শ্রুতিতে
চতুর্মহাবাক্যের মধ্যে অথর্ববেদীয়া মহাবাক্য হল ‘অয়মাত্মা ব্রহ্ম’ অর্থাৎ আত্মাই ব্রহ্ম।
মাণ্ডুক্য উপনিষদের প্রারম্ভে আগম প্রকরণের আলোচ্য বিষয় হইল ওঙ্কারের সর্ব্বাত্মকতা
প্রতিপাদন। যথা-
ॐ ইত্যেতদক্ষরমিদঁ সর্বং তস্যোপব্যাখ্যানং
ভূতং
ভবদ্ ভবিষ্যদিতি সর্বমোঙ্কার এব
যচ্চান্যত্
ত্রিকালাতীতং তদপ্যোঙ্কার এব .. ১..
শাঙ্করভাষ্য
অনুসারে ভাবার্থঃ-পরমহংস পরিব্রাজক ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য্যের ভাষ্য হইল- ওঙ্কারের তত্ত্বনির্ণয়ই
যে আত্মতত্ত্ববোধের উপায়, তাহা জানা যায় কিরূপে?
ওঙ্কারের
তত্ত্বনির্ণয়ই যে আত্মতত্ত্ববোধের উপায়, তাহা জানা যায় কিরূপে? হ্যাঁ বলা হইতেছে এই
'ওঙ্কারই শ্রেষ্ঠ আলম্বন (ধ্যেয়)', 'হে সত্যকাম এই যে ওঙ্কার, ইহাই পর ও অপর ব্রহ্ম;
সেইজন্য ওঙ্কারবিৎ পুরুষ এই ওঙ্কার আলম্বন দ্বারা (উত্তরায়ণ ও দক্ষিণানায়নের মধ্যে)
একটিকে প্রাপ্ত হন।' 'আত্মাকে ॐ ইত্যাকারে চিন্তা করিবে।' 'ওঙ্কারই ব্রহ্ম',
'ওঙ্কারই এই সমস্ত' ইত্যাদি শ্রুতি হইতে তাহা জানা যায়। রজ্জু প্রভৃতি সত্য পদার্থ
যেমন সর্পাদি-বিতর্কের আশ্রয়, তেমনি যথার্থ সত্য অদ্বিতীয় আত্মাই প্রাণাদি বিভিন্ন
কল্পিত ভাবের আশ্রয়। উক্ত দৃষ্টান্তটি যেরূপ ঠিক, সেইরূপই আত্মাতে প্রাণাদি বিকল্পবুদ্ধির
বিষয়ীভূত সমস্ত বাক্-প্রপঞ্চ বা শব্দরাশিও ওঙ্কারস্বরূপই, সেই ওঙ্কারও আবার নিশ্চয়ই
আত্মস্বরূপ; কেননা ওঙ্কারই আত্মার অভিধায়ক বা প্রতিপাদক। শব্দমাত্রই ওঙ্কার বিকার
(অর্থাৎ ওঙ্কার হইতে উৎপন্ন), সেই শব্দের অভিদেয় প্রাণাদি পদার্থমাত্রই আত্ম-বিকল্প
(আত্মাতে কল্পিত); সুতরাং সে সকলের শব্দাতিরিক্ত সত্তাই নাই। 'বিকার মাত্রই বাক্যারব্ধ
নাম মাত্র।' 'এই ব্রহ্মসম্বন্ধী এই সমস্ত জগৎই বাক্যরূপ দীর্ঘসূত্রময় নামরূপ রজ্জু
দ্বারা আবদ্ধ।' এই সমস্তই নামে স্থিত; ইত্যাদি শ্রুতি হইতে প্রমাণিত হয়। এইজন্য বলিতেছেন-
এই
যে অভিধেয়রূপ (বাক্যার্থ-স্বরূপ) বিষয়সমূহ, যেহেতু তাহা স্বীয় অভিধান বা বাচক শব্দ
হইতে অতিরিক্ত নহে, এবং যেহেতু বাচকশব্দমাত্রই ওঙ্কার হইতে অনতিরিক্ত; অতএব ওঙ্কারই
এই দৃশ্যমান সমস্ত পদার্থ। বাচ্য-বাচক সম্বন্ধ হইতেই পরব্রহ্মের প্রতীতি হইয়া থাকে;
সুতরাং তাহাও ওঙ্কার স্বরূপই বটে। পর ও অপরব্রহ্ম স্বরূপ সেই ॐ এই অক্ষরের উপব্যাখ্যান অর্থাৎ ইহাই ব্রহ্মপ্রতীতির উপায়স্বরূপ; অতএব
ব্রহ্মসন্নিহিতরূপে স্পষ্টাক্ষরে প্রকৃষ্টরূপে কথনরূপ (বর্ণনাত্মক) ইহার উপব্যাখ্যান
আরব্ধ হইতেছে, বুঝিতে হইবে। পূর্বোক্ত যুক্তি অনুসারে বুঝিতে হইবে ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্ত্তমান,
এই কালত্রয়বর্ত্তী যেকোন বস্তু, তাহাও ওঙ্কারস্বরূপই। এতদতিরিক্ত প্রকৃতি প্রভৃতি যে
সমস্ত পদার্থ উক্তকালত্রয় দ্বারা পরিচ্ছেদ যোগ্য নহে, অথচ কার্য্য-গম্য-মাত্র (কার্য্য-দর্শনে
অনুমেয় মাত্র), তাহাও এই ওঙ্কার হইতে অতিরিক্ত নহে।১
পরবর্তীতে
সেই ব্রহ্মের সর্ব্বাত্মকতা, আত্মস্বরূপতা বিষয়ক শ্রুতি মহাবাক্যটীর উল্লেখ রহিয়াছে-
‘সর্বম্
হ্যেতদ্ ব্রহ্ম, অয়মাত্মা ব্রহ্ম,........'।২
শাঙ্করভাষ্য
অনুসারে ভাবার্থঃ-এই সমস্তই ব্রহ্মস্বরূপ, অর্থাৎ যে সমস্তকে ওঙ্করাত্মক বলা হইয়াছে,
সেই সমস্তই ব্রহ্মস্বরূপ। সেই ব্রহ্মকে ইতঃপূর্ব্বে পরোক্ষভাবে নির্দ্দেশ করা হইয়াছে,
এখন আবার সাক্ষাৎ সম্বন্ধে বিশেষ করিয়া নির্দ্দেশ করিয়া বলিতেছেন যে- "এই আত্মা
ব্রহ্মস্বরূপ"। 'অয়ম্ আত্মা' এই বাক্যে 'অয়ং' শব্দ দ্বারা চতুস্পাদবিশিষ্টরূপে
যাহার বিভাগ করা হইতেছে, সেই আত্মাকে অভিনয় করিয়া প্রত্যক্ (জীব) আত্মারূপে নির্দ্দেশ
করিতেছেন।
বিদ্যারণ্য স্বামী "অয়মাত্মা ব্রহ্ম" অথর্ববেদীয় এই মহাবাক্যের ব্যাখ্যায় বলিতেছেন-" 'অয়ম' এই শব্দের উচ্চারণ দ্বারা আত্মার স্বপ্রকাশতা ও অপরোক্ষতা বুঝানো অভিপ্রেত। অহঙ্কার হইতে আরম্ভ করিয়া দেহ পর্য্যন্ত যে সঙ্ঘাত, তাহার অন্তরে সাক্ষিরূপে যিনি বিদ্যমান, তিনিই এই স্থলে 'আত্মা' শব্দদ্বারা লক্ষিত হইয়াছেন। দৃশ্যমান সমগ্র সৃষ্টির যাহা মূল কারণ তাহাই 'ব্রহ্ম' শব্দ দ্বারা কথিত হইয়াছে। সেই ব্রহ্ম স্বপ্রকাশ আত্মস্বরূপ।"-(পঞ্চদশী, মহাবাক্যবিবেক-প্রকরণ-৭,৮)
No comments:
Post a Comment