Friday, 27 December 2019

রূপবিহীন অমূর্ত্ত ও সর্ব্বগত ব্রহ্মের প্রতিবিম্বিত হওয়া বিষয়ে শ্রুতিসম্মতি প্রদর্শনঃ-


শ্রীমন্মহর্ষি বাদরায়ণ ভগবৎ প্রণীতম্ উত্তর মীমাংসা বেদান্তদর্শনে বর্ণিত আছে
-'দর্শনাচ্চ।।'-ব্রহ্মসূত্র ৩।২।২১।।
শারীরকভাষ্যম্ঃ-ভগবৎপূজ্যপাদ্ শঙ্করাচার্য্যের ভাষ্য হইল- আর দেহাদি উপাধিসকলের মধ্যে পরব্রহ্মেরই অনুপ্রবেশ প্রদর্শন করিতেছেন, যথা-'দ্বিপদ পুরসক অর্থাৎ শরীর সকল নির্ম্মাণ করিলেন, চতুষ্পদ পুরসকলের নির্ম্মাণ করিলেন। সেই পরমপুরুষ পূর্ব্বে পক্ষী হইয়া শরীরসকলে প্রবেশ করিলেন।'-(বৃহদারণ্যক উপনিষদ্-২।৫।১৮) ইত্যাদি এবং 'এই জীবাত্মারূপে অনুপ্রবেশ করিয়া' (ছান্দোগ্য উপনিষদ্-৬।৩।২) ইত্যাদি।
সেইহেতু রূপহীন সর্ব্বগত অমূর্ত্ত ব্রহ্মের প্রতিবিম্বরূপে পুরসকলে প্রবেশ শ্রতিসম্মত হওয়ায় 'অতএব চোপমা সূর্য্যকাদিবৎ।।'-ব্রহ্মসূত্র ৩।২।১৮।। সূত্রাদি যুক্তিসঙ্গত। সেইহেতু প্রতিবিম্বে প্রতিভাত ধর্ম্মসকল পরমার্থতঃ বিম্বে থাকে না বলিয়া ব্রহ্ম অবশ্যই নির্বিকল্পরূপ একলিঙ্গযুক্ত অর্থাৎ সর্ব্বপ্রকারবিকল্প-বর্জ্জিতত্বই তাঁহার একমাত্র স্বরূপ, তিনি সবিশেষ ও নির্বিশেষ উভয়স্বরূপ নহেন এবং নির্বিশেষতার বিপরীতস্বরূপ সবিশেষ নহেন, ইহা সিদ্ধ হইল।

Friday, 20 December 2019

'কালভৈরবাষ্টকম্'




ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য বিরচিত '#কালভৈরবাষ্টকম্' ও এর ভাবার্থঃ-

শ্রীকালভৈরবাষ্টকং

দেবরাজসেব্যমানপাবনাঙ্ঘ্রিপঙ্কজং

ব্যালযজ্ঞসূত্রমিন্দুশেখরং কৃপাকরম্ ।

নারদাদিযোগিবৃন্দবন্দিতং দিগম্বরং

কাশিকাপুরাধিনাথকালভৈরবং ভজে ||১||

ভাবার্থ - দেবরাজ ইন্দ্র যাঁর পতিত পাবন চরণ কমল সেবা করেন, সৰ্প যাঁর গলদেশের যজ্ঞসুত্ৰ, যিনি চন্দ্ৰশেখর, যিনি দয়া নিধান, নারদাদি যোগিগণ যাকে বন্দনা করেন, যিনি দিগম্বর আমি সেই কাশিপুরের অধীশ্বর কালভৈরবকে ভজনা করি ||১||

ভানুকোটিভাস্বরং ভবাব্ধিতারকং পরং

নীলকণ্ঠমীপ্সিতার্থদায়কং ত্রিলোচনম্ ।

কালকালমম্বুজাক্ষমক্ষশূলমক্ষরং

কাশিকাপুরাধিনাথকালভৈরবং ভজে ||২||

ভাবার্থঃ- যিনি কোটি সুৰ্য্য প্ৰতীকাশ, যিনি সংসার সাগরের কর্ণধার এবং পরাৎপর, যার কণ্ঠদেশ নীলবর্ণে রঞ্জিত, যিনি বাঞ্ছাকল্পতরু ও ত্ৰিলোচন, যিনি কালসংহারকারী মহাকাল এবং পদ্মপলাশলোচন, যিনি অক্ষমালা ও শূল ধারণ করেন এবং যিনি সনাতন, কাশীপুরীর অধীশ্বর সেই কালভৈরবকে আমি ভজনা করি ||২||

শূলটঙ্কপাশদণ্ডপাণিমাদিকারণং

শ্যামকায়মাদিদেবমক্ষরং নিরাময়ম্ ।

ভীমবিক্রমং প্রভুং বিচিত্রতাণ্ডবপ্রিয়ং

কাশিকাপুরাধিনাথকালভৈরবং ভজে ||৩||

ভাবার্থ - শূল, টঙ্ক (পাষাণভেদী অস্ত্ৰ বিশেষ), নাগপাশ ও দণ্ড যাঁর হস্তে, যিনি এই জগতের আদি কারণ, যাঁহার দেহ শ্যামবৰ্ণ, যিনি আদি দেব, অবিনাশী ও নিরাময়, যাঁর (অসুর-বিনাশকারী) বিক্ৰম অতি ভয়ানক, যিনি জগতের প্রভু এবং বিচিত্র তাণ্ডবপ্রিয়, কাশিকা রাজধানীর অধীশ্বর সেই কালভৈরবকে আমি ভজনা করি ||৩||

ভুক্তিমুক্তিদায়কং প্রশস্তচারুবিগ্রহং

ভক্তবৎসলং স্থিতং সমস্তলোকবিগ্রহম্ ।

বিনিক্বণন্মনোজ্ঞহেমকিঙ্কিণীলসৎকটিং

কাশিকাপুরাধিনাথকালভৈরবং ভজে ||৪||

ভাবার্থ - যিনি ভক্তজনের ভোগ ও মোক্ষবিধান করেন, যাঁর দেহ প্ৰশস্ত ও মনোরম, যিনি ভক্তবৎসল ও সুখাসীন, এই ত্ৰিভুবন যার মূৰ্ত্তি, যার কটিদেশ মঝুরধ্বনিবিশিষ্ট মনোহর সুবর্ণকিঙ্কিণী দ্বারা পরিশোভিত, কাশিকা রাজধানীর অধীশ্বর সেই কালভৈরবকে ভজনা করি ||৪||

ধর্মসেতুপালকং ত্বধর্মমার্গনাশকং

কর্মপাশমোচকং সুশর্মদায়কং বিভুম্ ।

স্বর্ণবর্ণশেষপাশশোভিতাঙ্গমণ্ডলং

কাশিকাপুরাধিনাথকালভৈরবং ভজে ||৫||

ভাবার্থ - যিনি (সংসার সাগরের) ধৰ্মরূপ সেতু রক্ষা করেন, এবং অধৰ্মপথ বিনাশ করেন, যিনি ভক্তজনের কৰ্মপাশ ছেদন করেন ও বিমল আনন্দ দান করেন, যিনি এই সংসারের প্রভু, স্বর্ণের ন্যায় মনোহর বর্ণবিশিষ্ট অনন্ত সৰ্পরূপ রজ্জুতে যাঁর অঙ্গ সুশোভিত, কাশিকা রাজধানীর অধীশ্বর সেই কালভৈরবকে ভজনা করি ||৫||

রত্নপাদুকাপ্রভাভিরামপাদযুগ্মকং

নিত্যমদ্বিতীয়মিষ্টদৈবতং নিরংজনম্ ।

মৃত্যুদর্পনাশনং করালদংষ্ট্রমোক্ষদং

কাশিকাপুরাধিনাথকালভৈরবং ভজে ||৬||

ভাবার্থ - রত্ননিৰ্মিত পাদুকা দ্বারা যাঁর পদযুগল বিরাজিত, যিনি সনাতন, মনোভিরাম এবং যিনি সৰ্বতোভাবে অদ্বিতীয়, যিনি ত্ৰিজগতের ইষ্টদেব ও নিরঞ্জন (নির্লিপ্ত), যিনি ভক্তের জন্য মৃত্যুর দিগ্বিজয়জনিত দৰ্প বিনাশ করেন, কালের করালদংষ্ট্রার মধ্য হতে যিনি ভক্তকে উদ্ধার করেন, কাশিকা রাজধানীর অধীশ্বর সেই কালভৈরবকে ভজনা করি ||৬||

অট্টহাসভিন্নপদ্মজাণ্ডকোশসন্ততিং

দৃষ্টিপাতনষ্টপাপজালমুগ্রশাসনম্ ।

অষ্টসিদ্ধিদায়কং কপালমালিকাধরং

কাশিকাপুরাধিনাথকালভৈরবং ভজে ||৭||

ভাবার্থ - (প্ৰলয় সময়ে) যাঁর অট্টহাসে অনন্ত ব্ৰহ্মাণ্ডকোষ চূর্ণ বিচুর্ণ হয়, যাঁর দৃষ্টিপাতমাত্ৰে পাপজাল ভস্মীভূত হয়, যাঁর (দেবাসুর শিরোধাৰ্য্য) শাসন নিতান্ত উগ্র, যিনি সাধকগণকে অষ্টসিদ্ধি দান করেন, এবং যাঁর গলদেশ নরকপাল মালায় অলঙ্কৃত ; কাশিকাপুরীর অধীশ্বর সেই কালভৈরবকে ভজনা করি ||৭||

ভূতসঙ্ঘনায়কং বিশালকীর্তিদায়কং

কাশিবাসলোকপুণ্যপাপশোধকং বিভুম্ ।

নীতিমার্গকোবিদং পুরাতনং জগৎপতিং

কাশিকাপুরাধিনাথকালভৈরবং ভজে ||৮||

ভাবার্থ - যিনি (প্রমথ প্রভৃতি) ভূতগণের (জীব সমূহের) নায়ক, যিনি কীৰ্তিলিপ্সু, জনগনকে কৰ্মানুযায়ী অসাধারণ কীৰ্ত্তি দান করেন, যাঁর প্ৰসাদে কাশীবাসিজনগণের পুণ্যপ্ৰভাবে পাপরাশি দূরীভূত হয়, যিনি জগতের বিভু এবং নীতিপথে অভিজ্ঞ, যিনি (সনাতন বলে) পুরাতন এবং জগৎপতি; কাশিকাপুরীর অধীশ্বর সেই কালভৈরবকে ভজনা করি ||৮||

॥ ফল শ্রুতি ॥

কালভৈরবাষ্টকং পঠন্তি যে মনোহরং

জ্ঞানমুক্তিসাধনং বিচিত্রপুণ্যবর্ধনম্ ।

শোকমোহদৈন্যলোভকোপতাপনাশনং

প্রয়ান্তি কালভৈরবাংঘ্রিসন্নিধিং নরা ধ্রুবম্ ||৯||

ভাবার্থ - যাঁরা বিচিত্র পুণ্যবর্দ্ধন, জ্ঞান ও মুক্তিসাধন, শোক, মোহ, দৈন্য, লোভ, কোপ ও তাপনাশক এই “কালভৈরবাষ্টক’ পাঠ করেন, তাঁরা নিশ্চয় শ্ৰীকালভৈরবের পদপ্রান্তে উপনীত হন ||৯||

|| ইতি শ্রীমৎপরমহংস পরিব্রাজকাচার্যস্য শ্রীগোবিন্দ ভগবৎ পূজ্যপাদ শিষ্যস্য শ্রীমচ্ছঙ্কর ভগবতঃ কৃতৌ শ্রী কালভৈরবাষ্টকং সম্পূর্ণম্ ||

ইতি শ্রীমৎপরমহংস পরিব্রাজকাচার্য শ্রীগোবিন্দ ভগবৎ পূজ্যপাদ শিষ্য শ্রীমৎ শঙ্কর ভগবৎ বিরচিত কালভৈরবা অষ্টক স্তোত্র সমাপ্ত।

..........................................................................


শ্রীশুভ চৌধুরী

ডিসেম্বর ২০, ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দ।

Thursday, 19 December 2019

ব্রহ্মবিন্দু শ্রুতিস্থ জলমধ্যগত সূর্য্যাদি প্রতিবিম্ববৎ উপমাবলে আত্মার নির্বিশেষতা প্রতিপাদনঃ-


শ্রীমন্মহর্ষি বাদরায়ণ ভগবৎ প্রণীতম্ উত্তর মীমাংসা বেদান্তদর্শনে বর্ণিত আছে
-'অতএব চোপমা সূর্য্যকাদিবৎ।।'-ব্রহ্মসূত্র ৩।২।১৮।।
শারীরকভাষ্যম্ঃ-ভগবৎপূজ্যপাদ্ শঙ্করাচার্য্যের ভাষ্য হইল-আর যেহেতু এই আত্মা চৈতন্যস্বরূপ, বিশেষবর্জ্জিত, বাক্য ও মনের অগোচর এবং অনাত্ম প্রতিষেধের দ্বারা উপদেশ্য, এইহেতু উপাধিরূপ নিমিত্তবশতঃ ইঁহার যে অপারমার্থিক সবিশেষস্বরূপতা, তাহাকে অভিপ্রায় করিয়া মোক্ষশাস্ত্রসকলে 'জলমধ্যগত সূর্য্যাদি প্রতিবিম্বের ন্যায়' এই উপমা পরিগৃহীত হইতেছে,যথা-
'যেমন জ্যোতিঃস্বরূপ এই সূর্য্য এক হইলেও বিভিন্ন জলকে অনুগমনকরতঃ বিভিন্ন পাত্রস্থ জলে প্রতিবিম্বিত হইয়া বহুপ্রকার হইয়া থাকেন, এইপ্রকারে এই স্বয়ংপ্রকাশ দেব জন্মরহিত আত্মা, মায়ারূপ উপাধির দ্বারা ক্ষেত্রসকলে অর্থাৎ মায়ার পরিণামভূত দেহেন্দ্রিয়াদি সংঘাত সকলে অনুগমন করতঃ প্রতিবিম্বিত হইয়া বিভিন্নরূপে কৃত বা প্রতিভাত হন।'-(ব্রহ্মবিন্দু উপনিষদ্-১২)
'যেহেতু প্রাণিগণের এই একই আত্মা বিভিন্ন প্রাণীতে বিশেষভাবে অবস্থিত আছেন, তিনি জলমধ্যস্থ চন্দ্রের ন্যায় একরূপে ও বহুরূপে পরিদৃষ্ট হন।'-(ঐ) ইত্যাদি এই সকল স্থলেও 'তাঁহার ঔপাধিক সবিশেষতা প্রদর্শিত হইয়াছে।'
অতএব নির্বিশেষতা আত্মার যথার্থ স্বরূপ, সবিশেষতা উপাধিকৃত, ইহাই সিদ্ধ হয়।

Wednesday, 18 December 2019

শ্রীভগবানের 'জনার্দন' নাম মাহাত্ম্যঃ-


শ্রীমহাভারতের অনুশাসনপর্ব্বের 'বিষ্ণুসহস্রনাম স্তোত্রম্' এর শঙ্করাচার্য্যকৃত শাঙ্করভাষ্যে শ্রীভগবানের 'জনার্দন' নাম মাহাত্ম্য বর্ণিত আছে এইভাবে-
'জন অর্থাৎ দুর্জন ব্যক্তিকে যিনি অর্দিত করেন অর্থাৎ হিংসা করেন তিনি জনার্দন। অথবা দুর্জন ব্যক্তিকে যিনি নরক প্রভৃতিতে পাঠাইয়া দেন তিনি জনার্দন। অথবা জনগণ যাঁর কাছে অভ্যুদয় অর্থাৎ স্বর্গাদি এবং নিঃশ্রেয়স মোক্ষ যাচঞা করে তিনিই জনার্দন।'-(শঙ্করভাষ্য, বিষ্ণুসহস্রনাম ২৭)

Tuesday, 17 December 2019

'পঞ্চীকরণ সূত্রম্' (১-৮)


                                              

শঙ্করাচার্য্য বিরচিত 'পঞ্চীকরণ সূত্রম্' সুরেশ্বরাচার্য্যের বার্তিক সমেতঃ-
শ্রীশ্রীশঙ্করভগবৎ বিরচিতং সূত্রম্-'অথাতঃ পরমহংসানাং সমাধিবিধিং ব্যাখ্যাস্যামঃ।।১
ভাবার্থঃ- 'অথ' এই মাঙ্গলিক শব্দ উচ্চারণপূর্বক 'অতঃ' অর্থাৎ তত্ত্বজ্ঞানের উপযোগ্যতাহেতু, পরমহংসগণের সমাধিবিধি ব্যাখ্যা করব।
শ্রীমৎ শঙ্করভগবৎ পূজ্যপাদশিষ্য শ্রীমৎ সুরেশ্বরাচার্য্যের বার্তিকঃ- ॐকার সমস্ত বেদের সার এবং তত্ত্বজ্ঞানের প্রকাশক। সেই ॐকারের দ্বারা মুমুক্ষুগণের কিপ্রকারে চিত্ত সমাহিত হয়, তাই প্রকাশ করা হচ্ছে।১
আচার্য্য শ্রীশ্রীশঙ্করভগবৎ বিরচিতং সূত্রম্-
'সৎ-শব্দবাচ্যম্ অবিদ্যাশবলং ব্রহ্ম।।'২
ব্রহ্মণঃ অব্যক্তম্।।৩
ভাবার্থঃ- অবিদ্যা হয়েছে 'শবল' অর্থাৎ উপাধি যাঁর এমন যে ব্রহ্ম, তিনিই বিচার্য সৎ-শব্দবাচ্য।।২
ব্রহ্ম হতে অব্যক্ত প্রধান অর্থাৎ অব্যাকৃতা বিক্ষেপাবরণাত্মিকা মায়া উদ্ভূতা হয়েছেন।।৩

শ্রীমৎ শঙ্করভগবৎ পূজ্যপাদশিষ্য শ্রীমৎ সুরেশ্বরাচার্য্যের বার্তিকঃ-
সৃষ্টির পূর্বে নিত্যমুক্ত অবিক্রিয় এক পরংব্রহ্মই বর্তমান ছিলেন। সেই ব্রহ্মতে শক্তিভূতা এবং নিজেতেই (ব্রহ্মতেই) অধ্যস্তা যে মায়া, তাঁহার আধ্যাসিক তাদাত্মাহেতু অব্যাকৃতাত্মক অর্থাৎ অনভিব্যক্ত নামরূপাত্মক জগতের তিনিই ঈশ্বর নামধেয় বীজস্বরূপ অর্থাৎ উপাদান কারণ।
ব্যাখ্যাঃ-সুরেশ্বরাচার্য্যের বার্তিকের উপর শ্রীমৎ অভিনবনারায়ণেন্দ্র সরস্বতী বিরচিত আভরণম্ এ বর্ণিত আছে- এখানে ভগবান ভাষ্যকার শঙ্কর কর্তৃক অধ্যারোপ-অপবাদ-ন্যায়ের দ্বারা প্রত্যক্ অর্থৎ জীব সাক্ষিচৈতন্য ও ব্রহ্মচৈতন্যের অভেদ-প্রতিপত্তি-প্রকার দেখানোর জন্য অধিষ্ঠানব্রহ্মের বাস্তবরূপ এবং তাতে অধ্যারোপ্য প্রপঞ্চের সৃষ্টি সিদ্ধবৎ গ্রহণ করে, তাকে কেবল অধ্যারোপ মাত্র বলিয়াছেন। 'বস্তুতে অবস্তুর আরোপ অর্থাৎ ভ্রমের নাম অধ্যারোপ।'-(বেদান্ত সার ১৩) 'বস্তুবিবর্ত অবস্তু সকল মিথ্যা অর্থাৎ চিদাত্মাতে অজ্ঞানকল্পিত জগৎপ্রপঞ্চ সমস্তই মিথ্যা, চিদাত্মাই সত্য- এইরূপ প্রতিপাদনকে অর্থাৎ জড়-পদার্থের মিথ্যাত্ব অর্থাৎ কার্য্য সকল মিথ্যা, কারণই সত্য-এইরূপ দেখানোকে অপবাদ বলে।-(বেদান্ত সার ৬০)
বার্তিকাচার্য্য সুরেশ্বরও প্রথমে জগদধ্যারোপের পূর্বে অবস্থিত অধিষ্ঠানভূত আত্মস্বরূপ সম্বন্ধে বলিতেছেন-'সৃষ্টির পূর্বে নিত্যমুক্ত অবিক্রিয় এক পরংব্রহ্মই বর্তমান ছিলেন।'অর্থাৎ ব্রহ্ম দেশকালরূপ বস্তুপরিচ্ছেদশূন্য, অতএব সৃষ্টিরপূর্বে এক সজাতীয় বিজাতীয়-স্বগতভেদশূন্য পরম অর্থাৎ পরমানন্দস্বরূপ, নিত্যমূক্ত, ত্রিকালেই সর্ব অনর্থরূপ প্রপঞ্চসম্বন্ধশূন্য সচ্চিদানন্দত্মক পরংব্রহ্মই বর্তমান ছিলেন।
শ্রুতিও তাই বলিতেছেন -'সদেব সোম্যেদমগ্র আসীদেকমেবাদ্বিতীয়ম্'- (ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৬/২/১)।
‘হে প্রিয়দর্শন, এই জগৎ উৎপত্তির পূর্ব্বে এক অদ্বিতীয় সৎ রূপেই বিদ্যমান ছিল।

এইরূপ অন্যস্থলেও শ্রুতি বলিতেছে-
'আত্মা বা ইদমেক এবাগ্র আসীত্৷ নান্যৎ কিঞ্চন মিষত্৷-(ঐতরেয় উপনিষৎ-১/১/১)
ইহা অর্থাৎ এই জগৎ উৎপত্তির পূর্ব্বে একমাত্র আত্মস্বরূপেই বিদ্যমান ছিল, ব্যাপারবান্ অন্য কিছুই ছিল না।

'বিজ্ঞানমানন্দং ব্রহ্ম'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৩/৯/২৮)।
অর্থাৎ ব্রহ্ম বিজ্ঞান ও আনন্দস্বরূপ।

'সত্যং জ্ঞানমনন্তং ব্রহ্ম'(তৈত্তিরীয় উপনিষৎ-২/১/১)
অর্থাৎ ব্রহ্ম সত্য জ্ঞান ও অনন্তস্বরূপ।

ইত্যাদি শ্রুতিহেতু এইরূপ অর্থ। যদিও দেশকালাতীত অদ্বিতীয়ের সহিত 'ছিলেন'-রূপ কালসম্বন্ধ যুক্তিযুক্ত হয় না, তথাপি শ্রোতাদের বুঝিবার সুবিধার জন্য ব্রহ্মে কালসম্বন্ধ আরোপ করে শ্রুতি উপদেশ করিতেছেন-এইরূপ বুঝিতে হইবে।
জগদুপাদান ব্রহ্মের কালত্রয়ের সহিত সম্বন্ধশূন্য কেন? তা সুরেশ্বর আচার্য্য বার্তিকে 'অবিক্রিয়ম্' অর্থাৎ অবিকারী ইত্যাদি পদের দ্বারা স্পষ্ট করিয়াছেন। বৃহদারণ্যক শ্রুতিও তাই বলছেন-''স বা এষ মহানজ আত্মাজরোমরোমৃতোভযো ব্রহ্ম'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪/৪/২৫) অর্থাৎ সেই এই মহান ও জন্মরহিত আত্মাই জরাবিহীন-অবিনাশী অমৃতস্বরূপ অভয়স্বরূপ ও নিরতিশয় মহান।'
ব্রহ্মের নিরবয়বত্ব ও বিভুত্বহেতু তাতে পরিণাম ও পরিস্পন্দন অসম্ভব বলিয়া ব্রহ্মের উপাদানত্বও নাই অর্থাৎ স্বীকৃত হয় না। তাহলে 'আত্মান আকাশঃ সম্ভূতঃ'-(তৈত্তিরীয় উপনিষৎ-২/১) অর্থাৎ 'আত্মা থেকে আকাশ হয়েছিল।', 'তৎ তেজোহসৃজত'-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৬/২/৩) অর্থাৎ 'তাহা হইতে তেজ সৃষ্টি হইয়াছিল।' ইত্যাদি শ্রুতিসকল হইতে যে ব্রহ্মের উপাদানত্ব-অভিধান পাওয়া যায়, তাহা কেমন করে সিদ্ধ হয়?
উত্তর হইল- 'তত্ত্বের অন্যথাভাবলক্ষণ' পরিণাম অর্থাৎ যেমন মৃত্তিকারূপ তত্ত্বটি হইতে ঘটের উৎপত্তি হয়, তখন ঘট অন্য প্রকারতা ধর্ম্ম বিশিষ্ট হইলেও তাহাতে তত্ত্ব বা কারণ মৃত্তিকা বর্তমান থাকে, এইভাবে পরিণামরূপ ব্রহ্মের জগৎকার্য্যত্ব সম্বন্ধে উপাদানত্ব হওয়া অসম্ভব হওয়ায়, ব্রহ্মের 'অতত্ত্বতঃ অন্যথালক্ষণ'-বিবর্ত অর্থাৎ শুক্তিতে যখন রজতভ্রান্তি হয়, তখন রজতরূপ মিথ্যা প্রতীতিটির সহিত তত্ত্বরূপ অর্থাৎ কারণরূপ শুক্তি ত্রিকালে পৃথক্ থাকেই, ঐ মিথ্যা প্রত্যয়ের অধিষ্ঠান হওয়ারূপ বিবর্ত-উপাদনত্ব সম্ভব হয়, এইজন্য সুরেশ্বর আচার্য্য বার্তিকে বলেছেন-'সেই ব্রহ্ম নিজ মায়া' ইত্যাদি। সেই ব্রহ্মতে শক্তিভূতা এবং নিজেতেই (ব্রহ্মতেই) অধ্যস্তা যে মায়া, তাঁহার আধ্যাসিক তাদাত্ম্য হইয়া থাকে, সেইজন্য ব্রহ্মকে বীজ বা উপাদান বলা যাইতে পারে। যেহেতু শুক্তি প্রভৃতির স্বরূপ বিকৃত না হইয়াই মিথ্যা-রজতাদির উপাদানত্ব অর্থাৎ আধ্যাসিক কারণত্ব দেখা যায়। অবিক্রিয় ব্রহ্মের জগদ্ বিবর্তের উপাদানত্ব অবিরুদ্ধ এইরূপ অর্থ।
(টীকাঃ- 'সতত্ত্বতোহন্যথা প্রথা বিকার ইত্যুদীরিতঃ। অতত্ত্বতোহন্যথা প্রথা বিবর্ত ইত্যুদাহৃতঃ।।'-(বেদান্ত সার ৬০)
অর্থাৎ যে কারণ স্বরূপ হইতে চ্যুত হয়ে কার্য্য উৎপন্ন করে তা বিকাররূপ কার্য্য; যেমন দুগ্ধ দধি হয়। আর যে কারণটি স্বরূপ হতে চ্যুত না হয়ে কার্য্য উৎপন্ন করে সেই কার্য্যের নাম বিবর্ত। যেমন রজ্জু সর্প হয়।
তাছাড়া আচার্য্য গৌড়পাদ মাণ্ডুক্যকারিকায় বলিতেছেন-
অনিশ্চিতা য়থা রজ্জুরন্ধকারে বিকল্পিতা ।
সর্পধারাদিভির্ভাবৈস্তদ্বদাত্মা বিকল্পিতঃ ॥ মাণ্ডুক্যকারিকা-২।১৭।।
অর্থাৎ অজ্ঞাত রজ্জু যেমন সর্পরূপে প্রতীতির হেতু, অজ্ঞাত নির্বিশেষ ব্রহ্মই তদ্রূপ জগৎরূপে প্রতীতির হেতু।)

আবার সেই নিত্যমুক্ত ব্রহ্মে উৎপত্তির পূর্ব্বে জগতের সুক্ষ্মরূপে অবস্থান অসম্ভব বলিয়া কি করে ব্রহ্মে জগদ্ বীজত্বের প্রতিষ্ঠা করা যায়?
তাই পূজ্যপাদ সুরেশ্বরাচার্য্য বার্তিকে বলিতেছেন-অব্যাকৃতাত্মক অর্থাৎ অনভিব্যক্ত নামরূপাত্মক জগতের তিনিই ঈশ্বর নামধেয় বীজস্বরূপ অর্থাৎ উপাদান কারণ।
স্বতঃসিদ্ধ নিত্যমুক্ত ব্রহ্মের সুক্ষ্মজগৎরূপ কার্য্যের আশ্রয়ত্ব অসম্ভব হইলেও তদাশ্রিত মায়াতে তাহা সম্ভব হওয়ায়, সেই অব্যাকৃতাত্মক অর্থাৎ অনভিব্যক্ত নামরূপাত্মক জগদাশ্রয় মূল মায়ার দ্বারা (শক্তি-শক্তিমানের আধ্যাসিক তাদাত্ম্য সম্বন্ধে এবং শ্রুতিতে 'সেই এই জগৎ অব্যাকৃতরূপে ছিল'-এইরূপ উপদেশ থাকায়, ব্রক্ষকেও অব্যাকৃতাত্মক
অর্থাৎ অনভিব্যক্ত নামরূপাত্মক জগদাশ্রয় বলা চলে।

(টীকাঃস্বতঃসিদ্ধ বিষয়ে টীকা হইল-'স্বস্য সত্তায়াঃ স্বত এব প্রমাণম্।' যো বেত্তি বিশ্বং ন চ তস্য বেত্তা'(শ্বেতাশ্বতর উপনিষৎ ৩।১৯)-অজ্ঞানবোধিনী।
অর্থাৎ নিজের সত্তার তুমি নিজেই প্রমাণ। যিনি সমগ্র বিশ্বকে জানেন, তাঁহার বেত্তা কেউ নাই।)
অতএব ব্রহ্মের জগৎবীজত্ব যুক্তই হইল-এইরূপ অর্থ।

অনন্ত শ্রীমৎ শঙ্কর ভগবৎপূজ্যপাদ্ বিরচিত-

সূত্রম্- অব্যক্তাৎ মহৎ।।৪

ভাবার্থঃ-অব্যাকৃতা প্রকৃতি হতে মহৎতত্ত্বের উদ্ভব হয়। ৪

সূত্রম্- মহতোহহংকারঃ।। ৫

ভাবার্থঃ-মহৎ হতে অহংকারের উৎপত্তি। ৫

সূত্রম্- অহংকারাৎ পঞ্চতন্মাত্রাণি।।৬

ভাবার্থঃ-অহংকার হতে পঞ্চ তন্মাত্র।৬

সূত্রম্- পঞ্চতন্মাত্রেভ্যঃ পঞ্চমহাভূতানি।।৭

ভাবার্থঃ-পঞ্চ তম্মাত্র হতে পঞ্চ স্থূল ভূতের উৎপত্তি হয়।৭

সূত্রম্- পঞ্চমহাভূতেভ্যঃ অখিলং জগৎ।।৮

ভাবার্থঃ-পঞ্চীকৃত পঞ্চ মহাভূত সকল হতে অখিল জগৎ উৎপত্তি হয়।।৮

ভগবান্ শঙ্করাচার্যের শিষ্য শ্রীমৎ সুরেশ্বরাচার্যের বার্তিক- এই ভাবে ব্রহ্মের প্রপঞ্চ-উপাদানত্ব (উপাদান কারণত্ব) প্রতিপাদন করে, এখন তাঁতে জগতের অধ্যারোপ দেখাবার জন্য তা হতে সৃষ্টি - বিবরণ বলছেন-

সেই অব্যক্তা প্রকৃতি হতে (কর্ণেন্দ্রিয়ের শব্দোৎপাদক সর্বাপকৃষ্ট শব্দ-স্পন্দ-কণারূপ) শব্দতন্মাত্ররূপ আকাশ উৎপন্ন হয়েছে, তা হতে (ত্বগেন্দ্রিয়ের স্পর্শোৎপাদক সর্বাপকৃষ্ট স্পর্শ-স্পন্দ-কণারূপ) স্পর্শতন্মাত্রাত্মক বায়ু,তা হতে (চক্ষুরিন্দ্রিয়গ্রাহ্য রূপোৎপাদক সর্বাপকৃষ্ট রূপ-স্পন্দ-কণারূপ) রূপতন্মাত্রাত্মক তেজের উৎপত্তি হয়েছে।।৩।।

বার্তিক- সেই তেজঃ হতে ( রসনায় রসোৎপাদক রস- স্পন্দ-কণারূপ ) রসাত্মিকা আপ (জল) এবং সেই জল-সমূহ হতে (নাসিকায় গন্ধোৎপাদক গন্ধ-স্পন্দ-কণারূপ) গন্ধতন্মাত্র-গুণবিশিষ্ট মহীর উৎপত্তি হয়। আকাশের একটি মাত্র অসাধারণ গুণ শব্দ অর্থাৎ কর্ণেন্দ্রিয়-গ্রাহ্য ধ্বনির উৎপাদক সর্বাপকৃষ্ট স্পন্দ-কণা।।৪।।

পূর্বোক্তরূপে (অস্তিত্ব, অনিত্যত্ব), শব্দ, স্পর্শ, (সাধারণ) ও রূপ (বিশেষ) গুণহেতু তেজের তিনটি গুণ। (মতান্তরে রসাকর্ষণ, ঊর্ধ্ব গতি, বেগ এই গুণত্রয় বায়ু হতে প্রাপ্ত সাধারণ গুণও তেজের আছে)। তারপর (অস্তিত্ব, অনিত্যত্ব) শব্দ, স্পর্শ, রূপ (সাধারণ) ও রস (অসাধারণ) গুণহেতু আপের চারটি গুণ। (মতান্তরে দ্রবত্ব, স্নেহত্ব, স্যন্দনত্বও জলের বিশেষ গুণ )।।৫।।

এবং পূর্বোক্তরূপে (অস্তিত্ব, অনিত্যত্ব) শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস (সাধারণ) এবং গন্ধ (বিশেষ) গুণহেতু মহী-ভূত পঞ্চগুণ-বিশিষ্ট। (মতান্তরে কঠিনত্ব, ভস্মাবশেষত্ব ক্ষিতির অপর দুটি বিশেষ গুণ)। এই (মহদব্রহ্মাখ্য, যাতে সাক্ষিচৈতন্য প্রতিবিম্বরূপ গর্ভাধান করে থাকেন) পঞ্চ মূল অপঞ্চীকৃত ভূতে অভিমানহেতু চিদাভাসরূপ সূত্রাত্মা (প্রতিবিম্ববাদীদের চিৎপ্রতিবিম্ব) সম্ভূত হলেন; অর্থাৎ মহত্তত্ত্বাভিমানী, ব্যষ্টি-সমষ্টি লিঙ্গ যাঁর সূক্ষ্মশরীর, সর্ব ব্যষ্টি-লিঙ্গশরীরে ব্যাপ্ত বলে যিনি সর্বাত্মক এবং হিরণ্যোজ্জ্বল পঞ্চীকৃত স্থূল সৃষ্টির যিনি গর্ভস্বরূপ অথবা হিরণ্যোজ্জ্বল সত্ত্ব-প্রধান মহদ্-ব্রহ্মাখ্য প্রকৃতি যাঁর গর্ভস্থান, তাঁর উৎপত্তি হলো।।৬।।

সেই পঞ্চ মূল-ভূত হতে পাঁচটি স্থূলভূতের উৎপত্তি হয় এবং তা হতে ঐ সমষ্টি স্থূলভূতাভিমানী বিরাট্-পুরুষ উৎপন্ন হন। পন্ডিতগণকর্তৃক পঞ্চীকৃত ভূত সকলই স্থূলভূত বলে কথিত হয়।।৭।।........

Wednesday, 11 December 2019

ব্রাহ্মীশ্রী প্রাপ্তির ছয়টি উপায়ঃ-



মানসম্বন্ধী বিষয়ে সর্বদা রত থাকিলে লৌকিক ঐশ্বর্যশ্রী প্রাপ্তি হয় বটে, কিন্তু সর্ব্বগুণ ও রূপবিহীন নিত্য চিদ্ঘন আনন্দস্বরূপ পরমশুদ্ধা ব্রাহ্মীশ্রী প্রাপ্তির উপায় বিষয়ে শ্রীমহাভারতের উদ্যোগপর্বের দ্বি-চত্বারিংশোহধ্যায়ের সনৎ-সুজাতীয় সম্বাদে পরমপ্রাচীন সনাতন ঋষি ভগবান সনৎ-সুজাত বলিতেছেন-
'দ্বারাণি সম্যক্ প্রবদন্তি সন্তো বহুপ্রকারাণি দুরাচরাণি।
সত্যার্জবে হ্রীর্দম শৌচ বিদ্যাঃ ষন্মান মোহ প্রতিবন্ধকানি।।৪৩।।

ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য্যের শাঙ্করভাষ্য অনুসারে ভাবার্থঃ- মান ও মোহের প্রতিবন্ধক অর্থাৎ বিনাশক সত্য তথা যথার্থ ভাষণ, আর্জব অর্থাৎ অকুটিলতা, হ্রী অর্থাৎ অন্যায় কার্য্য প্রবৃত্তিতে লজ্জা, দম অর্থাৎ অন্তরিন্দ্রিয় ও বহিরিন্দ্রিয় নিগ্রহ, শৌচ অর্থাৎ মলিনতা মার্জ্জন তথা বাহ্য মলিনতা মৃজ্জলাদি সহায়ে ও আন্তরমালিন্য চিত্তশুদ্ধির সাধনাভ্যাস দ্বারা ও ব্রহ্মবিদ্যা- বহুপ্রকার কষ্টসাধ্য সাধনের মধ্যে এই ছয়টিকে তত্ত্ববিদ্ সজ্জনগণ ব্রাহ্মীশ্রী অর্থাৎ মোক্ষস্বরূপের প্রবেশদ্বার রূপে বর্ণন করিয়া থাকেন। ৪৩

Friday, 6 December 2019

শ্রুতি ও স্মৃতিশাস্ত্রে দ্বৈতপ্রপঞ্চ নিষেধের দ্বারা উপদিষ্ট হওয়ায় ব্রহ্ম নির্বিশেষঃ-




শ্রুতি বলিতেছেন ব্রহ্ম চৈতন্যমাত্র, অন্য বিশেষ রূপরহিত এবং নির্বিশেষ, যথাঃ' যথা সৈন্ধবঘনোনন্তরোবাহ্যঃ কৃৎস্নো রসঘন এবৈবং বা অরেযমাত্মানন্তরোবাহ্যঃ কৃৎস্নঃ প্রজ্ঞানঘন এব'-(বৃহদারণ্যক উপনিষদ্ ৪।৫।১৩)

'সৈন্ধবঘন অর্থাৎ লবণপিণ্ড যেমন অন্তরশূন্য বাহ্যশূন্য অর্থাৎ বাহিরে ভিতরে সর্ব্বত্রই অন্য রসবর্জ্জিত, সমগ্রভাবে রসঘনই অর্থাৎ লবণৈকরসই; এইরূপ প্রিয়ে, এই আত্মা অন্তর্বহির্ভেদশূন্য সমগ্রভাবে চৈতন্যমাত্রস্বরূপই।'

কিন্তু সবিশেষ লবণপিণ্ড দৃষ্টান্তরূপে গৃহীত হওয়ায় দার্ষ্টান্তিক ব্রহ্মও সবিশেষ হইবেন। তদুত্তরে বলিতেছেনইহাই কথিত হইতেছে-এই আত্মার ভিতরে বাহিরে চৈতন্য হইতে ভিন্ন কোনরূপ নাই, একমাত্র চৈতন্যই কিন্তু ইঁহার নিরন্তর নিরবচ্ছিন্ন স্বরূপ। যেমন লবণ পিণ্ডের বাহিরে ভিতরে লবণরসই নিরবচ্ছিন্নভাবে বর্ত্তমান থাকে, অন্য রস থাকে না, সেইপ্রকারই; ইহাই ভাব। আর নির্বিশেষ হওয়ায় অনাত্মরূপের প্রতিষেধদ্বারাই শ্রুতি ব্রহ্মকে প্রদর্শন করিতেছেন, যথাঃ-

'অথাত আদেশো নেতি নেতি'-(বৃহদারণ্যক উপনিষদ্ ২।৩।৬)

'অনন্তর সত্যের স্বরূপ নির্দ্ধারণের পর, যেহেতু সত্যের সত্যব্রহ্ম অবশিষ্ট আছেন এইহেতু তাঁহার স্বরূপ নির্দ্ধারণের জন্য নেতি নেতি অর্থাৎ ইহা নহে ইহা নহে-ইহাই নির্দ্দেশ।'

'অন্যদেব তদ্বিদিতাদথো অবিদিতাদধি'-(কেন উপনিষদ্ ১।৩)

'তিনি জ্ঞাতবস্তু হইতে অবশ্যই ভিন্ন, আবার অজ্ঞাতবস্তু হইতেও ভিন্ন।'

'যতো বাচো নিবর্তন্তে অপ্রাপ্য মনসা সহ'-(তৈত্তিরীয় উপনিষদ্ ২।৪।১)

'যাঁহাকে প্রাপ্ত না হইয়া মনের সহিত বাগিন্দ্রিয় যাঁহা হইতে ফিরিয়া আসে', ইত্যাদি এইসকল শ্রুতি।

আবার বাষ্কলি কর্ত্তৃক জিজ্ঞাসিত হইয়া বাধ্ব অবচনের দ্বারাই অর্থাৎ কিছু না বলিয়াই ব্রহ্মবিষয়ে বলিয়াছিলেন ইহা শ্রুতিতে বর্ণিত হইতেছে, যথা-'তিনি অর্থাৎ বাষ্কলি বলিয়াছিলেন-'হে ভগবান, ব্রহ্মবিষয়ে উপদেশ করুন, তিনি অর্থাৎ বাধ্ব নিরুত্তর ছিলেন, দ্বিতীয় অথবা তৃতীয়বার জিজ্ঞাসিত হইলে বাধ্ব বাষ্কলিকে বলিয়াছিলেন-আমি বলিতেছি, তুমি কিন্তু বুঝিতে পারিতেছ না, এই আত্মা উপশান্ত অর্থাৎ দ্বৈতভাববিবর্জ্জিত' ইত্যাদি। এইপ্রকারে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাতে বর্ণিত আছে

'জ্ঞেয়ং যত্তত্প্রবক্ষ্যামি যজ্জ্ঞাত্বামৃতমশ্নুতে৷ অনাদিমত্পরং ব্রহ্ম সত্তন্নাসদুচ্যতে'-(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা-১৩।১২)

'যাহা জ্ঞেয়, তাহা তোমাকে বলিব, যাঁহাকে জানিয়া অমৃতত্ব লব্ধ হয়। তাহা এই অনাদি মৎপর অর্থাৎ আমা হইতে শ্রেষ্ঠ, আমার নির্বিশেষস্বরূপ ব্রহ্ম সদ্ রূপে অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যরূপে কথিত হন না, অসদ্ রূপে কথিত হন না।' ইত্যাদি এইসকল স্মৃতিশাস্ত্রেও অনাত্মরূপের প্রতিষেধ দ্বারাই ব্রহ্ম উপদিষ্ট হইতেছেন'।

এইরূপে বিশ্বরূপধারী নারায়ণ নারদকে বলিয়াছিলেন

'মায়া হ্যেষা ময়া সৃষ্টা যন্মাং পশ্যসি নারদ সর্বভূতগুণৈর্যুক্তং নৈবং মাং জ্ঞাতুমর্হসি।'

-(মহাভারত, শান্তিপর্ব্ব, ৩৩৯।৪৫-৪৬)

'হে নারদ, সর্ব্বভূতের গুণের দ্বারা অর্থাৎ জনকত্ব পালকত্বাদিরূপ সকল প্রাণীর গুণের দ্বারা, অথবা পৃথিব্যাদি ভূতের গুণ দিব্য গন্ধাদি দ্বারা যুক্ত এই যে আমাকে দর্শন করিতেছ, ইহা মৎকর্ত্তৃক সৃষ্টা অর্থাৎ অস্মদধিষ্ঠানে অভিব্যক্তা মায়া, এই প্রকারে তুমি আমার যথার্থস্বরূপ জানিতে পারিবে না, কারণ আমি বস্তুতঃ দ্বৈতাতীত।' ইত্যাদি স্মৃতিশাস্ত্রে বর্ণিত হইতেছে।....

তথ্যসূত্রঃ- ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্যের শারীরক-মীমাংসা ভাষ্য। (ব্রহ্মসূত্র //১৬, ১৭ শাঙ্করভাষ্য দ্রষ্টব্য)

শ্রীশুভ চৌধুরী

ডিসেম্বর , ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দ।

আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...