্কামকর্মযোগী সাধনায় উত্তীর্ণ হয়ে ঈশ্বরের প্রণিধানে সর্বকর্মফল ঈশ্বরে সমর্পন করেন। যৎকরোষি যদশ্নাসি যজ্জুহোষি দদাসি যৎ৷ যত্তপস্যসি কৌন্তেয় তৎকুরুষ্ব মদর্পণম্৷ ইতি শ্রীগীতায় ভগবৎ বচন।..................

শ্রীশুভ চৌধুরী

ডিসেম্বর ২৭, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দ।




Wednesday, 16 November 2022

অদ্বৈতবেদান্তে জগতের স্বরূপঃ-


সচ্চিদানন্দ ব্রহ্মই এই মায়াময় জগতের অধিষ্ঠান বা আশ্রয়। ব্রহ্মের নিত্য সত্তা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই জগৎ সত্য বলে বোধ হয়ে থাকে। জগৎ কিন্তু বাস্তবিক সৎ নয়, এই নামরূপাত্মক জগৎ মিথ্যা। এটা শ্রুতি সিদ্ধান্ত, শুক্ল যজুর্বেদীয় নিরালম্বোপনিষদে বর্ণিত আছে— "তপ ইতি চ ব্রহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যেতি"-(নিরালম্ব উপনিষৎ-৩৫) অর্থাৎ "ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা"। জগতের অধিষ্ঠান ব্রহ্মের সাক্ষাৎকার উৎপন্ন হলে সমস্তই ব্রহ্মময় হয়ে যায়, জগতের কোন স্বতন্ত্র অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। ব্রহ্মবোধের দ্বারা জগতের বোধ বাধিত হয়। যা বাধিত হয়, তা সত্য হবে কিরূপে? সেই বিষয়ে শ্রুতি প্রমাণ-

'যত্র নান্যত্পশ্যতি নান্যচ্ছৃণোতি নান্যদ্বিজানাতি স ভূমা' -(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৭/২৪/১)।

অর্থাৎ 'যেখানে অপর কিছু দর্শন করে না, অপর কিছু শ্রবণ করে না, অপর কিছু জানিতে পারে না, তাহাই ভূমা।'

'যত্র ত্বস্য সর্বমাত্মৈবাভূত্তত্কেন কং পশ্যেৎ'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪/৫/১৫)।

অর্থাৎ 'কিন্তু সমস্তই যখন ইহার আত্মাই হইয়া গেল, তখন কাহার দ্বারা কাহাকে দর্শন করিবে?'

বিকারমাত্রই এক অদ্বিতীয় ব্রহ্মে কল্পিত। যা কল্পিত তাই মিথ্যা। একই চন্দ্রে কল্পিত দ্বিচন্দ্র দর্শন সত্য হয় কি? এক অদ্বিতীয় সত্যস্বরূপ ব্রহ্মকে আশ্রয় করে অবস্থিত থাকে বলে বিভিন্ন কার্যবর্গ সত্য বলে ভ্রম হয়ে থাকে মাত্র। বস্তুতঃ কার্যবর্গ সত্য নয় মিথ্যা। এখানে লক্ষ্য করবার বিষয় এই যে, অদ্বৈতবেদান্তের মতে জগৎ মিথ্যা হলেও শুক্তি-রজতের ন্যায় প্রাতিভাসিক নয়, জগতের ব্যবহারিক সত্তা অবশ্য স্বীকার্য। ভগবান্ শঙ্করাচার্য তদীয় ভাষ্যে স্পষ্ট বাক্যেই জগতের ব্যবহারিক সত্তা অঙ্গীকার করেছেন এবং প্রাতিভাসিক শুক্তি-রজত হতে জাগতিক বস্তুর আপেক্ষিক সত্যতাও স্বীকার করেছেন (ব্রহ্মসূত্র, শঙ্করভাষ্য, ২/২/২৮-২৯) শুক্তি-রজতের দৃষ্টান্ত প্রদর্শনের তাৎপর্য এই যে, অধিষ্ঠান বা আশ্রয়ের স্বরূপজ্ঞান উদিত হলে যে জ্ঞান তিরোহিত হয়, ঐ জ্ঞান অর্থাৎ ঐ জ্ঞানের বিষয় মিথ্যা বলে জানবে।

জগৎ ব্রহ্মের ন্যায় সত্য না হলেও জাগতিক বস্তুগুলো আমাদের ব্যবহারিক জীবনের বিবিধ প্রয়োজন সাধন করে বলে, ব্যবসায়িকভাবে জগৎকে সত্য বলতে হবে, আকাশ-কুসুমের ন্যায় অলীক বলা চলবে না। সর্বজ্ঞাত্ম মুনি "সংক্ষেপ শারীরকম্" এ বলেছেন—চক্ষুরাদি প্রমাণের সাহায্যে লোকে বিষয় প্রত্যক্ষ করে থাকে। প্রমাণের সাহায্যে যে বস্তু নিশ্চিতরূপে জানা যায়, ওটাকে একেবারে অসত্য বলা যায় কিরূপে? জাগতিক বস্তুগুলোর ব্যবহারিক জীবনে সত্যতা অবশ্য স্বীকার্য। অবিকারী কূটস্থ ব্রহ্মই একমাত্র সত্য বস্তু, সেই তুলনায় ব্যবহারিক জগৎপ্রপঞ্চ প্রমাণগম্য হলেও অসত্য।

জগৎ অদ্বৈতবেদান্তীর মতে সৎও নয়, অসৎও নয়, এটা অনির্বচনীয়। নামরূপাত্মক জগৎকে ভগবান্ শঙ্করাচার্য অধ্যাস ভাষ্যে অনির্বচনীয় বলে ব্যাখ্যা করেছেন, যথা—"তত্বান্যত্বাভ্যামনির্বচনীয়ে নামরূপে" (অধ্যাস, শঙ্করভাষ্য)। যা অনির্বচনীয় তা মিথ্যা।

অনির্বাচ্য পদে ভামতীকার বাচস্পতি মিশ্র বলেন যে, যা প্রকাশিত হয়, তাই সত্য নয়, যা কষ্মিনকালেও বাধিত হয় না, এবং স্বপ্রকাশ ও স্বতঃপ্রমাণ তাই সত্য। ব্রহ্মই একমাত্র সত্য, তদ্ভিন্ন সকলই মিথ্যা। যা প্রকাশিত হয়, তাই যদি সত্য হয়, তবে মরু-মরীচিকায় যে জলের প্রকাশ হয়, তাও সত্য হত। আরোপিত বস্তুগুলো প্রকাশিত হলেও বস্তুতঃ সত্য নয়।

মিথ্যা শব্দের অনির্বচনীয় অর্থ গ্রহণ করে শঙ্করাচার্যের অনির্বাচ্যবাদকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আচার্য পদ্মপাদ বলেছেন— অনির্বচনীয়, অর্থাৎ সৎও নয়, অসৎও নয়; সদসৎও নয়; যে বস্তুকে সৎ বা সত্যরূপেও নির্বচন করা হয় না, অসত্যরূপেও নিরূপণ করা যায় না, সত্যাসত্যরূপেও ব্যাখ্যা করা সম্ভবপর হয় না; এরূপ বস্তুই অনির্বচনীয় আখ্যা লাভ করে। অনির্বচনীয় বস্তুমাত্রই মিথ্যা। ফলে, 'সদসদ্বিলক্ষণত্ব'ই মিথ্যাত্ব, এরূপ মিথ্যাত্বের লক্ষণই এসে পড়ে।‌ আচার্য পদ্মপাদ্ এই দৃষ্টিতেই তার মিথ্যাত্বের লক্ষণ বা পরিচয় লিপিবদ্ধ করেছেন। পদ্মপাদের এই লক্ষণটি চিৎসুখাচার্য তাঁর গ্রন্থে মিথ্যাত্বের পঞ্চম লক্ষণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

পদ্মপাদের উক্তির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে আচার্য প্রকাশাত্ম যতি তদীয় পঞ্চপাদিকা বিবরণে মিথ্যাত্বের আরও নূতন দুটি সংজ্ঞা নির্দেশ করেছেন। ব্রহ্মজ্ঞানের উদয় হলে জগদ্বিভ্রম বাধিত হয়। কেননা, ব্রহ্মজ্ঞান সত্য ও জগদ্বিভ্রম মিথ্যা। যা জ্ঞানবাধ্য তাই মিথ্যা। দ্বিতীয়ত স্বীয় আশ্রয়ে বা অধিকরণে যার অভাববোধের উদয় হবে, তা সত্য বস্তু হবে না, মিথ্যাই হবে। রজতের আশ্রয় শুক্তিতে শুক্তিজ্ঞানের উদয় হলে, রজতজ্ঞানের আশ্রয়েই রজতের অভাববোধের উদয় হয়ে থাকে। মিথ্যা দর্শনকালে মিথ্যা বস্তুর অভাববোধের উদয় হয় না বটে, কিন্তু সত্যদৃষ্টি উৎপন্ন হলে স্বীয় আশ্রয়েই বস্তুর অভাববোধের উদয় হতে দেখা যায়। মিথ্যা দৃষ্টি সাময়িক, সুতরাং ঐ মিথ্যা বস্তুর দর্শনও সাময়িক। সাময়িকভাবে দর্শন থাকলেও বর্তমান, ভূত ও ভবিষ্যৎ এই কালত্রয়ে স্বীয় অধিষ্ঠানে মিথ্যা বস্তুর সত্তাও থাকে না, দর্শনও থাকে না, বরংচ সত্তার অভাবই থাকে। যে বস্তুর অভাব হয়, সেই বস্তুই হয় অভাবের প্রতিযোগী। স্বীয় আশ্রয়ে ত্রৈকালিক অভাবের (নিষেধের) যা প্রতিযোগী, তাই মিথ্যা। ব্রহ্মই জগতের অধিষ্ঠান, সচ্চিদানন্দ পরব্রহ্মে জগৎ উপহিত বা কল্পিত হয়ে থাকে। ব্রহ্ম-অধিষ্ঠানে জগৎ বর্তমান, ভূত ও ভবিষ্যৎ এই তিনকালে বস্তুতঃ বিদ্যমান থাকে না। কেবল যতক্ষণ মায়া বা অজ্ঞানের খেলা আছে, ততক্ষণই মায়াময় জগতের অস্তিত্ব প্রতিভাত হয়ে থাকে। ব্রহ্মজ্ঞান উৎপন্ন হলে ব্রহ্মের এই জগদ্বিভাব তিরোহিত হয়; তখন ব্রহ্ম-অধিষ্ঠানেই জগৎ ত্রৈকালিক নিষেধের বা অভাবের প্রতিযোগী হয়ে দাঁড়ায়। এই প্রতিযোগিত্বয় মিথ্যাত্ব। এই প্রতিযোগিত্ব প্রতিযোগী জগতে আছে, সুতরাং জগতের মিথ্যাত্বও আছে বুঝতে হবে।....

তথ্যসূত্রঃ-

১. ভগবান্ শঙ্করাচার্যের ব্রহ্মসূত্র শারীরকমীমাংসা ভাষ্য ও তার উপর বাচস্পতি মিশ্রের ভামতী।

২. আচার্য পদ্মপাদের পঞ্চপাদিকা ও তার উপর প্রকাশাত্ম যতির পঞ্চপাদিকা বিবরণ।

৩. সর্বজ্ঞাত্ম মুনির সংক্ষেপ শারীরকম্।

৪. "বেদান্তদর্শন-অদ্বৈতবাদ্", কাব্য-ব্যাকরণ-সাংখ্য-বেদান্ততীর্থ, বিদ্যাবাচস্পতি শ্রীআশুতোষ ভট্টাচার্য শাস্ত্রী।

...............................................................................

শ্রীশুভ চৌধুরী।

নভেম্বর ১৬, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দ।

Tuesday, 15 November 2022

অদ্বৈতবেদান্তে জগৎমিথ্যা, এর অর্থ কি?

 


জগৎ ব্রহ্মেরই বিভাব। ব্রহ্মই জগৎরূপে প্রকাশিত হয়ে থাকেন। ব্রহ্ম হতেই জগতের উৎপত্তি, স্থিতি এবং পরিণামে ব্রহ্মেতেই তার লয় হয়ে থাকে। জগৎ দেশ-কাল-পরিচ্ছিন্ন এবং কার্য-কারণ-শৃঙ্খলায় নিয়ন্ত্রিত। যা পরিচ্ছিন্ন তাই মিথ্যা, সুতরাং সসীম, পরিচ্ছিন্ন জগৎও মিথ্যা। "জগৎ মিথ্যা", এর অর্থ কি? শঙ্করাচার্যের মতে জগৎ মায়াময়। মায়াময় হলেও জগৎ তাঁর মতে মৃগতৃষ্ণিকার (মরীচিকা) মত অলীক নয়, এক অদ্বিতীয় ব্রহ্মবিজ্ঞান উদয় হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ব্যবহারিক জগতের সত্যতা অবশ্য স্বীকার্য। শঙ্করাচার্য শারীরকমীমাংসা ভাষ্যে জগতের ব্যবহারিক সত্যতা স্পষ্টবাক্যেই স্বীকার করেছেন, যথা—"প্রাক্চাত্মৈকত্বাবগতেরব্যাহতঃ সর্বঃ সত্যানৃতব্যবহারো লৌকিকো বৈদিকশ্চেত্যবোচাম"-(ব্রহ্মসূত্র, শাঙ্করভাষ্য-২.১.১৪) অর্থাৎ 'আত্মার একত্ব অবগতির পূর্বে লৌকিক এবং বৈদিক সকলপ্রকার সত্য এবং মিথ্যা ব্যবহার অব্যাহত থাকে।' তাছাড়া বিজ্ঞানবাদী বৌদ্ধমত খণ্ডনপ্রসঙ্গেও আচার্য শঙ্কর ব্রহ্মসূত্র (২.২.২৮) ভাষ্যে এই বিষয়ে আরও স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন।

যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষের মন ক্রিয়াশীল আছে এবং ইন্দ্রিয়সকল তাদের স্ব স্ব বিষয় দর্শন করছে, ততক্ষণ পর্যন্ত (লৌকিক) প্রত্যক্ষাদি প্রমাণ ও প্রত্যক্ষাদি জ্ঞানের জ্ঞেয় জগৎপ্রপঞ্চ আছে বুঝতে হবে। আত্মবিচারের ফলে মনের বিলয় সাধিত হলেই দ্বৈতজগতের নিবৃত্তি হবে। রজ্জুতে কল্পিত সর্পের ন্যায় চৈতন্যস্বরূপ আত্মাতে মায়াদ্বারা বিকল্পিত মনই দ্বৈতরূপে অবভাত হয়।

"মনোদৃশ্যমিদং দ্বৈতং যৎকিঞ্চিৎ সচরাচরম্।

মনসো হ্যমনীভাবে দ্বৈতং নৈবোপলভ্যতে।"-(মাণ্ডুক্যকারিকা-৩/৩১)

অর্থাৎ "এই যা কিছু স্থাবরজঙ্গমাত্মক দ্বৈত জগৎ পরিদৃষ্ট হচ্ছে, তৎসমস্তই মন মাত্র; কারণ যতক্ষণ মন আছে ততক্ষণ জগৎ আছে, এই সঙ্কল্প বিকল্পাত্মক মন যখন সঙ্কল্প-বিকল্প পরিত্যাগপূর্বক সুষুপ্তি অবস্থায় এবং নিরোধ সমাধিতে লয়প্রাপ্ত হয়, তখন আর দ্বৈত উপলব্ধি হয় না।" এবং তখনই জগৎ মিথ্যা হয়ে দাঁড়াবে। এই জগৎ ব্রহ্ম-কার্য। অদ্বৈতবেদান্তের মতে কার্য কারণ হতে ভিন্ন নয়। এটার তাৎপর্য এই যে, কারণের সত্তা-নিবন্ধনই কার্যের সত্তা। কারণের যেরূপ স্বতন্ত্র সত্তা বা অস্তিত্ব আছে, কার্যের সেরূপ কোন স্বাধীন সত্তা নেই। কার্যের স্বাধীন সত্তা বা স্বতন্ত্র অস্তিত্বই বেদান্তে নিষিদ্ধ হয়েছে, "ভোগ্যভোক্ত্রাদিপ্রপঞ্চজাতস্য ব্রহ্মব্যতিরেকেণাভাব ইতি দ্রষ্টব্যম্"-"-(ব্রহ্মসূত্র, শাঙ্করভাষ্য-২.১.১৪)

ব্রহ্মসূত্রের আরম্ভণাধিকরণের যুক্তি অনুসারে সমগ্র আকাশাদি প্রপঞ্চের মিথ্যাত্ব বজ্রলেপসদৃশ সুস্থির। "তদনন্যত্বমারম্ভণশব্দাদিভ্যঃ"(ব্রহ্মসূত্র, ২/১/১৪)তৎ-অনন্যত্বম (ব্রহ্মরূপ অভিন্ন-নিমিত্ত-উপাদান-কারণ হতে তৎকার্যভূত এই জগৎপ্রপঞ্চ ভিন্ন নয়; কেন না)  আরম্ভণশব্দাদিভ্যঃ ("বাচারম্ভণং বিকারো নামধেয়ং মৃত্তিকেত্যেব সত্যম"—ছান্দোগ্যোপনিষৎ,৬/১/৪— ঘটাদি কার্য কেবল নাম, অর্থাৎ শব্দকে অবলম্বন করে বিদ্যমান আছে, কারণরূপী মৃত্তিকাই সত্য; "ঐতদাত্মাম ইদং সর্বম্"—কার্যভূত এই সমস্তই ব্রহ্মসত্তায় সত্তাবান—ছান্দোগ্যোপনিষৎ,৬/৮/৭; "ব্রহ্মৈবেদং সর্বম্"—ব্রহ্মই এই সমস্ত— ইত্যাদি শ্রুতিপ্রমাণ রয়েছে)।

অর্থাৎ রজ্জুতে যেমন পরমার্থতঃ সর্প কোন কালেই থাকে না তদ্রূপ ব্রহ্মরূপ অধিষ্ঠানে পরমার্থতঃ এই জগৎ কোন কালেই নেই। 'যত্র নান্যত্পশ্যতি নান্যচ্ছৃণোতি নান্যদ্বিজানাতি স ভূমা' -(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৭/২৪/১)। অর্থাৎ 'যেখানে অপর কিছু দর্শন করে না, অপর কিছু শ্রবণ করে না, অপর কিছু জানতে পারে না, তাই ভূমা।'

'যত্র ত্বস্য সর্বমাত্মৈবাভূত্তত্কেন কং পশ্যেৎ'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪/৫/১৫)। অর্থাৎ 'কিন্তু সমস্তই যখন এটার আত্মাই হয়ে গেল, তখন কার দ্বারা কাকে দর্শন করবে?' ইত্যাদি শ্রুতিবাক্যের দ্বারাও তাই বর্ণিত হচ্ছে। এই প্রকারে সকল উপনিষদই পরমার্থ অবস্থাতে সকলপ্রকার ব্যবহারের অভাবের কথা বলছেন। ঠিক এই দৃষ্টিতেই কার্যবর্গ মিথ্যা বলে বেদান্তে কথিত হয়েছে। জগৎ-সত্যতাবাদী নৈয়ায়িকগণ যেরূপ ঘটের কারণ মৃত্তিকা ও কার্য ঘট, এই দুই-এরই স্বতন্ত্র সত্তা স্বীকার করেন, অদ্বৈতবেদান্তীরা তা করেন না। তাঁদের মতে মৃত্তিকার সত্তা দ্বারাই ঘটের সত্তা অনুপ্রাণিত হয়ে থাকে। মাটিকে বাদ দিয়ে ঘটের কোন অস্তিত্বই থাকে না, সুতরাং ঘট স্বতন্ত্র সদ্বস্তু নয়। ঘট মৃত্তিকার বিকৃত রূপ। মাটিকে জানলে ঘটকেও জানা যায়। মৃত্তিকা ব্যতীত ঘটের যে একটি স্বতন্ত্র নাম ও রূপ আছে, তা দ্বারা ঘটের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব প্রমাণিত হয় না। ওটা মাটির বিভিন্ন অবস্থার পরিচায়ক মাত্র। কারণ হতে কার্যের স্বতন্ত্র সত্তা নিষিদ্ধ হয়েছে বলেই জগৎকারণ ব্রহ্মসত্তা ব্যতীত কার্য-জগতের কোন স্বাধীন সত্তা নেই। এটাই অদ্বৈতবেদান্ত সিদ্ধান্তে জগতের মিথ্যাত্বের রহস্য।.....

তথ্য সূত্রঃ—

১. ভগবান্ শঙ্করাচার্যের ব্রহ্মসূত্র শারীরকমীমাংসা ভাষ্য।

২. আচার্য গৌড়পাদের মাণ্ডুক্য কারিকা ও তার উপর শঙ্করাচার্যের ভাষ্য।

৩. "বেদান্তদর্শন-অদ্বৈতবাদ্", কাব্য-ব্যাকরণ-সাংখ্য-বেদান্ততীর্থ, বিদ্যাবাচস্পতি শ্রীআশুতোষ ভট্টাচার্য শাস্ত্রী।

...........................................................................

শ্রীশুভ চৌধুরী।

নভেম্বর ১৪, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দ।

Saturday, 12 November 2022

ব্রহ্মের সচ্চিদানন্দ স্বরূপের ব্যাখ্যাঃ-

 


ব্রহ্ম নির্গুণ নির্বিশেষ। তিনি অনাদি অনন্ত, ধ্রুব এবং ক্ষয়ব্যয় ও রূপরহিত। কঠ শ্রুতি স্পষ্ট বলছেন—'অশব্দমস্পর্শমরূপমব্যয়ম্'-(কঠ উপনিষদ্-১।৩।১৫) অর্থাৎ ' তিনি শব্দরহিত, স্পর্শরহিত, রূপবিহীন, ক্ষয়রহিত' ইত্যাদি। এই অক্ষর ব্রহ্ম 'অস্থূলমনণ্বহ্রস্বমদীর্ঘম্'-(বৃহদারণ্যক উপনিষদ্ ৩।৮।৮) 'ইনি স্থুল নন, অণু নন, হ্রস্ব নন, দীর্ঘ নন'।

তিনি ব্যবহারের অতীত, চিন্তার অতীত, নির্দেশের অতীত, একমাত্র আত্মারূপেই প্রসিদ্ধ, প্রপঞ্চাতীত, শান্ত, শিব, অদ্বৈত। তিনিই আত্মা, তিনিই ব্রহ্ম। মাণ্ডুক্য শ্রুতি বলছে—'অচিন্ত্যমব্যপদেশ্যমেকাত্মপ্রত্যযসারং প্রপঞ্চোপশমং শান্তং শিবমদ্বৈতং চতুর্থং মন্যন্তে স আত্মা স বিজ্ঞেয়'-(মাণ্ডুক্য উপনিষদ্-৭) অর্থাৎ "তিনি মানস-চিন্তার অবিষয়, শব্দ দ্বারা নির্দ্দেশের অযোগ্য; কেবল ‘আত্মা’ ইত্যাকার প্রতীতিগম্য, জাগ্রদাদি প্রপঞ্চের নিবৃত্তিস্থান, শান্ত (নির্বিকার); মঙ্গলময়, অদ্বৈত। তিনিই আত্মা; এবং তিনিই একমাত্র জ্ঞাতব্য পদার্থ।"

শ্রুতিতে এইরূপ বর্ণনার তাৎপর্য এই যে, যেভাবেই ব্রহ্মকে জানতে যাও না কেন, তাঁর যে নামই দেও না কেন, তাঁর কোনটিই ব্রহ্ম নন। ব্রহ্ম সর্ববিধ জ্ঞাত ও পরিচিত পদার্থ হতে বিলক্ষণ। তিনি অবাঙ্মনসগোচর। তিনি জ্ঞাতা, জ্ঞান ও জ্ঞেয়ের বাইরে। এইজন্যই সর্বপ্রপঞ্চাতীত নির্বিশেষ ব্রহ্মকে বিধিমুখে অর্থাৎ 'তিনি এইরূপ' এইভাবে প্রকাশ করা যায় না, নিষেধমুখে অর্থাৎ 'নেতি নেতি'-(বৃহদারণ্যক উপনিষদ্-২।৫।৬) তিনি এটা নন, তিনি তা নন, এইভাবেই তাকে জানতে পারা যায়।

ব্রহ্ম অজ্ঞেয়, অমেয় ও অনির্দেশ্য হলেও নির্গুণ নির্বিশেষ ব্রহ্মকে বেদান্তে সচ্চিদানন্দ-স্বরূপ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এই সদ্ভাব, চিদ্ভাব ও আনন্দভাবের বিশ্লেষণ আমরা বিভিন্ন প্রাচীন ও প্রামাণিক উপনিষদে দেখতে পাই।

সদ্ভাব

ছান্দোগ্য শ্রুতির মতে সত্যই ব্রহ্মের নাম, 'তস্য হ বা এতস্য ব্রহ্মণো নাম সত্যমিতি'-(ছান্দোগ্য উপনিষদ্-৮/৩/৪) বৃহদারণ্যক উপনিষদে আবার ব্রহ্মকে 'সত্যস্য সত্যম্' বলা হয়েছে, যথা— 'তস্যোপনিষৎসত্যস্য সত্যমিতি'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-২.১.২০), এবং সত্য, জ্ঞান ও আনন্দস্বরূপ ব্রহ্মের উপাসনারও উপদেশ করা হয়েছে। ব্রহ্মই পরমার্থ সত্য বস্তু, তার তুলনায় বিশ্বের অন্য সমস্ত বস্তুই মিথ্যা, ব্রহ্মের এই পরমার্থ সত্যতা বুঝাবার জন্যই ব্রহ্মকে 'সত্যস্য সত্যম্' বলে নির্দেশ করা হয়েছে। সত্য অর্থাৎ যেরূপে যা নিশ্চিত হয়েছে সেই স্বরূপকে যা লঙ্ঘন করে না তা সত্য। কিন্তু যেরূপে যাহা নিশ্চিত হয়েছে সেই স্বরূপকে লঙ্ঘনকারী যে বস্তু তা মিথ্যা বলে কথিত হয়। এইজন্য বিকার (পরিণামবিশিষ্ট বস্তু) অনিত্য, যেহেতু 'বিকার মাত্রই বাগবলম্বনে অবস্থিত নাম মাত্র, কেবল মৃত্তিকাই সত্য' এইরূপ 'সৎ' কেই (অবিকারীকেই) সত্য বলে অবধারণ করা হয়েছে। অতএব 'সত্যং ব্রহ্ম'-(তৈত্তিরীয় উপনিষদ্-২/১) এটা বলে শ্রুতি ব্রহ্মকে বিকার হতে নিবৃত্ত করেছেন।

চিদ্ভাব

সত্যস্বরূপ ব্রহ্ম চিন্ময় বা জ্ঞানস্বরূপ। 'জ্ঞানং ব্রহ্ম'-(তৈত্তিরীয় উপনিষদ্-২/১) আচার্য শঙ্কর এই শ্রুতির ভাষ্যে বলেছেন- 'এই জ্ঞানপদ ব্রহ্মের কর্তৃত্বাদি বিকার নিবৃত্তির জন্য এবং মৃত্তিকাদির ন্যায় অচেতনতা নিবৃত্তির জন্য প্রয়োগ করা হয়েছে।' ব্রহ্ম স্বয়ংজ্যোতি, বিশ্বের অন্য সমস্ত বস্তুই ব্রহ্মজ্যোতি দ্বারা প্রকাশিত হয়, কিন্তু ব্রহ্মের প্রকাশের জন্য অন্য কোন প্রকাশকের অপেক্ষা নেই; এই জন্যই উপনিষদে ব্রহ্মকে স্বপ্রকাশ বলা হয়েছে। বৃহদারণ্যকে জনক-যাজ্ঞবল্ক্য সংবাদে জনক যাজ্ঞবল্ক্যকে প্রশ্ন করেছেন যে, পুরুষ বা আত্মাকে প্রকাশ করে কে? এই প্রশ্নের উত্তরে যাজ্ঞবল্ক্য বলেছেন যে, আত্মাই আত্মার জ্যোতিঃ ও প্রকাশক। আত্মার জ্যোতিদ্বারাই সমস্ত জীব ও জগৎ জ্যোতির্ময় হয়ে থাকে। পুরুষ, আত্মা বা ব্রহ্মই জ্যোতির জ্যোতিঃ পরম জ্যোতিঃ। এই জ্যোতিঃ নিত্য ভাস্বর, এই জ্যোতির কখনো বিলোপ হয় না। যেখানে সূর্যের ভাতি নেই, চন্দ্রতারার প্রকাশ নেই, বিদ্যুতের বিকাশ নেই, অগ্নির আলোক নেই, সেখানেও এই নিত্য ব্রহ্মজ্যোতিঃ বিদ্যমান। চন্দ্র, সূর্য, বিদ্যুৎ, অগ্নি প্রভৃতি সমস্ত জ্যোতিষ্মান্ পদার্থই এই ব্রহ্মজ্যোতিঃ প্রভায়ই প্রভাবান্, ব্রহ্মের আলোকেই দ্যুতিমান্, চন্দ্র, সূর্য প্রভৃতি জড়-জ্যোতিঃ ব্রহ্মজ্যোতির ছায়ামাত্র। কঠশ্রুতিতে এই বিষয়ে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। "ন তত্র সূর্যো ভাতি ন চন্দ্রতারকং নেমা বিদ্যুতো ভান্তি কুতোঽয়মগ্নিঃ। তমেব ভান্তমনুভাতি সর্বং তস্য ভাসা সর্বমিদং বিভাতি।" -(কঠ উপনিষদ্-২.২.১৫)

উক্ত কঠশ্রুতির প্রতিধ্বনি করে ভগবদ্গীতায় শ্রীভগবান্ও বলেছেন যে, "যদাদিত্যগতং তেজো জগদ্ভাসযতেখিলম্৷ যচ্চন্দ্রমসি যচ্চাগ্নৌ তত্তেজো বিদ্ধি মামকম্৷৷"-(শ্রীগীতা-১৫/১২) অর্থাৎ 'যে জ্যোতিঃ সূর্যে, চন্দ্রে ও অগ্নিতে আছে এবং যা সমগ্র জগৎকে প্রকাশ করে, সেই জ্যোতিঃ আমার জানবে।' আত্মার চিন্ময় রূপ বুঝাবার জন্য বৃহদারণ্যক বলেছেন যে, লবণখণ্ডের যেমন ভিতর ও বাহির সমস্তই লবণ ব্যতীত আর কিছুই নয়, সেইরূপ বিজ্ঞানময় আত্মার অন্তর ও বাহির বিজ্ঞান ব্যতীত আর কিছুই নয়। "স যথা সৈন্ধবঘনোঽনন্তরোঽবাহ্যঃ কৃৎস্নো রসঘন এবৈ বং বা অরেঽয়মাত্মানন্তরোঽবাহ্যঃ কৃৎস্নঃ প্রজ্ঞানঘন এব"-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪.৫.১৩) এই বিজ্ঞান বিষয় ও ইন্দ্রিয়সংযোগের ফলে যে জ্ঞান উৎপন্ন হয় তা নয়, ওটা জন্য জ্ঞান, ঐজন্য জ্ঞানের উৎপত্তিও হয়, বিনাশও হয়। আত্মবিজ্ঞান নিত্য, সুতরাং আত্মবিজ্ঞানের উৎপত্তিও হয় না, বিনাশও হয় না। কারণ, বিজ্ঞানই আত্মার স্বরূপ।

আনন্দভাব

সৎস্বরূপ, চিৎস্বরূপ ব্রহ্ম আনন্দস্বরূপও বটে। "বিজ্ঞানমানন্দং ব্রহ্ম"-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৩.৯.২৮) ব্রহ্ম আনন্দের সমুদ্র, ব্রহ্মই প্রাণ, ব্রহ্মই প্রজ্ঞা, ব্রহ্মই আনন্দ। এই ব্রহ্মানন্দ অপরিমিত আনন্দ, এর কোন সীমা নেই, এ অসীম, অখণ্ড, ভূমানন্দ। এই আনন্দ সাংসারিক বিষয়ানন্দ নয়, এটা প্রকৃতপক্ষে সুখদুঃখের অতীতাবস্থা। মানুষ যখন এই আনন্দের সন্ধান পায় তখন সাংসারিক বিষয়ানন্দকে দুঃখেরই রূপান্তর বলে বিষের মত পরিত্যাগ করে। জাগতিক ভোগবিলাসের মধ্যে মানুষের যে আনন্দবোধ রয়েছে, তা অনন্ত ব্রহ্মানন্দেরই অতি ক্ষুদ্রতম কণিকামাত্র। সুখস্বরূপ, রসস্বরূপ, পূর্ণ ব্রহ্মই জীব ও জগতের অন্তরালে প্রচ্ছন্ন আছেন এবং জীবের বিষয়ভোগের মধ্যে আনন্দরূপে ও রসরূপে প্রকাশ পাচ্ছেন। এই রসস্বরূপ ব্রহ্মকে বিষয়ের মধ্য দিয়ে আস্বাদন করে বলেই জীব বিষয়ভোগেও আনন্দ লাভ করে। "পরম আনন্দ এতস্যৈবাঽঽনন্দস্যান্যানি ভূতানি মাত্রামুপজীবন্তি"-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪.৩.৩২)

এই বিষয়ানন্দ ব্রহ্মানন্দের তুলনায় নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর। বিষয়ানন্দ অকিঞ্চিৎকর হলেও তার সম্বন্ধে মানুষের একটি স্পষ্ট ধারণা আছে, এই জন্য তৈত্তিরীয় বৃহদারণ্যক প্রভৃতি উপনিষদে বিষয়ানন্দকে দৃষ্টান্তরূপে উপন্যাস করে ব্রহ্মানন্দের স্বরূপ বুঝাবার চেষ্টা করা হয়েছে। বৃহদারণ্যক শ্রুতি বলেছেন—"মানুষের মধ্যে যে ব্যক্তি সমৃদ্ধশালী এবং সমস্ত জাগতিক ভোগ যাঁর করায়ত্ত, যিনি সকলের অধিপতি, তাঁর যে আনন্দ সেই আনন্দই মানুষের পরমানন্দ; পিতৃলোকের আনন্দ এই মনুষ্যলোকের আনন্দের শতগুণ; গন্ধর্বলোকের আনন্দ আবার পিতৃলোকের আনন্দের শতগুণ। যাঁরা স্বীয় কর্মফলে দেবত্ব লাভ করেছেন ঐ কর্মদেবগণের আনন্দ গন্ধর্বলোকের আনন্দের শতগুণ, যাঁরা স্বভাবতঃই দেবতা অর্থাৎ কর্মদ্বারা দেবত্ব লাভ করেন নি তাঁদের আনন্দ কর্মদেবতাগণের আনন্দের শতগুণ। নিষ্পাপ, নিষ্কাম, শ্রোত্রিয়ের আনন্দও স্বভাব দেবতার আনন্দের তুল্য। প্রজাপতিলোকের আনন্দ আবার এই দেবতাগণের আনন্দের শতগুণ। ব্রহ্মলোকের আনন্দ প্রজাপতিলোকের আনন্দের শতগুণ। ইহাই আনন্দের পরাকাষ্ঠা পরমানন্দ ব্রহ্মানন্দ, এটাই ব্রহ্মলোক।" তৈত্তিরীয় উপনিষদেও এইরূপ দৃষ্টান্তের সাহায্যে ব্রহ্মানন্দের স্বরূপ বুঝাবার চেষ্টা করা হয়েছে। ঐসকল দৃষ্টান্তের অর্থ এই যে, ব্রহ্মানন্দ অপরিমেয় ও অসীম, ব্রহ্মানন্দের পরিমাণ নির্ধারণ করা অসম্ভব। শ্রুতি বলেছেন, বাক্য ও মন যাকে ধরতে না পেরে নিবৃত্ত হয়, সেই ব্রহ্মানন্দকে জানলে কোন কিছুতে ভয় থাকে না।........

তথ্যসূত্রঃ-

১. ভগবান্ শঙ্করাচার্যের তৈত্তিরীয় উপনিষদ্ ভাষ্য।

২. "বেদান্তদর্শন-অদ্বৈতবাদ্", কাব্য-ব্যাকরণ-সাংখ্য-বেদান্ততীর্থ, বিদ্যাবাচস্পতি শ্রীআশুতোষ ভট্টাচার্য শাস্ত্রী।

...…..........….............................................................

শ্রীশুভ চৌধুরী।

নভেম্বর ৬, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দ।


Saturday, 5 November 2022

অদ্বৈতবেদান্তে ব্রহ্ম ও ঈশ্বরঃ-

 


ব্রহ্ম নিত্য, শুদ্ধ, বুদ্ধ এবং মুক্তস্বভাব। 'অস্তি তাবদ্ব্রহ্ম নিত্যশুদ্ধবুদ্ধমুক্তস্বভাবং সর্বজ্ঞং সর্বশক্তিসমন্বিতম্'-(ব্রহ্মসূত্র, শাঙ্করভাষ্য,১.১.১)

যেহেতু ব্রহ্মের উৎপত্তি বা বিনাশ নেই এবং দেশ, কাল ও বস্তুর দ্বারা পরিচ্ছিন্ন নয়, সেহেতু ব্রহ্ম হলেন নিত্য। যেহেতু কোন প্রকার অবিদ্যাদি দোষ বা মালিন্য তাঁকে স্পর্শ করে না, সেহেতু তিনি হলেন শুদ্ধ। যেহেতু তিনি জাড্যশূন্য ও প্রকাশস্বরূপ, সেহেতু তিনি হলেন বুদ্ধ বা সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী। আবার অবিদ্যাদিদোষশূন্য ও প্রকাশস্বরূপ হওয়ায় বন্ধনের হেতুর অভাববশতঃ তিনি হলেন নিত্যমুক্ত। এইরূপ সকল দোষশূন্য হওয়ায় তৎ পদের লক্ষ্য নিত্যশুদ্ধবুদ্ধমুক্তস্বরূপ জ্ঞেয় নির্গুণ ব্রহ্ম সিদ্ধ হন।

ব্রহ্মের দ্বিবিধ বিভাবের কথা বেদান্তে উক্ত হয়েছে। একটি তাঁর সগুণভাব, অপরটি তাঁর নির্গুণভাব। সগুণ ব্রহ্মই সর্বজ্ঞ সর্বশক্তি, জগতের সৃষ্টি-স্থিতি-লয়-নিদান।নিরতিশয় মহান হওয়ায় ব্রহ্মের সর্বজ্ঞত্বও সিদ্ধ হয়। সর্বজ্ঞ হওয়ায় তিনি সর্বশক্তিমানও বটেন। এইরূপে তৎপদের বাচ্য সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান্ উপাস্য সগুণব্রহ্মও সিদ্ধ হন। এটা ব্রহ্মের প্রকৃত স্বরূপ নয়। ব্রহ্মের নির্বিশেষ, নিরঞ্জন ও সচ্চিদানন্দরূপই প্রকৃতরূপ। ভগবান্ শঙ্করাচার্য "জন্মাদাস্য যতঃ"-(ব্রহ্মসূত্র-১.১.২) এই সূত্রের ভাষ্যে জগৎযোনি ব্রহ্মের সগুণরূপ বিবৃত করেছেন। এটা ব্রহ্মের তটস্থ লক্ষণ। আনন্দরূপতাই ব্রহ্মের স্বরূপ লক্ষণ। ব্রহ্মের সগুণভাব ঔপাধিক। মায়ারূপ উপাধিবশতঃই নির্বিশেষ ব্রহ্ম সগুণ, সবিশেষ হয়ে থাকেন। তখন তিনি হন ঈশ্বর বা মহেশ্বর। এই মায়ারূপ উপাধি এবং তৎকৃত নামরূপাদি উপাধিযোগেই শুদ্ধ নির্গুণ ব্রহ্ম ঈশ্বর নামে অভিহিত হন।

সগুণ ও নির্গুণ ব্রহ্ম ভিন্ন তত্ত্ব নয়। যিনি স্বতঃ নির্গুণ, তিনিই মায়া উপাধি গ্রহণ করে সগুণ হন। এই সগুণভাব তাঁর লীলা মাত্র। লীলাময়, সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান পরমেশ্বরই প্রাণিগণের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে স্বেচ্ছানুরূপ মায়িক দেহ ধারণ করে জগতের রঙ্গমঞ্চে অবতীর্ণ হন, 'স্যাৎ পরমেশ্বরস্য অপি ইচ্ছাবশাৎ মায়াময়ং রূপং সাধকানুগ্রহার্থম্'-(ব্রহ্মসূত্র শাঙ্করভাষ্য-১.১.২০) অর্থাৎ সাধকদের অনুগ্রহ করবার জন্য পরমেশ্বরেরও মায়াময়রূপ সম্ভব হয়। ত্রিগুণময়ী জগজ্জননী মায়াকে বশীভূত করে জগতের সৃষ্টিলীলায় প্রবৃত্ত হন। শ্রীভগবান্ বাসুদেব বলিতেছেন-"অজোহপি সন্নব্যয়াত্মা ভূতানামীশ্বরোহপি সন্। প্রকৃতিং স্বামধিষ্ঠায় সম্ভবাম্যাত্মমায়য়া"-(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা-৪/৬)

'আমি অজ অর্থাৎ জন্মরহিত হয়েও; অব্যয়াত্মা অর্থাৎ যাঁর জ্ঞানশক্তির ক্ষয় নেই এইরূপ অক্ষীণ জ্ঞানশক্তি স্বভাব হয়েও; ব্রহ্মাদি থেকে তৃণ পর্য্যন্ত সর্ব্বভূতের ঈশ্বর হয়েও; আমার যে স্বপ্রকৃতি, অর্থাৎ ত্রিগুণাত্মিকা বৈষ্ণবী মায়া, সমস্ত জগৎ যার বশে বর্তমান, যদ্দ্বারা মোহিত হয়ে লোকে নিজের আত্মা বাসুদেবকে জানতে পারে না, সেই নিজ প্রকৃতিতে অধিষ্ঠিত হয়ে অর্থাৎ তাঁকে বশীভূত করে আমি সম্ভাবিত হই অর্থাৎ আত্মমায়ার দ্বারা যেন লোকবৎ দেহধারণ করে জন্মগ্রহণ করি; কিন্তু পরমার্থতঃ নয়।'

দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন ও ধর্মের গ্লানি দূর করবার জন্য জগতের বক্ষে আবির্ভূত হন। "ধর্ম্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে"-(ভগবদ্গীতা-৪/৮) ধর্ম্মের সম্যক্ স্থাপনের জন্য প্রতিযুগে আমি সম্ভাবিত হই অর্থাৎ অবতীর্ণ হই। তিনি মায়াধীশ তাঁর উপর মায়ার কোন প্রভাব নেই। তিনি মায়ার সাক্ষী মাত্র। এইজন্য ব্রহ্মের এই সগুণলীলা দ্বারা তাঁর নিত্য-শুদ্ধ-বুদ্ধ-মুক্তস্বভাবের কোন বিচ্যুতি হয় না। ঈশ্বর ও ব্রহ্ম অভিন্ন। ভেদ অবিদ্যা-কল্পিত ও মিথ্যা।

যেহেতু 'মায়া হ্যেষা ময়া সৃষ্টা যন্মাং পশ্যসি নারদ৷ সর্বভূতগুণৈর্যুক্তং মৈবং মাং জ্ঞাতুমর্হসি'-(মহাভারত শান্তিপর্ব-৩৩৯/৪৫-৪৬)

"হে নারদ! সর্বভূতের গুণসকলের দ্বারা যুক্তরূপে তুমি যে আমাকে দেখছ, এটা মৎকর্তৃক সৃষ্টা মায়ামাত্র, এপ্রকারে তুমি আমাকে সম্যগ্ রূপে জানতে পারবে না, (কারণ তত্ত্বতঃ আমি মায়াতীত নির্গুণস্বরূপ)," এপ্রকার স্মৃতিবাক্য আছে।

আর যেখানে পরমেশ্বরের সকলপ্রকার বিশেষবর্জিতরূপ উপদিষ্ট হয়, সে স্থলে এপ্রকার শাস্ত্রবচন আছে, যথা'অশব্দম্ অস্পর্শম্ অরূপম্ অব্যয়ম্'-(কঠ উপনিষদ-১/৩/১৫) 'তিনি শব্দরহিত, স্পর্শরহিত, রূপবিহীন, ক্ষয়রহিত' ইত্যাদি।....

তথ্য সূত্রঃ-

১. ভগবান্ শঙ্করাচার্যের ব্রহ্মসূত্র "শারীরকমীমাংসা" ভাষ্য ও "শ্রীগীতা" ভাষ্য।

২. "বেদান্তদর্শন-অদ্বৈতবাদ্", কাব্য-ব্যাকরণ-সাংখ্য-বেদান্ততীর্থ, বিদ্যাবাচস্পতি শ্রীআশুতোষ ভট্টাচার্য শাস্ত্রী।

...…..........….............................................................

শ্রীশুভ চৌধুরী।

নভেম্বর ৪, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দ।

আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...