সচ্চিদানন্দ
ব্রহ্মই এই মায়াময় জগতের অধিষ্ঠান বা আশ্রয়। ব্রহ্মের নিত্য সত্তা দ্বারা অনুপ্রাণিত
হয়েই জগৎ সত্য বলে বোধ হয়ে থাকে। জগৎ কিন্তু বাস্তবিক সৎ নয়, এই নামরূপাত্মক জগৎ
মিথ্যা। এটা শ্রুতি সিদ্ধান্ত, শুক্ল যজুর্বেদীয় নিরালম্বোপনিষদে বর্ণিত আছে—
"তপ ইতি চ ব্রহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যেতি"-(নিরালম্ব উপনিষৎ-৩৫) অর্থাৎ
"ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা"। জগতের অধিষ্ঠান ব্রহ্মের সাক্ষাৎকার উৎপন্ন হলে
সমস্তই ব্রহ্মময় হয়ে যায়, জগতের কোন স্বতন্ত্র অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। ব্রহ্মবোধের
দ্বারা জগতের বোধ বাধিত হয়। যা বাধিত হয়, তা সত্য হবে কিরূপে? সেই বিষয়ে শ্রুতি প্রমাণ-
'যত্র
নান্যত্পশ্যতি নান্যচ্ছৃণোতি নান্যদ্বিজানাতি স ভূমা' -(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৭/২৪/১)।
অর্থাৎ
'যেখানে অপর কিছু দর্শন করে না, অপর কিছু শ্রবণ করে না, অপর কিছু জানিতে পারে না, তাহাই
ভূমা।'
'যত্র
ত্বস্য সর্বমাত্মৈবাভূত্তত্কেন কং পশ্যেৎ'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪/৫/১৫)।
অর্থাৎ
'কিন্তু সমস্তই যখন ইহার আত্মাই হইয়া গেল, তখন কাহার দ্বারা কাহাকে দর্শন করিবে?'
বিকারমাত্রই
এক অদ্বিতীয় ব্রহ্মে কল্পিত। যা কল্পিত তাই মিথ্যা। একই চন্দ্রে কল্পিত দ্বিচন্দ্র
দর্শন সত্য হয় কি? এক অদ্বিতীয় সত্যস্বরূপ ব্রহ্মকে আশ্রয় করে অবস্থিত থাকে বলে
বিভিন্ন কার্যবর্গ সত্য বলে ভ্রম হয়ে থাকে মাত্র। বস্তুতঃ কার্যবর্গ সত্য নয় মিথ্যা।
এখানে লক্ষ্য করবার বিষয় এই যে, অদ্বৈতবেদান্তের মতে জগৎ মিথ্যা হলেও শুক্তি-রজতের
ন্যায় প্রাতিভাসিক নয়, জগতের ব্যবহারিক সত্তা অবশ্য স্বীকার্য। ভগবান্ শঙ্করাচার্য
তদীয় ভাষ্যে স্পষ্ট বাক্যেই জগতের ব্যবহারিক সত্তা অঙ্গীকার করেছেন এবং প্রাতিভাসিক
শুক্তি-রজত হতে জাগতিক বস্তুর আপেক্ষিক সত্যতাও স্বীকার করেছেন (ব্রহ্মসূত্র, শঙ্করভাষ্য,
২/২/২৮-২৯) শুক্তি-রজতের দৃষ্টান্ত প্রদর্শনের তাৎপর্য এই যে, অধিষ্ঠান বা আশ্রয়ের
স্বরূপজ্ঞান উদিত হলে যে জ্ঞান তিরোহিত হয়, ঐ জ্ঞান অর্থাৎ ঐ জ্ঞানের বিষয় মিথ্যা
বলে জানবে।
জগৎ
ব্রহ্মের ন্যায় সত্য না হলেও জাগতিক বস্তুগুলো আমাদের ব্যবহারিক জীবনের বিবিধ প্রয়োজন
সাধন করে বলে, ব্যবসায়িকভাবে জগৎকে সত্য বলতে হবে, আকাশ-কুসুমের ন্যায় অলীক বলা চলবে
না। সর্বজ্ঞাত্ম মুনি "সংক্ষেপ শারীরকম্" এ বলেছেন—চক্ষুরাদি প্রমাণের সাহায্যে
লোকে বিষয় প্রত্যক্ষ করে থাকে। প্রমাণের সাহায্যে যে বস্তু নিশ্চিতরূপে জানা যায়,
ওটাকে একেবারে অসত্য বলা যায় কিরূপে? জাগতিক বস্তুগুলোর ব্যবহারিক জীবনে সত্যতা অবশ্য
স্বীকার্য। অবিকারী কূটস্থ ব্রহ্মই একমাত্র সত্য বস্তু, সেই তুলনায় ব্যবহারিক জগৎপ্রপঞ্চ
প্রমাণগম্য হলেও অসত্য।
জগৎ
অদ্বৈতবেদান্তীর মতে সৎও নয়, অসৎও নয়, এটা অনির্বচনীয়। নামরূপাত্মক জগৎকে ভগবান্
শঙ্করাচার্য অধ্যাস ভাষ্যে অনির্বচনীয় বলে ব্যাখ্যা করেছেন, যথা—"তত্বান্যত্বাভ্যামনির্বচনীয়ে
নামরূপে" (অধ্যাস, শঙ্করভাষ্য)। যা অনির্বচনীয় তা মিথ্যা।
অনির্বাচ্য
পদে ভামতীকার বাচস্পতি মিশ্র বলেন যে, যা প্রকাশিত হয়, তাই সত্য নয়, যা কষ্মিনকালেও
বাধিত হয় না, এবং স্বপ্রকাশ ও স্বতঃপ্রমাণ তাই সত্য। ব্রহ্মই একমাত্র সত্য, তদ্ভিন্ন
সকলই মিথ্যা। যা প্রকাশিত হয়, তাই যদি সত্য হয়, তবে মরু-মরীচিকায় যে জলের প্রকাশ
হয়, তাও সত্য হত। আরোপিত বস্তুগুলো প্রকাশিত হলেও বস্তুতঃ সত্য নয়।
মিথ্যা
শব্দের অনির্বচনীয় অর্থ গ্রহণ করে শঙ্করাচার্যের অনির্বাচ্যবাদকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে
আচার্য পদ্মপাদ বলেছেন— অনির্বচনীয়, অর্থাৎ সৎও নয়, অসৎও নয়; সদসৎও নয়; যে বস্তুকে
সৎ বা সত্যরূপেও নির্বচন করা হয় না, অসত্যরূপেও নিরূপণ করা যায় না, সত্যাসত্যরূপেও
ব্যাখ্যা করা সম্ভবপর হয় না; এরূপ বস্তুই অনির্বচনীয় আখ্যা লাভ করে। অনির্বচনীয়
বস্তুমাত্রই মিথ্যা। ফলে, 'সদসদ্বিলক্ষণত্ব'ই মিথ্যাত্ব, এরূপ মিথ্যাত্বের লক্ষণই এসে
পড়ে। আচার্য পদ্মপাদ্ এই দৃষ্টিতেই তার মিথ্যাত্বের লক্ষণ বা পরিচয় লিপিবদ্ধ করেছেন।
পদ্মপাদের এই লক্ষণটি চিৎসুখাচার্য তাঁর গ্রন্থে মিথ্যাত্বের পঞ্চম লক্ষণ হিসেবে উল্লেখ
করেছেন।
পদ্মপাদের
উক্তির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে আচার্য প্রকাশাত্ম যতি তদীয় পঞ্চপাদিকা বিবরণে মিথ্যাত্বের
আরও নূতন দুটি সংজ্ঞা নির্দেশ করেছেন। ব্রহ্মজ্ঞানের উদয় হলে জগদ্বিভ্রম বাধিত হয়।
কেননা, ব্রহ্মজ্ঞান সত্য ও জগদ্বিভ্রম মিথ্যা। যা জ্ঞানবাধ্য তাই মিথ্যা। দ্বিতীয়ত
স্বীয় আশ্রয়ে বা অধিকরণে যার অভাববোধের উদয় হবে, তা সত্য বস্তু হবে না, মিথ্যাই
হবে। রজতের আশ্রয় শুক্তিতে শুক্তিজ্ঞানের উদয় হলে, রজতজ্ঞানের আশ্রয়েই রজতের অভাববোধের
উদয় হয়ে থাকে। মিথ্যা দর্শনকালে মিথ্যা বস্তুর অভাববোধের উদয় হয় না বটে, কিন্তু
সত্যদৃষ্টি উৎপন্ন হলে স্বীয় আশ্রয়েই বস্তুর অভাববোধের উদয় হতে দেখা যায়। মিথ্যা
দৃষ্টি সাময়িক, সুতরাং ঐ মিথ্যা বস্তুর দর্শনও সাময়িক। সাময়িকভাবে দর্শন থাকলেও
বর্তমান, ভূত ও ভবিষ্যৎ এই কালত্রয়ে স্বীয় অধিষ্ঠানে মিথ্যা বস্তুর সত্তাও থাকে না,
দর্শনও থাকে না, বরংচ সত্তার অভাবই থাকে। যে বস্তুর অভাব হয়, সেই বস্তুই হয় অভাবের
প্রতিযোগী। স্বীয় আশ্রয়ে ত্রৈকালিক অভাবের (নিষেধের) যা প্রতিযোগী, তাই মিথ্যা। ব্রহ্মই
জগতের অধিষ্ঠান, সচ্চিদানন্দ পরব্রহ্মে জগৎ উপহিত বা কল্পিত হয়ে থাকে। ব্রহ্ম-অধিষ্ঠানে
জগৎ বর্তমান, ভূত ও ভবিষ্যৎ এই তিনকালে বস্তুতঃ বিদ্যমান থাকে না। কেবল যতক্ষণ মায়া
বা অজ্ঞানের খেলা আছে, ততক্ষণই মায়াময় জগতের অস্তিত্ব প্রতিভাত হয়ে থাকে। ব্রহ্মজ্ঞান
উৎপন্ন হলে ব্রহ্মের এই জগদ্বিভাব তিরোহিত হয়; তখন ব্রহ্ম-অধিষ্ঠানেই জগৎ ত্রৈকালিক
নিষেধের বা অভাবের প্রতিযোগী হয়ে দাঁড়ায়। এই প্রতিযোগিত্বয় মিথ্যাত্ব। এই প্রতিযোগিত্ব
প্রতিযোগী জগতে আছে, সুতরাং জগতের মিথ্যাত্বও আছে বুঝতে হবে।....
তথ্যসূত্রঃ-
১.
ভগবান্ শঙ্করাচার্যের ব্রহ্মসূত্র শারীরকমীমাংসা ভাষ্য ও তার উপর বাচস্পতি মিশ্রের
ভামতী।
২.
আচার্য পদ্মপাদের পঞ্চপাদিকা ও তার উপর প্রকাশাত্ম যতির পঞ্চপাদিকা বিবরণ।
৩.
সর্বজ্ঞাত্ম মুনির সংক্ষেপ শারীরকম্।
৪.
"বেদান্তদর্শন-অদ্বৈতবাদ্", কাব্য-ব্যাকরণ-সাংখ্য-বেদান্ততীর্থ, বিদ্যাবাচস্পতি
শ্রীআশুতোষ ভট্টাচার্য শাস্ত্রী।
...............................................................................
শ্রীশুভ
চৌধুরী।
নভেম্বর
১৬, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দ।
No comments:
Post a Comment