বিগতপর্বেই বলিয়াছি এই অপ্রামাণিক ভ্রান্ত মতবাদ খণ্ডনে আমার বিন্দুমাত্র রুচিও নাই, কিন্তু বর্তমানে মাত্রাতিরিক্ত হারে কিছু অর্বাচীন সংগঠন শঙ্করাদি আচার্যের নিন্দা ও বশিষ্ঠ-ব্যাসাদি গুরুপরম্পরার সনাতন অদ্বৈতবাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার শুরু করিয়াছে, তাই এই দার্শনিক খণ্ডনগুলি ধারাবাহিকভাবে পর্ব আকারে লিখছি। অদ্য আলোচ্য বিষয় "ঈশ্বর সাকার হইতে পারে না ও অবতীর্ণ হইতে পারে না" এই শ্রুতি ও স্মৃতি বিরুদ্ধ মতের নিরাকরণ।
পূর্বপক্ষ—ঈশ্বর নিরাকার। যাহা সাকার অর্থাৎ শরীর বিশিষ্ট
তাহা ঈশ্বর নহে।
সিদ্ধান্ত—পারমার্থিক দৃষ্টিতে তৎপদের লক্ষ্য নিত্যশুদ্ধবুদ্ধমুক্তস্বরূপ
জ্ঞেয় নির্গুণ রূপবিহীন ব্রহ্ম সিদ্ধ হন, কিন্তু ব্যবহারিক
দৃষ্টিতে তিনি মায়া নামক স্বীয় শক্তিযোগে ক্রমমুক্তি ও উপাসনার জন্য উপাধিরূপ নিমিত্তবশত
তৎপদের বাচ্য সগুণ সর্বজ্ঞ সর্বশক্তিমান এবং সাকারূপেও অঙ্গীকৃত হন। ব্রহ্মের সাকারতা
একেবারে অস্বীকার করা যায় না।
শঙ্কা—কেন ঈশ্বরের সাকারতা একেবারে অস্বীকার করা যায় না?
উত্তর—যেহেতু প্রত্যেক বিদ্যাতে ব্রহ্মের বিভিন্ন আকারসকল উপদিষ্ট হইতেছে,
যথাঃ- 'চারিটী চরণযুক্ত ব্রহ্ম'-(ছান্দোগ্য উপনিষদ্-৩।১৮।২), 'ষোলটী কলাযুক্ত ব্রহ্ম'-(ছান্দোগ্য উপনিষদ্-৪।৫।২), 'বামনী প্রভৃতি লক্ষণযুক্ত
ব্রহ্ম'-(ছান্দোগ্য উপনিষদ্-৪।১৫।৩), 'বৈশ্বানরশব্দের দ্বারা বর্ণিত ত্রৈলোক্যশরীর ব্রহ্ম'-(ছান্দোগ্য উপনিষদ্-৫।১৮।২) ইত্যাদি এই জাতীয় শ্রুতি রহিয়াছে সেইহতু ব্রহ্মের
সবিশেষতাও অঙ্গীকৃত হইতেছে। কিন্তু শঙ্কা হইল, আমাদের সিদ্ধান্ত
তো ব্রহ্মের সবিশেষ ও নির্বিশেষ উভয়াত্মকতা সম্ভব নহে, ব্রহ্ম
নির্বিশেষই। এই পূর্বসমাধানও বিরুদ্ধ নহে, যেহেতু ব্রহ্মের
আকারভেদ উপাধিকৃত। আর শাস্ত্র প্রত্যেকটী উপাধিভেদে ব্রহ্মের অভেদতাই অর্থাৎ অভিন্নতাই
শ্রবণ করাইতেছেন, যথা-
‘যশ্চাযমস্যাং পৃথিব্যাং তেজোময়োমৃতময়ঃ পুরুষো যশ্চাযমধ্যাত্মং শারীরস্তেজোমযোমৃতময়ঃ
পুরুষোযমেব স যোয়মাত্মা'-(বৃহদারণ্যক উপনিষদ্-২।৫।১)
'এই পৃথিবীতে যিনি এই তেজোময় অমৃতময় পুরুষ এবং যিনি শরীরসম্বন্ধী ও শরীরে
অবস্থিত তেজোময় অমৃতময় পুরুষ, ইনিই তিনি, যিনি এই আত্মা' ইত্যাদি।
পূর্বপক্ষ— ঈশ্বর সাকার হইলে তিনি পরিমিত শক্তিসম্পন্ন,
দেশ-কাল-বস্তুসমূহে পরিচ্ছিন্ন এবং ক্ষুধা-তৃষ্ণা-ছেদন-ভেদন,
শীতোষ্ণ ও জ্বরপীড়াদিযুক্ত হইবেন। অর্থাৎ স্বরূপের নাশ হইবে।
সংশয়—কিপ্রকারে স্বরূপের নাশ ব্যতিরেকেই এক ব্রহ্মে অনেকপ্রকার আকারবিশিষ্ট সৃষ্টি
হইবে?
সিদ্ধান্তীর উত্তর— যেহেতু-'ন তত্র রথা ন রথযোগা ন পন্থানো ভবন্ত্যথ রথান্রথযোগান্পথঃ সৃজতে'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪/৩/১০)
অর্থাৎ "সেখানে (—স্বপ্নে) রথসকল থাকে না,
অশ্বসকল থাকে না এবং পথসকল থাকে না অথচ তিনি রথসকল অশ্বসকল ও পথসকল
সৃষ্টি করেন", ইত্যাদি শ্রুতিবাক্যের দ্বারা স্বপ্নদর্শী
এক আত্মাতেও স্বরূপের নাশ ব্যতিরেকেই অনেকপ্রকার আকারবিশিষ্ট সৃষ্টি পঠিত হইতেছে। আর
লোকমধ্যেও দেবতা প্রভৃতিতে এবং মায়াবী প্রভৃতিতে স্বরূপের নাশ ব্যতিরেকেই হস্তী ও
অশ্ব প্রভৃতি বিচিত্র সৃষ্টিসকল পরিদৃষ্ট হইতেছে। এইপ্রকারে এক ব্রহ্মেও স্বরূপের নাশ
ব্যতিরেকেই অনেকপ্রকার আকারবিশিষ্ট সৃষ্টি হইবে।
আর তাছাড়া বিভিন্ন প্রকার অর্থ প্রতিপাদক পিতা, পুত্র, ভ্রাতা, জামাতা ইত্যাদি শব্দসকল এক দেবদত্তকে বুঝাইলেও
যেমন বিরোধ হয় না, তদ্রূপ যথার্থ বচনরূপ লৌকিক অর্থেই নিরূঢ়
সত্যাদিশব্দ অখণ্ডকেই লক্ষ্য করে অর্থাৎ লক্ষণাবৃত্তিদ্বারা অখণ্ড ব্রহ্মকেই সমর্পণ
করে।
ইঁহার যে অপারমার্থিক সবিশেষস্বরূপতা, তাহাকে অভিপ্রায় করিয়া মোক্ষশাস্ত্রসকলে
'জলমধ্যগত সূর্য্যাদি প্রতিবিম্বের ন্যায়' এই উপমা পরিগৃহীত হইতেছে,যথা-
'যেমন জ্যোতিঃস্বরূপ এই সূর্য্য এক হইলেও বিভিন্ন জলকে অনুগমনকরতঃ বিভিন্ন
পাত্রস্থ জলে প্রতিবিম্বিত হইয়া বহুপ্রকার হইয়া থাকেন, এইপ্রকারে
এই স্বয়ংপ্রকাশ দেব জন্মরহিত আত্মা, মায়ারূপ উপাধির দ্বারা
ক্ষেত্রসকলে অর্থাৎ মায়ার পরিণামভূত দেহেন্দ্রিয়াদি সংঘাত সকলে অনুগমন করতঃ প্রতিবিম্বিত
হইয়া বিভিন্নরূপে কৃত বা প্রতিভাত হন।'-(ব্রহ্মবিন্দু উপনিষদ্-১২)
'যেহেতু প্রাণিগণের এই একই আত্মা বিভিন্ন প্রাণীতে বিশেষভাবে অবস্থিত আছেন,
তিনি জলমধ্যস্থ চন্দ্রের ন্যায় একরূপে ও বহুরূপে পরিদৃষ্ট হন।'-(ঐ) ইত্যাদি এই সকল স্থলেও 'তাঁহার ঔপাধিক সবিশেষতা
প্রদর্শিত হইয়াছে।'
পূর্বপক্ষ— নিত্য ঈশ্বর অবতীর্ণ হইতে পারেন না, অর্থাৎ তাহার জন্ম সম্ভব নহে।
সিদ্ধান্ত— "ধর্ম্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে"-(ভগবদ্গীতা-৪/৮)
ধর্ম্মের সম্যক্ স্থাপনের জন্য প্রতিযুগে আমি সম্ভাবিত হই অর্থাৎ অবতীর্ণ হই।
সংশয়—
নিত্য ঈশ্বরের জন্ম কিরূপে সম্ভব?
সিদ্ধান্তীর উত্তর— শ্রীভগবান বলিতেছেন-"অজোহপি
সন্নব্যয়াত্মা ভূতানামীশ্বরোহপি সন্। প্রকৃতিং স্বামধিষ্ঠায় সম্ভবাম্যাত্মমায়য়া"-(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা-৪/৬)
অর্থাৎ আমি অজ অর্থাৎ জন্মরহিত হইয়াও; অব্যয়াত্মা অর্থাৎ যাঁহার জ্ঞানশক্তির
ক্ষয় নাই এইরূপ অক্ষীণ জ্ঞানশক্তি স্বভাব হইয়াও; ব্রহ্মাদি
থেকে তৃণ পর্য্যন্ত সর্ব্বভূতের ঈশ্বর হইয়াও; আমার যে স্বপ্রকৃতি,
অর্থাৎ ত্রিগুণাত্মিকা বৈষ্ণবী মায়া, সমস্ত
জগৎ যাহার বশে বর্তমান, যদ্দ্বারা মোহিত হইয়া লোকে নিজের আত্মা
বাসুদেবকে জানিতে পারে না, সেই নিজ প্রকৃতিতে অধিষ্ঠিত হইয়া
অর্থাৎ তাঁহাকে বশীভূত করিয়া আমি সম্ভাবিত হই অর্থাৎ আত্মমায়ার দ্বারা যেন লোকবৎ দেহধারণ
করিয়া জন্মগ্রহণ করি; কিন্তু পরমার্থতঃ নহে।
ঋণ- ভগবান শঙ্করাচার্যকৃত শারীরকমীমাংসা ও শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ভাষ্য ও শ্রীভারতী তীর্থকৃত বৈয়াসিক ন্যায়মালা।
No comments:
Post a Comment