জগৎ ব্রহ্মেরই বিভাব। ব্রহ্মই জগৎরূপে প্রকাশিত হয়ে থাকেন। ব্রহ্ম হতেই জগতের উৎপত্তি, স্থিতি এবং পরিণামে ব্রহ্মেতেই তার লয় হয়ে থাকে। জগৎ দেশ-কাল-পরিচ্ছিন্ন এবং কার্য-কারণ-শৃঙ্খলায় নিয়ন্ত্রিত। যা পরিচ্ছিন্ন তাই মিথ্যা, সুতরাং সসীম, পরিচ্ছিন্ন জগৎও মিথ্যা। "জগৎ মিথ্যা", এর অর্থ কি? শঙ্করাচার্যের মতে জগৎ মায়াময়। মায়াময় হলেও জগৎ তাঁর মতে মৃগতৃষ্ণিকার (মরীচিকা) মত অলীক নয়, এক অদ্বিতীয় ব্রহ্মবিজ্ঞান উদয় হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ব্যবহারিক জগতের সত্যতা অবশ্য স্বীকার্য। শঙ্করাচার্য শারীরকমীমাংসা ভাষ্যে জগতের ব্যবহারিক সত্যতা স্পষ্টবাক্যেই স্বীকার করেছেন, যথা—"প্রাক্চাত্মৈকত্বাবগতেরব্যাহতঃ সর্বঃ সত্যানৃতব্যবহারো লৌকিকো বৈদিকশ্চেত্যবোচাম"-(ব্রহ্মসূত্র, শাঙ্করভাষ্য-২.১.১৪) অর্থাৎ 'আত্মার একত্ব অবগতির পূর্বে লৌকিক এবং বৈদিক সকলপ্রকার সত্য এবং মিথ্যা ব্যবহার অব্যাহত থাকে।' তাছাড়া বিজ্ঞানবাদী বৌদ্ধমত খণ্ডনপ্রসঙ্গেও আচার্য শঙ্কর ব্রহ্মসূত্র (২.২.২৮) ভাষ্যে এই বিষয়ে আরও স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন।
যতক্ষণ
পর্যন্ত মানুষের মন ক্রিয়াশীল আছে এবং ইন্দ্রিয়সকল তাদের স্ব স্ব বিষয় দর্শন করছে,
ততক্ষণ পর্যন্ত (লৌকিক) প্রত্যক্ষাদি প্রমাণ ও প্রত্যক্ষাদি জ্ঞানের জ্ঞেয় জগৎপ্রপঞ্চ
আছে বুঝতে হবে। আত্মবিচারের ফলে মনের বিলয় সাধিত হলেই দ্বৈতজগতের নিবৃত্তি হবে। রজ্জুতে
কল্পিত সর্পের ন্যায় চৈতন্যস্বরূপ আত্মাতে মায়াদ্বারা বিকল্পিত মনই দ্বৈতরূপে অবভাত
হয়।
"মনোদৃশ্যমিদং
দ্বৈতং যৎকিঞ্চিৎ সচরাচরম্।
মনসো
হ্যমনীভাবে দ্বৈতং নৈবোপলভ্যতে।"-(মাণ্ডুক্যকারিকা-৩/৩১)
অর্থাৎ
"এই যা কিছু স্থাবরজঙ্গমাত্মক দ্বৈত জগৎ পরিদৃষ্ট হচ্ছে, তৎসমস্তই মন মাত্র; কারণ
যতক্ষণ মন আছে ততক্ষণ জগৎ আছে, এই সঙ্কল্প বিকল্পাত্মক মন যখন সঙ্কল্প-বিকল্প পরিত্যাগপূর্বক
সুষুপ্তি অবস্থায় এবং নিরোধ সমাধিতে লয়প্রাপ্ত হয়, তখন আর দ্বৈত উপলব্ধি হয় না।"
এবং তখনই জগৎ মিথ্যা হয়ে দাঁড়াবে। এই জগৎ ব্রহ্ম-কার্য। অদ্বৈতবেদান্তের মতে কার্য
কারণ হতে ভিন্ন নয়। এটার তাৎপর্য এই যে, কারণের সত্তা-নিবন্ধনই কার্যের সত্তা। কারণের
যেরূপ স্বতন্ত্র সত্তা বা অস্তিত্ব আছে, কার্যের সেরূপ কোন স্বাধীন সত্তা নেই। কার্যের
স্বাধীন সত্তা বা স্বতন্ত্র অস্তিত্বই বেদান্তে নিষিদ্ধ হয়েছে, "ভোগ্যভোক্ত্রাদিপ্রপঞ্চজাতস্য
ব্রহ্মব্যতিরেকেণাভাব ইতি দ্রষ্টব্যম্"-"-(ব্রহ্মসূত্র, শাঙ্করভাষ্য-২.১.১৪)
ব্রহ্মসূত্রের
আরম্ভণাধিকরণের যুক্তি অনুসারে সমগ্র আকাশাদি প্রপঞ্চের মিথ্যাত্ব বজ্রলেপসদৃশ সুস্থির।
"তদনন্যত্বমারম্ভণশব্দাদিভ্যঃ"(ব্রহ্মসূত্র, ২/১/১৪)। তৎ-অনন্যত্বম (ব্রহ্মরূপ
অভিন্ন-নিমিত্ত-উপাদান-কারণ হতে তৎকার্যভূত এই জগৎপ্রপঞ্চ ভিন্ন নয়; কেন না) আরম্ভণশব্দাদিভ্যঃ ("বাচারম্ভণং বিকারো নামধেয়ং
মৃত্তিকেত্যেব সত্যম"—ছান্দোগ্যোপনিষৎ,৬/১/৪— ঘটাদি কার্য কেবল নাম, অর্থাৎ শব্দকে
অবলম্বন করে বিদ্যমান আছে, কারণরূপী মৃত্তিকাই সত্য; "ঐতদাত্মাম ইদং সর্বম্"—কার্যভূত
এই সমস্তই ব্রহ্মসত্তায় সত্তাবান—ছান্দোগ্যোপনিষৎ,৬/৮/৭; "ব্রহ্মৈবেদং সর্বম্"—ব্রহ্মই
এই সমস্ত— ইত্যাদি শ্রুতিপ্রমাণ রয়েছে)।
অর্থাৎ রজ্জুতে যেমন পরমার্থতঃ সর্প কোন কালেই থাকে না তদ্রূপ ব্রহ্মরূপ অধিষ্ঠানে পরমার্থতঃ এই জগৎ কোন কালেই নেই। 'যত্র নান্যত্পশ্যতি নান্যচ্ছৃণোতি নান্যদ্বিজানাতি স ভূমা' -(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৭/২৪/১)। অর্থাৎ 'যেখানে অপর কিছু দর্শন করে না, অপর কিছু শ্রবণ করে না, অপর কিছু জানতে পারে না, তাই ভূমা।'
'যত্র ত্বস্য সর্বমাত্মৈবাভূত্তত্কেন কং পশ্যেৎ'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪/৫/১৫)। অর্থাৎ 'কিন্তু সমস্তই যখন এটার আত্মাই হয়ে গেল, তখন কার দ্বারা কাকে দর্শন করবে?' ইত্যাদি শ্রুতিবাক্যের দ্বারাও তাই বর্ণিত হচ্ছে। এই প্রকারে সকল উপনিষদই পরমার্থ অবস্থাতে সকলপ্রকার ব্যবহারের অভাবের কথা বলছেন। ঠিক এই দৃষ্টিতেই কার্যবর্গ মিথ্যা বলে বেদান্তে কথিত হয়েছে। জগৎ-সত্যতাবাদী নৈয়ায়িকগণ যেরূপ ঘটের কারণ মৃত্তিকা ও কার্য ঘট, এই দুই-এরই স্বতন্ত্র সত্তা স্বীকার করেন, অদ্বৈতবেদান্তীরা তা করেন না। তাঁদের মতে মৃত্তিকার সত্তা দ্বারাই ঘটের সত্তা অনুপ্রাণিত হয়ে থাকে। মাটিকে বাদ দিয়ে ঘটের কোন অস্তিত্বই থাকে না, সুতরাং ঘট স্বতন্ত্র সদ্বস্তু নয়। ঘট মৃত্তিকার বিকৃত রূপ। মাটিকে জানলে ঘটকেও জানা যায়। মৃত্তিকা ব্যতীত ঘটের যে একটি স্বতন্ত্র নাম ও রূপ আছে, তা দ্বারা ঘটের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব প্রমাণিত হয় না। ওটা মাটির বিভিন্ন অবস্থার পরিচায়ক মাত্র। কারণ হতে কার্যের স্বতন্ত্র সত্তা নিষিদ্ধ হয়েছে বলেই জগৎকারণ ব্রহ্মসত্তা ব্যতীত কার্য-জগতের কোন স্বাধীন সত্তা নেই। এটাই অদ্বৈতবেদান্ত সিদ্ধান্তে জগতের মিথ্যাত্বের রহস্য।.....
তথ্য
সূত্রঃ—
১.
ভগবান্ শঙ্করাচার্যের ব্রহ্মসূত্র শারীরকমীমাংসা ভাষ্য।
২.
আচার্য গৌড়পাদের মাণ্ডুক্য কারিকা ও তার উপর শঙ্করাচার্যের ভাষ্য।
৩.
"বেদান্তদর্শন-অদ্বৈতবাদ্", কাব্য-ব্যাকরণ-সাংখ্য-বেদান্ততীর্থ, বিদ্যাবাচস্পতি
শ্রীআশুতোষ ভট্টাচার্য শাস্ত্রী।
...........................................................................
শ্রীশুভ
চৌধুরী।
নভেম্বর
১৪, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দ।
No comments:
Post a Comment