Wednesday, 14 April 2021

ব্রহ্মবিদ্যা প্রাপ্তির উপায়ঃ-

 



সামবেদীয় তলবকার ব্রাহ্মণের অন্তর্গত কেন উপনিষদে বর্ণিত আছে-

তস্যৈ তপো দমঃ কর্মেতি প্রতিষ্ঠা, বেদাঃ সর্বাঙ্গানি, সত্যমায়তনম্ ।

-(কেনোপনিষৎ-৪/৮)

ভগবৎপাদ্ শ্রী শঙ্করাচার্যের 'শাঙ্করভাষ্য' অনুসারে ভাবার্থঃ- আচার্য বলিলেন - তোমার নিকট পূর্বে যে ব্রাহ্মী উপনিষৎ অর্থাৎ ব্রহ্মবিদ্যা বলিলাম সেই পূর্বকথিত উপনিষদের ( ব্রহ্মবিদ্যার ) প্রাপ্তির উপায়স্বরূপ হইতেছে তপস্যা প্রভৃতি। 'তপঃ' শব্দে এখানে শরীর, ইন্দ্রিয় ও মনের একাগ্রতা বুঝাইতেছে। 'দম' অর্থ ইন্দ্রিয়ের বিষয়ভোগে নিবৃত্তি। কর্ম শব্দে অগ্নিহোত্র প্রভৃতি শাস্ত্রীয় কর্মকে বুঝিতে হইবে। দেখাও গিয়াছে যে এই সকল উপায়দ্বারা যিনি সংস্কারযুক্ত, সেই পুরুষেরই চিত্তশুদ্ধিদ্বারা তত্ত্বজ্ঞান উৎপত্তি হয়। আবার ইহাও দেখা গিয়াছে যে যাহার চিত্তের পাপ (মলিনতা) বিনষ্ট হয় নাই, তাহাকে ব্রহ্মবিদ্যার উপদেশ করিলেও ব্রহ্মবিষয়ে অজ্ঞান বা বিপরীতজ্ঞান হইয়া থাকে, যেমন (ছান্দোগ্য উপনিষদবর্ণিত) ইন্দ্র ও বিরোচন প্রভৃতির হইয়াছিল।

সুতরাং এই জন্মে বা অতীতে বহু জন্মান্তরে তপস্যা প্রভৃতি দ্বারা যাঁহার চিত্ত শুদ্ধ হইয়াছে, তাঁহারই উপনিষদুক্ত জ্ঞান উৎপন্ন হয়।

"যাঁহার পরমেশ্বরের প্রতি পরাভক্তি আছে, আবার পরমেশ্বরের প্রতি যেরূপ, গুরুতেও যদি সেইরূপ ভক্তি থাকে, তাহা হইলে সেই মহাত্মার নিকটেই উপনিষদুক্ত এই সকল তত্ত্ব স্বানুভবযোগ্য হয়।" এই (শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের ৬/২৩) মন্ত্রবর্ণ হইতে এবং

"পাপকর্মের ক্ষয় হইলে লোকের জ্ঞান উৎপন্ন হয়।"-(মহাভারতের শান্তি পর্ব-২০৪/৮)

এই স্মৃতিবাক্য হইতেও ইহা প্রতিপাদিত হয়।

মূলমন্ত্রের 'ইতি' শব্দটি উপলক্ষণার্থ (অর্থাৎ অন্যান্য সাধনের অন্তর্ভুক্তি) বুঝাইবার

জন্য ব্যবহৃত হইয়াছে। এইরূপ ইতি শব্দে 'অমানিত্ব, অদম্ভিত্ব' প্রভৃতিও যে জ্ঞানোৎপত্তির উপকারক, তাহা উল্লিখিত হইয়া যাইতেছে। প্রতিষ্ঠা অর্থ চরণদ্বয়। তপঃ প্রভৃতি ব্রহ্মবিদ্যার চরণদ্বয়ের মতো; যেহেতু তাহারা অর্থাৎ তপঃ প্রভৃতি সাধন থাকিলেই ব্রহ্মবিদ্যা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং অভয় ও আনন্দদানে প্রবৃত্ত হয়, যেমন পায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত হইয়াই পুরুষ কোন কার্যে প্রবৃত্ত হয়। ঋক্ প্রভৃতি চারিবেদ এবং শিক্ষা প্রভৃতি ছয় অঙ্গসকলও প্রতিষ্ঠা, কেননা বেদসকল কর্ম জ্ঞানের প্রকাশক এবং বেদাঙ্গগুলি বেদের রক্ষক বলিয়া তাহারা ব্রহ্মবিদ্যার প্রতিষ্ঠা।

সত্যই ব্রহ্মবিদ্যার আয়তন বা আশ্রয়, কারণ যেখানে ব্রহ্মবিদ্যা অবস্থান করেন তাহাই তাঁহার আয়তন বা আশ্রয় হয়। বাক্য, মন ও শরীরের অমায়িত্ব অর্থাৎ অকুটিলতা হইতেছে সত্য। যাঁহারা অমায়াবী অর্থাৎ কূটিলতারহিত সাধু তাঁহাদিগকেই ব্রহ্মবিদ্যা আশ্রয় করে, কিন্তু অসুর প্রকৃতির মায়াবীগণেতে ব্রহ্মবিদ্যা স্থিত হয় না।

শ্রুতিতে আছে- "যাঁহাদিগেতে কুটিলতা, অসত্য ও মিথ্যাচার নাই, ব্রহ্মবিদ্যা তাহাদিগকে আশ্রয় করে।"-(প্রশ্ন উপনিষৎ-১/১৬)

এইজন্য সত্যকে ব্রহ্মবিদ্যার আশ্রয় বলিয়া কল্পনা করা হয়। তপস্যা প্রভৃতির মধ্যেই প্রতিষ্ঠারূপে প্রাপ্ত সত্যের পুনরায় যে আয়তন রূপে গ্রহণ করা হইয়াছে, তাহা সাধনরূপে উহার শ্রেষ্ঠতা জানাইবার জন্য। তাছাড়া স্মৃতিতেও আছে-

"সহস্র অশ্বমেধ যজ্ঞ আর সত্যকে যদি এক তুলা দণ্ডে ধরা হয়, তাহা হইলে সহস্র অশ্বমেধের অপেক্ষা এক সত্যই বিশিষ্ট অর্থাৎ অধিক হয়।"-(বিষ্ণু স্মৃতি-৮).....

 

No comments:

আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...