Saturday, 30 May 2020

সেই ব্রহ্ম জ্ঞাত বস্তু হইতে ভিন্নই, আবার অজ্ঞাত বস্তু হইতেও ভিন্নঃ-


সামবেদের তলবকার ব্রাহ্মণের অন্তর্গত কেন উপনিষদে বর্ণিত আছে-
....অন্যদেব তদ্বিদিতাদথো অবিদিতাদধি ৷ ইতি শুশ্রুম পূর্বেষাং যে নস্তদ্ব্যাচচক্ষিরে ৷- (কেন উপনিষৎ ১।৩)

শঙ্করাচার্য্যের 'শাঙ্করভাষ্য' অনুসারে ভাবার্থঃ- ইহা ঠিক যে প্রত্যক্ষাদি প্রমাণের দ্বারা অপরকে (ব্রহ্ম) বুঝানো যায় না; কিন্তু উপদেশ পরম্পরা দ্বারা ব্রহ্মকে বুঝাইতে পারা যায় বলিয়া ব্রহ্মের উপদেশের জন্য পরম্পরাবাক্য বলিতেছেন-'সেই ব্রহ্ম বিদিত ও অবিদিত হইতে ভিন্ন।'অর্থাৎ যাঁহার এই প্রকরণ তিনি অন্যই অর্থাৎ পৃথকই, সেই যাঁহাকে শ্রোত্রাদি ইন্দ্রিয়সকলের অবিষয় বলা হইয়াছে, তিনি জ্ঞাতবস্তু হইতে পৃথকই।
বিদিতবস্তু অর্থাৎ বিদিক্রিয়ার (অন্তঃকরণবৃত্তিজনিত জ্ঞানক্রিয়ার) দ্বারা যাহা সম্যগ্ রূপে প্রাপ্ত হওয়া যায়, বিদিক্রিয়ার কর্ম্মস্বরূপ নামরূপাত্মক বস্তু মাত্রই কোথাও কিয়দংশেও, কাহারও জ্ঞাত হয় বলিয়া সমস্ত ব্যাকৃত (নামরূপে অভিব্যক্ত) বস্তুমাত্রই বিদিত; আর ব্রহ্ম সেই বিদিত বস্তু হইতে পৃথক-ইহাই তাৎপর্য্য। ইনি অবিদিত অর্থাৎ বিদিতের বিপরীত অর্থাৎ ব্যক্তপদার্থের কারণস্বরূপ অজ্ঞানরূপ অব্যক্ত হইতেও ভিন্ন।
আর যে বস্তু বিদিত হয়, তাহা অল্প, বিনাশশীল এবং দুঃখাত্মক হয় বলিয়া হেয় বা পরিত্যাজ্য হয়-যেহেতু সেই ব্রহ্ম বিদিত বস্তু হইতে ভিন্ন তাই অপরিত্যাজ্য। আবার ব্রহ্ম অবিদিত হইতে ভিন্ন বলিলে ব্রহ্মের অনুপাদেয়ত্ব অর্থাৎ অগ্রাহ্যতা প্রতিপাদিত হইয়া যায়। কার্য্যসম্পাদনের জন্য কোন কর্তার দ্বারা নিজ হইতে ভিন্ন কোন কারণ বা সাধন সংগৃহীত হয়। কিন্তু জ্ঞাতার নিজ ভিন্ন আর কোন বস্তু গ্রহণযোগ্য হয় না।
এই প্রকার 'বিদিত ও অবিদিত হইতে ভিন্ন।'-এই উক্তির দ্বারা পরিত্যাজ্য ও গ্রাহ্যের নিষেধ করার ফলে (জ্ঞেয়বস্তু) নিজ আত্মার সহিত এক হইয়া যাওয়াতে ব্রহ্মবিষয়ক জিজ্ঞাসার নিবৃত্তি হইয়া যায়। আর যেহেতু, নিজ আত্মা হইতে ভিন্নকোন বস্তুরই বিদিত ও অবিদিত এই উভয় হইতে ভিন্ন হওয়া সম্ভব হয় না, অতএব 'অয়মাত্মা ব্রহ্ম'-(মাণ্ডুক্য উপনিষৎ ২) অর্থাৎ 'প্রত্যাগাত্মাই ব্রহ্ম'-ইহাই 'অন্য দেব' ইত্যাদি বাক্যের তাৎপর্য্য।
'য আত্মাপহতপাপ্মা'-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৮।৭।১)
অর্থাৎ 'যে আত্মা পাপ-পূণ্যরহিত।'

'যত্সাক্ষাদপরোক্ষাদ্ব্রহ্ম'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৩।৪।১)
অর্থাৎ 'যিনি সাক্ষাৎ অপরোক্ষ তিনি ব্রহ্ম।'

তাছাড়া 'যিনি সকলের অন্তর্নিহিত পরমাত্মা' ইতাদি অপরসকল শ্রুতি হইতেও এই কথা প্রতিপাদিত হয়।
এইভাবে সর্বাত্মনঃ সর্ববিশেষরহিত চিন্মাত্র জ্যোতিঃস্বরূপ ব্রহ্মত্ব প্রতিপাদক বাক্যার্থ যে আচার্য্য উপদেশ পরম্পরায় প্রাপ্ত হওয়া যায় তাহা 'ইতি শুশ্রুম' ইত্যাদি বাক্যে গুরু শিষ্যকে বলিতেছেন৷ ব্রহ্মকে আচার্য্য উপদেশ পরম্পরাক্রমেই জানিতে হইবে, তর্কদ্বারা, প্রবচন, মেধা, বহুশ্রুত, তপোযজ্ঞাদি দ্বারা তাঁহাকে জানা যায় না- এই প্রকার আমরা পূর্ববর্তী আচার্য্যগণের উপদেশ শুনিয়াছি, যে আচার্য্যগণ আমাদিগকে স্পষ্টভাবে ব্রহ্মতত্ত্বের ব্যখ্যা বলিতেন।
ইতি ভাষ্যানুবাদ।

Friday, 29 May 2020

ব্রহ্মই জগতের অভিন্ন নিমিত্তোপাদানঃ-


মায়াধীশ পরমেশ্বরই জগতের নিমিত্তকারণ। ঈশ্বরের অধ্যক্ষতায়ই মায়ার বিকাশ হইয়া থাকে এবং এই মায়ার সহায়তায় তিনি চরাচর জগতের সৃষ্টি করিয়া থাকেন। নির্বিশেষ পরব্রহ্ম মায়ার এবং মায়িক নাম-রূপ প্রপঞ্চের একমাত্র অধিষ্ঠান বা আশ্রয়। এক ব্রহ্মই বহু হইয়াছেন, বহু নামে বহু রূপে প্রতিভাত হইতেছেন। তাঁহার এই ভাতি বা প্রকাশের দ্বারা তিনি কিছুমাত্র রূপান্তরিত বা বিকৃত হন নাই, সম্পূর্ণ অবিকারী ভাবেই অজ্ঞানলীলার ভিত্তিরূপে বিরাজ করিতেছেন। ব্রহ্ম-ভিত্তি সদা বিদ্যমান আছে বলিয়াই মায়ার এরূপ বিচিত্র খেলা চলিতেছে এবং মায়িক জগৎ সত্য বলিয়া বোধ হইতেছে। এই অবিকারী কূটস্থ ব্রহ্মই জড় জগতের অপরিণামী উপাদান বা বিবর্ত কারণ। এই অপরিণামী উপাদানকারণকে আশ্রয় করিয়া অনির্বচনীয় অবিদ্যা বিবিধ অনির্বচনীয় নামরূপে পরিণত হইতেছে, সুতরাং অবিদ্যা জড়জগতের পরিণামী উপাদান।

ব্রহ্ম কেবল জগতের নিমিত্তকারণই নহেন। তিনি নিমিত্তকারণও বটেন, উপাদানকারণও বটেন। ইহাই ভগবান্ সূত্রকার এবং ভাষ্যকার স্পষ্টবাক্যে আমাদিগকে বলিয়া দিয়াছেন। যথা'প্রকৃতিশ্চ প্রতিজ্ঞাদৃষ্টান্তানুপরোধাৎ।'-(ব্রহ্মসূত্র-..২৩) প্রকৃতিশ্চ উপাদানকারণঞ্চ ব্রহ্ম অভ্যুপগন্তব্যং নিমিত্তকারণঞ্চ। কেবলং নিমিত্তকারণমেব (ব্রহ্মসূত্র, শঙ্করভাষ্য-১।৪।২৩) কারণ যেহেতু প্রতিজ্ঞা দৃষ্টান্তের সঙ্কোচ হয় না। ভাষ্যকার ভগবান্ শঙ্করাচার্য তাঁহার উক্ত সিদ্ধান্তের অনুকূলে শ্রুতিকেই প্রধান অবলম্বন হিসাবে গ্রহণ করিয়াছেন। প্রতিজ্ঞা এই প্রকার'উত তমাদেশমপ্রাক্ষ্যো যেনাশ্রুতং শ্রুতং ভবত্যমতং মতমবিজ্ঞাতং বিজ্ঞাতম্'-(ছান্দোগ্য উপনিষদ্-৬।১।২) বেদান্তে এক ব্রহ্মকে জানিলেই বিশ্বের তাবৎ বস্তু জানা যায় বলিয়া (এক-বিজ্ঞানে সর্ব-বিজ্ঞান-প্ৰতিজ্ঞা) যে সিদ্ধান্ত করা হইয়াছে, ঐরূপ সিদ্ধান্ত ব্রহ্মকে উপাদানকারণরূপে গ্রহণ করিলেই সম্ভবপর হয়, নতুবা হয় না। কেননা, এক উপাদানকে জানিলেই উপাদানের বিবিধ বিকারকে জানা যায়। কারণ, বিকারগুলি উপাদানেরই অবস্থান্তরমাত্র।

আর দৃষ্টান্ত এই প্রকার'যথা সোম্যৈকেন মৃৎপিণ্ডেন সর্বং মৃন্ময়ং বিজ্ঞাতং স্যাদ্বাচারম্ভণং বিকারো নামধেয়ং মৃত্তিকেত্যেব সত্যম্'-(ছান্দোগ্য উপনিষদ্-৬।১।৪)

অর্থাৎ হে সোম্য, যেমন একটী মৃৎপিণ্ডের সমস্ত মৃন্ময় বস্তু বিজ্ঞাত হয়, কারণ যা বিকার (—কার্য্যবস্তু), তা বাগবলম্বনে অবস্থিত নাম মাত্র। কেবল মৃত্তিকাই সত্য", ইত্যাদি দৃষ্টান্তও উপাদানকারণ বিষয়েই পঠিত হইতেছে।

কিন্তু কোন হেতুবশতঃ আত্মার নিমিত্তকারণতা উপাদানকারণতা সিদ্ধ হয়? ভগবান সূত্রকার বলিতেছেন'অভিধ্যোপদেশাচ্চ৷'-(ব্রহ্মসূত্র ..২৪) ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য্য শারীরকভাষ্যে বলিতেছেনঅভিধ্যানের অর্থাৎ ভাবী সৃষ্টিবিষয়ক সঙ্কল্পের উপদেশও আত্মার নিমিত্তকারণতা উপাদানকারণতা জ্ঞাপন করিতেছে, যথা

'সোকাময়ত বহু স্যাং প্রজায়েয়'-(তৈত্তিরীয় উপনিষৎ ২।৬)

অর্থাৎ তিনি কামনা করিয়াছিলেন, "আমি বহু হইব, প্রকৃষ্টরূপে উৎপন্ন হইব", ইত্যাদি শ্রুতি। এবং

'তদৈক্ষত বহু স্যাং প্রজায়েয়'-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৬।২।৩)

অর্থাৎ তাহা (-সেই সৎপদার্থ) ঈক্ষণ করিয়াছিলেন,"আমি বহু হইব, প্রকৃষ্টরূপে উৎপন্ন হইব", ইত্যাদি শ্রুতি। সেইস্থলে অভিধ্যানপূর্ব্বক স্বাধীনভাবে প্রবৃত্তি বর্ণিত হওয়ায় ব্রহ্ম নিমিত্তকারণ, ইহা অবগত হওয়া যাইতেছে। "বহু হইব" এইপ্রকার যে বহু হইবার সঙ্কল্প, তাহা প্রত্যাগাত্মাকে বিষয় করে বলিয়া ব্রহ্ম উপাদানকারণ, ইহা অবগত হওয়া যাইতেছে।

'যতো বা ইমানি ভূতানি জায়ন্তে' (তৈত্তিরীয় উপনিষদ-৩।১) ইত্যাদি তৈত্তিরীয় শ্রুতিমূলে 'জন্মাদ্যস্য যতঃ' (ব্রহ্মসূত্র ১।১।২) এই সূত্রে যে ব্রহ্ম হইতে জগতের উৎপত্তি, স্থিতি, লয় বর্ণিত হইয়াছে, সেখানেওযতঃ' এই পঞ্চমী বিভক্তি জনিকর্তুঃ প্রকৃতিঃ' (পাণিনি সূত্র ১।৪।৩০) এই পাণিনীয় সূত্র দ্বারা বিহিত হওয়ায়, 'যতঃশব্দে (শ্ৰুতিস্থযৎ’, শব্দে) প্রকৃতি বা উপাদানকেই বুঝাইতেছে। ব্রহ্মকে যে জগদ্ যোনি বলা হইয়াছে তাহা দ্বারাও ব্রহ্ম উপাদানকারণ এই সিদ্ধান্তই সমর্থিত হয়।

অবশ্য 'তদৈক্ষত বহুস্যাং প্রজায়েয়'(ছান্দোগ্য উপনিষদ্-৬।২।৩), ' ঈক্ষত লোকান্নু সৃজা ইতি ইমান্ লোকানসৃজত' (ঐতরেয় উপনিষদ্-১।১।১) এই সকল শ্রুতিবাক্যে জগতস্রষ্টা পরমেশ্বর প্রথমতঃ দেখিলেন, পরে সৃষ্টি করিলেন, এইরূপ যে পরমেশ্বরের বীক্ষণ অর্থাৎ দর্শনপূর্বক সৃষ্টি করার কথা বলা হইয়াছে, তাহা দ্বারা পরমেশ্বর জগতের নিমিত্তকারণ ইহা মনে আসাই স্বাভাবিক। কারণ দেখা যায় যে, যিনি কাজ করেন, সেই কৰ্তাই প্রথমতঃ দেখিয়া শুনিয়া, ভাবিয়া চিন্তিয়া কাজটি করেন। কর্তা কার্যের নিমিত্তকারণ, উপাদানকারণ নহেন। জগৎসৃষ্টির ব্যাপারেও প্রথমতঃ এইরূপ বীক্ষণ বা দর্শনের কথা আছে বলিয়া জগৎকর্তা পরমেশ্বরও কুম্ভকার প্রভৃতির ন্যায় নিমিত্তকারণই হইয়া দাঁড়ান। নিমিত্ত উপাদান কারণ অভিন্ন নহে, বিভিন্ন এইরূপই দেখা যায়। মাটি ঘটের উপাদানকারণ, কুম্ভকার প্রভৃতি নিমিত্তকারণ। এইরূপে নিমিত্তকারণ এবং উপাদানকারণের ভেদ যখন প্রত্যক্ষদৃষ্ট, তখন একই ব্রহ্মকে নিমিত্ত উপাদান এই উভয়বিধ কারণ বলা যায় কিরূপে? ইহার উত্তরে অদ্বৈতবেদান্তী বলেন যে, প্রত্যক্ষদৃষ্ট ঘটাদি সৃষ্টিতে নিমিত্তকারণ উপাদানকারণ বিভিন্ন হইলেও বিশ্বসৃষ্টির পূর্বে যখন এক বৈ আর দ্বিতীয় কিছু ছিল না, তখন সেই এককেই বিশ্বসৃষ্টির উপাদানও বলিতে হইবে, নিমিত্তও বলিতে হইবে। এই দৃষ্টিতেই অদ্বৈতবেদান্তে ব্রহ্মকে নিমিত্ত এবং উপাদান উভয়বিধ কারণ বলা হইয়া থাকে।

......................................................................

বিঃদ্রঃ- এই বিষয়ে লিখা চলিবে।

তথ্যসূত্রঃ-

. ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য বিরচিত শারীরক মীমাংসা ভাষ্য।

. বেদান্তদর্শন অদ্বৈতবাদ, প্রথম খণ্ড, আশুতোষ শাস্ত্রী কাব্য-ব্যাকরণ-সাংখ্য-বেদান্ততীর্থ বিদ্যাবাচস্পতি।


শ্রীশুভ চৌধুরী


আচার্য্য ও গুরু ভগবান সদৃশ, ইহা শাস্ত্রসিদ্ধঃ-


আচার্য্য যে ভগবৎসদৃশ তাহা স্বয়ং শ্রুতিতেই আছে। সামবেদীয় ছান্দোগ্য উপনিষদে বর্ণিত আছে-
'শ্রুতং হ্যেব মে ভগবদ্দৃশেভ্য আচার্যাদ্ধৈব বিদ্যা বিদিতা সাধিষ্ঠং প্রাপতীতি..' -(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৪।৯।৩)
অর্থাৎ (সত্যকাম)- 'ভগবৎসদৃশ আচার্য্যগণের নিকটেই আমি ইহা বিদিত আছি যে, গুরুমুখে বিজ্ঞাত বিদ্যাই কল্যাণতম হইয়া থাকে।
তাছাড়া শ্রতিতেই অন্যত্র দৃষ্ট হয় যে মহাগৃহস্থ শৌনক ভারদ্বাজ শিষ্য আচার্য্য অঙ্গিরার নিকট আত্মজ্ঞান লাভার্থ উপস্থিত হইয়া তাহাকে 'ভগবান্' বলিয়া সম্বোধন করিয়াছিলেন-
'কস্মিন্নু ভগবো বিজ্ঞাতে সর্বমিদং বিজ্ঞাতং ভবতীতি৷৷'-(অথর্ববেদীয় মুণ্ডক উপনিষৎ-১।১।৩)
অর্থাৎ হে ভগবন্! কোন বিষয়টি জানিলে পরে এই যাহা কিছু সর্ববিজ্ঞেয় পদার্থকে বিশেষরূপে জ্ঞাত অর্থাৎ অবগত হওয়া যায়?
মুখ্য উপনিষদসমূহ ছাড়াও যদি আমরা অন্য উপনিষৎসমূহে দৃষ্টিপাত করি দেখিব সর্বজায়গায় গুরুকে ভগবৎসদৃশ রূপেই আখ্যায়িত করা হইয়াছে। যথা-
'গুরুরেব হরিঃ সাক্ষানান্য ইত্যব্রবীচ্ছ্রুতিঃ।'-(ব্রহ্মবিদ্যোপনিষৎ- ৩১)
অর্থাৎ গুরুই সাক্ষাৎ হরি, অন্য কেউ নয় স্বয়ং শ্রুতিই ইহা বলিয়াছেন।

'গুরুর্ব্রহ্মা গুরুর্বিষ্ণুর্গুরুদেবঃ সদাচ্যুতঃ।'-(যোগশিখোপনিষৎ-৫।৫৬)
অর্থাৎ গুরুই ব্রহ্মা, গুরুই বিষ্ণু, গুরুদেব সদাচ্যুত।

'গুরুরেব পরংব্রহ্ম গুরুরেব পরাগতিঃ'--(অদ্বয়তারকোপনিষৎ-১৭)
অর্থাৎ গুরু পরব্রহ্ম, গুরুই পরমগতি।

শ্রুতির পরবর্তীতে যদি আমরা স্মৃতিশাস্ত্রে দৃষ্টিপাত করি তাহলে স্বয়ং মনুস্মৃতিতেই আচার্য্যকে পরব্রহ্মের মূর্ত্তি বলা হইয়াছে-
'আচার্যো ব্রহ্মণো মূর্তিঃ'-(মনুসংহিতা-২।২২৫)
অর্থাৎ আচার্য্য বেদান্ত নামে প্রসিদ্ধ উপনিষৎমধ্যে প্রতিপাদিত পরব্রহ্ম বা পরমাত্মার মূর্তি।

স্মৃতিতে অন্যত্র দেবতা, গুরু ও ধার্মিক ঈশ্বরপদবাচ্য। গৌতমসংহিতার নবম অধ্যায়ে বর্ণিত আছে-
'যোগক্ষেমার্থমীশ্বরমধিগচ্ছেন্নান্যমন্যত্র দেবগুরুধার্ম্মিকেভ্যঃ...'-
অর্থাৎ 'যোগক্ষেম লাভার্থ ঈশ্বরের নিকট গমন করিবে, অন্যত্র নহে। দেবতা, গুরু এবং ধার্ম্মিক ইহারাই ঈশ্বর।'

মহাভারতের অনুশাসনপর্বের বিষ্ণুসহস্রনামস্তোত্রমেও শ্রীভগবানের নামমাহাত্মে 'গুরু' শব্দটির উল্লেখ আছে। যথা-'গুরুর্গুরুতমো ধামঃ সত্যঃ সত্যপরাক্রমঃ।'-(মহাভারত, অনুশাসনপর্ব,১২৭তম অধ্যায় বিষ্ণুসহস্রনামস্তোত্রম্-৩৬)
তাছাড়া তন্ত্রপুরাণাদি শাস্ত্রের অসংখ্য স্থানে গুরুকে ভগবৎসদৃশ রূপেই অভিহিত করা হইয়াছে। সর্বাধিক প্রসিদ্ধ বিশ্বসার তন্ত্রের গুরুস্তোত্রমে বর্ণিত আছে-
গুরুর্ব্রহ্মা গুরুর্বিষ্ণুঃ গুরুর্দেবো মহেশ্বরঃ।
গুরুরেব পরং ব্রহ্ম তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ।।১

শ্রীগুরুদেবই ব্রহ্মা, গুরুই বিষ্ণু, গুরুই দেব মহেশ্বর, শ্রীগুরুই পরব্রহ্ম স্বরূপ; সেই শ্রীগুরুদেবকে পুনঃ পুনঃ ভক্তিভরে প্রণাম করি।

Monday, 18 May 2020

।।কৌপীনপঞ্চকম্।।


ভগবদপাদ শ্রীমদ আদ্যশংকর কৃত "কৌপীনপঞ্চকম্" বঙ্গানুবাদ সহিত পরিবেশিত হইল :-

।কৌপীনপঞ্চকম্।।

বেদান্তবাক্যেষু সদা রমন্তোঃ
ভিক্ষান্ন চ তুষ্টিমন্তঃ।
অশোকমন্তঃ করণে চরন্তঃ
কৌপীনবন্তঃ খলু ভাগ্যবন্তঃ।।১।।

বঙ্গানুবাদ:-প্রতিনিয়ত যাঁহারা বেদান্তবাক্যে রমন করেন ও ভিক্ষালব্ধ অন্নেই পরিতৃপ্ত হইয়া থাকেন । শোক বিকারহীন অন্তঃকরণে বিচরণকারী সেই কৌপীনধারী পুরুষেরাই প্রকৃত ভাগ্যবান।।১।।
মূলং তরোঃ কেবলমাশ্রয়ন্তঃ
পানিদ্বয়ং ভোক্তুমমত্রয়ন্তঃ।
কন্থামিব শ্রীমপি কুৎসয়ন্তঃ
কৌপীনবন্তঃ খলু ভাগ্যবন্তঃ।।২।।

বঙ্গানুবাদ:-বৃক্ষের মূলমাত্র যাঁহাদিগের আশ্রয়স্থল ও করদ্বয়ই যাঁহাদিগের ভোজনপাত্র।
ছিন্ন কন্থার ন্যায় শ্রী লক্ষ্মীকে বর্জনীয় জ্ঞানে নিন্দনকারী সেই কৌপীনধারী পুরুষেরাই প্রকৃত রূপে ভাগ্যবান।।২।।

স্বানন্দভাবে পরিতুষ্টমন্তঃ
সুশান্তসর্ব্বেন্দ্রিয়বৃত্তিমন্তঃ।
অহর্নিশং ব্রহ্মসুখে রমন্তঃ
কৌপীনবন্তঃ খলু ভাগ্যবন্তঃ।।৩।।

বঙ্গানুবাদ:-সদা স্বীয় আনন্দ স্বভাবে বিভোর যাঁহাদের ইন্দ্রিয়বৃত্তি সমূহ প্রশান্তভাবে স্থিত।
দিবানিশি ব্রহ্মানন্দরত ইদৃশ কৌপীনধারী পুরুষেরাই প্রকৃত ভাগ্যবান।।৩।।

দেহাদিভাবং পরিবর্জয়ন্তঃ
স্বাত্মানমাত্মান্যবলোকয়ন্তঃ।
নান্তং ন মধ্যং ন বহিঃ স্মরন্তঃ
কৌপীনবন্তঃ খলু ভাগ্যবন্তঃ।।৪।।

বঙ্গানুবাদ:-দেহাদিতে আত্মবোধ যাহারা সম্পূর্ণ রূপে ত্যাগ করিয়াছেন,অন্তঃকরণে সদা নিজের স্বরূপকে দর্শন করিয়া থাকেন।
যাঁহারা কি অন্তঃ ,কি মধ্য , কিইবা বহির্ভাগ - এ সকল কিছুই স্মরণ করেন না ,ইদৃশ কৌপীনধারী পুরুষেরাই প্রকৃত ভাগ্যবান।।৪।।

ব্রহ্মাক্ষরং পাবনমুচ্চরন্তো,
ব্রহ্মাহমস্মীতি বিভাবয়ন্তঃ।
ভিক্ষাশিনো দিক্ষু পরিভ্রমন্তঃ,
কৌপীনবন্তঃ খলু ভাগ্যবন্তঃ।।৫।।

বঙ্গানুবাদ:-পবিত্র অক্ষর ব্রহ্ম (ওঁ) যাঁহারা সতত উচ্চারণ করেন,'আমিই ব্রহ্ম'ইহাই যাঁহারা প্রতিনিয়ত চিন্তন করেন, যাঁহারা ভিক্ষাজীবি এবং সকল দিক্ পরিভ্রমণ করেন,ইদৃশ কৌপীনধারী পুরুষেরাই প্রকৃত ভাগ্যবান।।৫।।
ইতি ভগবদপাদ শ্রীমচ্ছংকরাচার্যঃ কৃতৌ শ্রী কৌপীনপঞ্চকম্ সম্পূর্ণম ।
ভগবান শংকরাচার্যকৃত কৌপীনপঞ্চক সম্পূর্ণ হইল।
বঙ্গানুবাদ কৃতজ্ঞতা -  শ্রীমৎ বিবোধানন্দ সরস্বতী।

Saturday, 16 May 2020

অদ্বৈতবেদান্তে জগৎঃ-


গৌড়পাদাচার্য্য মাণ্ডুক্যকারিকায় বলিতেছেন- 

অনিশ্চিতা য়থা রজ্জুরন্ধকারে বিকল্পিতা । 

সর্পধারাদিভির্ভাবৈস্তদ্বদাত্মা বিকল্পিতঃ ॥- (মাণ্ডুক্যকারিকা-২।১৭) 

অর্থাৎ অজ্ঞাত রজ্জু যেমন সর্পরূপে প্রতীতির হেতু, অজ্ঞাত নির্বিশেষ ব্রহ্মই তদ্রূপ জগৎরূপে প্রতীতির হেতু।রজ্জুতে যেমন পরমার্থতঃ সর্প কোন কালেই থাকে না তদ্রূপ ব্রহ্মরূপ অধিষ্ঠানে পরমার্থতঃ এই জগৎ কোন কালেই নাই। ব্রহ্মসূত্রের ২।১।১৪ এর ভাষ্যে ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য্য তাহা স্পষ্ট করিয়াছেন-"পারমার্থিক দৃষ্টিতে শুদ্ধ চৈতন্যে ঈশ্বরত্ব ও জীবত্ব প্রভৃতি দ্বৈতবুদ্ধি উপপন্ন হয় না, সেই বিষয়ে শ্রুতি প্রমাণ-

'যত্র নান্যত্পশ্যতি নান্যচ্ছৃণোতি নান্যদ্বিজানাতি স ভূমা' -(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৭/২৪/১)।

অর্থাৎ 'যেখানে অপর কিছু দর্শন করে না, অপর কিছু শ্রবণ করে না, অপর কিছু জানিতে পারে না, তাহাই ভূমা।'

'যত্র ত্বস্য সর্বমাত্মৈবাভূত্তত্কেন কং পশ্যেৎ'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪/৫/১৫)।

অর্থাৎ 'কিন্তু সমস্তই যখন ইহার আত্মাই হইয়া গেল, তখন কাহার দ্বারা কাহাকে দর্শন করিবে?'

ইত্যাদি শ্রুতিবাক্যের দ্বারাও তাহাই বর্ণিত হইতেছে। এই প্রকারে সকল উপনিষদই পরমার্থ অবস্থাতে সকলপ্রকার ব্যবহারের অভাবের কথা বলিতেছেন। সেইরূপেই ঈশ্বর ভগবদ্গীতাতে বলিতেছেন-

'ন কর্তৃত্বং ন কর্মাণি লোকস্য সৃজতি প্রভুঃ৷ ন কর্মফলসংযোগং স্বভাবস্তু প্রবর্ততে' 'নাদত্তে কস্যচিত্পাপং ন চৈব সুকৃতং বিভুঃ৷ অজ্ঞানেনাবৃতং জ্ঞানং তেন মুহ্যন্তি জন্তবঃ'।-(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা- ৫।১৪,১৫)

অর্থাৎ 'কারণ প্রভু আত্মা মনুষ্যের কর্তৃত্ব, কর্ম ও কর্মফলপ্রাপ্তি সৃষ্টি করেন না; কিন্তু স্বভাব অর্থাৎ নিজ বা পরমাত্মার যে সদসদাত্মিকা ভাব অর্থাৎ অবিদ্যালক্ষণা মায়াশক্তি কর্তৃত্বাদিরূপে প্রবর্তিত হয়। অর্থাৎ অবিদ্যাপ্রভাবে কর্তৃত্ব ও কারয়িতৃত্বাদি আত্মাতে আরোপিত হয় । পরমার্থতঃ বিভু আত্মা কাহারও পাপ বা পূজা জপহোমাদিরূপ পুণ্যও গ্রহণ করেন না । পূর্বোক্ত অবিদ্যা দ্বারা ‘আমি কর্তৃত্ব ও কারয়িতৃত্বাদিরহিত’ - এই বিবেকজ্ঞান আত্মজ্ঞান দ্বারা আবৃত বলিয়া প্রাণিগণ মোহগ্রস্থ হয়, অর্থাৎ মোহবশে ‘আমি করি ও করাই’, ‘আমি ভোগ করি ও করাই’ - ইত্যাদি ভ্রম করিয়া থাকে।'এইপ্রকারে পারমার্থিক অবস্থাতে শাসক (ঈশ্বর) ও শাসিত (জীব) ইত্যাদি ব্যবহারের অভাব প্রদর্শিত হইতেছে।

জগৎ যদি চিদাত্মা হইতে ভিন্ন নহে তবে উহা ভিন্নরূপে প্রতিভাত হয় কেন? এই শঙ্কার উত্তরে বলিতেছেন-"আত্মবিষয়ক অজ্ঞানবশতই জগৎ প্রতিভাত হইয়া থাকে, অধিষ্ঠানভূত আত্মার জ্ঞান হইলে আর আত্মা হইতে পৃথকরূপে কোন জগৎ দৃষ্টিগোচর হয় না। যেমন রজ্জুস্বরূপের অজ্ঞানবশতই ভ্রান্তিসর্প দেখা যায়, রজ্জুর জ্ঞান হইলে আর ঐ সর্পপ্রতীতি হয় না।" -(অষ্টাবক্র গীতা, শিষ্যোক্তমাত্মানুভবোল্লাসঃ, ৭)

অদ্বৈত বেদান্তে জগতের উৎপত্ত্যাদিবোধক শ্রুতি বাক্যসকল নিষেধ্য সমর্পণের দ্বারা নির্ব্বিশেষ ব্রহ্মজ্ঞানোৎপত্তিতে সহকারিমাত্র। আচার্য্য শঙ্কর ব্রহ্মসূত্রের (৪।৩।১৪) ভাষ্যে তাহাই স্বীকার করিয়াছেন-

"জগতের উৎপত্ত্যাদিবোধক শ্রুতি বাক্যসকলের অন্যার্থতা অর্থাৎ প্রয়োজন সম্পাদকতা প্রত্যক্ষভাবে সম্যগ্ অবগত হওয়া যায়। যেমন দেখ-

'তত্রৈতচ্ছুঙ্গমুত্পতিতং সোম্য বিজানীহি নেদমমূলং ভবিষ্যতি'-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৬/৮/৩)।

'এই প্রকার হইলে হে সৌম্য, এই দেহরূপ অঙ্কুরকে রসাদিভাবে পরিণত অন্ন হইতে উদ্গত বলিয়া জানিবে, ইহা অমূল অর্থাৎ কারণরহিত হইবে না।' এইপ্রকারে দেহাদিরূপ বিশেষের উল্লেখ করিয়া উদর্কে (পরে, ছান্দোগ্য উপনিদ ৮।৬।৪ বাক্যে) জগতের কারণস্বরূপ এক সদ্বস্তুরই বিজ্ঞেয়তা শ্রুতি প্রদর্শন করিতেছন।

আর 'যতো বা ইমানি ভূতানি জায়ন্তে৷ যেন জাতানি জীবন্তি৷ যত্প্রয়ন্ত্যভিসংবিশন্তি৷ তদ্বিজিজ্ঞাসস্ব৷ তদ্ব্রহ্মেতি৷'-(তৈত্তিরীয় উপনিষৎ-৩।১।১)

অর্থাৎ যাঁহা হইতে এই ব্রহ্মাদি তৃণপর্য্যন্ত দেহবর্গ উৎপন্ন হয়, উৎপন্ন হইয়া প্রাণধারণ করে অর্থাৎ বর্ধিত হয়, আবার বিনাশকালে যাঁহাকে প্রাপ্ত হয়, যাহাতে প্রবেশ করে অর্থাৎ অভেদ হইয়া যায় অর্থাৎ উৎপত্তি,স্থিতি ও লয়কালে দেহবর্গ যৎসত্তা ত্যাগ করে না, এইরূপ যে ব্রহ্মের লক্ষণ, সেই ব্রহ্মকে স্পষ্ট করিয়া জান। ইত্যদি শ্রুতি হইতেও নির্ব্বিশেষ ব্রহ্মেরই জ্ঞেয়তা অবগত হওয়া যায়।

ইহাই নির্গুণব্রহ্মবিদ্যা অনুশীলনকারীর বিবর্ত্তবাদাবলম্বী পারমার্থিক দৃষ্টি। আবার ব্যাবহারিক দৃষ্টিতে কিন্তু মায়ারূপ উপাধিযুক্ত সর্বজ্ঞ সর্বশক্তিমান্ পরমেশ্বর জগতের অভিন্ন নিমিত্তোপাদান কারণ। ঊর্ণনাভি (মাকড়সা) শরীরের তন্তুরূপে পরিণামের ন্যায় মায়ারূপ উপাধির পরিণামে মায়ী মহশ্বরের অভিন্ন নিমিত্তোপাদানতা সিদ্ধ হয়। ব্যবহারিক দৃষ্টিতে অদ্বৈতবেদান্তে পরিণামবাদও অঙ্গীকৃত হয়। শঙ্করাচার্য্যে ব্রহ্মসূত্র (২।১।১৪) ভাষ্যে তাহা স্বীকৃত-

কিন্তু ব্যবহার অবস্থাতে শ্রুতিতেও ঈশ্বরাদি ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। যথা-

'এষ সর্বেশ্বর এষ ভূতাধিপতিরেষ ভূতপাল এষ সেতুর্বিধরণ এষাং লোকানামসংভেদায়'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪/৪/২২)।

অর্থাৎ'ইনি সকলের ঈশ্বর, ইনি ভূতসকলের অধিপতি, ইনি ভূতসকলের পালক, এই ভূরাদি লোকসকলের অসংমিশ্রণের জন্য ইনি বিধারক সেতুস্বরূপ।'

আর ভগবদ্গীতাতেও সেইরূপ ব্যবহারাবস্থাতে জীব ও ঈশ্বরাদি ভেদব্যবহার ঈশ্বর কর্তৃক কথিত হইয়াছে- 'ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং হৃদ্দেশের্জুন তিষ্ঠতি৷ ভ্রামযন্সর্বভূতানি যন্ত্রারূঢানি মায়য়া'-(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা- ১৮।৬১)

অর্থাৎ 'হে অর্জুন, অন্তর্যামী ঈশ্বর সর্বজীবের হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হইয়া সর্বভূতকে যন্ত্রারূঢ় পুত্তলিকার ন্যায় মায়া দ্বারা চালিত করিতেছেন। '

ভগবান সূত্রকার বাদরায়ণও পরমার্থ অভিপ্রায়ে 'তদনন্যত্বম্' এবং ব্যবহারিক অভিপ্রায়ে কিন্তু 'স্যাল্লোকবতৎ' সূত্রের মাধ্যমে ব্রহ্মের মহাসমূদ্রস্থানীয়তার কথা বলিতেছেন। আর কার্য্যপ্রপঞ্চকে প্রত্যাখ্যান না করিয়া সগুণ উপাসনাতে উপযোগী হইবে, এই অভিপ্রায়ে পরিণাম প্রক্রিয়াকে আশ্রয় করিয়াছেন। 

Thursday, 14 May 2020

বিদ্বানের জ্ঞান দ্বারাই মোক্ষপ্রাপ্তিঃ-


ভগবান সনৎসুজাত বলিতেছেন-
'জ্ঞানেন চাত্মানমুপৈতি বিদ্বান্ ন চান্যথা বর্গফলানুকাঙ্ক্ষী।
অস্মিন্ কৃতং তৎ পরিগৃহ্য সর্বম্ অমুত্র ভুঙ্ক্তে পুনরেতি মার্গম্।।'৯
(শ্রীমহাভারত, উদ্যোগপর্ব, ৪৩তম অধ্যায়, সনৎ-সুজাতীয় সম্বাদ-৯)

শাঙ্করভাষ্য অনুসারে ভাবার্থঃ- বিদ্বান তত্ত্বজ্ঞান দ্বারাই অজ্ঞানবিনাশপূর্বক পরমাত্মাকে প্রাপ্ত হইয়া থাকেন, অন্য কোন প্রকারেই নহে। আবার ঈশ্বরার্থে কর্ম্মানুষ্ঠান না করিলে ও সর্ব্বপাপ বিনষ্ট না হইলে কেহই তত্ত্বজ্ঞান লাভ করিতে পারে না। বর্গ অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গণ, তাহার প্রিয়ফল বিষয়সুখ, তদাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তিই বর্গফলানুকাঙ্ক্ষী অর্থাৎ সকামী স্বর্গাদি ফলাভিলাষী জীব ভোগপ্রদ কর্মানুষ্ঠানোদ্ভব অপূর্ব (অর্থাৎ শাস্ত্রবিহিত ও নিষিদ্ধক্রিয়া হইতে উৎপন্ন কালান্তরভাবি সুখদুঃখের হেতুভূত যে পূণ্য ও পাপ তাহাই পূর্বমীমাংসকগণ কর্তৃক স্বীকৃত অপূর্ব) সঙ্গে লইয়া পরলোকে যায় ও ঐসকল কর্ম্মের ফলভোগ সেখানে শেষ হইলে পূনরায় অবশিষ্ট কর্ম্মফলের দ্বারা প্রেরিত হইয়া জন্মমৃত্যু প্রবাহসঙ্কুল এই সংসারগতি প্রাপ্ত হইয়া থাকে। ছান্দোগ্য শ্রুতিও তাই বলিতেছে-
'কর্ম্মক্ষয় পর্যন্ত স্বর্গলোকে বাস করিয়া পূনরায় তাহারা এই সংসারগতি প্রাপ্ত হইয়া থাকে।'-(ছান্দোগ্য উপনিষদ্-৫।১০।৫)

Tuesday, 12 May 2020

শ্রীকৃষ্ণাষ্টকম্ঃ-


শঙ্করাচার্য্য বিরচিত 'কৃষ্ণাষ্টকম্' ও ইহার ভাবার্থ-
শ্রিয়াঽঽশ্লিষ্টো বিষ্ণুঃ স্থিরচরগুরুর্বেদবিষয়ো
ধিয়াং সাক্ষী শুদ্ধো হরিরসুরহন্তাব্জনয়নঃ ।
গদী শঙ্খী চক্রী বিমলবনমালী স্থিররুচিঃ
শরণ্যো লোকেশো মম ভবতু কৃষ্ণোঽক্ষিবিষয়ঃ ॥ ১॥

যিনি চরাচর সকলের গুরু, যিনি বেদপ্রতিপাদ্য, যে বিষ্ণু সর্ব্বদা লক্ষ্মী কর্তৃক আলিঙ্গিত আছেন, যিনি বুদ্ধির সাক্ষী অর্থাৎ সকলের অন্তর্যামী, যিনি অসুরগণের হন্তা, যাঁহার নয়ন পদ্মদলের ন্যায় শোভমান, যিনি শঙ্খ,চক্র ও গদাধারী, যিনি বিমল বনমালা ধারণ করেন, যাঁহার উজ্জল দীপ্তি কখনও তিরোহিত হয় না, যিনি সকলের শরণ্য ও ত্রিভুবনের ঈশ্বর, সেই কৃষ্ণ আমার নয়নগোচর হউন।১
য়তঃ সর্বং জাতং বিয়দনিলমুখ্যং জগদিদম্
স্থিতৌ নিঃশেষং য়োঽবতি নিজসুখাংশেন মধুহা ।
লয়ে সর্বং স্বস্মিন্হরতি কলয়া য়স্তু স বিভুঃ
শরণ্যো লোকেশো মম ভবতু কৃষ্ণোঽক্ষিবিষয়ঃ ॥ ২॥

সৃষ্টিকালে যাঁহা হইতে আকাশ ও বায়ুপ্রমুখ সমগ্র জগৎ উৎপন্ন হইয়াছে, স্থিতিকালে যিনি নিজ সুখাংশ দ্বারা অনন্তব্রহ্মাণ্ড পালন করিতেছেন, যিনি মধুদৈত্যকে বিনাশ করিয়াছেন, যিনি প্রলয়কালে বিশ্বান্তর্নিহিত আত্মশক্তির সহিত আপনাতে সকল বিলীন করেন, যে বিষ্ণু সকলের শরণ্য ও ত্রিভুবনের ঈশ্বর, সেই কৃষ্ণ আমার নয়নগোচর হউন।২
অসূনায়ম্যাদৌ য়মনিয়মমুখ্যৈঃ সুকরণৈ-
র্নিরুদ্ধ্যেদং চিত্তং হৃদি বিলয়মানীয় সকলম্ ।
য়মীড্যং পশ্যন্তি প্রবরমতয়ো মায়িনমসৌ
শরণ্যো লোকেশো মম ভবতু কৃষ্ণোঽক্ষিবিষয়ঃ ॥ ৩॥

শ্রেষ্ঠমতি মুনিগণ প্রথমতঃ প্রাণসংযম করিয়া যমনিয়মাদি সাধনপূর্ব্বক ইন্দ্রিয়গ্রাম নিরোধকরত চিত্ত বিলয় করিয়া যে ত্রিলোকপূজ্য মায়াময় বিষ্ণুকে দর্শন করিতেন এবং যিনি সকলের শরণ্য ও ত্রিভুবনের ঈশ্বর, সেই কৃষ্ণ আমার নয়নগোচর হউন।৩
পৃথিব্যাং তিষ্ঠন্যো য়ময়তি মহীং বেদ ন ধরা
য়মিত্যাদৌ বেদো বদতি জগতামীশমমলম্ ।
নিয়ন্তারং ধ্যেয়ং মুনিসুরনৃণাং মোক্ষদমসৌ
শরণ্যো লোকেশো মম ভবতু কৃষ্ণোঽক্ষিবিষয়ঃ ॥ ৪॥

পৃথিবীতে অবস্থান করিয়া যিনি মহীমণ্ডল নিয়মিত করিয়া থাকেন, কিন্তু পৃথিবী যাঁহাকে জানেন না, ইত্যাদি মর্মের 'যঃ পৃথিব্যাং তিষ্ঠন্' ইত্যাদি সন্দর্ভে শ্রুতি(বৃহদারণ্যক) যাঁহার মাহাত্ম্যকীর্ত্তন করেন, যিনি জগতে অদ্বিতীয় অধীশ্বর বলিয়া কথিত আছেন, যিনি অমল এবং সর্ব্বপ্রকার দোষশূন্য, যিনি সকলের নিয়ন্তা, মুনিগণ, দেবগণ ও রাজগণ যাহাকে নিয়ত ধ্যান করেন, যিনি সকলের মোক্ষদাতা ও সকলের আশ্রয়, সেই ত্রিলোকপতি ভগবান কৃষ্ণ আমার নয়নগোচর হউন।৪
মহেন্দ্রাদির্দেবো জয়তি দিতিজান্যস্য বলতো
ন কস্য স্বাতন্ত্র্যং ক্বচিদপি কৃতৌ য়ত্কৃতিমৃতে ।
বলারাতের্গর্বং পরিহরতি য়োঽসৌ বিজয়িনঃ
শরণ্যো লোকেশো মম ভবতু কৃষ্ণোঽক্ষিবিষয়ঃ ॥ ৫॥

যাঁহার বলে মহেন্দ্রাদি দেবগণ দানবদিগকে জয় করিয়া থাকেন, যাঁহার চেষ্টা ব্যতিরেকে কোন কালেও কোন কার্য্যে কাহারও স্বাতন্ত্র্য নাই, যাহার শক্তিসাহায্য ভিন্ন জগতে কেহ কোন কার্য্যই স্বাধীনভাবে সম্পন্ন করিতে সমর্থ হয় না, যিনি দিগ্বিজয়ী পণ্ডিতবর্গের কবিত্বাদি-জনিত গর্ব হরণ করেন, যিনি জগতের আশ্রয় ও ত্রিভুবনের ঈশ্বর, সেই কৃষ্ণ আমার নয়নগোচর হউন। ৫
বিনা য়স্য ধ্যানং ব্রজতি পশুতাং সূকরমুখাং
বিনা য়স্য জ্ঞানং জনিমৃতিভয়ং য়াতি জনতা ।
বিনা য়স্য স্মৃত্যা কৃমিশতজনিং য়াতি স বিভুঃ
শরণ্যো লোকেশো মম ভবতু কৃষ্ণোঽক্ষিবিষয়ঃ ॥ ৬॥

যাঁহাকে ধ্যান না করিলে সকল লোক শূকরাদি পশুত্বপ্রাপ্ত হয়, যাঁহার জ্ঞান ব্যতিরেকে লোক সকল কেবল জন্ম-মৃত্যুর বশীভূত হইয়া থাকে, যাঁহাকে স্মরণ না করিলে প্রাণিগণ শত শত কৃমিযোনি প্রাপ্ত হয়, যিনি সকলের আশ্রয় ও ত্রিলোকের অদ্বিতীয় অধীশ্বর, সেই কৃষ্ণ আমার নয়নগোচর হউন। ৬
নরাতঙ্কোত্তঙ্কঃ শরণশরণো ভ্রান্তিহরণো
ঘনশ্যামো বামো ব্রজশিশুবয়স্যোঽর্জুনসখঃ ।
স্বয়ম্ভূর্ভূতানাং জনক উচিতাচারসুখদঃ
শরণ্যো লোকেশো মম ভবতু কৃষ্ণোঽক্ষিবিষয়ঃ ॥ ৭॥

যিনি নরগণের ভীতিহরণ করেন, যিনি রক্ষকের রক্ষকত্ব সম্পাদন করেন, যিনি জগতের ভ্রান্তিহরণ করেন, যিনি নবঘনের ন্যায় শ্যামল কলেবর, যিনি রামরূপে অবতীর্ণ হইয়াছিলেন, যিনি ব্রজবালকদিগের বয়স্য, যিনি অর্জ্জুনের সখা, যিনি নিজে ইচ্ছাবশে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন অথচ যিনি সকলের জনক , যিনি সদাচারীদিগকে যথোচিত সুখপ্রদান করিয়া থাকেন, যিনি সকলের আশ্রয় ও ত্রিলোকের অধীশ্বর, সেই কৃষ্ণ আমার নয়নগোচর হউন। ৭
য়দা ধর্মগ্লানির্ভবতি জগতাং ক্ষোভকরণী
তদা লোকস্বামী প্রকটিতবপুঃ সেতুধৃদজঃ ।
সতাং ধাতা স্বচ্ছো নিগমগণগীতো ব্রজপতিঃ
শরণ্যো লোকেশো মম ভবতু কৃষ্ণোঽক্ষিবিষয়ঃ ॥ ৮॥

যখন যখন ধর্ম্মবিপ্লব উপস্থিত হইয়া জগৎকে বিত্রস্ত করিয়াছে, তখনই জন্মরহিত হইয়াও যিনি লোকনায়করূপে আবির্ভূত হইয়া ধর্ম্মমর্য্যাদা রক্ষা করিয়াছেন, যিনি এইজগতের সৎপদার্থমাত্রের বিধানকর্তা, যিনি সর্ব্ব-বিকারশূন্য, নিগমাদি শাস্ত্রে যাহার গুণগান বর্ণিত আছে, সকলের আশ্রয় ও ত্রিলোকের অধীশ্বর, সেই কৃষ্ণ আমার নয়নগোচর হউন। ৮
ইতি হরিরখিলাত্মাঽঽরাধিতঃ শঙ্করেণ
শ্রুতিবিশদগুণোঽসৌ মাতৃমোক্ষার্থমাদ্যঃ ।
য়তিবরনিকটে শ্রীয়ুক্ত আবির্বভূব
স্বগুণবৃত উদারঃ শঙ্খচক্রাঞ্জহস্তঃ ॥ ৯॥

ইতি পরিব্রাজকবর শঙ্করাচার্য্য মাতার মোক্ষের নিমিত্ত উক্তপ্রকারে নিখিলজগতের আত্মা শ্রুতিবর্ণিত গুণসম্পন্ন আদিপুরুষ হরির স্তবদ্বারা আরাধনা করিলে , তিনি নিজগুণকৃত দেহধারণপূর্বক শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম হস্তে শ্রীযুক্ত উদাররূপে সেই যতিরাজের সমক্ষে আবির্ভূত হইলেন।৯
ইতি শ্রীমত্পরমহংসপরিব্রাজকাচার্যস্য
শ্রীগোবিন্দভগবত্পূজ্যপাদশিষ্যস্য
শ্রীমচ্ছঙ্করভগবতঃ কৃতৌ কৃষ্ণাষ্টকং সম্পূর্ণম্ ॥

ইতি শ্রীমৎ পরমহংসপরিব্রাজকাচার্য্য গোবিন্দভগবৎপাদ শিষ্য শ্রীমৎ শঙ্কর ভগবৎ কৃত কৃষ্ণাষ্টকং সম্পূর্ণ ॥

আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...