গৌড়পাদাচার্য্য মাণ্ডুক্যকারিকায় বলিতেছেন-
অনিশ্চিতা য়থা রজ্জুরন্ধকারে বিকল্পিতা ।
সর্পধারাদিভির্ভাবৈস্তদ্বদাত্মা বিকল্পিতঃ ॥- (মাণ্ডুক্যকারিকা-২।১৭)
অর্থাৎ অজ্ঞাত রজ্জু যেমন সর্পরূপে প্রতীতির হেতু, অজ্ঞাত নির্বিশেষ ব্রহ্মই তদ্রূপ জগৎরূপে প্রতীতির হেতু।রজ্জুতে যেমন পরমার্থতঃ সর্প কোন কালেই থাকে না তদ্রূপ ব্রহ্মরূপ অধিষ্ঠানে পরমার্থতঃ এই জগৎ কোন কালেই নাই। ব্রহ্মসূত্রের ২।১।১৪ এর ভাষ্যে ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য্য তাহা স্পষ্ট করিয়াছেন-"পারমার্থিক দৃষ্টিতে শুদ্ধ চৈতন্যে ঈশ্বরত্ব ও জীবত্ব প্রভৃতি দ্বৈতবুদ্ধি উপপন্ন হয় না, সেই বিষয়ে শ্রুতি প্রমাণ-
'যত্র নান্যত্পশ্যতি নান্যচ্ছৃণোতি নান্যদ্বিজানাতি স
ভূমা' -(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৭/২৪/১)।
অর্থাৎ 'যেখানে অপর কিছু দর্শন করে না, অপর কিছু শ্রবণ
করে না, অপর কিছু জানিতে পারে না, তাহাই ভূমা।'
'যত্র ত্বস্য সর্বমাত্মৈবাভূত্তত্কেন কং পশ্যেৎ'-(বৃহদারণ্যক
উপনিষৎ-৪/৫/১৫)।
অর্থাৎ 'কিন্তু সমস্তই যখন ইহার আত্মাই হইয়া গেল, তখন
কাহার দ্বারা কাহাকে দর্শন করিবে?'
ইত্যাদি শ্রুতিবাক্যের দ্বারাও তাহাই বর্ণিত হইতেছে। এই
প্রকারে সকল উপনিষদই পরমার্থ অবস্থাতে সকলপ্রকার ব্যবহারের অভাবের কথা বলিতেছেন। সেইরূপেই
ঈশ্বর ভগবদ্গীতাতে বলিতেছেন-
'ন কর্তৃত্বং ন কর্মাণি লোকস্য সৃজতি প্রভুঃ৷ ন কর্মফলসংযোগং
স্বভাবস্তু প্রবর্ততে' 'নাদত্তে কস্যচিত্পাপং ন চৈব সুকৃতং বিভুঃ৷ অজ্ঞানেনাবৃতং জ্ঞানং
তেন মুহ্যন্তি জন্তবঃ'।-(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা- ৫।১৪,১৫)
অর্থাৎ 'কারণ প্রভু আত্মা মনুষ্যের কর্তৃত্ব, কর্ম ও কর্মফলপ্রাপ্তি
সৃষ্টি করেন না; কিন্তু স্বভাব অর্থাৎ নিজ বা পরমাত্মার যে সদসদাত্মিকা ভাব অর্থাৎ
অবিদ্যালক্ষণা মায়াশক্তি কর্তৃত্বাদিরূপে প্রবর্তিত হয়। অর্থাৎ অবিদ্যাপ্রভাবে কর্তৃত্ব
ও কারয়িতৃত্বাদি আত্মাতে আরোপিত হয় । পরমার্থতঃ বিভু আত্মা কাহারও পাপ বা পূজা জপহোমাদিরূপ
পুণ্যও গ্রহণ করেন না । পূর্বোক্ত অবিদ্যা দ্বারা ‘আমি কর্তৃত্ব ও কারয়িতৃত্বাদিরহিত’
- এই বিবেকজ্ঞান আত্মজ্ঞান দ্বারা আবৃত বলিয়া প্রাণিগণ মোহগ্রস্থ হয়, অর্থাৎ মোহবশে
‘আমি করি ও করাই’, ‘আমি ভোগ করি ও করাই’ - ইত্যাদি ভ্রম করিয়া থাকে।'এইপ্রকারে পারমার্থিক
অবস্থাতে শাসক (ঈশ্বর) ও শাসিত (জীব) ইত্যাদি ব্যবহারের অভাব প্রদর্শিত হইতেছে।
জগৎ যদি চিদাত্মা হইতে ভিন্ন নহে তবে উহা ভিন্নরূপে প্রতিভাত হয় কেন? এই শঙ্কার উত্তরে বলিতেছেন-"আত্মবিষয়ক অজ্ঞানবশতই জগৎ প্রতিভাত হইয়া থাকে, অধিষ্ঠানভূত আত্মার জ্ঞান হইলে আর আত্মা হইতে পৃথকরূপে কোন জগৎ দৃষ্টিগোচর হয় না। যেমন রজ্জুস্বরূপের অজ্ঞানবশতই ভ্রান্তিসর্প দেখা যায়, রজ্জুর জ্ঞান হইলে আর ঐ সর্পপ্রতীতি হয় না।" -(অষ্টাবক্র গীতা, শিষ্যোক্তমাত্মানুভবোল্লাসঃ, ৭)
অদ্বৈত বেদান্তে জগতের উৎপত্ত্যাদিবোধক শ্রুতি বাক্যসকল
নিষেধ্য সমর্পণের দ্বারা নির্ব্বিশেষ ব্রহ্মজ্ঞানোৎপত্তিতে সহকারিমাত্র। আচার্য্য শঙ্কর
ব্রহ্মসূত্রের (৪।৩।১৪) ভাষ্যে তাহাই স্বীকার করিয়াছেন-
"জগতের উৎপত্ত্যাদিবোধক শ্রুতি বাক্যসকলের অন্যার্থতা
অর্থাৎ প্রয়োজন সম্পাদকতা প্রত্যক্ষভাবে সম্যগ্ অবগত হওয়া যায়। যেমন দেখ-
'তত্রৈতচ্ছুঙ্গমুত্পতিতং সোম্য বিজানীহি নেদমমূলং ভবিষ্যতি'-(ছান্দোগ্য
উপনিষৎ-৬/৮/৩)।
'এই প্রকার হইলে হে সৌম্য, এই দেহরূপ অঙ্কুরকে রসাদিভাবে
পরিণত অন্ন হইতে উদ্গত বলিয়া জানিবে, ইহা অমূল অর্থাৎ কারণরহিত হইবে না।' এইপ্রকারে
দেহাদিরূপ বিশেষের উল্লেখ করিয়া উদর্কে (পরে, ছান্দোগ্য উপনিদ ৮।৬।৪ বাক্যে) জগতের
কারণস্বরূপ এক সদ্বস্তুরই বিজ্ঞেয়তা শ্রুতি প্রদর্শন করিতেছন।
আর 'যতো বা ইমানি ভূতানি জায়ন্তে৷
যেন জাতানি জীবন্তি৷ যত্প্রয়ন্ত্যভিসংবিশন্তি৷ তদ্বিজিজ্ঞাসস্ব৷ তদ্ব্রহ্মেতি৷'-(তৈত্তিরীয়
উপনিষৎ-৩।১।১)
অর্থাৎ যাঁহা হইতে এই ব্রহ্মাদি তৃণপর্য্যন্ত দেহবর্গ উৎপন্ন হয়, উৎপন্ন হইয়া প্রাণধারণ করে অর্থাৎ বর্ধিত হয়, আবার বিনাশকালে যাঁহাকে প্রাপ্ত হয়, যাহাতে প্রবেশ করে অর্থাৎ অভেদ হইয়া যায় অর্থাৎ উৎপত্তি,স্থিতি ও লয়কালে দেহবর্গ যৎসত্তা ত্যাগ করে না, এইরূপ যে ব্রহ্মের লক্ষণ, সেই ব্রহ্মকে স্পষ্ট করিয়া জান। ইত্যদি শ্রুতি হইতেও নির্ব্বিশেষ ব্রহ্মেরই জ্ঞেয়তা অবগত হওয়া যায়।
ইহাই নির্গুণব্রহ্মবিদ্যা অনুশীলনকারীর বিবর্ত্তবাদাবলম্বী
পারমার্থিক দৃষ্টি। আবার ব্যাবহারিক দৃষ্টিতে কিন্তু মায়ারূপ উপাধিযুক্ত সর্বজ্ঞ সর্বশক্তিমান্
পরমেশ্বর জগতের অভিন্ন নিমিত্তোপাদান কারণ। ঊর্ণনাভি (মাকড়সা) শরীরের তন্তুরূপে পরিণামের
ন্যায় মায়ারূপ উপাধির পরিণামে মায়ী মহশ্বরের অভিন্ন নিমিত্তোপাদানতা সিদ্ধ হয়। ব্যবহারিক
দৃষ্টিতে অদ্বৈতবেদান্তে পরিণামবাদও অঙ্গীকৃত হয়। শঙ্করাচার্য্যে ব্রহ্মসূত্র (২।১।১৪)
ভাষ্যে তাহা স্বীকৃত-
কিন্তু ব্যবহার অবস্থাতে শ্রুতিতেও ঈশ্বরাদি ব্যবহারের
কথা বলা হয়েছে। যথা-
'এষ সর্বেশ্বর এষ ভূতাধিপতিরেষ ভূতপাল এষ সেতুর্বিধরণ
এষাং লোকানামসংভেদায়'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪/৪/২২)।
অর্থাৎ'ইনি সকলের ঈশ্বর, ইনি ভূতসকলের অধিপতি, ইনি ভূতসকলের
পালক, এই ভূরাদি লোকসকলের অসংমিশ্রণের জন্য ইনি বিধারক সেতুস্বরূপ।'
আর ভগবদ্গীতাতেও সেইরূপ ব্যবহারাবস্থাতে জীব ও ঈশ্বরাদি
ভেদব্যবহার ঈশ্বর কর্তৃক কথিত হইয়াছে- 'ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং হৃদ্দেশের্জুন
তিষ্ঠতি৷ ভ্রামযন্সর্বভূতানি যন্ত্রারূঢানি মায়য়া'-(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা- ১৮।৬১)
অর্থাৎ 'হে অর্জুন, অন্তর্যামী ঈশ্বর সর্বজীবের হৃদয়ে
অধিষ্ঠিত হইয়া সর্বভূতকে যন্ত্রারূঢ় পুত্তলিকার ন্যায় মায়া দ্বারা চালিত করিতেছেন।
'
ভগবান সূত্রকার বাদরায়ণও পরমার্থ অভিপ্রায়ে 'তদনন্যত্বম্' এবং ব্যবহারিক অভিপ্রায়ে কিন্তু 'স্যাল্লোকবতৎ' সূত্রের মাধ্যমে ব্রহ্মের মহাসমূদ্রস্থানীয়তার কথা বলিতেছেন। আর কার্য্যপ্রপঞ্চকে প্রত্যাখ্যান না করিয়া সগুণ উপাসনাতে উপযোগী হইবে, এই অভিপ্রায়ে পরিণাম প্রক্রিয়াকে আশ্রয় করিয়াছেন।
No comments:
Post a Comment