Saturday, 25 June 2022

উমামহেশ্বরস্তোত্রম্ ও শ্রীশৈলভ্রমরাম্বাস্তুতিঃ-

 


উমামহেশ্বরস্তোত্রম্ 

নমঃ শিবাভ্যাং নবয়ৌবনাভ্যাম্

পরস্পরাশ্লিষ্টবপুর্ধরাভ্যাম্ 

নাগেন্দ্রকন্যাবৃষকেতনাভ্যাম্

নমো নমঃ শঙ্করপার্বতীভ্যাম্  ||১||

ভাবার্থ - নবযৌবনবিশিষ্ট পরস্পর মিলিত শরীরধারী ( অর্ধনারীশ্বর মূর্তি ) শিব ও শিবাকে নমস্কার ।নাগেন্দ্রকন্যা, বৃষকেতনযুক্ত শঙ্কর ও পার্বতীকে পুনঃ পুনঃ নমস্কার ||১||

নমঃ শিবাভ্যাং সরসোৎসবাভ্যাম্

নমস্কৃতাভীষ্টবরপ্রদাভ্যাম্ 

নারায়ণেনার্চিতপাদুকাভ্যাং

নমো নমঃ শঙ্করপার্বতীভ্যাম্  ||২||

ভাবার্থ - নমস্কৃত হইলে অভীষ্ট বরপ্রদানকারী সরস অনন্দময় শিব ও শিবাকে নমস্কার, যাদের পাদুকা নারায়ণ অর্চ্চনা করেছেন ( এমন ) শঙ্কর ও পার্বতীকে পুনঃ পুনঃ নমস্কার ||২||

নমঃ শিবাভ্যাং বৃষবাহনাভ্যাম্

বিরিঞ্চিবিষ্ণ্বিন্দ্রসুপূজিতাভ্যাম্ 

বিভূতিপাটীরবিলেপনাভ্যাম্

নমো নমঃ শঙ্করপার্বতীভ্যাম্  ||৩||

ভাবার্থ - ব্ৰহ্মা, বিষ্ণু ও ইন্দ্র কর্তৃক সুপূজিত বৃষবাহন শিব ও শিবাকে নমস্কার: বিভূতি ও চন্দন বিলেপনযুক্ত শিব ও পার্বতীকে পুনঃ পুনঃ নমস্কার ||৩||

নমঃ শিবাভ্যাং জগদীশ্বরাভ্যাম্

জগৎপতিভ্যাং জয়বিগ্রহাভ্যাম্ 

জম্ভারিমুখ্যৈরভিবন্দিতাভ্যাম্

নমো নমঃ শঙ্করপার্বতীভ্যাম্  ||৪||

ভাবার্থ - জগতের অধিপতি জগতের ঈশ্বর জয়রূপী শরীরধারী শিব ও শিবা কে নমস্কার ( অর্থাৎ জগতের পালক, জগৎ সম্বন্ধে সর্বপ্রকার সামর্থ্য বিশিষ্ট এবং জয়রূপ অর্থাৎ সংসারজয়কারী বা মুক্তিদায়ক বিগ্রহ বা শরীরধারী– এ স্থলে এটাই তাৎপর্য যে, শিব ও ভবানীর শরীর ভক্তের সংসার-শৃঙ্খলা মোচন করে সুতরাং ওটাই জয় ) জম্ভারি ইন্দ্রপ্রমুখ দেবগণ কর্তৃক অভি বন্দিত শঙ্কর-পার্বতীকে পুনঃ পুনঃ নমস্কার ||৪||

নমঃ শিবাভ্যাং পরমৌষধাভ্যাম্

পঞ্চাক্ষরী পঞ্জররঞ্জিতাভ্যাম্ 

প্রপঞ্চসৃষ্টিস্থিতি সংহৃতাভ্যাম্

নমো নমঃ শঙ্করপার্বতীভ্যাম্  ||৫||

ভাবার্থ - শিব ও শিবাকে নমস্কার। পরম ঔষধস্বরূপ পঞ্চাক্ষর ও পঞ্জরাখ্য স্তব দ্বারা রচিত ( স্তুত ) প্রপঞ্চ ( জগৎ ) সৃষ্টিস্থিতিসংহারকারী শঙ্কর-পার্বতীকে পুনঃ পুনঃ নমস্কার ||৫||

নমঃ শিবাভ্যামতিসুন্দরাভ্যাম্

অত্যন্তমাসক্তহৃদম্বুজাভ্যাম্ 

অশেষলোকৈকহিতঙ্করাভ্যাম্

নমো নমঃ শঙ্করপার্বতীভ্যাম্  ||৬||

ভাবার্থ - শিব ও শিবাকে প্রণাম। অতি সুন্দর, যাদের হদয়কমল অত্যন্ত আসক্ত ( অর্থাৎ পরস্পর অত্যন্ত সংবদ্ধ ), নিখিল লােকের একমাত্র হিতকর শঙ্কর-পার্বতীকে পুনঃ পুনঃ নমস্কার ||৬||

নমঃ শিবাভ্যাং কলিনাশনাভ্যাম্

কঙ্কালকল্যাণবপুর্ধরাভ্যাম্ 

কৈলাসশৈলস্থিতদেবতাভ্যাম্

নমো নমঃ শঙ্করপার্বতীভ্যাম্  ||৭||

ভাবার্থ - শিব ও শিবাকে প্রণাম। কলিনাশকারী অস্থিমালা ও কল্যাণদায়ক শরীরবিশিষ্ট কৈলাসপর্বতস্থিত দেবতা শঙ্কর ও পার্বতীকে পুনঃ পুনঃ প্রণাম ||৭||

নমঃ শিবাভ্যামশুভাপহাভ্যাম্

অশেষলোকৈকবিশেষিতাভ্যাম্ 

অকুণ্ঠিতাভ্যাম্  স্মৃতিসম্ভৃতাভ্যাম্

নমো নমঃ শঙ্করপার্বতীভ্যাম্  ||৮||

ভাবার্থ - শিব ও শিবা কে নমস্কার, অশুভাপহারী অশেষলোকবিলক্ষণ, অকুণ্ঠিত, স্মৃতিতে অবস্থিত ( চিন্তার বিষয় ) শঙ্কর পার্বতী কে পুনঃ পুনঃ নমস্কার ||৮||

নমঃ শিবাভ্যাং রথবাহনাভ্যাম্

রবীন্দুবৈশ্বানরলোচনাভ্যাম্ 

রাকাশশাঙ্কাভমুখাম্বুজাভ্যাম্

নমো নমঃ শঙ্করপার্বতীভ্যাম্  ||৯||

ভাবার্থ - শিব ও শিবাকে প্রণাম। রথ ও বাহনযুক্ত, সূর্য্য, চন্দ্র ও অগ্নিরূপ চক্ষুবিশিষ্ট, পূর্ণিমাচন্দ্রের ন্যায় মুখপদ্মের কান্তিবিশিষ্ট শঙ্কর ও পার্বতীকে পুনঃ পুঃ প্রণাম ||৯||

নমঃ শিবাভ্যাং জটিলন্ধরভ্যাম্

জরামৃতিভ্যাং চ বিবর্জিতাভ্যাম্ 

জনার্দনাব্জোদ্ভবপূজিতাভ্যাম্

নমো নমঃ শঙ্করপার্বতীভ্যাম্  ||১০||

ভাবার্থ - শিব ও শিবাকে নমস্কার। জটাধারী জরা ও মৃত্যু কর্তৃক বিবর্জিত ( অর্থাৎ অজর ও অমর ), বিষ্ণু ও ব্ৰহ্মা কর্ক্তৃক পূৃজিত শঙ্কর ও পার্বতীকে পুনঃ পুনঃ নমস্কার ||১০||

নমঃ শিবাভ্যাং বিষমেক্ষণাভ্যাম্

বিল্বচ্ছদামল্লিকদামভৃদ্ভ্যাম্ 

শোভাবতী শান্তবতীশ্বরাভ্যাম্

নমো নমঃ শঙ্করপার্বতীভ্যাম্  ||১১||

ভাবার্থ - শিব ও পার্বতীকে নমঙ্কার। বিষম সংখ্যক চক্ষুর্যুক্ত, বিল্বপত্র ও মল্লিকামালাধারী, শােভাবর্তী ও শান্তবতীশর শঙ্কর-পার্ব্বতীকে বারংবার প্রণাম ||১১||

নমঃ শিবাভ্যাং পশুপালকাভ্যাম্

জগত্রয়ীরক্ষণ বদ্ধহৃদ্ভ্যাম্ 

সমস্ত দেবাসুরপূজিতাভ্যাম্

নমো নমঃ শঙ্করপার্বতীভ্যাম্  ||১২||

ভাবার্থ - শিব ও শিবাকে নমস্কার. পশু (জীব) পালক, জগত্রয়ের রক্ষণে বদ্ধহৃদয়, সমস্ত দেবাসুরপূজিত শঙ্কর ও পার্বতীকে পুনঃ পুনঃ নমস্কার ||১২||

স্তোত্রং ত্রিসন্ধ্যং শিবপার্বতীভ্যাম্

ভক্ত্যা পঠেদ্দ্বাদশকং নরো যঃ ।

স সর্বসৌভাগ্য ফলানি ভুঙ্ক্তে

শতায়ুবন্তে শিবলোকমেতি ||১৩||

ভাবার্থ - যে ব্যাক্তি ত্রিসন্ধ্যায় ভক্তিপূর্বক শিবপার্বতীর দ্বাদশ (শিবপার্বতীভ্যাম্ উপলক্ষিতং দ্বাদশকং) সংখ্যক স্তব পাঠ করে, সে শতায়ু লাভ করে সর্বপ্রকার সৌভাগ্য ফলভোগ করে ও অন্তে শিবলােক প্রাপ্ত হয় ||১৩||

শ্রীশৈলেশভ্রমরাম্বাস্তুতিঃ/ভ্রমরাম্বাষ্টকম্ অথবা শ্রীমাতৃস্তবঃ

চাঞ্চল্যারুণলোচনাঞ্চিতকৃপাচন্দ্রার্কচূড়ামণিং

চারুস্মেরমুখাং চরাচরজগৎসংরক্ষণীং তৎপদাম্ ।

চঞ্চচ্চম্পকনাসিকাগ্রবিলসন্মুক্তামণীরঞ্জিতাং

শ্রীশৈলস্থলবাসিনীং ভগবতীং শ্রীমাতরং ভাবয়ে ||১||

ভাবার্থ - যার আরক্ত নয়নে চঞ্চলতা দ্বারা কূপা অভিব্যক্ত, অর্দ্ধচন্দ্র যার চূড়ামণি, দোদুল্যমান চম্পকাকৃতি স্বর্ণভূষণভূষি ত নাসিকার অগ্রভাগ দিব্যমুক্তা-বিরাজিত হয়ে যার প্রীতিবর্দ্ধন করছে, সেই স্মেরচারু-বদনা, চরাচরজগৎ-পালিনী, তৎপদ প্রতিপাদ্য অর্থাৎ ঈশ্বরস্বরূপা শ্রীশৈলবাসিনী ভগবতী

শ্ৰীমাতাকে ভাবনা করি ||১||

কস্তূরীতিলকাঞ্চিতেন্দুবিলসৎপ্রোদ্ভাসিভালস্থলীং

কর্পূরদ্রবমিশ্রচূর্ণখদিরামোদোল্লসদ্বীটিকাম্ ।

লোলাপাঙ্গতরঙ্গিতৈরধিকৃপাসারৈর্নতানন্দিনীং

শ্রীশৈলস্থলবাসিনীং ভগবতীং শ্রীমাতরং ভাবয়ে ||২||

ভাবার্থ - যার কস্তূরীতিলক যােগে শােভমান শশিকলা-সমুদ্ভাসিত স্বভাবসুন্দর ললাট, মুখে কর্পূরদ্রব সংযুক্ত স-চূর্ণ খদির-সুরভি তাম্বুল, করুণা- পূরিত অচল অপাঙ্গভঙ্গী দ্বারা প্রণত জনগণের আনন্দবিধায়িনী সেই শ্রীশৈলবাসিনী ভগবতী মাতাকে ভাবনা করি ||২||

রাজন্মত্তমরালমন্দগমনাং রাজীবপত্রেক্ষণাং

রাজীবপ্রভবাদিদেবমকুটৈ রাজৎপদাম্ভোরুহাম্ ।

রাজীবায়তমন্দমণ্ডিতকুচাং রাজাধিরাজেশ্বরীং

শ্রীশৈলস্থলবাসিনীং ভগবতীং শ্রীমাতরং ভাবয়ে ||৩||

ভাবার্থ - যার সুঠাম ধীরগমন মত্তমরালগমনতুল্য, নয়ন পদ্মপলাশ সদৃশ, পাদপদ্ম পদ্মযোনিপ্রমুখ দেবতাগণের মুকুটনিচয়ে রঞ্জিত এবং স্তনযুগল প্রফুল্লকমলবৎ আয়ত ও ময়ূরপুচ্ছে ভূষিত, সেই শ্রীশৈলস্থলবাসিনী শ্রীমাতা ভগবতী রাজরাজেশ্বরীকে ভাবনা করি ||৩||

ষট্তারাং গণদীপিকাং শিবসতীং ষড়্বৈরিবর্গাপহাং

ষট্চক্রান্তরসংস্থিতাং বরসুধাং ষড়্যোগিনীবেষ্টিতাম্ ।

ষট্চক্রাঞ্চিতপাদুকাঞ্চিতপদাং ষড়্ষভাবগাং ষোড়শীং

শ্রীশৈলস্থলবাসিনীং ভগবতীং শ্রীমাতরং ভাবয়ে ||৪||

ভাবার্থ - যিনি ষট্তারা ও গণদীপিকা নামে কথিত, যিনি মহাদেবের সহধর্মিণী, যিনি কামাদি ষড়রিপুকে সংহার করেন, ( জীবশরীরস্থিত ) ষট্চক্রাভ্যন্তরে যার অধিষ্ঠান, যিনি পরমামৃতরূপিণী, ( ডাকিনী, রাকিণী, লাকিনী, সাকিনী, শাকিনী, ও হাকিনী ) এই ছয়টি যােগিনী যাকে পরিবেষ্টন করে রয়েছে, ( ষােড়শদল চক্র, অষ্টদল চক্র, চতুর্দশার চক্র, বহির্দশার চক্র, অন্তর্দশার চক্র এবং অষ্টার চক্র) এই ষটচক্রস্থিত পাদুকাতে যার পদম্বয় বিদ্যমান, যিনি ষড়ভাবের ( জন্ম, বিদ্যমানতা, বৃদ্ধি, হ্রাস, পরিবর্তন ও ধ্বংস এই ছয় অবস্থায় ) অধিষ্ঠাত্রী, এবং যিনি ষোড়শীরূপা, সেই শৈলবাসিনী ভগবতী মাতাকে আমি ভাবনা করি ||৪||

( বিশেষ কথা – ষট্তারা–ছয়টি তার অর্থাৎ প্রণব বাহার মন্ত্রমূর্তিতে বিদ্যমান, তিনি ষট্তারা। তন্ত্রশান্ত্রে এ বিষয়ে প্রমাণ, যথা-

শ্রীপরা বাগভবাদ্যৈশ্চ ঈশ্বরী তারমন্মথৈঃ।

আদ্যভুতৈর্ভিদ্যমানা সুন্দরী ষড়্ বিধা ভবেৎ ॥

ত্রিপুরসুন্দরীর বীজমন্ত্রপূর্ণ এই তান্ত্রিক বচনের ব্যাখ্যা করব না, কেবল 'ষট্' আর 'তার' এই দুইটি পদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য প্রমাণ উদ্ধত হইল ।

গণদীপিকা – গণ এবং কূট একার্থক শব্দ ; ত্রিপুরসুন্দরীমন্ত্র ত্রিকুট, 'দীপনী' বিদ্যা প্রত্যেক কুটেরই আছে। মন্ত্রসমূহের দীপ্তি সম্পাদন কযরেন বলে এই বিদ্যার নাম 'দীপনী', মন্ত্রের বীর্য্যই দীপ্তি। তন্ত্রশান্ত্রে কথিত হয়েছে;-

‘এষা তু দীপনী বিদ্যা অজপা প্রাণরূপিণী

********************************

দীপনেনৈৰ যুক্তা সর্বে মন্ত্রা বীর্ঘ্যবস্তো ভবন্তি।’  ত্রিকুটমন্ত্রের পূর্বে উচ্চারণীয় পঞ্চাক্ষর প্রভৃতি মন্ত্র দীপনী বিদ্যা। মন্ত্রগণের দীপ্তিবিধায়িনী বলে দীপনীই গণদীপিকা নামে গৃহীত হয়েছে। )

শ্রীনাথাদৃতপালিতাত্রিভুবনাং শ্রীচক্রসঞ্চারিণীং

জ্ঞানাসক্তমনোজযৌবনলসদ্গন্ধর্বকন্যাদৃতাম্ ।

দীনানামাতিবেলভাগ্যজননীং দিব্যাম্বরালঙ্কৃতাং

শ্রীশৈলস্থলবাসিনীং ভগবতীং শ্রীমাতরং ভাবয়ে ||৫||

ভাবার্থ - শ্রীশব্দযোগে 'নাথ'সমূহস্বরূপ স্থানে যিনি আদৃতা, ( সংস্থার প্রাপ্ত ) ত্রিভুবনকে যিনি ( মূর্তি প্রদান করে ) পালন করেন, শ্রীচক্রে যার সঞ্চার, জ্ঞান-রত কামদেব এবং যুবতী গন্ধর্ব্বকন্যাগণ যার অর্চনা করেন, যিনি দরিদ্রগণেরও অত্যন্ত সৌভাগ্য-সম্পাদন করেন, দিব্য-বসনভূষণ সজ্জিতা সেই শ্রীশৈলস্থলবাসিনী ভগবতী শ্রীমাতাকে ভাবনা করি ||৫||

লাবণ্যাধিকভূষিতাঙ্গলতিকাং লাক্ষালসদ্রাগিণীং

সেবায়াতসমস্তদেববনিতাং সীমন্তভূষান্বিতাম্ ।

ভাবোল্লাসবশীকৃতপ্রিয়তমাং ভণ্ডাসুরচ্ছেদিনীং

শ্রীশৈলস্থলবাসিনীং ভগবতীং শ্রীমাতরং ভাবয়ে ||৬||

ভাবার্থ - যার অঙ্গলতিকা অসামান্য লাবণ্যে বিমণ্ডিত, সেবার্থ সমাগত সমস্ত দেববনিতাগণের সীমন্তভূষণে রঞ্জিত হওয়াতে যার চরণস্থ লাক্ষারাগ অধিকতর উজ্জ্বল, ভাবাবেশে প্রিয়তম মহাদেবকে যিনি একান্ত বশীভূত করেছেন, সেই ভণ্ডাসুরবিমর্দিনী শ্রীশৈলস্থলবাসিনী ভগবতী মাতাকে ভাবনা করি ||৬||

ধন্যাং সোমবিভাবনীয়চরিতাং ধারাধরশ্যামলাং

মুন্যারাধনমেধিনীং সুযুবতীং মুক্তিপ্রদানব্রতাম্ ।

কন্যাপূজনসুপ্রসন্নহৃদয়াং কাঞ্চীলসন্মধ্যমাং

শ্রীশৈলস্থলবাসিনীং ভগবতীং শ্রীমাতরং ভাবয়ে ||৭||

ভাবার্থ - যিনি ধন্যা, যার চরিত্র সােম-বিভাবনীয়, যিনি মেঘসদৃশ শ্যামকান্তি, মুনিগণের আরাধনা-সামর্থ্যের বৃদ্ধিদায়িনী, পূর্ণযুবতী ও মুক্তিদানপরায়ণা ; কুমারী পূজা করলে যার হৃদয় প্রসন্ন হয়, যার মধ্যভাগ কাঞ্চীভূষণশােভিত, সেই শ্রীশৈলস্থলবাসিনী ভগবতী শ্ৰীমাতাকে ভাবনা করি ||৭||

কর্পূরাগরুকুঙ্কুমাঙ্কিতকুচাং কর্পূরবর্ণস্থিতাং

কৃষ্টোৎকৃষ্টসুকৃষ্টকর্মদহনাং কামেশ্বরীং কামিনীম্ ।

কামাক্ষীং করুণারসার্দ্রহৃদয়াং কল্পান্তরস্থায়িনীং

শ্রীশৈলস্থলবাসিনীং ভগবতীং শ্রীমাতরং ভাবয়ে ||৮||

ভাবার্থ - যার স্তনদ্বয় কর্পূর, অগুরু ও কুঙ্কুমে লিপ্ত, যিনি কর্পূরবর্ণস্থিতা, কৃষ্ট ( বিপ্রকৃষ্ট সঞ্চিত ), উৎকৃষ্ট ( প্রারদ্ধ ) এবং সুকৃষ্ট ( সন্নিহিত ক্রিয়মাণ ) ত্রিবিধকর্ম্ম যার কৃপায় দগ্ধ হয়ে যায়, যিনি কামেশ্বরী এবং কামিনীশক্তি, যিনি কামাক্ষী, যার হৃদয় করুণারসে আর্দ্র, কল্পান্তরেও যার স্থিতি অব্যাহত, সেই শ্রীশৈলস্থলবাসিনী ভগবতী শ্রীমাতাকে ভাবনা করি ||৮||

গায়ত্রীং গরুড়ধ্বজাং গগনগাং গান্ধর্বগানপ্রিয়াং

গম্ভীরাং গজগামিনীং গিরিসুতাং গন্ধাক্ষতালঙ্কৃতাম্ ।

গঙ্গাগৌত্মগর্গসন্নুতপদাং গাং গৌতমীং গোমতীং

শ্রীশৈলস্থলবাসিনীং ভগবতীং শ্রীমাতরং ভাবয়ে ||৯||

ভাবার্থ - যিনি গায়ত্রীস্বরূপা ( ব্রাহ্মীশক্তি ), গরুড়ধ্বজা ( বৈষ্ণবীশক্তি ), যিনি শূন্যচারিণী ও গন্ধর্বকৃত গানে প্রীতিমতী, যার মূর্তি গম্ভীর, গতি গজেন্দ্রের ন্যায়, যিনি পর্ব্বতরাজের কন্যা ( শৈবীশক্তি ) ও চন্দনাক্ষতে বিমণ্ডিতা, গঙ্গা, গৌতম ও গর্গ যার চরণ বন্দনা করেন এবং যিনি বসুমতী, গােদাবরী ও গােমতীরূপিণী, আমি সেই শ্রীশৈলস্থলবাসিনী ভগবতী শ্রীমাতাকে ভাবনা করি ||৯||

|| ইতি শ্রীমৎপরমহংস পরিব্রাজকাচার্য্যস্য শ্রীগোবিন্দ ভগবৎ পূজ্যপাদ শিষ্যস্য শ্রীমচ্ছঙ্কর ভগবতঃ কৃতৌ উমামহেশ্বর ও শ্রীশৈলভ্রমরাম্বাস্তুতি সম্পূর্ণম্ ||

ইতি শ্রীমৎপরমহংস পরিব্রাজকাচার্য্য শ্রীগোবিন্দ ভগবৎ পূজ্যপাদ শিষ্য শ্রীমৎ শঙ্করাচার্য বিরচিত উমামহেশ্বর ও শ্রীশৈলভ্রমরাম্বাস্তুতি সমাপ্ত।

Thursday, 23 June 2022

ব্রহ্মের স্বরূপলক্ষণ ও তটস্থলক্ষণ কি?



বস্তুর স্বরূপই বস্তুর স্বরূপলক্ষণ, যা বস্তুর স্বরূপ হয়ে অন্য বস্তু হতে সেই বস্তুকে ভিন্নভাবে বোধ করায়, তাই স্বরূপলক্ষণ। যেমন— "সত্যং জ্ঞানমনন্তং ব্রহ্ম", ইহা ব্রহ্মের স্বরূপলক্ষণ; কারণ সত্যাদি পদার্থ ব্রহ্মের স্বরূপ হয়ে অন্য বস্তু হতে ব্রহ্মকে ভিন্নভাবে বোধ করায়।

আবার লক্ষ্যবস্তু যতকাল থাকে, ততকাল তার সাথে না থেকে যা লক্ষ্যবস্তুকে অন্য বস্তু হতে ভিন্নভাবে বোধ করায়, তাই তটস্থলক্ষণ। যেমন— পারমার্থিক দৃষ্টিতে জগৎ মিথ্যা হওয়ায় সেই কল্পিত জগতের কর্তৃত্ব ব্রহ্মে পরমার্থতঃ না থাকলেও, ব্যবহারিক দৃষ্টিতে জগতের জন্মাদির কারণ হওয়া-রূপ লক্ষণটি অন্য বস্তু হতে ভিন্নভাবে ব্রহ্মকে বোধ করায় বলে ইহা ব্রহ্মের তটস্থলক্ষণ।

Saturday, 11 June 2022

আর্যসমাজের দয়ানন্দ সরস্বতী প্রচারিত ভ্রান্তমত ত্রৈতবাদ খণ্ডনঃ- (পর্ব-০২)

 


বিগতপর্বেই বলিয়াছি এই অপ্রামাণিক ভ্রান্ত মতবাদ খণ্ডনে আমার বিন্দুমাত্র রুচিও নাই, কিন্তু বর্তমানে মাত্রাতিরিক্ত হারে কিছু অর্বাচীন সংগঠন শঙ্করাদি আচার্যের নিন্দা ও বশিষ্ঠ-ব্যাসাদি গুরুপরম্পরার সনাতন অদ্বৈতবাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার শুরু করিয়াছে, তাই এই দার্শনিক খণ্ডনগুলি ধারাবাহিকভাবে পর্ব আকারে লিখছি। অদ্য আলোচ্য বিষয় "ঈশ্বর সাকার হইতে পারে না ও অবতীর্ণ হইতে পারে না" এই শ্রুতি ও স্মৃতি বিরুদ্ধ মতের নিরাকরণ।

পূর্বপক্ষঈশ্বর নিরাকার। যাহা সাকার অর্থাৎ শরীর বিশিষ্ট তাহা ঈশ্বর নহে।

সিদ্ধান্তপারমার্থিক দৃষ্টিতে তৎপদের লক্ষ্য নিত্যশুদ্ধবুদ্ধমুক্তস্বরূপ জ্ঞেয় নির্গুণ রূপবিহীন ব্রহ্ম সিদ্ধ হন, কিন্তু ব্যবহারিক দৃষ্টিতে তিনি মায়া নামক স্বীয় শক্তিযোগে ক্রমমুক্তি ও উপাসনার জন্য উপাধিরূপ নিমিত্তবশত তৎপদের বাচ্য সগুণ সর্বজ্ঞ সর্বশক্তিমান এবং সাকারূপেও অঙ্গীকৃত হন। ব্রহ্মের সাকারতা একেবারে অস্বীকার করা যায় না।

শঙ্কাকেন ঈশ্বরের সাকারতা একেবারে অস্বীকার করা যায় না?

উত্তরযেহেতু প্রত্যেক বিদ্যাতে ব্রহ্মের বিভিন্ন আকারসকল উপদিষ্ট হইতেছে, যথাঃ- 'চারিটী চরণযুক্ত ব্রহ্ম'-(ছান্দোগ্য উপনিষদ্-৩।১৮।২), 'ষোলটী কলাযুক্ত ব্রহ্ম'-(ছান্দোগ্য উপনিষদ্-৪।৫।২), 'বামনী প্রভৃতি লক্ষণযুক্ত ব্রহ্ম'-(ছান্দোগ্য উপনিষদ্-৪।১৫।৩), 'বৈশ্বানরশব্দের দ্বারা বর্ণিত ত্রৈলোক্যশরীর ব্রহ্ম'-(ছান্দোগ্য উপনিষদ্-৫।১৮।২) ইত্যাদি এই জাতীয় শ্রুতি রহিয়াছে সেইহতু ব্রহ্মের সবিশেষতাও অঙ্গীকৃত হইতেছে। কিন্তু শঙ্কা হইল, আমাদের সিদ্ধান্ত তো ব্রহ্মের সবিশেষ ও নির্বিশেষ উভয়াত্মকতা সম্ভব নহে, ব্রহ্ম নির্বিশেষই। এই পূর্বসমাধানও বিরুদ্ধ নহে, যেহেতু ব্রহ্মের আকারভেদ উপাধিকৃত। আর শাস্ত্র প্রত্যেকটী উপাধিভেদে ব্রহ্মের অভেদতাই অর্থাৎ অভিন্নতাই শ্রবণ করাইতেছেন, যথা-

যশ্চাযমস্যাং পৃথিব্যাং তেজোময়োমৃতময়ঃ পুরুষো যশ্চাযমধ্যাত্মং শারীরস্তেজোমযোমৃতময়ঃ পুরুষোযমেব স যোয়মাত্মা'-(বৃহদারণ্যক উপনিষদ্-২।৫।১)

'এই পৃথিবীতে যিনি এই তেজোময় অমৃতময় পুরুষ এবং যিনি শরীরসম্বন্ধী ও শরীরে অবস্থিত তেজোময় অমৃতময় পুরুষ, ইনিই তিনি, যিনি এই আত্মা' ইত্যাদি।

পূর্বপক্ষঈশ্বর সাকার হইলে তিনি পরিমিত শক্তিসম্পন্ন, দেশ-কাল-বস্তুসমূহে পরিচ্ছিন্ন এবং ক্ষুধা-তৃষ্ণা-ছেদন-ভেদন, শীতোষ্ণ ও জ্বরপীড়াদিযুক্ত হইবেন। অর্থাৎ স্বরূপের নাশ হইবে।

সংশয়কিপ্রকারে স্বরূপের নাশ ব্যতিরেকেই এক ব্রহ্মে অনেকপ্রকার আকারবিশিষ্ট সৃষ্টি হইবে?

সিদ্ধান্তীর উত্তরযেহেতু-'ন তত্র রথা ন রথযোগা ন পন্থানো ভবন্ত্যথ রথান্রথযোগান্পথঃ সৃজতে'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪/৩/১০)

অর্থাৎ "সেখানে (স্বপ্নে) রথসকল থাকে না, অশ্বসকল থাকে না এবং পথসকল থাকে না অথচ তিনি রথসকল অশ্বসকল ও পথসকল সৃষ্টি করেন", ইত্যাদি শ্রুতিবাক্যের দ্বারা স্বপ্নদর্শী এক আত্মাতেও স্বরূপের নাশ ব্যতিরেকেই অনেকপ্রকার আকারবিশিষ্ট সৃষ্টি পঠিত হইতেছে। আর লোকমধ্যেও দেবতা প্রভৃতিতে এবং মায়াবী প্রভৃতিতে স্বরূপের নাশ ব্যতিরেকেই হস্তী ও অশ্ব প্রভৃতি বিচিত্র সৃষ্টিসকল পরিদৃষ্ট হইতেছে। এইপ্রকারে এক ব্রহ্মেও স্বরূপের নাশ ব্যতিরেকেই অনেকপ্রকার আকারবিশিষ্ট সৃষ্টি হইবে।

আর তাছাড়া বিভিন্ন প্রকার অর্থ প্রতিপাদক পিতা, পুত্র, ভ্রাতা, জামাতা ইত্যাদি শব্দসকল এক দেবদত্তকে বুঝাইলেও যেমন বিরোধ হয় না, তদ্রূপ যথার্থ বচনরূপ লৌকিক অর্থেই নিরূঢ় সত্যাদিশব্দ অখণ্ডকেই লক্ষ্য করে অর্থাৎ লক্ষণাবৃত্তিদ্বারা অখণ্ড ব্রহ্মকেই সমর্পণ করে।

ইঁহার যে অপারমার্থিক সবিশেষস্বরূপতা, তাহাকে অভিপ্রায় করিয়া মোক্ষশাস্ত্রসকলে 'জলমধ্যগত সূর্য্যাদি প্রতিবিম্বের ন্যায়' এই উপমা পরিগৃহীত হইতেছে,যথা-

'যেমন জ্যোতিঃস্বরূপ এই সূর্য্য এক হইলেও বিভিন্ন জলকে অনুগমনকরতঃ বিভিন্ন পাত্রস্থ জলে প্রতিবিম্বিত হইয়া বহুপ্রকার হইয়া থাকেন, এইপ্রকারে এই স্বয়ংপ্রকাশ দেব জন্মরহিত আত্মা, মায়ারূপ উপাধির দ্বারা ক্ষেত্রসকলে অর্থাৎ মায়ার পরিণামভূত দেহেন্দ্রিয়াদি সংঘাত সকলে অনুগমন করতঃ প্রতিবিম্বিত হইয়া বিভিন্নরূপে কৃত বা প্রতিভাত হন।'-(ব্রহ্মবিন্দু উপনিষদ্-১২)

'যেহেতু প্রাণিগণের এই একই আত্মা বিভিন্ন প্রাণীতে বিশেষভাবে অবস্থিত আছেন, তিনি জলমধ্যস্থ চন্দ্রের ন্যায় একরূপে ও বহুরূপে পরিদৃষ্ট হন।'-(ঐ) ইত্যাদি এই সকল স্থলেও 'তাঁহার ঔপাধিক সবিশেষতা প্রদর্শিত হইয়াছে।'

পূর্বপক্ষনিত্য ঈশ্বর অবতীর্ণ হইতে পারেন না, অর্থাৎ তাহার জন্ম সম্ভব নহে।

সিদ্ধান্ত"ধর্ম্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে"-(ভগবদ্গীতা-৪/৮) ধর্ম্মের সম্যক্ স্থাপনের জন্য প্রতিযুগে আমি সম্ভাবিত হই অর্থাৎ অবতীর্ণ হই।

সংশয়নিত্য ঈশ্বরের জন্ম কিরূপে সম্ভব?

সিদ্ধান্তীর উত্তরশ্রীভগবান বলিতেছেন-"অজোহপি সন্নব্যয়াত্মা ভূতানামীশ্বরোহপি সন্। প্রকৃতিং স্বামধিষ্ঠায় সম্ভবাম্যাত্মমায়য়া"-(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা-৪/৬)

অর্থাৎ আমি অজ অর্থাৎ জন্মরহিত হইয়াও; অব্যয়াত্মা অর্থাৎ যাঁহার জ্ঞানশক্তির ক্ষয় নাই এইরূপ অক্ষীণ জ্ঞানশক্তি স্বভাব হইয়াও; ব্রহ্মাদি থেকে তৃণ পর্য্যন্ত সর্ব্বভূতের ঈশ্বর হইয়াও; আমার যে স্বপ্রকৃতি, অর্থাৎ ত্রিগুণাত্মিকা বৈষ্ণবী মায়া, সমস্ত জগৎ যাহার বশে বর্তমান, যদ্দ্বারা মোহিত হইয়া লোকে নিজের আত্মা বাসুদেবকে জানিতে পারে না, সেই নিজ প্রকৃতিতে অধিষ্ঠিত হইয়া অর্থাৎ তাঁহাকে বশীভূত করিয়া আমি সম্ভাবিত হই অর্থাৎ আত্মমায়ার দ্বারা যেন লোকবৎ দেহধারণ করিয়া জন্মগ্রহণ করি; কিন্তু পরমার্থতঃ নহে।

ঋণ- ভগবান শঙ্করাচার্যকৃত শারীরকমীমাংসা ও শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ভাষ্য ও শ্রীভারতী তীর্থকৃত বৈয়াসিক ন্যায়মালা।

Thursday, 9 June 2022

স্বপ্নসাক্ষী ও মায়াবীর দৃষ্টান্তাবলম্বনে ব্রহ্মের বিবর্ত্তোপাদানতা প্রতিপাদনঃ-

 


ভগবান সূত্রকার স্বপ্নের প্রকাশক সাক্ষিচৈতন্যকে দৃষ্টান্তরূপে গ্রহণদ্বারা ব্রহ্মের বিবর্ত্তোপাদানতাকে দৃঢ়করতঃ অদ্বৈতবাদকে পরিস্ফুট করিতেছেন-

আত্মনি চেব বিচিত্রাশ্চ হি৷৷- (ব্রহ্মসূত্র-২.১.১৮)

ভগবান শঙ্করাচার্য ভাষ্যে বলিতেছেন—কিপ্রকারে স্বরূপের নাশ ব্যতিরেকেই এক ব্রহ্মে অনেকপ্রকার আকারবিশিষ্ট সৃষ্টি হইবে?

যেহেতু-'ন তত্র রথা ন রথযোগা ন পন্থানো ভবন্ত্যথ রথান্রথযোগান্পথঃ সৃজতে'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪/৩/১০)

অর্থাৎ "সেখানে (—স্বপ্নে) রথসকল থাকে না, অশ্বসকল থাকে না এবং পথসকল থাকে না অথচ তিনি রথসকল অশ্বসকল ও পথসকল সৃষ্টি করেন", ইত্যাদি শ্রুতিবাক্যের দ্বারা স্বপ্নদর্শী এক আত্মাতেও স্বরূপের নাশ ব্যতিরেকেই অনেকপ্রকার আকারবিশিষ্ট সৃষ্টি পঠিত হইতেছে। আর লোকমধ্যেও দেবতা প্রভৃতিতে এবং মায়াবী প্রভৃতিতে স্বরূপের নাশ ব্যতিরেকেই হস্তী ও অশ্ব প্রভৃতি বিচিত্র সৃষ্টিসকল পরিদৃষ্ট হইতেছে। এইপ্রকারে এক ব্রহ্মেও স্বরূপের নাশ ব্যতিরেকেই অনেকপ্রকার আকারবিশিষ্ট সৃষ্টি হইবে।

 

Monday, 6 June 2022

"উপনিষৎ বেদ নহে", এই ভ্রান্তমতের খণ্ডনঃ—

 


পূর্বপক্ষঃ- শুধুমাত্র সংহিতা ভাগই বেদ, উপনিষৎ বেদ নহে।

সিদ্ধান্তঃ- বেদের গুহ্যভাগ উপনিষৎ।

শঙ্কা- কি হেতু?

উত্তর- 'তদ্ বেদগুহ্যোপনিষৎসু গূঢ়ং', স্বয়ং এই শ্রুতিই বলিতেছেন বেদের গুহ্যভাগ উপনিষৎ। কৃষ্ণযজুর্বেদীয় শ্বেতাশ্বতরোপনিষৎ এর পঞ্চম অধ্যায়ে বর্ণিত আছে-

তদ্ বেদগুহ্যোপনিষৎসু গূঢ়ং

তদ্ ব্রহ্মা বেদতে ব্রহ্মযোনিম্ ।-(শ্বেতাশ্বতরোপনিষৎ-৫।৬)

অর্থাৎ বেদগুহ্য অর্থ উপনিষৎ। যে আত্মতত্ত্বের প্রস্তাব চলিতেছে, তাহা বেদের গুহ্যভাগ উপনিষৎসমূহে গূঢ় অর্থাৎ প্রচ্ছন্নভাবে নিহিত আছে। বেদই এইসকল বিষয়ে একমাত্র প্রমাণ এইকারণে উহা ব্রহ্মযোনি। ব্রহ্মা-হিরণ্যগর্ভই সেই পূর্ব্বপ্রস্তাবিত আত্মার স্বরূপ জানেন, অথবা হিরণ্যগর্ভ নামক ব্রহ্মের যোনি, কিংবা ব্রহ্ম অর্থ বেদ, তাহার যোনি-ব্রহ্মযোনি।

Sunday, 5 June 2022

আত্মাশ্রিতা মায়া তিন প্রকারে বিনাশ প্রাপ্ত হয়ঃ-

 


শ্রুতিতে এই বিষয়ে স্পষ্ট আলোচনা হইয়াছে। যথা—

"শাস্ত্রেণ ন স্যাৎ পরমার্থদৃষ্টিঃ, কার্য্যক্ষমং পশ্যতি চাপরোক্ষম্। প্রারব্ধনাশাৎ প্রতিভাসনাশঃ, এবং ত্রিধা নশ্যতি চাত্মমায়া।।"- (বরাহ উপনিষৎ-২/৬৯)

১. শাস্ত্রের দ্বারা অর্থাৎ বেদান্তশাস্ত্র অধ্যয়নজনিত ব্রহ্মাত্মবিষয়ক পরোক্ষ জ্ঞানের দ্বারা, মায়া ও তৎকার্য্য জগৎপ্রপঞ্চে পরমার্থ দৃষ্টি থাকে না। অর্থাৎ 'মায়া ও তৎকার্য্য জগৎ পরমার্থতঃ আছে' এইপ্রকার বুদ্ধি বিনষ্ট হয়।

২. আর অবিদ্যাধ্বংসী ব্রহ্মাত্মবিষয়ক অপরোক্ষকে জ্ঞানী কার্য্যক্ষমরূপে অর্থাৎ মায়া, তৎকার্য্য জগৎ ও বন্ধনের বাধকরূপে দর্শন করেন।

৩. প্রারব্ধের নাশ হইলে প্রতিভাস অর্থাৎ ব্রহ্মাত্মবিষয়ক অপরোক্ষ জ্ঞানের দ্বারা আবরণ ও বিক্ষেপশক্তিযুক্তা মায়ার নাশ হইলেও, প্রারব্ধ কর্ম্মরূপ প্রতিবন্ধকবশতঃ বিক্ষেপশক্তির অবিনষ্ট অংশবিশেষের বলে ব্রহ্মজ্ঞের দৃষ্টিতে 'দগ্ধ বস্ত্রের ন্যায়' যে মায়া ও তৎকার্য্য জগৎপ্রপঞ্চের প্রতীতি হয়, তাহা বিনষ্ট হয়।

এইরূপে আত্মাশ্রিতা মায়া তিন প্রকারে বিনাশ প্রাপ্ত হয়।

Friday, 3 June 2022

আর্যসমাজের দয়ানন্দ সরস্বতী প্রচারিত ভ্রান্তমত ত্রৈতবাদ খণ্ডনঃ- (পর্ব-০১)

অদ্য আলোচ্য বিষয়, দয়ানন্দ সরস্বতী প্রচারিত অপ্রামাণিক ত্রৈতবাদসম্মত সিদ্ধান্ত 'ঈশ্বর কেবলমাত্র নিমিত্তকারণ, উপাদানকারণ নহে', এই মতবাদ নিরাকরণ। এই ভ্রান্তমতের সমালোচনায় আমার খুব একটা রুচি নাই, তবে ইদানিং কিছু অর্বাচীন সংগঠন শঙ্করাদি আচার্যের নিন্দাপূর্বক শাশ্বত অদ্বৈতবাদ খণ্ডনের দুঃসাহস প্রদর্শন করিতেছেন, তাই আমি এই কর্ম্মে প্রবৃত্ত হইতেছি।

পূর্বপক্ষ—ব্রহ্ম কেবল নিমিত্তকারণ, আর ব্রহ্ম হইতে ভিন্ন প্রকৃতি উপাদানকারণ।

সিদ্ধান্ত—এইপ্রকার পূর্ব্বপক্ষ প্রাপ্ত হইলে আমরা বলিতেছি—ব্রহ্মকে প্রকৃতিরূপেও, অর্থাৎ উপাদানকারণরূপেও অঙ্গীকার করিতে হইবে এবং নিমিত্তকারণরূপেও 'অঙ্গীকার করিতে হইবে'। তিনি কেবল নিমিত্তকারণই নহেন।

শঙ্কা— কেন ঈশ্বরের কেবল নিমিত্তকারণমাত্রতা মান্য নহে?

সিদ্ধান্ত—এইহেতু অবৈদিক মতের দ্বারা বেদান্তসমন্বয়ে এইপ্রকার বিরোধ হয়ে পড়ে বলিয়া উত্তর কথিত হইতেছে—"পত্যুরসামঞ্জস্যাৎ" অর্থাৎ— পতির অর্থাৎ ঈশ্বরের প্রধান ও পুরুষের প্রেরকরূপে জগৎকারণতা (-জগতের নিমিত্তকারণতা) যুক্তিসঙ্গত নহে। তাহাতে হেতু কি? উত্তর— যেহেতু সামঞ্জস্য হয় না। আচ্ছা, অসামঞ্জস্যটী কি? হীন মধ্যম ও উত্তমভাবে (—যথাক্রমে কীটপতঙ্গাদি, মনুষ্য ও দেবতা প্রভৃতিরূপে) প্রাণীসকলের ভেদের বিধানকর্ত্তা (—উচ্চাবচ প্রাণীর সৃষ্টিকর্ত্তা) ঈশ্বরের অনুরাগ ও দ্বেষ প্রভৃতি দোষ হইয়া পড়ে বলিয়া আমাদিগের ন্যায় তাঁহার অনীশ্বরতা হইয়া পড়িবে। অর্থাৎ বৈষম্যাদি দোষ হইয়া পড়ে বলিয়া ব্রহ্মের কেবল নিমিত্তকারণমাত্রতা যুক্তিসঙ্গত নহে।

সংশয়— আচ্ছা, আমরা তাহা হইলে এই দোষ কিপ্রকারে পরিহার করিয়াছি?

সিদ্ধান্ত— যেহেতু 'ঈশ্বর প্রাণিগণের কর্ম্মকে অপেক্ষা করেন', ইহাই আমরা বলিতেছি। সেই অঙ্গীকারের প্রতি বেদই আমাদের প্রমাণ। আর যদি তোমরাও বেদকে অঙ্গীকার কর, তাহা হইলে বেদপ্রতিপাদিত ঈশ্বর স্বীকৃত হইলে "বহু স্যাং প্রজায়েয়"-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৬/২/৩) "বহু হইব, প্রকৃষ্ট রূপে উৎপন্ন হইব", এই সামবেদীয় ছান্দোগ্য শ্রুতির বিরোধবশতঃ ঈশ্বরের মাত্র নিমিত্তকারণতা তোমাকেও পরিত্যাগ করিতে হইবে।

শঙ্কা— 'ব্রহ্মই অভিন্ননিমিত্তোপাদান কারণ' তাহাতে হেতু কি?

সিদ্ধান্ত— তদুত্তরে বলিতেছেন-'প্রতিজ্ঞাদৃষ্টান্তানুপরোধাতৎ' অর্থাৎ "যেহেতু প্রতিজ্ঞা ও দৃষ্টান্তের সঙ্কোচ হয় না"। পরিষ্কারভাবে যদি বলি, এইপ্রকারে ব্রহ্ম উপাদানকারণ ও নিমিত্তকারণ উভয়ই হইলে শ্রুতিতে বর্ণিত প্রতিজ্ঞা ও দৃষ্টান্ত বাধিত হয় না। প্রতিজ্ঞা এইপ্রকার—

'উত তমাদেশমপ্রাক্ষ্যো যেনাশ্রুতং শ্রুতং ভবত্যমতং মতমবিজ্ঞাতং বিজ্ঞাতম্'-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৬/১/২) "তুমি কি সেই আদেশটী জিজ্ঞাসা করিয়াছিলে, যাহার দ্বারা অশ্রুত বিষয় বিজ্ঞাত হয়", ইত্যাদি। উক্ত শ্রুতিবাক্যে বিজ্ঞাত একটীর দ্বারা, অবিজ্ঞাত হইলেও অন্য সমস্ত বিজ্ঞাত হয়, এই প্রকার অর্থ প্রতিভাত হইতেছে। আর সেই সর্ব্ববিজ্ঞান উপাদানকারণবিষয়ক জ্ঞান হইলে হয় সম্ভব, যেহেতু কার্য্যবস্তু উপাদানকারণ হইতে অভিন্ন।

সংশয়—কিন্তু নিমিত্তকারণবিষয়ক জ্ঞান হইতে সর্ব্ববিজ্ঞান কেন হয় না?

সিদ্ধান্ত— তদুত্তরে বলিতেছেন—কিন্তু নিমিত্তকারণ হইতে অভিন্নতা কার্য্যবস্তুর নাই, যেহেতু তক্ষা (—সুত্রধর) হইতে প্রাসাদের ভিন্নতা লোকমধ্যে পরিদৃষ্ট হয়। আবার, 'যথা সোম্যৈকেন মৃৎপিণ্ডেন সর্বং মৃন্মযং বিজ্ঞাতং স্যাদ্বাচারম্ভণং বিকারো নামধেযং মৃত্তিকেত্যেব সত্যম্'-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৬/১/৪) অর্থাৎ "হে সৌম্য, যেমন একটী মৃৎপিন্ডের দ্বারা সমস্ত মৃন্ময় বস্তু বিজ্ঞাত হয়, কারণ যাহা বিকার (—কার্য্যবস্তু), তাহা বাগবলম্বনে অবস্থিত নামমাত্র, কেবল মৃত্তিকাই সত্য", ইত্যাদি দৃষ্টান্তও উপাদানকারণবিষয়েই পঠিত হইতেছে।

এইরূপে, 'একেন লোহমণিনা সর্বং লোহমযং বিজ্ঞাতং স্যাৎ' 'একেন নখনিকৃন্তনেন সর্বং কার্ষ্ণাযসং বিজ্ঞাতং স্যাৎ'-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৬/১/৫,৬) "একটী লোহমণির (—সুবর্ণপিন্ডের) দ্বারা সুবর্ণময় সমস্ত বস্তু বিজ্ঞাত হয়" এবং "একটী নখকৃন্তনের (—নরুণের অর্থাৎ লৌহপিন্ডের) দ্বারা লৌহের পরিণামভূত সমস্ত বস্তু বিজ্ঞাত হয়" ইত্যাদি দৃষ্টান্তসকলও উপাদানকারণ বিষয়েই পঠিত হইতেছে।

এইরূপে অন্যত্রও (—শ্রুতির অন্য শাখাতেও) ''কস্মিন্নু ভগবো বিজ্ঞাতে সর্বমিদং বিজ্ঞাতং ভবতি'-(মুণ্ডক উপনিষৎ-১/১/৩) ইতি প্রতিজ্ঞা; 'যথা পৃথিব্যামোষধযঃ সংভবন্তি'-(মুণ্ডক উপনিষৎ-১/১/৭) ইতি দৃষ্টান্তঃ "হে ভগবন, কোন বস্তুটী বিজ্ঞাত হইলে এই সমস্ত বিজ্ঞাত হয়", এই প্রকার প্রতিজ্ঞা এবং "যেমন পৃথিবী হইতে ধান্য যবাদি ওষধিসকল উৎপন্ন হয়", এইপ্রকার দৃষ্টান্ত 'উপাদানকারণবিষয়েই পঠিত হইতেছে।

এইরূপে অপর শাখাতে 'ইদং সর্বং বিদিতম্' ইতি প্রতিজ্ঞা; 'স যথা দুন্দুভের্হন্যমানস্য ন বাহ্যাঞ্শব্দাঞ্শক্নুযাদ্গ্রহণায দুন্দুভেস্তু গ্রহণেন দুন্দুভ্যাঘাতস্য বা শব্দো গৃহীতঃ'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪/৫/৬,৮) ইতি দৃষ্টান্তঃ' "প্রিয়ে, আত্মা দৃষ্ট শ্রুত বিচারিত ও বিজ্ঞাত হইলে এই সমস্ত বিজ্ঞাত হয়" এইপ্রকার প্রতিজ্ঞা এবং "তাহা (—উক্ত বিষয়ে দৃষ্টান্ত) যমন দুন্দুভি (—দামামা) বাদিত হইতে থাকিলে বাহ্য শব্দসকলকে (—দুন্দুভির বিশেষ শব্দসকলকে) গ্রহণ করিতে পারা যায় না, কিন্তু দুন্দুভির গ্রহণের দ্বারা অথবা দুন্দুভির আঘাতের গ্রহণের দ্বারা শব্দ গৃহীত হয়", এইপ্রকার দৃষ্টান্ত 'উপাদানকারণ বিষয়েই পঠিত হইতেছে'।

এইরূপে প্রত্যেক উপনিষদে প্রতিজ্ঞা ও দৃষ্টান্তকে যথাসম্ভব ব্রহ্মের উপাদানকারণতার সাধনরূপে অবগত হইতে হইবে। এইরূপে প্রতিজ্ঞা ও দৃষ্টান্তের সামঞ্জস্যরূপ লিঙ্গপ্রমাণ বলে ব্রহ্মের উপাদানকারণতা প্রতিপাদিত হইল। এক্ষণে পঞ্চমীবিভক্তিরূপ শ্রুতিপ্রমাণবলে পুনরায় তাহাই প্রতিপাদন করিতেছি—যতো বা ইমানি ভূতানি জাযন্তে'-(তৈত্তিরীয় উপনিষৎ-৩/১) "যাহা হইতে এই প্রাণিগণ জন্মগ্রহণ করে", ইত্যাদি এইস্থলে "যতঃ" এই পঞ্চমী বিভক্তিটী, "জনিকর্ত্তুঃ প্রকৃতিঃ"(পাণিনী সূত্র-১.৪.৩০) 'জায়মান কার্য্যের যাহা প্রকৃতি—উপাদান, তাহা অপাদান সংজ্ঞা লাভ করে', ব্যাকরণস্মৃতির এই বিশেষ সূত্রবশতঃ প্রকৃতিলক্ষণ (—উপাদানকারণস্বরূপ) অপাদানেই প্রযুক্ত হইয়াছে, বুঝিতে হইবে।

সংশয়—কিন্তু কোন হেতুবশতঃ আত্মার নিমিত্তকারণতা ও উপাদানকারণতা সিদ্ধ হয়?

সিদ্ধান্ত— 'অভিধ্যোপদেশাচ্চ' অভিধ্যানের অর্থাৎ ভাবী সৃষ্টিবিষয়ক সঙ্কল্পের উপদেশও ব্রহ্মের নিমিত্তকারণতা ও উপাদানকারণতা জ্ঞাপন করিতেছে, যথা-

'সোকাময়ত বহু স্যাং প্রজায়েয়'-(তৈত্তিরীয় উপনিষৎ ২।৬) অর্থাৎ তিনি কামনা করিয়াছিলেন, "আমি বহু হইব, প্রকৃষ্টরূপে উৎপন্ন হইব", ইত্যাদি শ্রুতি। এবং 'তদৈক্ষত বহু স্যাং প্রজায়েয়'-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৬/২/৩) অর্থাৎ তাহা (-সেই সৎপদার্থ) ঈক্ষণ করিয়াছিলেন,"আমি বহু হইব, প্রকৃষ্টরূপে উৎপন্ন হইব", ইত্যাদি শ্রুতি। সেইস্থলে অভিধ্যানপূর্ব্বক স্বাধীনভাবে প্রবৃত্তি বর্ণিত হওয়ায় ব্রহ্ম নিমিত্তকারণ, ইহা অবগত হওয়া যাইতেছে। "বহু হইব" এইপ্রকার যে বহু হইবার সঙ্কল্প, তাহা প্রত্যাগাত্মাকে বিষয় করে বলিয়া ব্রহ্ম উপাদানকারণ, ইহা অবগত হওয়া যাইতেছে। 

আর এই হেতুবশতঃও ব্রহ্ম জগতের উপাদান কারণ, যেহেতু সাক্ষাৎভাবে ব্রহ্মকেই কারণরূপে গ্রহণ করিয়া উৎপত্তি ও প্রলয়, এই দুইটী পঠিত হইতেছে, যথা- 'সর্বাণি হ বা ইমানি ভূতানি আকাশাৎ এব সমুত্পদ্যন্তে৷ আকাশং প্রত্যস্তং যন্তি' -(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-১।৯।১) অর্থাৎ "স্থাবরজঙ্গমাত্মক এই সমস্ত ভূতবর্গ আকাশ হইতেই সমুৎপন্ন হয় ও আকাশে অস্তগমন করে।" ইত্যাদি শ্রুতি।

যাহা হইতে যাহা উৎপন্ন হয় এবং যাহাতে প্রলীন হয়, তাহা তাহার উপাদান, ইহা প্রসিদ্ধ, যেমন পৃথিবী ধান্য ও যবাদির উপাদান। উপরোক্ত 'আকাশাৎ এব' শ্রুতিবাক্যগত 'এব' কারণটীর দ্বারা যে অন্য উপাদানের অগ্রহণ সূচিত হয়, তাহাকে ভগবান সূত্রকার 'সাক্ষাৎ' এই পদটীর দ্বারা প্রদর্শন করিতছেন। আর কার্য্যবস্তুর যে প্রলয়, তাহা উপাদান হইতে অন্যস্থলে পরিদৃষ্ট হয় না। সুতরাং আকাশশব্দিত ব্রহ্মবস্তুই জগতের উপাদান, ইহাই নির্ণীত হয়।

সংশয়—আচ্ছা এখন প্রশ্ন হইল, যিনি পূর্ব্বসিদ্ধ (পূর্ব্ব হইতে বিদ্যমান) কর্ত্তৃরূপে অবস্থিত সদ্বস্তু, তাঁহার ক্রিয়মানতা (-জগৎরূপে উৎপন্ন হওয়া) কি প্রকারে সম্পাদন করা যায়?

সিদ্ধান্ত— তদুত্তরে আমরা বলিব-যেহেতু পরিণাম হয়। আত্মা পূর্ব্বসিদ্ধ হইলেও বিশেষ বিকারাত্মকরূপে (মিথ্যা কার্য্যরূপে) নিজেকে পরিণত (বিবর্ত্তিত) করিয়াছিলেন। ঠিক যেমন মৃত্তিকা প্রভৃতি উপাদানকারণ সকলে (ঘটাদি) কার্য্যরূপে পরিণাম উপলব্ধ হয়। 'পরিণামাৎ' তাঁহার অর্থ এই -আর এই হেতুবশতঃ ব্রহ্ম জগতের উপাদান কারণ, যেহেতু-

'সচ্চ ত্যচ্চাভবন্নিরুক্তং চানিরুক্তং চ' -(তৈত্তিরীয় উপনিষৎ-২।৬) অর্থাৎ "তিনি সৎ(মূর্ত্ত) এবং ত্যৎ (অমূর্ত্ত) হইলেন। মূর্ত্তামূর্ত্ত অর্থাৎ আত্মাতে স্থিত অনভিব্যক্তি নামরূপ, অন্তঃপ্রবিষ্ট আত্মার নিমিত্ত মূর্ত্তামূর্ত্ত শব্দসংজ্ঞায় অভিব্যক্ত হইল। তিনি নিরুক্ত (পরিচ্ছিন্ন) ও অনিরূক্ত (অপরিচ্ছিন্ন) হইলেন। নিরূক্ত হইতেছে সজাতীয় বিজাতীয় পদার্থসকল হইতে পৃথক্ করিয়া স্থানকালবিশিষ্টরূপে অর্থাৎ 'ইহা তাহা' এই রূপে যাহা কথিত আর অনিরুক্ত হইতছে তাহার বিপরীত।" ইত্যাদি এইরূপ সামানাধিকরণ্যের দ্বারা অর্থাৎ সমান বিভক্তিযুক্ত পদপ্রয়োগের দ্বারা ব্রহ্মেরই বিকারাত্মকরূপে (কার্য্যবস্তুরূপে) পরিণাম (বিবর্ত্ত) শ্রুতিতে পঠিত হইতেছে।

আর এইহেতুবশতঃও ব্রহ্ম জগতের উপাদান কারণ, যেহেতু উপনিষৎ সকলে ব্রহ্ম 'যোনি', এইরূপেও পঠিত হইতেছেন, যথা- 'কর্তারমীশং পুরুষং ব্রহ্মযোনিম্'-(মুণ্ডক উপনিষৎ-৩.১.৩) অর্থাৎ 'জগতের কর্ত্তা ঈশ্বর পুরুষ ব্রহ্মযোনি অর্থাৎ যিনি ব্রহ্ম আবার সর্ব্বকারণও।'

তদব্যয়ং যদ্ভূতযোনিং পরিপশ্যন্তি ধীরাঃ৷৷-(মুণ্ডক উপনিষৎ-১.১.৬) অর্থাৎ 'এইরূপ লক্ষণবিশিষ্ট ভূতযোনি অর্থাৎ প্রাণিগণের সৃষ্টির কারণস্বরূপ, স্থাবর-জঙ্গমের কারণস্বরূপ পৃথিবীর ন্যায় যাঁহাকে তথা সকলের স্বরূপভূত সেই অব্যয়কে বিবেকিগণ সর্বত্র উপলব্ধি করেন।'ইত্যাদি শ্রুতি।

আর 'যোনি' শব্দটী প্রকৃতির (-উপাদানকারণের) বাচক, ইহা লোকমধ্যে অবগত হওয়া যায়, যথা-'পৃথিবী ওষধি ও বনস্পতিসকলের যোনি' ইত্যাদি। স্ত্রী যোনিও স্বীয় অবয়বের (-শোনিতের) দ্বারা হয় গর্ভের প্রতি উপাদানকারণ। কোন কোন স্থলে 'যোনি' শব্দ স্থানের বাচকরূপেও পরিদৃষ্ট হয়, যথা-

'যোনিষ্ট ইন্দ্র নিষদে অকারি'-(ঋগ্বেদ সংহিতা ১।১০৪।১) অর্থাৎ 'হে ইন্দ্র!, তোমার উপবেশনের জন্য আমি যোনি (-স্থান) নির্ম্মাণ করিয়াছি।'

কিন্তু এখানে 'যথোর্ণনাভিঃ সৃজতে গৃহ্ণতে চ'-(মুণ্ডক উপনিষৎ-১.১.৭) 'মাকড়সা কোন অন্যকারণের অপেক্ষা না করিয়া নিজেই সৃষ্টি করে অর্থাৎ নিজ শরীর হইতে অভিন্ন তন্তুরাশিকে বাহিরে প্রসারিত করে, আবার সেই সকলকে গ্রহণও করে অর্থাৎ নিজের সহিত একীভূত করিয়া ফেলে।' ইত্যাদি এইজাতীয় বাক্যশেষবশতঃ যোনিশব্দটীর উপাদানকারণতারূপ অর্থ পরিগৃহীত হইতেছে। এইপ্রকারে ব্রহ্মের উপাদানকারণতা প্রকৃষ্টরূপে সিদ্ধ হইল।

এইরূপ মাকড়সার শরীরের তন্তুরূপে পরিণামের ন্যায় ঈশ্বরের উপাধিভূতা মায়ার জগদ্রূপে পরিণামে ঈশ্বরের উপাদানকারণতাও সিদ্ধ হয়। এইরূপে মায়া-শবলিত ঈশ্বররূপ ব্রহ্মই হন জগতের অভিন্ননিমিত্তোপাদান কারণ।.......ইতি।

ঋণ- ভগবান শঙ্করাচার্যকৃত শারীরকমীমাংসা ভাষ্য ও শ্রীভারতী তীর্থকৃত বৈয়াসিক ন্যায়মালা।

আত্মানাত্মবিবেকঃ-

  আত্মা ও অনাত্মা অর্থাৎ আত্মা ভিন্ন দেহের পৃথকত্বের বিবেকবোধই আত্মানাত্মবিবেক। দেহকেই আমরা ' আমি ' ভাবিয়া থাকি। ...