Saturday, 5 November 2022

অদ্বৈতবেদান্তে ব্রহ্ম ও ঈশ্বরঃ-

 


ব্রহ্ম নিত্য, শুদ্ধ, বুদ্ধ এবং মুক্তস্বভাব। 'অস্তি তাবদ্ব্রহ্ম নিত্যশুদ্ধবুদ্ধমুক্তস্বভাবং সর্বজ্ঞং সর্বশক্তিসমন্বিতম্'-(ব্রহ্মসূত্র, শাঙ্করভাষ্য,১.১.১)

যেহেতু ব্রহ্মের উৎপত্তি বা বিনাশ নেই এবং দেশ, কাল ও বস্তুর দ্বারা পরিচ্ছিন্ন নয়, সেহেতু ব্রহ্ম হলেন নিত্য। যেহেতু কোন প্রকার অবিদ্যাদি দোষ বা মালিন্য তাঁকে স্পর্শ করে না, সেহেতু তিনি হলেন শুদ্ধ। যেহেতু তিনি জাড্যশূন্য ও প্রকাশস্বরূপ, সেহেতু তিনি হলেন বুদ্ধ বা সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী। আবার অবিদ্যাদিদোষশূন্য ও প্রকাশস্বরূপ হওয়ায় বন্ধনের হেতুর অভাববশতঃ তিনি হলেন নিত্যমুক্ত। এইরূপ সকল দোষশূন্য হওয়ায় তৎ পদের লক্ষ্য নিত্যশুদ্ধবুদ্ধমুক্তস্বরূপ জ্ঞেয় নির্গুণ ব্রহ্ম সিদ্ধ হন।

ব্রহ্মের দ্বিবিধ বিভাবের কথা বেদান্তে উক্ত হয়েছে। একটি তাঁর সগুণভাব, অপরটি তাঁর নির্গুণভাব। সগুণ ব্রহ্মই সর্বজ্ঞ সর্বশক্তি, জগতের সৃষ্টি-স্থিতি-লয়-নিদান।নিরতিশয় মহান হওয়ায় ব্রহ্মের সর্বজ্ঞত্বও সিদ্ধ হয়। সর্বজ্ঞ হওয়ায় তিনি সর্বশক্তিমানও বটেন। এইরূপে তৎপদের বাচ্য সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান্ উপাস্য সগুণব্রহ্মও সিদ্ধ হন। এটা ব্রহ্মের প্রকৃত স্বরূপ নয়। ব্রহ্মের নির্বিশেষ, নিরঞ্জন ও সচ্চিদানন্দরূপই প্রকৃতরূপ। ভগবান্ শঙ্করাচার্য "জন্মাদাস্য যতঃ"-(ব্রহ্মসূত্র-১.১.২) এই সূত্রের ভাষ্যে জগৎযোনি ব্রহ্মের সগুণরূপ বিবৃত করেছেন। এটা ব্রহ্মের তটস্থ লক্ষণ। আনন্দরূপতাই ব্রহ্মের স্বরূপ লক্ষণ। ব্রহ্মের সগুণভাব ঔপাধিক। মায়ারূপ উপাধিবশতঃই নির্বিশেষ ব্রহ্ম সগুণ, সবিশেষ হয়ে থাকেন। তখন তিনি হন ঈশ্বর বা মহেশ্বর। এই মায়ারূপ উপাধি এবং তৎকৃত নামরূপাদি উপাধিযোগেই শুদ্ধ নির্গুণ ব্রহ্ম ঈশ্বর নামে অভিহিত হন।

সগুণ ও নির্গুণ ব্রহ্ম ভিন্ন তত্ত্ব নয়। যিনি স্বতঃ নির্গুণ, তিনিই মায়া উপাধি গ্রহণ করে সগুণ হন। এই সগুণভাব তাঁর লীলা মাত্র। লীলাময়, সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান পরমেশ্বরই প্রাণিগণের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে স্বেচ্ছানুরূপ মায়িক দেহ ধারণ করে জগতের রঙ্গমঞ্চে অবতীর্ণ হন, 'স্যাৎ পরমেশ্বরস্য অপি ইচ্ছাবশাৎ মায়াময়ং রূপং সাধকানুগ্রহার্থম্'-(ব্রহ্মসূত্র শাঙ্করভাষ্য-১.১.২০) অর্থাৎ সাধকদের অনুগ্রহ করবার জন্য পরমেশ্বরেরও মায়াময়রূপ সম্ভব হয়। ত্রিগুণময়ী জগজ্জননী মায়াকে বশীভূত করে জগতের সৃষ্টিলীলায় প্রবৃত্ত হন। শ্রীভগবান্ বাসুদেব বলিতেছেন-"অজোহপি সন্নব্যয়াত্মা ভূতানামীশ্বরোহপি সন্। প্রকৃতিং স্বামধিষ্ঠায় সম্ভবাম্যাত্মমায়য়া"-(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা-৪/৬)

'আমি অজ অর্থাৎ জন্মরহিত হয়েও; অব্যয়াত্মা অর্থাৎ যাঁর জ্ঞানশক্তির ক্ষয় নেই এইরূপ অক্ষীণ জ্ঞানশক্তি স্বভাব হয়েও; ব্রহ্মাদি থেকে তৃণ পর্য্যন্ত সর্ব্বভূতের ঈশ্বর হয়েও; আমার যে স্বপ্রকৃতি, অর্থাৎ ত্রিগুণাত্মিকা বৈষ্ণবী মায়া, সমস্ত জগৎ যার বশে বর্তমান, যদ্দ্বারা মোহিত হয়ে লোকে নিজের আত্মা বাসুদেবকে জানতে পারে না, সেই নিজ প্রকৃতিতে অধিষ্ঠিত হয়ে অর্থাৎ তাঁকে বশীভূত করে আমি সম্ভাবিত হই অর্থাৎ আত্মমায়ার দ্বারা যেন লোকবৎ দেহধারণ করে জন্মগ্রহণ করি; কিন্তু পরমার্থতঃ নয়।'

দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন ও ধর্মের গ্লানি দূর করবার জন্য জগতের বক্ষে আবির্ভূত হন। "ধর্ম্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে"-(ভগবদ্গীতা-৪/৮) ধর্ম্মের সম্যক্ স্থাপনের জন্য প্রতিযুগে আমি সম্ভাবিত হই অর্থাৎ অবতীর্ণ হই। তিনি মায়াধীশ তাঁর উপর মায়ার কোন প্রভাব নেই। তিনি মায়ার সাক্ষী মাত্র। এইজন্য ব্রহ্মের এই সগুণলীলা দ্বারা তাঁর নিত্য-শুদ্ধ-বুদ্ধ-মুক্তস্বভাবের কোন বিচ্যুতি হয় না। ঈশ্বর ও ব্রহ্ম অভিন্ন। ভেদ অবিদ্যা-কল্পিত ও মিথ্যা।

যেহেতু 'মায়া হ্যেষা ময়া সৃষ্টা যন্মাং পশ্যসি নারদ৷ সর্বভূতগুণৈর্যুক্তং মৈবং মাং জ্ঞাতুমর্হসি'-(মহাভারত শান্তিপর্ব-৩৩৯/৪৫-৪৬)

"হে নারদ! সর্বভূতের গুণসকলের দ্বারা যুক্তরূপে তুমি যে আমাকে দেখছ, এটা মৎকর্তৃক সৃষ্টা মায়ামাত্র, এপ্রকারে তুমি আমাকে সম্যগ্ রূপে জানতে পারবে না, (কারণ তত্ত্বতঃ আমি মায়াতীত নির্গুণস্বরূপ)," এপ্রকার স্মৃতিবাক্য আছে।

আর যেখানে পরমেশ্বরের সকলপ্রকার বিশেষবর্জিতরূপ উপদিষ্ট হয়, সে স্থলে এপ্রকার শাস্ত্রবচন আছে, যথা'অশব্দম্ অস্পর্শম্ অরূপম্ অব্যয়ম্'-(কঠ উপনিষদ-১/৩/১৫) 'তিনি শব্দরহিত, স্পর্শরহিত, রূপবিহীন, ক্ষয়রহিত' ইত্যাদি।....

তথ্য সূত্রঃ-

১. ভগবান্ শঙ্করাচার্যের ব্রহ্মসূত্র "শারীরকমীমাংসা" ভাষ্য ও "শ্রীগীতা" ভাষ্য।

২. "বেদান্তদর্শন-অদ্বৈতবাদ্", কাব্য-ব্যাকরণ-সাংখ্য-বেদান্ততীর্থ, বিদ্যাবাচস্পতি শ্রীআশুতোষ ভট্টাচার্য শাস্ত্রী।

...…..........….............................................................

শ্রীশুভ চৌধুরী।

নভেম্বর ৪, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দ।

No comments:

জ্ঞানবিজ্ঞানযোগ-

  শ্রীভগবানুবাচ ময্যাসক্তমনাঃ পার্থ যোগং যুঞ্জন্মদাশ্রয়ঃ৷ অসংশয়ং সমগ্রং মাং যথা জ্ঞাস্যসি তচ্ছৃণু ৷৷ ১   ‘শাঙ্করভাষ্য’   অনুস...