"সজাতীয়প্রবাহশ্চ বিজাতীয়তিরস্কৃতিঃ নিয়মো হি পরানন্দো নিয়মাৎক্রিয়তে বুধৈঃ" অর্থাৎ 'অহম্ ব্রহ্মাস্মি' এই চিন্তা বা প্রত্যয়ের একতানতা ব্রহ্মবিজ্ঞানের সহায়ক সমধর্মী চিন্তাপ্রবাহ ও বিপরীতধর্মী চিন্তার নিবৃত্তি 'নিয়ম' বলে কথিত। পরমানন্দস্বরূপ জ্ঞানিগণকর্তৃক এটা নিয়মিত কৃত হয়। অপরোক্ষানুভূতিতে ভগবান্ শঙ্করাচার্যের এটাই অভিপ্রায়।
শ্রীপাতঞ্জলে
সাংখ্যপ্রবচনে বৈয়াসিকে সাধনপাদে বর্ণিত আছে—
'শৌচ-সন্তোষ-তপঃ-স্বাধ্যায়েশ্বরপ্রণিধানানি
নিয়মাঃ'
-বাহ্য
ও অন্তঃশৌচ, সন্তোষ, তপস্যা, স্বাধ্যায় (মন্ত্রজপ বা অধ্যাত্ম-শাস্ত্রপাঠ) ও ঈশ্বরোপাসনা
এইগুলি ‘নিয়ম’।
এই
সূত্রের ব্যাসভাষ্যে বর্ণিত আছে—'এদের মধ্যে শৌচ হলো, মাটি ও জলাদি প্রয়োগে শুচিতা
ও মেধ্য আহারাদি গ্রহণ, এগুলি বাহ্য শুচিতা। আভ্যন্তর হলো, চিত্তগত মলগুলি দূর করা।
সন্তোষ হলো, কাছে এসে যাওয়া ইপ্সিত বস্তু প্রাপ্তির অধিক কিছু না চাওয়া-পাওয়ার মনোভাবনা।
তপঃ হলো গ্রীষ্ম-শীত জাত সুখ-দুঃখ রূপ দ্বন্দ্ব সহ্য করা। দ্বন্দ্ব হলো ক্ষুধা ও তৃষ্ণা,
শীত ও উষ্ণ এবং আসনে স্থিরভাবে থাকা, কাঠের মতো নিশ্চলতায় মৌন থাকা ও মাত্র আকার ইঙ্গিতে
জানানো। ব্রতগুলি হলো, যোগানুশাসন অনুযায়ী কৃচ্ছতায় ও চান্দ্রায়ণাদিতে সম্যক্ তপ্ত
হওয়ারূপ তপস্যাগুলি। স্বাধ্যায় হলো, মোক্ষ শাস্ত্রগুলির অধ্যয়ন বা প্রণব জপ।
পরমগুরুতে
সমস্ত কর্ম্ম সমর্পন হলো ঈশ্বর-প্রণিধান। শুয়ে থাকা, বসে থাকা বা রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো-আদি
অবস্থাতে যে আত্মাতে স্থিত পুরুষ, যাঁর সংশয়-বিপর্যয়াদি বিতর্কজাল সম্পূর্ণরূপে তিরোহিত,
যিনি সংসারের বীজভূতা অবিদ্যার নাশ অনুভব করেন, তিনিই নিত্যমুক্ত, অমৃত ভোগ-ভাগী। এই
অনুযায়ী সূত্রকারের মাধ্যমে কথিত হয়েছে, ঈশ্বর প্রণিধানহেতু প্রত্যক্ চৈতন্যের সাক্ষাৎকার
হয়ে যায়, ও যুগপৎ অন্তরায়গুলি বিলীন হয়।'
এখন
নিয়মের সিদ্ধিসকল যোগ সূত্রানুসারে আলোচনা করব। শৌচ প্রতিষ্ঠিত হলে নিজের শরীরের প্রতি
ঘৃণার উদ্রেক হয়, অন্যের সঙ্গ করতেও আর প্রবৃত্তি থাকে না। স্বকীয় শরীরে হেয়তাবুদ্ধিযুক্ত
ব্যক্তি নিজ কায়কে মৃজ্জলাদির দ্বারা ক্ষালন করেও যখন শুদ্ধি দেখতে পান না, তখন অত্যন্তমলিন
পরকায়ের সাথে কিরূপ সংসর্গ করবেন?
এই
শৌচ হতে সত্ত্ব-শুদ্ধি (অন্তঃকরণের নির্মলতা), সৌমনস্য অর্থাৎ মনের প্রফুল্ল ভাব, একাগ্রতা,
ইন্দ্রিয় জয় ও আত্মদর্শনের যোগ্যতা লাভ হয়ে থাকে। সন্তোষ হতে পরম সুখলাভ হয়। অশুদ্ধি-ক্ষয়-নিবন্ধন
তপস্যা হতে দেহ ও ইন্দ্রিয়ের নানাপ্রকার শক্তি আসে। মন্ত্রাদির পুনঃপুনঃ উচ্চারণ বা
অভ্যাস দ্বারা ইষ্টদেবতার দর্শনলাভ হয়ে থাকে। ঈশ্বরে সমুদয় অর্পণ করিলে সমাধিলাভ হয়ে
থাকে। ঈশ্বরে সর্বভাবার্পিত যোগীর সমাধি সিদ্ধি হয়। ঈশ্বরে সর্বভাবার্পণ অর্থে ভাবনা
দ্বারা ঈশ্বরে নিজেকে ডুবিয়ে রাখা। এই ঈশ্বরপ্রণিধানই সমাধিসিদ্ধির সাক্ষাৎ হেতু।
তাছাড়া
পাঁচপ্রকার নিয়ম যে ব্রাহ্মণের স্বভাবজাত তা শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাতেও স্পষ্টভাবে বর্ণিত
আছে-
'শমো
দমস্তপঃ শৌচং ক্ষান্তিরার্জবমেব চ৷ জ্ঞানং বিজ্ঞানমাস্তিক্যং ব্রহ্মকর্ম স্বভাবজম্'-(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা-১৮।৪২)
অর্থাৎ
বাহ্যেন্দ্রিয় ও অন্তরিন্দ্রিয়ের সংযম, কায়িক, বাচিক ও মানসিক তপস্যা; অন্তর্বহিঃ শৌচ,
ক্ষমা, সরলতা, শাস্ত্রজ্ঞান ও তত্ত্বানুভূতি এবং শাস্ত্রে ও ভগবানে বিশ্বাস - এই সকল
নিয়ম ব্রাহ্মণের স্বভাব জাত। এইভাবে তপস্যাদি নিয়মের দ্বারা নিষ্কামকর্মযোগী সাধনায়
উত্তীর্ণ হয়ে ঈশ্বরের প্রণিধানে সর্বকর্মফল ঈশ্বরে সমর্পন করেন। যৎকরোষি যদশ্নাসি যজ্জুহোষি
দদাসি যৎ৷ যত্তপস্যসি কৌন্তেয় তৎকুরুষ্ব মদর্পণম্৷ ইতি শ্রীগীতায় ভগবৎ বচন।..................
শ্রীশুভ
চৌধুরী
ডিসেম্বর
২৭, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দ।
No comments:
Post a Comment