Friday, 7 August 2020

অদ্বৈতবেদান্তে জীবঃ


ইতোমধ্যে আলোচনা করিয়াছি অদ্বৈতবেদান্তে ব্রহ্মই অজ্ঞানের (-মায়ার) আশ্রয় ও বিষয়। পরমার্থতঃ ব্রহ্মভিন্ন জীব নামক কিছুই নাই। জীব স্বরূপতঃ ব্রহ্মই, বুদ্ধিরূপ উপাধিসম্বন্ধই জীবের জীবত্ব। সেই সম্বন্ধ ব্রহ্মাত্মজ্ঞানোদয় পর্য্যন্ত বর্তমান থাকে। ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য্য ব্রহ্মসূত্রের (২.৩.৩০) শারীরকভাষ্যে তাহা স্পষ্ট করিতেছেন-

" বুদ্ধিসংযোগ (বুদ্ধির সহিত চৈতন্যের সম্বন্ধ) যাবদাত্মভাবী অর্থাৎ (ব্রহ্মাত্মজ্ঞানোৎপত্তি দ্বারা জীবাত্মভাবের উপশম না হওয়া পর্য্যন্ত স্থায়ী)। এই আত্মা যতকাল পর্য্যন্ত সংসারী থাকে, অর্থাৎ সম্যগ্ দর্শনের দ্বারা ইহার সংসারিত্ব যতকাল পর্য্যন্ত নিবৃত্ত না হয়, ততকাল পর্য্যন্ত বুদ্ধির সহিত ইহার সংযোগ নিবৃত্ত হয় না। আর যতকাল পর্য্যন্ত বুদ্ধিরূপ উপাধির সহিত এই সম্বন্ধ থাকে, ততকাল পর্য্যন্তই জীবের জীবত্ব ও সংসারিত্ব। পরমার্থতঃ কিন্তু বুদ্ধিরূপ উপাধির সহিত সম্বন্ধের দ্বারা পরিকল্পিত স্বরূপ ব্যতিরেকে জীব নামক কিছুই নাই। যেহেতু উপনিষদৎসকলের অর্থ নিরূপণ করিলে নিত্যমুক্তস্বরূপ সর্ব্বজ্ঞ ঈশ্বর হইতে ভিন্ন দ্বিতীয় চেতন ধাতু(-পদার্থ) উপলব্ধ হয় না;

'নান্যোতোস্তি দ্রষ্টা শ্রোতা মন্তা বিজ্ঞাতা'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৩।৭।২৩)
অর্থাৎ 'ইঁহা হইতে ভিন্ন কোন দ্রষ্টা, শ্রোতা, মননকর্ত্তা ও বিজ্ঞাতা নাই।'

'নান্যদতোস্তি দ্রষ্টৃ শ্রোতৃ মন্তৃ বিজ্ঞাতৃ'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৩।৮।১১)
অর্থাৎ ''ইঁহা হইতে ভিন্ন দ্রষ্টা, শ্রোতা, মনতা ও বিজ্ঞাতা কেহ নাই।'

'তত্ত্বমসি'-(ছান্দোগ্যোপনিষৎ ৬।৮।৭)
অর্থাৎ 'তুমিই তৎস্বরূপ।'

'অহং ব্রহ্মাস্মি' -(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-১।৪।১০)
অর্থাৎ 'আমিই ব্রহ্ম।'

ইত্যাদি শত শত শ্রুতি হইতে ইহা অবগত হওয়া যায়।....."

বুদ্ধির (-অন্তঃকরণের) সহিত ব্যাপক ব্রহ্মচৈতন্যের যে সম্বন্ধবশতঃ তিনি জীব নামে কথিত হন, সেইসম্বন্ধ কি প্রকার, এই বিষয়ে বিভিন্ন অদ্বৈতবাদী আচার্য্যের বিভিন্ন মতবাদ পরিদৃষ্ট হয়। যথা-

পূজ্যপাদ বিবরণাচার্য্য কর্তৃক বর্ণিত প্রতিবিম্ববাদ মতে-'অজ্ঞানে (-অবিদ্যাতে) প্রতিবিম্বিত ব্রহ্মচৈতন্যকে জীব বলা হয়।' পূজ্যপাদ্ আচার্য্য বিদ্যারণ্য স্বামীর আভাসবাদে জীবের স্বরূপ এইপ্রকার-'জলপূর্ণ ঘটে ব্যাপক আকাশের প্রতিবিম্বের ন্যায় অন্তঃকরণে যে সর্ব্বব্যাপী ব্রহ্মচৈতন্যের প্রতিবিম্ব (-চিদাভাস) এবং সেই অন্তঃকরণের অধিষ্ঠানভূত যে কূটস্থ ব্রহ্মচৈতন্য, এই উভয়ের যে আধ্যাসিক মিলিতাবস্থা, ইহাই জীব।' আবার আচার্য্য বাচস্পতি মিশ্র কর্তৃক বর্ণিত অবচ্ছেদবাদে-'আকাশ ব্যাপক পদার্থ হইলেও ব্যবহারিক দৃষ্টিতে ঘট যেমন তাহাকে যেন সসীম করিয়া ফেলে অর্থাৎ ঘটমধ্যগত আকাশ মহাকাশ হইতে যেন ভিন্নই হইয়া পড়ে; তদ্রূপ ব্রহ্মচৈতন্য সর্ব্বব্যাপী হইলেও অন্তঃকরণ যেন তাঁহাকে কতকটা সসীমরূপে বোধ করায়। অন্তঃকরণের দ্বারা সসীমভাব প্রাপ্ত এই যে চৈতন্য, অর্থাৎ অন্তঃকরণাবচ্ছিন্ন চৈতন্য, ইহাই জীব।'

অষ্টাবক্র মুনির মতে-"ভ্রমবশতই আত্মা সংসারী জীবের ন্যায় প্রতিভাত হন। কিন্তু বস্তুতঃ জীব (আত্মা) সংসারী নহেন, কারণ আত্মা স্বভাবতই সাক্ষী, বিভূ, পূর্ণ, এক, মুক্ত, চিদ্রূপ, অক্রিয়, অসঙ্গ, নিঃস্পৃহ শান্তস্বরূপ।"-(অষ্টাবক্র গীতা, আত্মানুভব উপদেশ-১২)

মহাভারতের উদ্যোগপর্বে ভগবান সনৎ-সুজাত বলিতেছেন-"ব্রহ্মে নানাত্ব কল্পনা করিলে বহুদোষ (নানারূপে পরিণামহেতু ব্রহ্মের অনিত্যত্বাদি দোষ) অপরিহার্য হইবে। বস্তুতঃ অনাদি মায়াযোগেই নিত্যজীবসমূহ উৎপন্ন হয়। মায়িকভেদ স্বীকার করিলেও ব্রহ্মের স্বরূপমহিমা কিছু মাত্র ক্ষুণ্ন হয় না। অদ্বিতীয় পরমাত্মার মায়িক বহুরূপত্বে কোন দোষ হয় না। সৃষ্ট জীব-জগৎ সব মায়াময় বলিয়া ব্রহ্ম নির্বিকার সদা অপরিণামীরূপেই বিরাজমান থাকেন। অনাদি মায়াযোগেই বিভিন্ন জীব সৃষ্টি হয় জানিবে।"-(সুনাৎ-সুজাতীয় সংবাদ, প্রথম অধ্যায়-২০)

অদ্বৈতবেদান্তে জীব নিত্য, নিত্যচৈতন্যস্বরূপ এবং স্বরূপত ব্রহ্ম হওয়ায় বিভু হইলেও বদ্ধদশাতে অবিদ্যা ও তদুথ্থ অন্তঃকরণের পরিমাণানুযায়ী মধ্যমপরিমাণ, কর্ত্তা ভোক্তা এবং পরমেশ্বরের কল্পিত অংশরূপে অঙ্গীকৃত হয়। জীবের কর্ত্তৃত্ব ঈশ্বরাধীন।....................................

No comments:

আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...