মায়াধীশ পরমেশ্বরই জগতের নিমিত্তকারণ। ঈশ্বরের অধ্যক্ষতায়ই মায়ার বিকাশ হইয়া থাকে এবং এই মায়ার সহায়তায় তিনি চরাচর জগতের সৃষ্টি করিয়া থাকেন। নির্বিশেষ পরব্রহ্ম মায়ার এবং মায়িক নাম-রূপ প্রপঞ্চের একমাত্র অধিষ্ঠান বা আশ্রয়। এক ব্রহ্মই বহু হইয়াছেন, বহু নামে বহু রূপে প্রতিভাত হইতেছেন। তাঁহার এই ভাতি বা প্রকাশের দ্বারা তিনি কিছুমাত্র রূপান্তরিত বা বিকৃত হন নাই, সম্পূর্ণ অবিকারী ভাবেই অজ্ঞানলীলার ভিত্তিরূপে বিরাজ করিতেছেন। ব্রহ্ম-ভিত্তি সদা বিদ্যমান আছে বলিয়াই মায়ার এরূপ বিচিত্র খেলা চলিতেছে এবং মায়িক জগৎ সত্য বলিয়া বোধ হইতেছে। এই অবিকারী কূটস্থ ব্রহ্মই জড় জগতের অপরিণামী উপাদান বা বিবর্ত কারণ। এই অপরিণামী উপাদানকারণকে আশ্রয় করিয়া অনির্বচনীয় অবিদ্যা বিবিধ অনির্বচনীয় নামরূপে পরিণত হইতেছে, সুতরাং অবিদ্যা জড়জগতের পরিণামী উপাদান।
ব্রহ্ম
কেবল জগতের নিমিত্তকারণই নহেন। তিনি নিমিত্তকারণও বটেন,
উপাদানকারণও বটেন। ইহাই ভগবান্ সূত্রকার
এবং ভাষ্যকার স্পষ্টবাক্যে আমাদিগকে বলিয়া দিয়াছেন। যথা—'প্রকৃতিশ্চ প্রতিজ্ঞাদৃষ্টান্তানুপরোধাৎ।'-(ব্রহ্মসূত্র-১.৪.২৩)
প্রকৃতিশ্চ উপাদানকারণঞ্চ ব্রহ্ম অভ্যুপগন্তব্যং নিমিত্তকারণঞ্চ। ন কেবলং নিমিত্তকারণমেব
(ব্রহ্মসূত্র, শঙ্করভাষ্য-১।৪।২৩)। কারণ যেহেতু
প্রতিজ্ঞা ও দৃষ্টান্তের সঙ্কোচ
হয় না। ভাষ্যকার ভগবান্
শঙ্করাচার্য তাঁহার উক্ত সিদ্ধান্তের অনুকূলে
শ্রুতিকেই প্রধান অবলম্বন হিসাবে গ্রহণ করিয়াছেন। প্রতিজ্ঞা এই প্রকার—'উত
তমাদেশমপ্রাক্ষ্যো যেনাশ্রুতং শ্রুতং ভবত্যমতং মতমবিজ্ঞাতং বিজ্ঞাতম্'-(ছান্দোগ্য উপনিষদ্-৬।১।২) বেদান্তে এক ব্রহ্মকে জানিলেই
বিশ্বের তাবৎ বস্তু জানা
যায় বলিয়া (এক-বিজ্ঞানে সর্ব-বিজ্ঞান-প্ৰতিজ্ঞা) যে সিদ্ধান্ত করা
হইয়াছে, ঐরূপ সিদ্ধান্ত ব্রহ্মকে
উপাদানকারণরূপে গ্রহণ করিলেই সম্ভবপর হয়, নতুবা হয়
না। কেননা, এক উপাদানকে জানিলেই
উপাদানের বিবিধ বিকারকে জানা যায়। কারণ,
বিকারগুলি উপাদানেরই অবস্থান্তরমাত্র।
আর
দৃষ্টান্ত এই প্রকার—'যথা
সোম্যৈকেন মৃৎপিণ্ডেন সর্বং মৃন্ময়ং বিজ্ঞাতং স্যাদ্বাচারম্ভণং বিকারো নামধেয়ং মৃত্তিকেত্যেব সত্যম্'-(ছান্দোগ্য উপনিষদ্-৬।১।৪)
অর্থাৎ
হে সোম্য, যেমন একটী মৃৎপিণ্ডের
সমস্ত মৃন্ময় বস্তু বিজ্ঞাত হয়, কারণ যা
বিকার (—কার্য্যবস্তু), তা বাগবলম্বনে অবস্থিত
নাম মাত্র। কেবল মৃত্তিকাই সত্য",
ইত্যাদি দৃষ্টান্তও উপাদানকারণ বিষয়েই পঠিত হইতেছে।
কিন্তু
কোন হেতুবশতঃ আত্মার নিমিত্তকারণতা ও উপাদানকারণতা সিদ্ধ
হয়? ভগবান সূত্রকার বলিতেছেন—'অভিধ্যোপদেশাচ্চ৷'-(ব্রহ্মসূত্র ১.৪.২৪)
ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য্য শারীরকভাষ্যে বলিতেছেন—অভিধ্যানের অর্থাৎ ভাবী সৃষ্টিবিষয়ক সঙ্কল্পের
উপদেশও আত্মার নিমিত্তকারণতা ও উপাদানকারণতা জ্ঞাপন
করিতেছে, যথা—
'সোকাময়ত বহু
স্যাং প্রজায়েয়'-(তৈত্তিরীয় উপনিষৎ ২।৬)
অর্থাৎ
তিনি কামনা করিয়াছিলেন, "আমি বহু হইব,
প্রকৃষ্টরূপে উৎপন্ন হইব", ইত্যাদি শ্রুতি। এবং
'তদৈক্ষত বহু
স্যাং প্রজায়েয়'-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৬।২।৩)
অর্থাৎ
তাহা (-সেই সৎপদার্থ) ঈক্ষণ
করিয়াছিলেন,"আমি বহু হইব,
প্রকৃষ্টরূপে উৎপন্ন হইব", ইত্যাদি শ্রুতি। সেইস্থলে অভিধ্যানপূর্ব্বক স্বাধীনভাবে প্রবৃত্তি বর্ণিত হওয়ায় ব্রহ্ম নিমিত্তকারণ, ইহা অবগত হওয়া
যাইতেছে। "বহু হইব" এইপ্রকার
যে বহু হইবার সঙ্কল্প,
তাহা প্রত্যাগাত্মাকে বিষয় করে বলিয়া
ব্রহ্ম উপাদানকারণ, ইহা অবগত হওয়া
যাইতেছে।
'যতো বা
ইমানি ভূতানি জায়ন্তে' (তৈত্তিরীয় উপনিষদ-৩।১) ইত্যাদি তৈত্তিরীয়
শ্রুতিমূলে 'জন্মাদ্যস্য যতঃ' (ব্রহ্মসূত্র ১।১।২) এই সূত্রে যে
ব্রহ্ম হইতে জগতের উৎপত্তি,
স্থিতি, লয় বর্ণিত হইয়াছে,
সেখানেও ‘যতঃ' এই পঞ্চমী
বিভক্তি ‘জনিকর্তুঃ প্রকৃতিঃ' (পাণিনি সূত্র ১।৪।৩০) এই পাণিনীয় সূত্র
দ্বারা বিহিত হওয়ায়, 'যতঃ’ শব্দে (শ্ৰুতিস্থ
‘যৎ’, শব্দে) প্রকৃতি বা উপাদানকেই বুঝাইতেছে।
ব্রহ্মকে যে জগদ্ যোনি
বলা হইয়াছে তাহা দ্বারাও ব্রহ্ম
উপাদানকারণ এই সিদ্ধান্তই সমর্থিত
হয়।
অবশ্য
'তদৈক্ষত বহুস্যাং প্রজায়েয়'(ছান্দোগ্য উপনিষদ্-৬।২।৩), 'স ঈক্ষত লোকান্নু
সৃজা ইতি স ইমান্
লোকানসৃজত' (ঐতরেয় উপনিষদ্-১।১।১) এই সকল শ্রুতিবাক্যে
জগতস্রষ্টা পরমেশ্বর প্রথমতঃ দেখিলেন, পরে সৃষ্টি করিলেন,
এইরূপ যে পরমেশ্বরের বীক্ষণ
অর্থাৎ দর্শনপূর্বক সৃষ্টি করার কথা বলা
হইয়াছে, তাহা দ্বারা পরমেশ্বর
জগতের নিমিত্তকারণ ইহা মনে আসাই
স্বাভাবিক। কারণ দেখা যায়
যে, যিনি কাজ করেন,
সেই কৰ্তাই প্রথমতঃ দেখিয়া শুনিয়া, ভাবিয়া চিন্তিয়া কাজটি করেন। ঐ কর্তা কার্যের
নিমিত্তকারণ, উপাদানকারণ নহেন। জগৎসৃষ্টির ব্যাপারেও প্রথমতঃ এইরূপ বীক্ষণ বা দর্শনের কথা
আছে বলিয়া জগৎকর্তা পরমেশ্বরও কুম্ভকার প্রভৃতির ন্যায় নিমিত্তকারণই হইয়া দাঁড়ান। নিমিত্ত ও উপাদান কারণ
অভিন্ন নহে, বিভিন্ন এইরূপই
দেখা যায়। মাটি ঘটের উপাদানকারণ,
কুম্ভকার প্রভৃতি নিমিত্তকারণ। এইরূপে নিমিত্তকারণ এবং উপাদানকারণের ভেদ
যখন প্রত্যক্ষদৃষ্ট, তখন একই ব্রহ্মকে
নিমিত্ত ও উপাদান এই
উভয়বিধ কারণ বলা যায়
কিরূপে? ইহার উত্তরে অদ্বৈতবেদান্তী
বলেন যে, প্রত্যক্ষদৃষ্ট ঘটাদি
সৃষ্টিতে নিমিত্তকারণ ও উপাদানকারণ বিভিন্ন
হইলেও বিশ্বসৃষ্টির পূর্বে যখন এক বৈ
আর দ্বিতীয় কিছু ছিল না,
তখন সেই এককেই বিশ্বসৃষ্টির
উপাদানও বলিতে হইবে, নিমিত্তও বলিতে হইবে। এই দৃষ্টিতেই অদ্বৈতবেদান্তে
ব্রহ্মকে নিমিত্ত এবং উপাদান উভয়বিধ
কারণ বলা হইয়া থাকে।
......................................................................
বিঃদ্রঃ-
এই বিষয়ে লিখা চলিবে।
তথ্যসূত্রঃ-
১.
ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য বিরচিত শারীরক মীমাংসা ভাষ্য।
২.
বেদান্তদর্শন অদ্বৈতবাদ, প্রথম খণ্ড, আশুতোষ শাস্ত্রী কাব্য-ব্যাকরণ-সাংখ্য-বেদান্ততীর্থ বিদ্যাবাচস্পতি।
শ্রীশুভ
চৌধুরী
No comments:
Post a Comment