ব্রহ্ম নির্গুণ নির্বিশেষ। তিনি অনাদি অনন্ত, ধ্রুব এবং ক্ষয়ব্যয় ও রূপরহিত। কঠ শ্রুতি স্পষ্ট বলছেন—'অশব্দমস্পর্শমরূপমব্যয়ম্'-(কঠ উপনিষদ্-১।৩।১৫) অর্থাৎ ' তিনি শব্দরহিত, স্পর্শরহিত, রূপবিহীন, ক্ষয়রহিত' ইত্যাদি। এই অক্ষর ব্রহ্ম 'অস্থূলমনণ্বহ্রস্বমদীর্ঘম্'-(বৃহদারণ্যক উপনিষদ্ ৩।৮।৮) 'ইনি স্থুল নন, অণু নন, হ্রস্ব নন, দীর্ঘ নন'।
তিনি
ব্যবহারের অতীত, চিন্তার অতীত, নির্দেশের অতীত, একমাত্র আত্মারূপেই প্রসিদ্ধ, প্রপঞ্চাতীত,
শান্ত, শিব, অদ্বৈত। তিনিই আত্মা, তিনিই ব্রহ্ম। মাণ্ডুক্য শ্রুতি বলছে—'অচিন্ত্যমব্যপদেশ্যমেকাত্মপ্রত্যযসারং
প্রপঞ্চোপশমং শান্তং শিবমদ্বৈতং চতুর্থং মন্যন্তে স আত্মা স বিজ্ঞেয়'-(মাণ্ডুক্য উপনিষদ্-৭)
অর্থাৎ "তিনি মানস-চিন্তার অবিষয়, শব্দ দ্বারা নির্দ্দেশের অযোগ্য; কেবল ‘আত্মা’
ইত্যাকার প্রতীতিগম্য, জাগ্রদাদি প্রপঞ্চের নিবৃত্তিস্থান, শান্ত (নির্বিকার); মঙ্গলময়,
অদ্বৈত। তিনিই আত্মা; এবং তিনিই একমাত্র জ্ঞাতব্য পদার্থ।"
শ্রুতিতে
এইরূপ বর্ণনার তাৎপর্য এই যে, যেভাবেই ব্রহ্মকে জানতে যাও না কেন, তাঁর যে নামই দেও
না কেন, তাঁর কোনটিই ব্রহ্ম নন। ব্রহ্ম সর্ববিধ জ্ঞাত ও পরিচিত পদার্থ হতে বিলক্ষণ।
তিনি অবাঙ্মনসগোচর। তিনি জ্ঞাতা, জ্ঞান ও জ্ঞেয়ের বাইরে। এইজন্যই সর্বপ্রপঞ্চাতীত
নির্বিশেষ ব্রহ্মকে বিধিমুখে অর্থাৎ 'তিনি এইরূপ' এইভাবে প্রকাশ করা যায় না, নিষেধমুখে
অর্থাৎ 'নেতি নেতি'-(বৃহদারণ্যক উপনিষদ্-২।৫।৬) তিনি এটা নন, তিনি তা নন, এইভাবেই তাকে
জানতে পারা যায়।
ব্রহ্ম
অজ্ঞেয়, অমেয় ও অনির্দেশ্য হলেও নির্গুণ নির্বিশেষ ব্রহ্মকে বেদান্তে সচ্চিদানন্দ-স্বরূপ
বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এই সদ্ভাব, চিদ্ভাব ও আনন্দভাবের বিশ্লেষণ আমরা বিভিন্ন প্রাচীন
ও প্রামাণিক উপনিষদে দেখতে পাই।
সদ্ভাব
ছান্দোগ্য
শ্রুতির মতে সত্যই ব্রহ্মের নাম, 'তস্য হ বা এতস্য ব্রহ্মণো নাম সত্যমিতি'-(ছান্দোগ্য
উপনিষদ্-৮/৩/৪) বৃহদারণ্যক উপনিষদে আবার ব্রহ্মকে 'সত্যস্য সত্যম্' বলা হয়েছে, যথা—
'তস্যোপনিষৎসত্যস্য সত্যমিতি'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-২.১.২০), এবং সত্য, জ্ঞান ও আনন্দস্বরূপ
ব্রহ্মের উপাসনারও উপদেশ করা হয়েছে। ব্রহ্মই পরমার্থ সত্য বস্তু, তার তুলনায় বিশ্বের
অন্য সমস্ত বস্তুই মিথ্যা, ব্রহ্মের এই পরমার্থ সত্যতা বুঝাবার জন্যই ব্রহ্মকে 'সত্যস্য
সত্যম্' বলে নির্দেশ করা হয়েছে। সত্য অর্থাৎ যেরূপে যা নিশ্চিত হয়েছে সেই স্বরূপকে
যা লঙ্ঘন করে না তা সত্য। কিন্তু যেরূপে যাহা নিশ্চিত হয়েছে সেই স্বরূপকে লঙ্ঘনকারী
যে বস্তু তা মিথ্যা বলে কথিত হয়। এইজন্য বিকার (পরিণামবিশিষ্ট বস্তু) অনিত্য, যেহেতু
'বিকার মাত্রই বাগবলম্বনে অবস্থিত নাম মাত্র, কেবল মৃত্তিকাই সত্য' এইরূপ 'সৎ' কেই
(অবিকারীকেই) সত্য বলে অবধারণ করা হয়েছে। অতএব 'সত্যং ব্রহ্ম'-(তৈত্তিরীয় উপনিষদ্-২/১)
এটা বলে শ্রুতি ব্রহ্মকে বিকার হতে নিবৃত্ত করেছেন।
চিদ্ভাব
সত্যস্বরূপ
ব্রহ্ম চিন্ময় বা জ্ঞানস্বরূপ। 'জ্ঞানং ব্রহ্ম'-(তৈত্তিরীয় উপনিষদ্-২/১) আচার্য শঙ্কর
এই শ্রুতির ভাষ্যে বলেছেন- 'এই জ্ঞানপদ ব্রহ্মের কর্তৃত্বাদি বিকার নিবৃত্তির জন্য
এবং মৃত্তিকাদির ন্যায় অচেতনতা নিবৃত্তির জন্য প্রয়োগ করা হয়েছে।' ব্রহ্ম স্বয়ংজ্যোতি,
বিশ্বের অন্য সমস্ত বস্তুই ব্রহ্মজ্যোতি দ্বারা প্রকাশিত হয়, কিন্তু ব্রহ্মের প্রকাশের
জন্য অন্য কোন প্রকাশকের অপেক্ষা নেই; এই জন্যই উপনিষদে ব্রহ্মকে স্বপ্রকাশ বলা হয়েছে।
বৃহদারণ্যকে জনক-যাজ্ঞবল্ক্য সংবাদে জনক যাজ্ঞবল্ক্যকে প্রশ্ন করেছেন যে, পুরুষ বা
আত্মাকে প্রকাশ করে কে? এই প্রশ্নের উত্তরে যাজ্ঞবল্ক্য বলেছেন যে, আত্মাই আত্মার জ্যোতিঃ
ও প্রকাশক। আত্মার জ্যোতিদ্বারাই সমস্ত জীব ও জগৎ জ্যোতির্ময় হয়ে থাকে। পুরুষ, আত্মা
বা ব্রহ্মই জ্যোতির জ্যোতিঃ পরম জ্যোতিঃ। এই জ্যোতিঃ নিত্য ভাস্বর, এই জ্যোতির কখনো
বিলোপ হয় না। যেখানে সূর্যের ভাতি নেই, চন্দ্রতারার প্রকাশ নেই, বিদ্যুতের বিকাশ নেই,
অগ্নির আলোক নেই, সেখানেও এই নিত্য ব্রহ্মজ্যোতিঃ বিদ্যমান। চন্দ্র, সূর্য, বিদ্যুৎ,
অগ্নি প্রভৃতি সমস্ত জ্যোতিষ্মান্ পদার্থই এই ব্রহ্মজ্যোতিঃ প্রভায়ই প্রভাবান্, ব্রহ্মের
আলোকেই দ্যুতিমান্, চন্দ্র, সূর্য প্রভৃতি জড়-জ্যোতিঃ ব্রহ্মজ্যোতির ছায়ামাত্র। কঠশ্রুতিতে
এই বিষয়ে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। "ন তত্র সূর্যো ভাতি ন চন্দ্রতারকং নেমা বিদ্যুতো
ভান্তি কুতোঽয়মগ্নিঃ। তমেব ভান্তমনুভাতি সর্বং তস্য ভাসা সর্বমিদং বিভাতি।"
-(কঠ উপনিষদ্-২.২.১৫)
উক্ত কঠশ্রুতির প্রতিধ্বনি করে ভগবদ্গীতায় শ্রীভগবান্ও বলেছেন যে, "যদাদিত্যগতং তেজো জগদ্ভাসযতেখিলম্৷ যচ্চন্দ্রমসি যচ্চাগ্নৌ তত্তেজো বিদ্ধি মামকম্৷৷"-(শ্রীগীতা-১৫/১২) অর্থাৎ 'যে জ্যোতিঃ সূর্যে, চন্দ্রে ও অগ্নিতে আছে এবং যা সমগ্র জগৎকে প্রকাশ করে, সেই জ্যোতিঃ আমার জানবে।' আত্মার চিন্ময় রূপ বুঝাবার জন্য বৃহদারণ্যক বলেছেন যে, লবণখণ্ডের যেমন ভিতর ও বাহির সমস্তই লবণ ব্যতীত আর কিছুই নয়, সেইরূপ বিজ্ঞানময় আত্মার অন্তর ও বাহির বিজ্ঞান ব্যতীত আর কিছুই নয়। "স যথা সৈন্ধবঘনোঽনন্তরোঽবাহ্যঃ কৃৎস্নো রসঘন এবৈ বং বা অরেঽয়মাত্মানন্তরোঽবাহ্যঃ কৃৎস্নঃ প্রজ্ঞানঘন এব"-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪.৫.১৩) এই বিজ্ঞান বিষয় ও ইন্দ্রিয়সংযোগের ফলে যে জ্ঞান উৎপন্ন হয় তা নয়, ওটা জন্য জ্ঞান, ঐজন্য জ্ঞানের উৎপত্তিও হয়, বিনাশও হয়। আত্মবিজ্ঞান নিত্য, সুতরাং আত্মবিজ্ঞানের উৎপত্তিও হয় না, বিনাশও হয় না। কারণ, বিজ্ঞানই আত্মার স্বরূপ।
আনন্দভাব
সৎস্বরূপ,
চিৎস্বরূপ ব্রহ্ম আনন্দস্বরূপও বটে। "বিজ্ঞানমানন্দং ব্রহ্ম"-(বৃহদারণ্যক
উপনিষৎ-৩.৯.২৮) ব্রহ্ম আনন্দের সমুদ্র, ব্রহ্মই প্রাণ, ব্রহ্মই প্রজ্ঞা, ব্রহ্মই আনন্দ।
এই ব্রহ্মানন্দ অপরিমিত আনন্দ, এর কোন সীমা নেই, এ অসীম, অখণ্ড, ভূমানন্দ। এই আনন্দ
সাংসারিক বিষয়ানন্দ নয়, এটা প্রকৃতপক্ষে সুখদুঃখের অতীতাবস্থা। মানুষ যখন এই আনন্দের
সন্ধান পায় তখন সাংসারিক বিষয়ানন্দকে দুঃখেরই রূপান্তর বলে বিষের মত পরিত্যাগ করে।
জাগতিক ভোগবিলাসের মধ্যে মানুষের যে আনন্দবোধ রয়েছে, তা অনন্ত ব্রহ্মানন্দেরই অতি
ক্ষুদ্রতম কণিকামাত্র। সুখস্বরূপ, রসস্বরূপ, পূর্ণ ব্রহ্মই জীব ও জগতের অন্তরালে প্রচ্ছন্ন
আছেন এবং জীবের বিষয়ভোগের মধ্যে আনন্দরূপে ও রসরূপে প্রকাশ পাচ্ছেন। এই রসস্বরূপ ব্রহ্মকে
বিষয়ের মধ্য দিয়ে আস্বাদন করে বলেই জীব বিষয়ভোগেও আনন্দ লাভ করে। "পরম আনন্দ
এতস্যৈবাঽঽনন্দস্যান্যানি ভূতানি মাত্রামুপজীবন্তি"-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪.৩.৩২)
এই
বিষয়ানন্দ ব্রহ্মানন্দের তুলনায় নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর। বিষয়ানন্দ অকিঞ্চিৎকর হলেও
তার সম্বন্ধে মানুষের একটি স্পষ্ট ধারণা আছে, এই জন্য তৈত্তিরীয় বৃহদারণ্যক প্রভৃতি
উপনিষদে বিষয়ানন্দকে দৃষ্টান্তরূপে উপন্যাস করে ব্রহ্মানন্দের স্বরূপ বুঝাবার চেষ্টা
করা হয়েছে। বৃহদারণ্যক শ্রুতি বলেছেন—"মানুষের মধ্যে যে ব্যক্তি সমৃদ্ধশালী এবং
সমস্ত জাগতিক ভোগ যাঁর করায়ত্ত, যিনি সকলের অধিপতি, তাঁর যে আনন্দ সেই আনন্দই মানুষের
পরমানন্দ; পিতৃলোকের আনন্দ এই মনুষ্যলোকের আনন্দের শতগুণ; গন্ধর্বলোকের আনন্দ আবার
পিতৃলোকের আনন্দের শতগুণ। যাঁরা স্বীয় কর্মফলে দেবত্ব লাভ করেছেন ঐ কর্মদেবগণের আনন্দ
গন্ধর্বলোকের আনন্দের শতগুণ, যাঁরা স্বভাবতঃই দেবতা অর্থাৎ কর্মদ্বারা দেবত্ব লাভ করেন
নি তাঁদের আনন্দ কর্মদেবতাগণের আনন্দের শতগুণ। নিষ্পাপ, নিষ্কাম, শ্রোত্রিয়ের আনন্দও
স্বভাব দেবতার আনন্দের তুল্য। প্রজাপতিলোকের আনন্দ আবার এই দেবতাগণের আনন্দের শতগুণ।
ব্রহ্মলোকের আনন্দ প্রজাপতিলোকের আনন্দের শতগুণ। ইহাই আনন্দের পরাকাষ্ঠা পরমানন্দ ব্রহ্মানন্দ,
এটাই ব্রহ্মলোক।" তৈত্তিরীয় উপনিষদেও এইরূপ দৃষ্টান্তের সাহায্যে ব্রহ্মানন্দের
স্বরূপ বুঝাবার চেষ্টা করা হয়েছে। ঐসকল দৃষ্টান্তের অর্থ এই যে, ব্রহ্মানন্দ অপরিমেয়
ও অসীম, ব্রহ্মানন্দের পরিমাণ নির্ধারণ করা অসম্ভব। শ্রুতি বলেছেন, বাক্য ও মন যাকে
ধরতে না পেরে নিবৃত্ত হয়, সেই ব্রহ্মানন্দকে জানলে কোন কিছুতে ভয় থাকে না।........
তথ্যসূত্রঃ-
১.
ভগবান্ শঙ্করাচার্যের তৈত্তিরীয় উপনিষদ্ ভাষ্য।
২.
"বেদান্তদর্শন-অদ্বৈতবাদ্", কাব্য-ব্যাকরণ-সাংখ্য-বেদান্ততীর্থ, বিদ্যাবাচস্পতি
শ্রীআশুতোষ ভট্টাচার্য শাস্ত্রী।
...…..........….............................................................
শ্রীশুভ
চৌধুরী।
নভেম্বর
৬, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দ।
No comments:
Post a Comment