শ্রুতি বলিতেছেন ব্রহ্ম চৈতন্যমাত্র, অন্য বিশেষ রূপরহিত এবং নির্বিশেষ, যথাঃ- 'স যথা সৈন্ধবঘনোনন্তরোবাহ্যঃ কৃৎস্নো রসঘন এবৈবং বা অরেযমাত্মানন্তরোবাহ্যঃ কৃৎস্নঃ প্রজ্ঞানঘন এব'-(বৃহদারণ্যক উপনিষদ্ ৪।৫।১৩)
'সৈন্ধবঘন অর্থাৎ লবণপিণ্ড যেমন অন্তরশূন্য ও বাহ্যশূন্য অর্থাৎ বাহিরে ও ভিতরে সর্ব্বত্রই অন্য রসবর্জ্জিত, সমগ্রভাবে রসঘনই অর্থাৎ লবণৈকরসই; এইরূপ প্রিয়ে, এই আত্মা অন্তর্বহির্ভেদশূন্য সমগ্রভাবে চৈতন্যমাত্রস্বরূপই।'
কিন্তু সবিশেষ লবণপিণ্ড দৃষ্টান্তরূপে গৃহীত হওয়ায় দার্ষ্টান্তিক ব্রহ্মও সবিশেষ হইবেন। তদুত্তরে বলিতেছেন— ইহাই কথিত হইতেছে-এই আত্মার ভিতরে ও বাহিরে চৈতন্য হইতে ভিন্ন কোনরূপ নাই, একমাত্র চৈতন্যই কিন্তু ইঁহার নিরন্তর নিরবচ্ছিন্ন স্বরূপ। যেমন লবণ পিণ্ডের বাহিরে ও ভিতরে লবণরসই নিরবচ্ছিন্নভাবে বর্ত্তমান থাকে, অন্য রস থাকে না, সেইপ্রকারই; ইহাই ভাব। আর নির্বিশেষ হওয়ায় অনাত্মরূপের প্রতিষেধদ্বারাই শ্রুতি ব্রহ্মকে প্রদর্শন করিতেছেন, যথাঃ-
'অথাত আদেশো
নেতি নেতি'-(বৃহদারণ্যক উপনিষদ্ ২।৩।৬)
'অনন্তর সত্যের স্বরূপ নির্দ্ধারণের পর, যেহেতু সত্যের সত্যব্রহ্ম অবশিষ্ট আছেন এইহেতু তাঁহার স্বরূপ নির্দ্ধারণের জন্য নেতি নেতি অর্থাৎ ইহা নহে ইহা নহে-ইহাই নির্দ্দেশ।'
'অন্যদেব তদ্বিদিতাদথো
অবিদিতাদধি'-(কেন উপনিষদ্ ১।৩)
'তিনি জ্ঞাতবস্তু হইতে অবশ্যই ভিন্ন, আবার অজ্ঞাতবস্তু হইতেও ভিন্ন।'
'যতো বাচো
নিবর্তন্তে অপ্রাপ্য মনসা সহ'-(তৈত্তিরীয় উপনিষদ্ ২।৪।১)
'যাঁহাকে প্রাপ্ত না হইয়া মনের সহিত বাগিন্দ্রিয় যাঁহা হইতে ফিরিয়া আসে', ইত্যাদি এইসকল শ্রুতি।
আবার বাষ্কলি কর্ত্তৃক জিজ্ঞাসিত হইয়া বাধ্ব অবচনের দ্বারাই অর্থাৎ কিছু না বলিয়াই ব্রহ্মবিষয়ে বলিয়াছিলেন ইহা শ্রুতিতে বর্ণিত হইতেছে, যথা-'তিনি অর্থাৎ বাষ্কলি বলিয়াছিলেন-'হে ভগবান, ব্রহ্মবিষয়ে উপদেশ করুন, তিনি অর্থাৎ বাধ্ব নিরুত্তর ছিলেন, দ্বিতীয় অথবা তৃতীয়বার জিজ্ঞাসিত হইলে বাধ্ব বাষ্কলিকে বলিয়াছিলেন-আমি বলিতেছি, তুমি কিন্তু বুঝিতে পারিতেছ না, এই আত্মা উপশান্ত অর্থাৎ দ্বৈতভাববিবর্জ্জিত' ইত্যাদি। এইপ্রকারে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাতে বর্ণিত আছে—
'জ্ঞেয়ং যত্তত্প্রবক্ষ্যামি যজ্জ্ঞাত্বামৃতমশ্নুতে৷ অনাদিমত্পরং ব্রহ্ম ন সত্তন্নাসদুচ্যতে'-(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা-১৩।১২)
'যাহা জ্ঞেয়, তাহা তোমাকে বলিব, যাঁহাকে জানিয়া অমৃতত্ব লব্ধ হয়। তাহা এই অনাদি ও মৎপর অর্থাৎ আমা হইতে শ্রেষ্ঠ, আমার নির্বিশেষস্বরূপ ব্রহ্ম সদ্ রূপে অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যরূপে কথিত হন না, অসদ্ রূপে কথিত হন না।' ইত্যাদি এইসকল স্মৃতিশাস্ত্রেও অনাত্মরূপের প্রতিষেধ দ্বারাই ব্রহ্ম উপদিষ্ট হইতেছেন'।
এইরূপে
বিশ্বরূপধারী নারায়ণ নারদকে বলিয়াছিলেন—
'মায়া হ্যেষা
ময়া সৃষ্টা যন্মাং পশ্যসি নারদ ৷ সর্বভূতগুণৈর্যুক্তং নৈবং মাং
জ্ঞাতুমর্হসি।'
-(মহাভারত, শান্তিপর্ব্ব, ৩৩৯।৪৫-৪৬)
'হে নারদ, সর্ব্বভূতের গুণের দ্বারা অর্থাৎ জনকত্ব ও পালকত্বাদিরূপ সকল প্রাণীর গুণের দ্বারা, অথবা পৃথিব্যাদি ভূতের গুণ দিব্য গন্ধাদি দ্বারা যুক্ত এই যে আমাকে দর্শন করিতেছ, ইহা মৎকর্ত্তৃক সৃষ্টা অর্থাৎ অস্মদধিষ্ঠানে অভিব্যক্তা মায়া, এই প্রকারে তুমি আমার যথার্থস্বরূপ জানিতে পারিবে না, কারণ আমি বস্তুতঃ দ্বৈতাতীত।' ইত্যাদি স্মৃতিশাস্ত্রে বর্ণিত হইতেছে।....
তথ্যসূত্রঃ- ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্যের শারীরক-মীমাংসা ভাষ্য। (ব্রহ্মসূত্র ৩/২/১৬, ১৭ শাঙ্করভাষ্য দ্রষ্টব্য)
শ্রীশুভ
চৌধুরী
ডিসেম্বর
৬, ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দ।
No comments:
Post a Comment