সামবেদের তলবকার ব্রাহ্মণের অন্তর্গত কেন উপনিষদে বর্ণিত আছে-
....অন্যদেব তদ্বিদিতাদথো অবিদিতাদধি ৷ ইতি শুশ্রুম পূর্বেষাং যে নস্তদ্ব্যাচচক্ষিরে ৷- (কেন উপনিষৎ ১।৩)
শঙ্করাচার্য্যের 'শাঙ্করভাষ্য' অনুসারে ভাবার্থঃ- ইহা ঠিক যে প্রত্যক্ষাদি প্রমাণের দ্বারা অপরকে (ব্রহ্ম) বুঝানো যায় না; কিন্তু উপদেশ পরম্পরা দ্বারা ব্রহ্মকে বুঝাইতে পারা যায় বলিয়া ব্রহ্মের উপদেশের জন্য পরম্পরাবাক্য বলিতেছেন-'সেই ব্রহ্ম বিদিত ও অবিদিত হইতে ভিন্ন।'অর্থাৎ যাঁহার এই প্রকরণ তিনি অন্যই অর্থাৎ পৃথকই, সেই যাঁহাকে শ্রোত্রাদি ইন্দ্রিয়সকলের অবিষয় বলা হইয়াছে, তিনি জ্ঞাতবস্তু হইতে পৃথকই।
বিদিতবস্তু অর্থাৎ বিদিক্রিয়ার (অন্তঃকরণবৃত্তিজনিত জ্ঞানক্রিয়ার) দ্বারা যাহা সম্যগ্ রূপে প্রাপ্ত হওয়া যায়, বিদিক্রিয়ার কর্ম্মস্বরূপ নামরূপাত্মক বস্তু মাত্রই কোথাও কিয়দংশেও, কাহারও জ্ঞাত হয় বলিয়া সমস্ত ব্যাকৃত (নামরূপে অভিব্যক্ত) বস্তুমাত্রই বিদিত; আর ব্রহ্ম সেই বিদিত বস্তু হইতে পৃথক-ইহাই তাৎপর্য্য। ইনি অবিদিত অর্থাৎ বিদিতের বিপরীত অর্থাৎ ব্যক্তপদার্থের কারণস্বরূপ অজ্ঞানরূপ অব্যক্ত হইতেও ভিন্ন।
আর যে বস্তু বিদিত হয়, তাহা অল্প, বিনাশশীল এবং দুঃখাত্মক হয় বলিয়া হেয় বা পরিত্যাজ্য হয়-যেহেতু সেই ব্রহ্ম বিদিত বস্তু হইতে ভিন্ন তাই অপরিত্যাজ্য। আবার ব্রহ্ম অবিদিত হইতে ভিন্ন বলিলে ব্রহ্মের অনুপাদেয়ত্ব অর্থাৎ অগ্রাহ্যতা প্রতিপাদিত হইয়া যায়। কার্য্যসম্পাদনের জন্য কোন কর্তার দ্বারা নিজ হইতে ভিন্ন কোন কারণ বা সাধন সংগৃহীত হয়। কিন্তু জ্ঞাতার নিজ ভিন্ন আর কোন বস্তু গ্রহণযোগ্য হয় না।
এই প্রকার 'বিদিত ও অবিদিত হইতে ভিন্ন।'-এই উক্তির দ্বারা পরিত্যাজ্য ও গ্রাহ্যের নিষেধ করার ফলে (জ্ঞেয়বস্তু) নিজ আত্মার সহিত এক হইয়া যাওয়াতে ব্রহ্মবিষয়ক জিজ্ঞাসার নিবৃত্তি হইয়া যায়। আর যেহেতু, নিজ আত্মা হইতে ভিন্নকোন বস্তুরই বিদিত ও অবিদিত এই উভয় হইতে ভিন্ন হওয়া সম্ভব হয় না, অতএব 'অয়মাত্মা ব্রহ্ম'-(মাণ্ডুক্য উপনিষৎ ২) অর্থাৎ 'প্রত্যাগাত্মাই ব্রহ্ম'-ইহাই 'অন্য দেব' ইত্যাদি বাক্যের তাৎপর্য্য।
'য আত্মাপহতপাপ্মা'-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৮।৭।১)
অর্থাৎ 'যে আত্মা পাপ-পূণ্যরহিত।'
'যত্সাক্ষাদপরোক্ষাদ্ব্রহ্ম'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৩।৪।১)
অর্থাৎ 'যিনি সাক্ষাৎ অপরোক্ষ তিনি ব্রহ্ম।'
তাছাড়া 'যিনি সকলের অন্তর্নিহিত পরমাত্মা' ইতাদি অপরসকল শ্রুতি হইতেও এই কথা প্রতিপাদিত হয়।
এইভাবে সর্বাত্মনঃ সর্ববিশেষরহিত চিন্মাত্র জ্যোতিঃস্বরূপ ব্রহ্মত্ব প্রতিপাদক বাক্যার্থ যে আচার্য্য উপদেশ পরম্পরায় প্রাপ্ত হওয়া যায় তাহা 'ইতি শুশ্রুম' ইত্যাদি বাক্যে গুরু শিষ্যকে বলিতেছেন৷ ব্রহ্মকে আচার্য্য উপদেশ পরম্পরাক্রমেই জানিতে হইবে, তর্কদ্বারা, প্রবচন, মেধা, বহুশ্রুত, তপোযজ্ঞাদি দ্বারা তাঁহাকে জানা যায় না- এই প্রকার আমরা পূর্ববর্তী আচার্য্যগণের উপদেশ শুনিয়াছি, যে আচার্য্যগণ আমাদিগকে স্পষ্টভাবে ব্রহ্মতত্ত্বের ব্যখ্যা বলিতেন।
ইতি ভাষ্যানুবাদ।
No comments:
Post a Comment