Friday, 3 June 2022

আর্যসমাজের দয়ানন্দ সরস্বতী প্রচারিত ভ্রান্তমত ত্রৈতবাদ খণ্ডনঃ- (পর্ব-০১)

অদ্য আলোচ্য বিষয়, দয়ানন্দ সরস্বতী প্রচারিত অপ্রামাণিক ত্রৈতবাদসম্মত সিদ্ধান্ত 'ঈশ্বর কেবলমাত্র নিমিত্তকারণ, উপাদানকারণ নহে', এই মতবাদ নিরাকরণ। এই ভ্রান্তমতের সমালোচনায় আমার খুব একটা রুচি নাই, তবে ইদানিং কিছু অর্বাচীন সংগঠন শঙ্করাদি আচার্যের নিন্দাপূর্বক শাশ্বত অদ্বৈতবাদ খণ্ডনের দুঃসাহস প্রদর্শন করিতেছেন, তাই আমি এই কর্ম্মে প্রবৃত্ত হইতেছি।

পূর্বপক্ষ—ব্রহ্ম কেবল নিমিত্তকারণ, আর ব্রহ্ম হইতে ভিন্ন প্রকৃতি উপাদানকারণ।

সিদ্ধান্ত—এইপ্রকার পূর্ব্বপক্ষ প্রাপ্ত হইলে আমরা বলিতেছি—ব্রহ্মকে প্রকৃতিরূপেও, অর্থাৎ উপাদানকারণরূপেও অঙ্গীকার করিতে হইবে এবং নিমিত্তকারণরূপেও 'অঙ্গীকার করিতে হইবে'। তিনি কেবল নিমিত্তকারণই নহেন।

শঙ্কা— কেন ঈশ্বরের কেবল নিমিত্তকারণমাত্রতা মান্য নহে?

সিদ্ধান্ত—এইহেতু অবৈদিক মতের দ্বারা বেদান্তসমন্বয়ে এইপ্রকার বিরোধ হয়ে পড়ে বলিয়া উত্তর কথিত হইতেছে—"পত্যুরসামঞ্জস্যাৎ" অর্থাৎ— পতির অর্থাৎ ঈশ্বরের প্রধান ও পুরুষের প্রেরকরূপে জগৎকারণতা (-জগতের নিমিত্তকারণতা) যুক্তিসঙ্গত নহে। তাহাতে হেতু কি? উত্তর— যেহেতু সামঞ্জস্য হয় না। আচ্ছা, অসামঞ্জস্যটী কি? হীন মধ্যম ও উত্তমভাবে (—যথাক্রমে কীটপতঙ্গাদি, মনুষ্য ও দেবতা প্রভৃতিরূপে) প্রাণীসকলের ভেদের বিধানকর্ত্তা (—উচ্চাবচ প্রাণীর সৃষ্টিকর্ত্তা) ঈশ্বরের অনুরাগ ও দ্বেষ প্রভৃতি দোষ হইয়া পড়ে বলিয়া আমাদিগের ন্যায় তাঁহার অনীশ্বরতা হইয়া পড়িবে। অর্থাৎ বৈষম্যাদি দোষ হইয়া পড়ে বলিয়া ব্রহ্মের কেবল নিমিত্তকারণমাত্রতা যুক্তিসঙ্গত নহে।

সংশয়— আচ্ছা, আমরা তাহা হইলে এই দোষ কিপ্রকারে পরিহার করিয়াছি?

সিদ্ধান্ত— যেহেতু 'ঈশ্বর প্রাণিগণের কর্ম্মকে অপেক্ষা করেন', ইহাই আমরা বলিতেছি। সেই অঙ্গীকারের প্রতি বেদই আমাদের প্রমাণ। আর যদি তোমরাও বেদকে অঙ্গীকার কর, তাহা হইলে বেদপ্রতিপাদিত ঈশ্বর স্বীকৃত হইলে "বহু স্যাং প্রজায়েয়"-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৬/২/৩) "বহু হইব, প্রকৃষ্ট রূপে উৎপন্ন হইব", এই সামবেদীয় ছান্দোগ্য শ্রুতির বিরোধবশতঃ ঈশ্বরের মাত্র নিমিত্তকারণতা তোমাকেও পরিত্যাগ করিতে হইবে।

শঙ্কা— 'ব্রহ্মই অভিন্ননিমিত্তোপাদান কারণ' তাহাতে হেতু কি?

সিদ্ধান্ত— তদুত্তরে বলিতেছেন-'প্রতিজ্ঞাদৃষ্টান্তানুপরোধাতৎ' অর্থাৎ "যেহেতু প্রতিজ্ঞা ও দৃষ্টান্তের সঙ্কোচ হয় না"। পরিষ্কারভাবে যদি বলি, এইপ্রকারে ব্রহ্ম উপাদানকারণ ও নিমিত্তকারণ উভয়ই হইলে শ্রুতিতে বর্ণিত প্রতিজ্ঞা ও দৃষ্টান্ত বাধিত হয় না। প্রতিজ্ঞা এইপ্রকার—

'উত তমাদেশমপ্রাক্ষ্যো যেনাশ্রুতং শ্রুতং ভবত্যমতং মতমবিজ্ঞাতং বিজ্ঞাতম্'-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৬/১/২) "তুমি কি সেই আদেশটী জিজ্ঞাসা করিয়াছিলে, যাহার দ্বারা অশ্রুত বিষয় বিজ্ঞাত হয়", ইত্যাদি। উক্ত শ্রুতিবাক্যে বিজ্ঞাত একটীর দ্বারা, অবিজ্ঞাত হইলেও অন্য সমস্ত বিজ্ঞাত হয়, এই প্রকার অর্থ প্রতিভাত হইতেছে। আর সেই সর্ব্ববিজ্ঞান উপাদানকারণবিষয়ক জ্ঞান হইলে হয় সম্ভব, যেহেতু কার্য্যবস্তু উপাদানকারণ হইতে অভিন্ন।

সংশয়—কিন্তু নিমিত্তকারণবিষয়ক জ্ঞান হইতে সর্ব্ববিজ্ঞান কেন হয় না?

সিদ্ধান্ত— তদুত্তরে বলিতেছেন—কিন্তু নিমিত্তকারণ হইতে অভিন্নতা কার্য্যবস্তুর নাই, যেহেতু তক্ষা (—সুত্রধর) হইতে প্রাসাদের ভিন্নতা লোকমধ্যে পরিদৃষ্ট হয়। আবার, 'যথা সোম্যৈকেন মৃৎপিণ্ডেন সর্বং মৃন্মযং বিজ্ঞাতং স্যাদ্বাচারম্ভণং বিকারো নামধেযং মৃত্তিকেত্যেব সত্যম্'-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৬/১/৪) অর্থাৎ "হে সৌম্য, যেমন একটী মৃৎপিন্ডের দ্বারা সমস্ত মৃন্ময় বস্তু বিজ্ঞাত হয়, কারণ যাহা বিকার (—কার্য্যবস্তু), তাহা বাগবলম্বনে অবস্থিত নামমাত্র, কেবল মৃত্তিকাই সত্য", ইত্যাদি দৃষ্টান্তও উপাদানকারণবিষয়েই পঠিত হইতেছে।

এইরূপে, 'একেন লোহমণিনা সর্বং লোহমযং বিজ্ঞাতং স্যাৎ' 'একেন নখনিকৃন্তনেন সর্বং কার্ষ্ণাযসং বিজ্ঞাতং স্যাৎ'-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৬/১/৫,৬) "একটী লোহমণির (—সুবর্ণপিন্ডের) দ্বারা সুবর্ণময় সমস্ত বস্তু বিজ্ঞাত হয়" এবং "একটী নখকৃন্তনের (—নরুণের অর্থাৎ লৌহপিন্ডের) দ্বারা লৌহের পরিণামভূত সমস্ত বস্তু বিজ্ঞাত হয়" ইত্যাদি দৃষ্টান্তসকলও উপাদানকারণ বিষয়েই পঠিত হইতেছে।

এইরূপে অন্যত্রও (—শ্রুতির অন্য শাখাতেও) ''কস্মিন্নু ভগবো বিজ্ঞাতে সর্বমিদং বিজ্ঞাতং ভবতি'-(মুণ্ডক উপনিষৎ-১/১/৩) ইতি প্রতিজ্ঞা; 'যথা পৃথিব্যামোষধযঃ সংভবন্তি'-(মুণ্ডক উপনিষৎ-১/১/৭) ইতি দৃষ্টান্তঃ "হে ভগবন, কোন বস্তুটী বিজ্ঞাত হইলে এই সমস্ত বিজ্ঞাত হয়", এই প্রকার প্রতিজ্ঞা এবং "যেমন পৃথিবী হইতে ধান্য যবাদি ওষধিসকল উৎপন্ন হয়", এইপ্রকার দৃষ্টান্ত 'উপাদানকারণবিষয়েই পঠিত হইতেছে।

এইরূপে অপর শাখাতে 'ইদং সর্বং বিদিতম্' ইতি প্রতিজ্ঞা; 'স যথা দুন্দুভের্হন্যমানস্য ন বাহ্যাঞ্শব্দাঞ্শক্নুযাদ্গ্রহণায দুন্দুভেস্তু গ্রহণেন দুন্দুভ্যাঘাতস্য বা শব্দো গৃহীতঃ'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪/৫/৬,৮) ইতি দৃষ্টান্তঃ' "প্রিয়ে, আত্মা দৃষ্ট শ্রুত বিচারিত ও বিজ্ঞাত হইলে এই সমস্ত বিজ্ঞাত হয়" এইপ্রকার প্রতিজ্ঞা এবং "তাহা (—উক্ত বিষয়ে দৃষ্টান্ত) যমন দুন্দুভি (—দামামা) বাদিত হইতে থাকিলে বাহ্য শব্দসকলকে (—দুন্দুভির বিশেষ শব্দসকলকে) গ্রহণ করিতে পারা যায় না, কিন্তু দুন্দুভির গ্রহণের দ্বারা অথবা দুন্দুভির আঘাতের গ্রহণের দ্বারা শব্দ গৃহীত হয়", এইপ্রকার দৃষ্টান্ত 'উপাদানকারণ বিষয়েই পঠিত হইতেছে'।

এইরূপে প্রত্যেক উপনিষদে প্রতিজ্ঞা ও দৃষ্টান্তকে যথাসম্ভব ব্রহ্মের উপাদানকারণতার সাধনরূপে অবগত হইতে হইবে। এইরূপে প্রতিজ্ঞা ও দৃষ্টান্তের সামঞ্জস্যরূপ লিঙ্গপ্রমাণ বলে ব্রহ্মের উপাদানকারণতা প্রতিপাদিত হইল। এক্ষণে পঞ্চমীবিভক্তিরূপ শ্রুতিপ্রমাণবলে পুনরায় তাহাই প্রতিপাদন করিতেছি—যতো বা ইমানি ভূতানি জাযন্তে'-(তৈত্তিরীয় উপনিষৎ-৩/১) "যাহা হইতে এই প্রাণিগণ জন্মগ্রহণ করে", ইত্যাদি এইস্থলে "যতঃ" এই পঞ্চমী বিভক্তিটী, "জনিকর্ত্তুঃ প্রকৃতিঃ"(পাণিনী সূত্র-১.৪.৩০) 'জায়মান কার্য্যের যাহা প্রকৃতি—উপাদান, তাহা অপাদান সংজ্ঞা লাভ করে', ব্যাকরণস্মৃতির এই বিশেষ সূত্রবশতঃ প্রকৃতিলক্ষণ (—উপাদানকারণস্বরূপ) অপাদানেই প্রযুক্ত হইয়াছে, বুঝিতে হইবে।

সংশয়—কিন্তু কোন হেতুবশতঃ আত্মার নিমিত্তকারণতা ও উপাদানকারণতা সিদ্ধ হয়?

সিদ্ধান্ত— 'অভিধ্যোপদেশাচ্চ' অভিধ্যানের অর্থাৎ ভাবী সৃষ্টিবিষয়ক সঙ্কল্পের উপদেশও ব্রহ্মের নিমিত্তকারণতা ও উপাদানকারণতা জ্ঞাপন করিতেছে, যথা-

'সোকাময়ত বহু স্যাং প্রজায়েয়'-(তৈত্তিরীয় উপনিষৎ ২।৬) অর্থাৎ তিনি কামনা করিয়াছিলেন, "আমি বহু হইব, প্রকৃষ্টরূপে উৎপন্ন হইব", ইত্যাদি শ্রুতি। এবং 'তদৈক্ষত বহু স্যাং প্রজায়েয়'-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৬/২/৩) অর্থাৎ তাহা (-সেই সৎপদার্থ) ঈক্ষণ করিয়াছিলেন,"আমি বহু হইব, প্রকৃষ্টরূপে উৎপন্ন হইব", ইত্যাদি শ্রুতি। সেইস্থলে অভিধ্যানপূর্ব্বক স্বাধীনভাবে প্রবৃত্তি বর্ণিত হওয়ায় ব্রহ্ম নিমিত্তকারণ, ইহা অবগত হওয়া যাইতেছে। "বহু হইব" এইপ্রকার যে বহু হইবার সঙ্কল্প, তাহা প্রত্যাগাত্মাকে বিষয় করে বলিয়া ব্রহ্ম উপাদানকারণ, ইহা অবগত হওয়া যাইতেছে। 

আর এই হেতুবশতঃও ব্রহ্ম জগতের উপাদান কারণ, যেহেতু সাক্ষাৎভাবে ব্রহ্মকেই কারণরূপে গ্রহণ করিয়া উৎপত্তি ও প্রলয়, এই দুইটী পঠিত হইতেছে, যথা- 'সর্বাণি হ বা ইমানি ভূতানি আকাশাৎ এব সমুত্পদ্যন্তে৷ আকাশং প্রত্যস্তং যন্তি' -(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-১।৯।১) অর্থাৎ "স্থাবরজঙ্গমাত্মক এই সমস্ত ভূতবর্গ আকাশ হইতেই সমুৎপন্ন হয় ও আকাশে অস্তগমন করে।" ইত্যাদি শ্রুতি।

যাহা হইতে যাহা উৎপন্ন হয় এবং যাহাতে প্রলীন হয়, তাহা তাহার উপাদান, ইহা প্রসিদ্ধ, যেমন পৃথিবী ধান্য ও যবাদির উপাদান। উপরোক্ত 'আকাশাৎ এব' শ্রুতিবাক্যগত 'এব' কারণটীর দ্বারা যে অন্য উপাদানের অগ্রহণ সূচিত হয়, তাহাকে ভগবান সূত্রকার 'সাক্ষাৎ' এই পদটীর দ্বারা প্রদর্শন করিতছেন। আর কার্য্যবস্তুর যে প্রলয়, তাহা উপাদান হইতে অন্যস্থলে পরিদৃষ্ট হয় না। সুতরাং আকাশশব্দিত ব্রহ্মবস্তুই জগতের উপাদান, ইহাই নির্ণীত হয়।

সংশয়—আচ্ছা এখন প্রশ্ন হইল, যিনি পূর্ব্বসিদ্ধ (পূর্ব্ব হইতে বিদ্যমান) কর্ত্তৃরূপে অবস্থিত সদ্বস্তু, তাঁহার ক্রিয়মানতা (-জগৎরূপে উৎপন্ন হওয়া) কি প্রকারে সম্পাদন করা যায়?

সিদ্ধান্ত— তদুত্তরে আমরা বলিব-যেহেতু পরিণাম হয়। আত্মা পূর্ব্বসিদ্ধ হইলেও বিশেষ বিকারাত্মকরূপে (মিথ্যা কার্য্যরূপে) নিজেকে পরিণত (বিবর্ত্তিত) করিয়াছিলেন। ঠিক যেমন মৃত্তিকা প্রভৃতি উপাদানকারণ সকলে (ঘটাদি) কার্য্যরূপে পরিণাম উপলব্ধ হয়। 'পরিণামাৎ' তাঁহার অর্থ এই -আর এই হেতুবশতঃ ব্রহ্ম জগতের উপাদান কারণ, যেহেতু-

'সচ্চ ত্যচ্চাভবন্নিরুক্তং চানিরুক্তং চ' -(তৈত্তিরীয় উপনিষৎ-২।৬) অর্থাৎ "তিনি সৎ(মূর্ত্ত) এবং ত্যৎ (অমূর্ত্ত) হইলেন। মূর্ত্তামূর্ত্ত অর্থাৎ আত্মাতে স্থিত অনভিব্যক্তি নামরূপ, অন্তঃপ্রবিষ্ট আত্মার নিমিত্ত মূর্ত্তামূর্ত্ত শব্দসংজ্ঞায় অভিব্যক্ত হইল। তিনি নিরুক্ত (পরিচ্ছিন্ন) ও অনিরূক্ত (অপরিচ্ছিন্ন) হইলেন। নিরূক্ত হইতেছে সজাতীয় বিজাতীয় পদার্থসকল হইতে পৃথক্ করিয়া স্থানকালবিশিষ্টরূপে অর্থাৎ 'ইহা তাহা' এই রূপে যাহা কথিত আর অনিরুক্ত হইতছে তাহার বিপরীত।" ইত্যাদি এইরূপ সামানাধিকরণ্যের দ্বারা অর্থাৎ সমান বিভক্তিযুক্ত পদপ্রয়োগের দ্বারা ব্রহ্মেরই বিকারাত্মকরূপে (কার্য্যবস্তুরূপে) পরিণাম (বিবর্ত্ত) শ্রুতিতে পঠিত হইতেছে।

আর এইহেতুবশতঃও ব্রহ্ম জগতের উপাদান কারণ, যেহেতু উপনিষৎ সকলে ব্রহ্ম 'যোনি', এইরূপেও পঠিত হইতেছেন, যথা- 'কর্তারমীশং পুরুষং ব্রহ্মযোনিম্'-(মুণ্ডক উপনিষৎ-৩.১.৩) অর্থাৎ 'জগতের কর্ত্তা ঈশ্বর পুরুষ ব্রহ্মযোনি অর্থাৎ যিনি ব্রহ্ম আবার সর্ব্বকারণও।'

তদব্যয়ং যদ্ভূতযোনিং পরিপশ্যন্তি ধীরাঃ৷৷-(মুণ্ডক উপনিষৎ-১.১.৬) অর্থাৎ 'এইরূপ লক্ষণবিশিষ্ট ভূতযোনি অর্থাৎ প্রাণিগণের সৃষ্টির কারণস্বরূপ, স্থাবর-জঙ্গমের কারণস্বরূপ পৃথিবীর ন্যায় যাঁহাকে তথা সকলের স্বরূপভূত সেই অব্যয়কে বিবেকিগণ সর্বত্র উপলব্ধি করেন।'ইত্যাদি শ্রুতি।

আর 'যোনি' শব্দটী প্রকৃতির (-উপাদানকারণের) বাচক, ইহা লোকমধ্যে অবগত হওয়া যায়, যথা-'পৃথিবী ওষধি ও বনস্পতিসকলের যোনি' ইত্যাদি। স্ত্রী যোনিও স্বীয় অবয়বের (-শোনিতের) দ্বারা হয় গর্ভের প্রতি উপাদানকারণ। কোন কোন স্থলে 'যোনি' শব্দ স্থানের বাচকরূপেও পরিদৃষ্ট হয়, যথা-

'যোনিষ্ট ইন্দ্র নিষদে অকারি'-(ঋগ্বেদ সংহিতা ১।১০৪।১) অর্থাৎ 'হে ইন্দ্র!, তোমার উপবেশনের জন্য আমি যোনি (-স্থান) নির্ম্মাণ করিয়াছি।'

কিন্তু এখানে 'যথোর্ণনাভিঃ সৃজতে গৃহ্ণতে চ'-(মুণ্ডক উপনিষৎ-১.১.৭) 'মাকড়সা কোন অন্যকারণের অপেক্ষা না করিয়া নিজেই সৃষ্টি করে অর্থাৎ নিজ শরীর হইতে অভিন্ন তন্তুরাশিকে বাহিরে প্রসারিত করে, আবার সেই সকলকে গ্রহণও করে অর্থাৎ নিজের সহিত একীভূত করিয়া ফেলে।' ইত্যাদি এইজাতীয় বাক্যশেষবশতঃ যোনিশব্দটীর উপাদানকারণতারূপ অর্থ পরিগৃহীত হইতেছে। এইপ্রকারে ব্রহ্মের উপাদানকারণতা প্রকৃষ্টরূপে সিদ্ধ হইল।

এইরূপ মাকড়সার শরীরের তন্তুরূপে পরিণামের ন্যায় ঈশ্বরের উপাধিভূতা মায়ার জগদ্রূপে পরিণামে ঈশ্বরের উপাদানকারণতাও সিদ্ধ হয়। এইরূপে মায়া-শবলিত ঈশ্বররূপ ব্রহ্মই হন জগতের অভিন্ননিমিত্তোপাদান কারণ।.......ইতি।

ঋণ- ভগবান শঙ্করাচার্যকৃত শারীরকমীমাংসা ভাষ্য ও শ্রীভারতী তীর্থকৃত বৈয়াসিক ন্যায়মালা।

No comments:

আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...