Sunday, 20 November 2022

নির্বিশেষ ব্রহ্ম

 


ব্রহ্ম স্বতঃ নির্গুণ নির্বিশেষ।  ব্রহ্ম নির্বিশেষ বলেই তো শ্রুতি কেবল "নেতি নেতি"-(বৃহদারণ্যক উপনিষদ্-২।৫।৬) অর্থাৎ "ইহা ব্রহ্ম নহে", "উহা ব্রহ্ম নহে", এইরূপে নিষেধমুখে নির্বিশেষ ব্রহ্মের স্বরূপ বুঝাইতে চেষ্টা করিয়াছেন ; ব্রহ্মের স্বরূপ বুঝাইবার জন্য নিষেধসূচক 'ন'-এর অসংখ্য প্রয়োগ করিয়াছেন। কঠ শ্রুতি স্পষ্ট বলিতেছেন-

অশব্দমস্পর্শমরূপমব্যয়ং তথারসং নিত্যমগন্ধবচ্চ যত্ ৷ অনাদ্যনন্তং মহতঃ পরং ধ্রুবং নিচায্য তন্মৃত্যুমুখাত্ প্রমুচ্যতে ৷৷- (কঠ উপনিষদ্-১।৩।১৫)

ভগবান্ শঙ্করাচার্য এই শ্রুতির ভাষ্যে বলিতেছেন- 'অশব্দমস্পর্শমরূপমরসমগন্ধবচ্চ যত্' এতদ্ব্যাখ্যায় ব্রহ্ম অব্যয়; কারণ যাহা শব্দাদি বিশিষ্ট তাহাই ব্যয়িত অর্থাৎ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। এই ব্রহ্ম শব্দাদি রহিত বলিয়া অব্যয়, ব্যয়িত অর্থাৎ ক্ষয়প্রাপ্ত হয় না; অতএব তিনি নিত্য। ইহাছাড়া এই জন্যও তিনি নিত্য যেহেতু তিনি অনাদি, তাহার আদি কারণ অবিদ্যমান-এইজন্য অনাদি। কারণ যে বস্তু আদিমান্ তাহাই কার্য্যবস্তু বলিয়া অনিত্য,কেননা কার্য্য নিজ কারণে লয় হয় যথা পৃথিব্যাদি। কিন্তু এই প্রত্যাগ্রাত্মা সর্বকারণ বলিয়া অকার্য্য এবং অকার্য্য বলিয়া নিত্য; তাহার কোন কারণই নাই যাহাতে তিনি লীন হইবেন৷ সেইরূপ তিনি অনন্তও। তাহার অন্ত অর্থাৎ কার্য্যও নাই তাই তিনি অনন্ত৷ যেভাবে ফলাদি কার্য উত্পাদনহতু কদলী প্রভৃতি বৃক্ষের অনিত্যতা দৃষ্ট হয়, সেইরূপ অন্তবত্ত্বও এই ব্রহ্মের নাই; এইজন্যও তিনি নিত্য৷

নিত্য বিজ্ঞপ্তিস্বরূপ বলিয়া তিনি জড়বুদ্ধি সংজ্ঞক মহৎ তত্ত্ব হইতেও পর অর্থাৎ বিলক্ষণ; কারণ সর্বভূতের অন্তরাত্মা বলিয়া ব্রহ্ম সর্বসাক্ষি অর্থাৎ সকলের প্রকাশক। 'এষ সর্বেষু ভূতেষু' অর্থাৎ তিনি যে সর্বভূতের গূঢ় আত্মা ইত্যাদি মন্ত্রে পূর্বেই বলা হইয়াছে ৷ আর তিনি ধ্রুব অ্থাৎ কূটস্থ নিত্য, পৃথিব্যাদির ন্যায় তাহার নিত্যত্ব আপেক্ষিক নহে ৷ এইরূপ সেই ব্রহ্মস্বরূপ প্রত্যগাত্মাকে উপলব্ধি করিয়া মুমুক্ষু প্রেয়, তন্নিমিত্ত কামনা ও তন্নিমিত্ত কর্মরূপ মৃত্যুর নাগাল হইতে মুক্ত অর্থাৎ বিযুক্ত হইয়া যান।

ব্রহ্ম নিত্য, শুদ্ধ, বুদ্ধ এবং মুক্তস্বভাব। যত্তদদ্রেশ্যমগ্রাহ্যমগোত্রমবর্ণমচক্ষুঃশ্রোত্রং তদপাণিপাদম্৷ নিত্যং বিভুং সর্বগতং সুসূক্ষ্মং তদব্যযং যদ্ভূতযোনিং পরিপশ্যন্তি ধীরাঃ৷৷-(মুণ্ডক উপনিষৎ-১.১.৬)

শঙ্করাচার্য এই শ্রুতির ভাষ্যে বলিতেছেন-"সেই ব্রহ্ম যিনি অদৃশ্য অর্থাৎ সকল জ্ঞানেন্দ্রিয়ের অবিষয়, কেননা যেহেতু বহির্জগতের উৎপন্ন জ্ঞান পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে সম্পন্ন হইয়া থাকে। তিনি অগ্রাহ্য অর্থাৎ কর্ম্মেন্দ্রিয়ের অবিষয় এবং অগোত্র-গোত্র, অন্বয় বা মূল ইত্যাদি সমার্থক বলিয়া অগোত্রম্ অর্থাৎ অনন্বয়। কেননা ব্রহ্মের কোন মূল নাই যাহার সহিত উহা অন্বিত হইবে। তিনি অবর্ণ অর্থাৎ যাহার বর্ণনা করা যায় সেই স্থূলত্বাদি বা শুক্লত্বাদিরূপ বস্তুর বিভিন্ন ধর্ম্মসমূহ বর্ণসংজ্ঞক, সেই বর্ণসকল যাহার নাই তিনিই অবর্ণ অর্থাৎ অক্ষর। তিনি অচক্ষুঃশ্রোত্রম্ অর্থাৎ শোত্র ও চক্ষু-এই ইন্দ্রিয়দ্বয় সর্ব্বজীবের নাম ও রূপের গ্রাহক, এই দুটি যাহর নাই তিনিই অচক্ষুঃশ্রোত্রম্।তিনি অপাণিপাদম্ অর্থাৎ হস্তপদাদি কর্মেন্দ্রিয়রহিত। যেহেতু তিনি এইরূপ অর্থাৎ জ্ঞেয় কিংবা জ্ঞাতা হন না বলিয়া নিত্য বা অবিনাশিস্বরূপ। তিনি বিভু- বিবিধরূপে অর্থাৎ ব্রহ্মা হইতে স্থাবর পর্যন্ত বিভিন্ন প্রাণিরূপে সৃষ্ট হন বলিয়া বিভুসংজ্ঞক।

তিনি সর্ব্বগত অর্থাৎ আকাশের মতো ব্যাপক এবং সুসূক্ষ্ম অর্থাৎ স্থূলত্বাদির কারণ যে শব্দাদি সেই শব্দাদি ধর্ম্মরহিত। এই শব্দ প্রভৃতিগুণই আকাশ, বায়ু প্রভৃতি ভূতের ক্রমশঃ এক হইতে অপরের অধিক স্থুলতার কারণ, সুতরাং সই শব্দাদির অভাববশত ব্রহ্ম সুসূক্ষ্মম্। উক্ত ধর্ম্মবশতঃ তাহার ক্ষয় নাই বলিয়া তিনি অব্যয়। কারণ নিরবয়ব ব্রহ্মের পক্ষে শরীরের ক্ষয় হওয়ার ন্যায় স্বীয় অবয়ব-হ্রাসরূপ ক্ষয় হওয়াও সম্ভব হয় না এবং নির্বিশেষ ব্রহ্মের পক্ষে রাজার ধনাগার হ্রাস হওয়ার ন্যায় হ্রাস হওয়ারূপ ক্ষয় হওয়াও সম্ভব হয় না। আর নির্গুণ ও সর্বাত্মক বলিয়া গূণহ্রাসদ্বারাও তাঁহার ক্ষয় হওয়া সম্ভব হয় না। এইরূপ লক্ষণবিশিষ্ট ভূতযোনি অর্থাৎ প্রাণিগণের সৃষ্টির কারণস্বরূপ, স্থাবর-জঙ্গমের কারণস্বরূপ পৃথিবীর ন্যায় যাঁহাকে তথা সকলের স্বরূপভূত সেই অব্যয়কে বিবেকিগণ সর্বত্র উপলব্ধি করেন এবং যে তত্ত্বোপলব্ধির মাধ্যমে এইরূপ অবিনশ্বর ব্রহ্ম উপলব্ধ হন সেই অনুভূতিই হইতেছে পরাবিদ্যা।"


No comments:

আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...