সামবেদের তলবকার ব্রাহ্মণের অন্তর্গত কেনোপনিষদের প্রথম খণ্ডে বর্ণিত আছে-
যদ্বাচানভ্যুদিতং যেন বাগভ্যুদ্যতে ৷
তদেব ব্রহ্ম ত্বং বিদ্ধি নেদং যদিদমুপাসতে ৷৷ কেন উপনিষৎ ১.৪ ৷৷
ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য্যের 'শাঙ্করভাষ্য' অনুসারে ভাবার্থঃ- যে চৈতন্যমাত্রসত্তাস্বরূপ ব্রহ্ম, যিনি বাক্যের দ্বারা অপ্রকাশিত তিনিও বাক্, আবার বাক্ জিহ্বামূল প্রভৃতি আটটি স্থান সংলগ্ন অগ্নিদেবতা কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত বর্ণসকলের অভিব্যক্তকারী বাগিন্দ্রিয়কেও বুঝায় এবং অর্থসম্বন্ধ বিশিষ্ট নির্দিষ্টসংখ্যক নির্দিষ্টক্রমে প্রযুক্ত বর্ণসকলকে অথবা ঐ প্রকারে বর্ণসকলের ধ্বনির দ্বারা অভিব্যক্ত শব্দও, পদ বা বাক্ বলিয়া কথিত হয়।
'অকারো বৈ সর্বা বাক্সৈষাস্য স্পর্শান্তঃস্থোষ্মভির্ব্যজ্যমানা বহ্বী নানারূপা ভবতি'-(ঐতরেয় আরণ্যক ২।৩।৬।১৮)
অর্থাৎ 'অকারই সম্পূর্ণ বাক্ অর্থাৎ অকার প্রধান ওঙ্কার (অ+উ+ম) দ্বারা উপলক্ষিত স্ফোট নামক চৈতন্যের শক্তিই সকল শব্দের মূল যাহা স্পর্শ, অন্তঃস্থ এবং উষ্ম প্রভৃতি বর্ণদ্বারা অভিব্যক্ত হইয়া বহু নাম ও নানারূপ হইয়া থাকে।'
এবং নিয়ত ঋক্ মন্ত্র, অনিয়ত যজুঃমন্ত্র, গীতিবিশিষ্ট সামমন্ত্র এবং সত্য ও মিথ্যাবচন-এই যাঁহার বিকার তাহা (অর্থাৎ সেই মূল বাক্ বা ব্রহ্ম), সেই পদরূপ পরিচ্ছিন্ন বাকের দ্বারা এবং বাগিন্দ্রিয়রূপ গৌনবাকের দ্বারা অপ্রকাশিত অর্থাৎ অনুচ্চারিত। পক্ষান্তরে ব্রহ্মের নিমিত্তই যে বাগিন্দ্রিয়ের সহিত শব্দ অভীষ্ট অর্থকে প্রকাশ করিতে উচ্চারিত হয় অর্থাৎ চৈতন্যজ্যোতিঃস্বরূপ ব্রহ্মের নিমিত্তই যে শব্দ প্রকাশিত হয় এবং বাগিন্দ্রিয় প্রেরিত হয়, এইকথা 'যিনি বাক্যেরও বাক্যস্বরূপ' এইরূপে এই উপনিষদের ২য় মন্ত্রে বলা হইয়াছে। আবার বৃহদারণ্যক উপনিষদে-
"বদন্বাক্"-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-১।৪।৭)
অর্থাৎ 'শব্দ সম্পাদন করেন বলিয়া তাঁহার নাম বাক্।'
যো বাচমন্তরো যময়তি-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৩।৭।১৭)
অর্থাৎ 'যিনি অন্তরে থাকিয়া বাক্যকে নিয়ন্ত্রিত করেন।' ইত্যাদি শ্রুতিবাক্যেও বলা হইয়াছে।
'যে বাক্ পুরুষে অ্থাৎ চেতন প্রাণীতে আছেন, তিনিই শব্দে স্থিত, তাঁহাকে কোন ব্রহ্মনিষ্ঠ পুরুষই জানিতে পারেন'-এইভাবে শ্রুতিতে মূল বাক্ বা ব্রহ্মের সম্বন্ধে প্রশ্ন উঠাইয়া উত্তরে বলা হইয়াছে-'যাঁহার নিমিত্ত জীব স্বপ্নে কথা বলে তিনিই মূল বাক্।' অর্থাৎ সেই চৈতন্যজ্যোতিঃস্বরূপ নিত্য বাক্ই বক্তার বচনশক্তি। শ্রুতিতেও আছে-
"ন হি বক্তুর্বক্তের্বিপরিলোপো বিদ্যতে"- -(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪।৩।২৬)
অর্থাৎ 'বক্তার (নিত্য) বচনশক্তির (ব্রহ্মের) কখনই বিনাশ হয় না।'
অতএব হে শিষ্য, সেই নিজস্বরূপকেই তুমি ব্রহ্ম বলিয়া জানিও কারণ বৃহৎ বলিয়া তাঁহাই সর্বোৎকৃষ্ট ভূমা সংজ্ঞক ব্রহ্ম। বাকের বাক্, চক্ষুর চক্ষু, কর্ণের কর্ণ, মনের মন, কর্তা, ভোক্তা, বিজ্ঞাতা, নিয়ন্তা, শাসনকর্তা, বিজ্ঞানস্বরূপ, আনন্দস্বরূপ ব্রহ্ম ইত্যাদি যে সমস্ত ব্যবহার, সর্বলোকব্যবহারের অবিষয় নির্বিশেষ, অতিশয় সাম্য (সর্বত্র একরূপ) ব্রহ্মেতে বাগিন্দ্রিয় প্রভৃতি উপাধি নিমিত্তই প্রযুক্ত হয়, সেই সমস্ত উপাধিকে নিরাকৃত করিয়া নিজের নির্বিশেষ আত্মাকেই ব্রহ্ম বলিয়া জানিবে-ইহাই শ্রুতিতে 'তৎএব' শব্দের তাৎপর্য্যার্থ। এমনকি এই যে লোকে বিবিধ অনাত্ম-উপাধিরূপ ভেদবিশিষ্ট ঈশ্বরাদিকে উপাসনা অর্থাৎ ধ্যান করে ইনিও শুদ্ধ ব্রহ্মসংজ্ঞক নন। এই বাক্য দ্বারা অনাত্মা উপাধি প্রভৃতির অব্রহ্মত্ব বলা হইয়াছে। নির্বিশেষ আত্মাতেই ব্রহ্মবুদ্ধি করিতে হইবে এই নিয়ম করিবার জন্য অথবা আত্মভিন্ন পদার্থে ব্রহ্মবুদ্ধির নিবৃত্তি করিবার জন্য 'ইহা ব্রহ্ম নহে' এই বাক্য শ্রুত হইয়াছে।.
No comments:
Post a Comment