Tuesday, 27 February 2024

মুক্তির সাধন কি?

 


অদ্বৈতবেদান্তে জ্ঞানই একমাত্র মুক্তির সাধন। ভগবান্ শঙ্করাচার্য শ্রীগীতাভাষ্যের তৃতীয় অধ্যায়ের উপক্রমণিকাতে বলেছেন"তস্মাৎ কেবলাদেব জ্ঞানাৎ মোক্ষ ইত্যেষোঽর্থো নিশ্চিতো গীতাসু সর্বোপনিষৎসু চ।" অর্থাৎ কেবল জ্ঞানের দ্বারাই যে মোক্ষলাভ হয়, তা গীতা সকল উপনিষদে নিশ্চিতরূপে প্রতিপাদিত হয়েছে। জীবের সংসার-বন্ধন মিথ্যা, অজ্ঞানমূলক। জ্ঞানই অজ্ঞানকে বিনাশ করতে পারে; জ্ঞান ব্যতীত অপর কিছু দ্বারা অজ্ঞানের বিনাশ হয় না। আলোক যেমন অন্ধকারকে বিনাশ করেই উৎপন্ন হয়, চিদালোকও সেরূপ অজ্ঞানান্ধকারকে দূর করেই উদিত হয়। জ্ঞানোদয়ে কর্ম নিরস্ত হয়, কর্ম বাধ্য, জ্ঞান কর্মের বাধক; সুতরাং নিত্য ব্রহ্মবিজ্ঞানে কর্ম কোনমতেই সাধন হতে পারে না।

বেদান্তদর্শনের পুরুষার্থাধিকরণে বর্ণিত আছে

"পুরুষার্থোঽতঃ শব্দাদিতি বাদরায়ণঃ"-(ব্রহ্মসূত্র-..)

অর্থাৎ বেদান্তবিহিত এই স্বতন্ত্র (কর্মনিরপেক্ষ) আত্মজ্ঞান হতে (মোক্ষরূপ) পুরুষার্থ সিদ্ধ হয়, এটা আচার্য বাদরায়ণ মনে করেন। কোন প্রমাণবলে? উত্তর —'শব্দ (শ্রুতি) হতে', এটা ভগবান্ সূত্রকার বলছেন। সেই শ্রুতিগুলো এই

'তরতি শোকমাত্মবিৎ'-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-..) অর্থাৎ আত্মবিৎ শোককে অতিক্রম করেন।

 ' যো বৈ তৎপরমং ব্রহ্ম বেদ ব্রহ্মৈব ভবতি'-(মুণ্ডক উপনিষৎ-..) অর্থাৎ যিনি সেই পরব্রহ্মকে জানেন, তিনি ব্রহ্মই হয়ে যান।

 'ব্রহ্মবিদাপ্নোতি পরম্'-(তৈত্তিরীয় উপনিষৎ-..) অর্থাৎ ব্রহ্মবিদ্ পরব্রহ্মকে প্রাপ্ত হন।

'আচার্যবান্পুরুষো বেদ তস্য তাবদেব চিরং যাবন্ন বিমোক্ষ্যেথ সংপৎস্যে'-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-.১৪.) অর্থাৎ আচার্যবান পুরুষই ব্রহ্মকে জানতে পারেন, সৎস্বরূপ আত্মলাভে তাঁর ততকালই বিলম্ব, যতকাল না বিমুক্ত হন (—প্রারব্ধ কর্মের ক্ষয় হয়ে দেহ পাত হয়), অনন্তর সতের সহিত একীভূত হন।

'সর্বাংশ্চ লোকানাপ্নোতি সর্বাংশ্চ কামান্যস্তমাত্মানমনুবিদ্য বিজানাতি'-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-..) অর্থাৎ যিনি এই আত্মাকে (শাস্ত্র আচার্যের উপদেশ হতে) অবগত হয়ে বিশেষরূপে জানেন, তিনি সকল লোক সকল কাম্যবস্তু প্রাপ্ত হন।

 'এতাবদরে খল্বমৃতত্বম্'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-..১৫)

অর্থাৎ হে মৈত্রেয়ি, এইটুকুমাত্রই (—আত্মদর্শনই) অমৃতত্বের সাধন", ইত্যাদি এই জাতীয় শ্রুতি কেবল কর্মনিরপেক্ষ ব্রহ্মবিদ্যার পুরুষার্থহেতুতা শ্রবণ করাচ্ছেন।

এখন প্রশ্ন হল, কর্ম যদি জীবের মুক্তি দানে সমর্থ না হয়, তবে শাস্ত্রে যে যজ্ঞ, দান, সেবা প্রভৃতি জীবের অবশ্য কর্তব্য কর্মের উপদেশ দেয়া হয়েছে, সে সকল শাস্ত্রবিধি কি অর্থহীন? এই আপত্তির উত্তরে শঙ্করাচার্য গীতাভাষ্যে বলেন যে, নিষ্কাম কর্ম চিত্তের শুচিতা সম্পাদন করে বলে কর্ম নিরর্থক নয়। নিষ্কামভাবে ঈশ্বরার্পণ-বুদ্ধিতে কর্মের অনুষ্ঠান করলে চিত্তের মলিনতা বিদূরিত হয়। চিত্তশুদ্ধির ফলে সংসারে বৈরাগ্যোদয় হয়, সংসার-বন্ধন হতে মুক্ত হবার জন্য তীব্র আকাঙ্ক্ষা প্রভৃতির উদয় হয়। নির্মল নিষ্কলুষ চিত্তে স্বতঃস্ফূর্ত ব্রহ্মজ্ঞান প্রতিফলিত হয়। "শুধ্যমানন্তু তচ্চিত্তমীশ্বরাপিতকর্মভিঃ। বৈরাগ্যং ব্রহ্মলোকাদৌ ব্যনক্ত্যর্থ সুনির্মলম্।"-(নৈষ্কর্মসিদ্ধি)

কর্ম অদ্বৈতমতে মুক্তির সাক্ষাৎ সাধন নয়, গৌণ সাধন। ব্রহ্মজ্ঞানে যজ্ঞাদি সকল কর্মেরই যে অপেক্ষা আছে তা আচার্য শঙ্কর ব্রহ্মসূত্রের (..২৬) এর ভাষ্যে স্পষ্ট বলছেন"অপেক্ষতে বিদ্যা সর্বাণ্যাশ্রমকর্মাণি, নাত্যন্তমনপেক্ষৈব৷" অর্থাৎ ব্রহ্মবিদ্যা আশ্রমবিহিত (কাম্যবর্জ্জিত নিত্য নৈমিত্তিক) সকল কর্ম্মকে অপেক্ষা করে, অত্যন্ত অনপেক্ষ অবশ্যই নয়। তাতে প্রমাণ কি? যেহেতু যজ্ঞাদিবোধক শ্রতিবাক্য আছে, যথা'তমেতং বেদানুবচনেন ব্রাহ্মণা বিবিদিষন্তি যজ্ঞেন দানেন তপসানাশকেন '-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-..২২) অর্থাৎ সেই উপনিষৎপ্রতিপাদ্য ব্রহ্মকে ব্রাহ্মণগণ বেদপাঠ, যজ্ঞ, দান যথেচ্ছ ভোজন না করারূপ তপস্যার দ্বারা জানতে ইচ্ছা করেন।" এই শ্রুতিতে 'বিবিদিষা মাত্র', অর্থাৎ ব্রহ্মকে জানবার ইচ্ছা মাত্র উৎপাদ্যরূপে সমর্পিত হচ্ছে। আর বিবিদিষার সহিত সম্বন্ধবশতঃ আশ্রমবিহিত কর্মের ব্রহ্মজ্ঞানের উৎপত্তিতে সাধনভাব নিশ্চিত হচ্ছে। কর্মসকল পরম্পরাসম্বন্ধে ব্রহ্মজ্ঞানের সাধন। কর্মসকল পাপকে নাশ করে, জ্ঞান কিন্তু পরমা গতি (—মোক্ষের সাধন), কর্মসকলের দ্বারা পাপ বিনষ্ট হলে তদনন্তর জ্ঞানের উদয় হয়।....

তথ্যসূত্রঃ-

. ভগবান্ শঙ্করাচার্যের শারীরক-মীমাংসা শ্রীগীতা ভাষ্য।

. সুরেশ্বরাচার্যের নৈষ্কর্মসিদ্ধি।

শ্রীশুভ চৌধুরী

ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০২৪ খৃষ্টাব্দ।

No comments:

আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...